অপরাহ্ন
সুজিৎ মুখোপাধ্যায়
( চরিত্র : অমলা -- বড়বোন, বয়স ৫৫, বিধবা। রমলা -- ছোটবোন, বয়স ৪৩, অধ্যাপিকা, অবিবাহিতা। সময় -- প্রায় সন্ধ্যা। অমলা ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে )
অমলা : রুমি, এই রুমি! তখন থেকে কী এত রান্নাঘরে ঘুটুর ঘুটুর করছিস? আর রাঁধতে হবে না। একটু এদিকে এসে বোস তো!
রমলা : কিছু না দিদি! রান্না হয়ে গেছে। এই চা-টা ছেঁকে এখুনি আসছি।
(একটু পরেই রমলার প্রবেশ)
অমলা : আয় আয়, বোস! রান্নাঘরে এতক্ষণ কী করছিলি? দুজনে বসে যে একটু কথা কইব, তার উপায় নেই। একটু ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ করলেই তো হয়!
রমলা : (হেসে) থাক থাক, আর বেশি কথা কইতে হবে না। এখন চা খাও তো! কত ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খানেওয়ালা, আমার জানা আছে। একদিন দায়সারা রান্না করলেই খাবার সময়...। নাও তো, এখন চা বিস্কুট খাও।
অমলা : আঃ চা-টার কী সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে রে! অনন্ত চা-টা খুব ভালো দেয়, কি বল? কিন্তু এই চায়ের সঙ্গে এই অখাদ্য মেরিগোল্ড না ফেরিগোল্ড না হয়ে যদি পাতলা মুচমুচে পাঁপড়ভাজা হতো না...!
রমলা : এ-এ-এই দেখ, দেখলে তো! সাত হাত নোলা আবার বড়বড় কথা। ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ! শোনো, রাত্তিরের জন্য পেঁয়াজ-পোস্ত করেছি, ইচ্ছে না হলে খেয়ো না। ভাতের সঙ্গে একটা আলুসেদ্ধ করে দেবখন... খেয়ো।
অমলা : তুই চিরকাল এই রকম। খালি ঝগড়া আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। এই জন্যেই...
রমলা : বলো বলো, থামলে কেন! শেষ করো কথাটা!
অমলা : (রেগে) না, বলব না, যা!
রমলা : তাহলে আমিই বলছি, “এই জন্যই তোর কপালে বর জুটলো না”।
অমলা : (হেসে) না, আমি সে কথা মোটেও বলতে যাচ্ছিলাম না।
রমলা : (হেসে) আহা বললেই বা, আমি তাতে একটুও রাগ করব না, দুঃখও পাব না। যাকগে, কী কথা বলবে বলছিলে, বলো।
অমলা : (একটু ইতঃস্তত করে) তোর কলেজে বেরিয়ে যাবার পরে পরেই নন্তুর ফোন এসেছিল।
রমলা : তা ফোন এসেছিল তো মেজাজ ভালো থাকার কথা। কি, ডিসেম্বর মাসে আসতে পারবে না বলেছে নাকি?
অমলা : হ্যাঁ, বলছিল কী সব ওদের ট্রেনিং ফ্রেনিং আছে। নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যেতে হতে পারে।
রমলা : (হেসে) ঐ এক কথা! আচ্ছা দিদি, তুমি কী বলো তো! নতুন বিয়ে করেছে, এখন ওরা একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে, না এখানে এসে এই দুই বুড়ির সঙ্গে বসে আড্ডা মারবে?
অমলা : কতদিন হয়ে গেল, তা প্রায় দু’বছর হতে চললো, ওর সঙ্গে চোখের দেখাও নেই। বিয়েটাও ওখানে হুট করে করে ফেললো, তাতেও থাকতে পারলাম না।
রমলা : তোমার না সব তাতেই বেশি বেশি! কোথায় ছেলে বিদেশে ভালো কাজ করছে বলে সেই আনন্দে দু’হাত তুলে নেত্য করবে, তা না, সকাল সন্ধ্যে খালি প্যানপ্যান আর প্যানপ্যান। আরে বাবা, আজকাল কোনো সমস্যা আছে নাকি! যত খুশি যখন খুশি প্রাণ খুলে ফোনে কথা বললেই হলো!
অমলা : তুই চুপ কর তো! আমি বলছি ওকে দুটো বছর চোখে দেখিনি, আর উনি বলছেন ফোনের কথা।
রমলা : (হেসে) আরে বাবা, “দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া ক’রে...”। একথা মেনেছো বলেই তো ছেলে মানুষ হয়েছে। নয়তো রাখতে আঁচলের তলায়, “রেখেছো বাঙালি ক’রে মানুষ করনি”।
অমলা : মেয়েটাকে নিয়েও হয়েছে জ্বালা! নিজে ভালোবেসে বিয়ে করলি, দু’বছর যেতে না যেতেই ডিভোর্স-টিভোর্স ক’রে সবশেষ। এখন ঐটুকুন একরত্তি মেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে নিজে চাকরি করছে।
রমলা : উঃ দিদি, আর কত চিন্তা করবে? আর যাকে নিয়ে তোমার এত দুঃশ্চিন্তা, সে কিন্তু দিব্যি আছে।
অমলা : থাম তো, দিব্যি আছে না কচু আছে! আমি মা, আমি বুঝি না, আর তুই বেশি বুঝছিস!
রমলা : (হেসে) দেখ দিদি, আমি যদি মা হতাম তাহলে হয়তো আমিও দুঃশ্চিন্তায় ছটফট করতাম। কিন্তু মা নই বলেই একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছি, চিন্তা করতে পারছি। (একটু থেমে) দিদি, প্রত্যেকেরই নানা দুঃখ নানা যন্ত্রণা। সেই তত বেশি সুখী যে যত বেশি দুঃখ সহ্য করতে পারে, আর তার সঙ্গে লড়াই করতে পারে।
অমলা : ভাব তো রুমি, মেয়েটা একা একা সারাটা জীবন কী ক’রে কাটাবে! আর ঐ যে দুধের শিশু মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ সবকিছু হারিয়ে একটা বোর্ডিং স্কুলে অনাথ বাচ্চার মতো প’ড়ে আছে! আমি যে ভাবতেই পারি না – সারারাত ঘুমোতে পারি না।
রমলা : (সামান্য হেসে) দিদি, একটু স্থির হও। শান্ত হও। আবার বলছি, ওরা দুঃখে নেই। ওরা শুধু আর সকলের মতো বিভিন্ন অসুবিধের সঙ্গে লড়াই করছে মাত্র। আচ্ছা বলো তো, আজ তোমার কাছে কে আছে? কোথায় তোমার স্বামী! কোথায় বা তোমার ছেলেমেয়ে!
অমলা : আমার কথা বাদ দে! আমার নিজের কোনো অসুবিধা নেই। তুই আছিস কাছে – আমাকে তো কুটোটাও নাড়তে হয় না। একটু এদিক থেকে ওদিক হবার যো নেই – সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার।
রমলা : কী যে বলো তুমি! আমি থাকা আর নিজের স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা কি এক হলো? আর ধরো, আমিই যদি না থাকতাম তোমার কাছে, তাহলে?
অমলা : তাহলে আবার কি? যা হবার তা হতো। আচ্ছা রুমি, তুই এত একগুঁয়ে জেদি কেন বল তো? গোঁয়ার্তুমি ক’রে কিছুতেই বিয়ে করলি না। আজ আমি আছি, কাল যখন থাকব না, তখন তোকে কে দেখবে?
রমলা : (হেসে) এই রে, আবার আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? এই তো বেশ আলোচনা চলছিল।
অমলা : হাসিস না তো! সবেতেই তোর হাসি দেখলে না আমার গা জ্বালা করে।
রমলা : কী মুশকিল! যার উত্তর আমার জানা নেই, তা আমি দেব কী ক’রে? তোমার না আসলে দিদি, দুঃশ্চিন্তা করাটা একটা বিলাসিতা হয়ে গেছে। দেখ দিদি, শেষ বয়সে কেউ দেখবে কিনা এই দুঃশ্চিন্তায় আমি যে কোনো একজন মানুষকে নিয়ে তো ঘর করতে পারি না!
অমলা : আহা, যে কোনো লোককে কেন বিয়ে করবি? যাকে তোর ভালো লাগবে তাকে বিয়ে করলেই হলো। কেন, সে লোক কি তোমার ছিল না নাকি – ন্যাকা!
রমলা : কাউকে ভালো লাগাটাও আর দশটা জিনিসের মতো একটা প্রাকৃতিক নিয়মে মনের মধ্যে ওঠে আবার মিলিয়েও যায়। চিরস্থায়ী তো হয়ই না, বোধহয় খুব একটা দীর্ঘস্থায়ীও হয় না।
অমলা : (হেসে উঠে) দেখ রুমি, মুশকিলটা কি জানিস – বেশি পড়াশোনা করলে অনেক সময় নিজের স্বাভাবিক চিন্তাটাও ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যায়। যেটা বোধহয় তোর হয়েছে। দেখ শুধু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে মানুষ পাগল হয়ে যাবে। সব কাজ তুচ্ছ, পন্ডশ্রম, নিরর্থক বলে মনে হবে। জেনে রাখ, প্রকৃতি যেমন আমাদের বুদ্ধি দিয়েছে, তেমনি হৃদয় মন বলেও কিছু দিয়েছে।
রমলা : দিদি শোনো, আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ শত চেষ্টা করেও জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে পায়নি। তাই সব চিন্তাশীল মানুষ শেষ পর্যন্ত কনফিউসড থেকে যায়। (হেসে) তবে তুমি ঘুরিয়ে আমাকে হৃদয়হীন ব’লে বোধহয় আমার ওপর একটা অবিচার করলে।
অমলা : দূর পাগলী! আমি তোকে হৃদয়হীন ভাবতে যাব কোন্ দুঃখে! হৃদয়হীন হলে কি আমার কথায় তোর অভিমান হতো, না আমার মতো এক বুড়িকে এতকাল ধরে সারাক্ষণ এভাবে আগলে রাখতিস? আসলে তোর যোগ্য তোর মনের মতো মানুষের মুখোমুখি তুই আজও...। হয়তো কোনো একদিন হবি, হয়তো বা হবি না, কিংবা হয়তো কোনোদিন হয়েছিলি, খেয়ালই করিসনি।
রমলা : একসেলেন্ট! একসেলেন্ট! এই না হলে আমার দিদি! ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথরের এমন অসাধারণ ব্যাখ্যা অকল্পনীয়!
অমলা : ঠাট্টা করছিস? কর। কিন্তু যতই পন্ডিত হোস না কেন, মনকে কিছুতেই বশে আনতে পারবি না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন কর, ঠিক উত্তর পাবি।
রমলা : দেখ দিদি, আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি, প্রত্যেক মানুষেরই একটা সময় আসে যখন সে বুঝতে পারে, যতই স্বামী-পুত্র-কন্যা থাক না কেন, সে কিন্তু আসলে একেবারে নিঃসঙ্গ, সম্পূর্ণ একা। আর এই বিশ্ব সংসারে কারও কাছেই তার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এই উপলব্ধির আবার দুটি দিক আছে, একদিকে যেমন তার স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা লাগে, তেমনি অন্যদিকে ভারি নিশ্চিন্তে সে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে। মনে হয়, সমুখে শান্তি পারাবার।
অমলা : রুমি, তোর সব কথা হয়তো একেবারে ঠিক, কিন্তু এই পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় শব্দটা কি জানিস – ভালোবাসা। এর তল খুঁজতে গেলে অনেক হাবুডুবু খেতে হবে, কিন্তু কিছুতেই তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি এক অতি সাধারণ অশীতিপর রুগ্ন বৃদ্ধাকে বলতে শুনেছি – তাঁর অতিবৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যু যেন তাঁর মৃত্যুর আগে হয়। তাঁর চিন্তা, তাঁর নিজের মৃত্যু আগে হলে, এই অসহায় বৃদ্ধকে কে দেখবে! এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর নিজের যে কী হবে, সে কথা একেবারেই ভাবছেন না। এটা দেখার পর মনে হয়েছে, ভালোবাসার অতিরিক্ত এই ব্রক্ষ্মান্ডে আর কিছুই নেই।
রমলা : আঃ দিদি, একথা শুনলেও মনটা জুড়িয়ে যায়। আবার মনটা ভারী বিষণ্নও হয়ে যায়। মনে হয়, কাউকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, কারোর কাছে পরম নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পণ করতে পারলে বোধহয় দেহ মন জুড়িয়ে যেত! কিংবা যদি এর উল্টোটিও হতো, যদি আমার মনের মতো কেউ আমার কাছে আসতো – অসহায় – আশ্রয়ের খোঁজে – যেমন –
অমলা :
রমলা :
রমলা : দিদি, রাত হলো। ওঠো, খাবে চলো।
অমলা : ওমা, সত্যিই তো! অনেক রাত হলো। চল চল, খাবি চল।
(দূর থেকে সুর ভেসে আসে)
সুজিৎ মুখোপাধ্যায়
( চরিত্র : অমলা -- বড়বোন, বয়স ৫৫, বিধবা। রমলা -- ছোটবোন, বয়স ৪৩, অধ্যাপিকা, অবিবাহিতা। সময় -- প্রায় সন্ধ্যা। অমলা ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে )
অমলা : রুমি, এই রুমি! তখন থেকে কী এত রান্নাঘরে ঘুটুর ঘুটুর করছিস? আর রাঁধতে হবে না। একটু এদিকে এসে বোস তো!
রমলা : কিছু না দিদি! রান্না হয়ে গেছে। এই চা-টা ছেঁকে এখুনি আসছি।
(একটু পরেই রমলার প্রবেশ)
অমলা : আয় আয়, বোস! রান্নাঘরে এতক্ষণ কী করছিলি? দুজনে বসে যে একটু কথা কইব, তার উপায় নেই। একটু ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ করলেই তো হয়!
রমলা : (হেসে) থাক থাক, আর বেশি কথা কইতে হবে না। এখন চা খাও তো! কত ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খানেওয়ালা, আমার জানা আছে। একদিন দায়সারা রান্না করলেই খাবার সময়...। নাও তো, এখন চা বিস্কুট খাও।
অমলা : আঃ চা-টার কী সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে রে! অনন্ত চা-টা খুব ভালো দেয়, কি বল? কিন্তু এই চায়ের সঙ্গে এই অখাদ্য মেরিগোল্ড না ফেরিগোল্ড না হয়ে যদি পাতলা মুচমুচে পাঁপড়ভাজা হতো না...!
রমলা : এ-এ-এই দেখ, দেখলে তো! সাত হাত নোলা আবার বড়বড় কথা। ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ! শোনো, রাত্তিরের জন্য পেঁয়াজ-পোস্ত করেছি, ইচ্ছে না হলে খেয়ো না। ভাতের সঙ্গে একটা আলুসেদ্ধ করে দেবখন... খেয়ো।
অমলা : তুই চিরকাল এই রকম। খালি ঝগড়া আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। এই জন্যেই...
রমলা : বলো বলো, থামলে কেন! শেষ করো কথাটা!
অমলা : (রেগে) না, বলব না, যা!
রমলা : তাহলে আমিই বলছি, “এই জন্যই তোর কপালে বর জুটলো না”।
অমলা : (হেসে) না, আমি সে কথা মোটেও বলতে যাচ্ছিলাম না।
রমলা : (হেসে) আহা বললেই বা, আমি তাতে একটুও রাগ করব না, দুঃখও পাব না। যাকগে, কী কথা বলবে বলছিলে, বলো।
অমলা : (একটু ইতঃস্তত করে) তোর কলেজে বেরিয়ে যাবার পরে পরেই নন্তুর ফোন এসেছিল।
রমলা : তা ফোন এসেছিল তো মেজাজ ভালো থাকার কথা। কি, ডিসেম্বর মাসে আসতে পারবে না বলেছে নাকি?
অমলা : হ্যাঁ, বলছিল কী সব ওদের ট্রেনিং ফ্রেনিং আছে। নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যেতে হতে পারে।
রমলা : (হেসে) ঐ এক কথা! আচ্ছা দিদি, তুমি কী বলো তো! নতুন বিয়ে করেছে, এখন ওরা একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে, না এখানে এসে এই দুই বুড়ির সঙ্গে বসে আড্ডা মারবে?
অমলা : কতদিন হয়ে গেল, তা প্রায় দু’বছর হতে চললো, ওর সঙ্গে চোখের দেখাও নেই। বিয়েটাও ওখানে হুট করে করে ফেললো, তাতেও থাকতে পারলাম না।
রমলা : তোমার না সব তাতেই বেশি বেশি! কোথায় ছেলে বিদেশে ভালো কাজ করছে বলে সেই আনন্দে দু’হাত তুলে নেত্য করবে, তা না, সকাল সন্ধ্যে খালি প্যানপ্যান আর প্যানপ্যান। আরে বাবা, আজকাল কোনো সমস্যা আছে নাকি! যত খুশি যখন খুশি প্রাণ খুলে ফোনে কথা বললেই হলো!
অমলা : তুই চুপ কর তো! আমি বলছি ওকে দুটো বছর চোখে দেখিনি, আর উনি বলছেন ফোনের কথা।
রমলা : (হেসে) আরে বাবা, “দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া ক’রে...”। একথা মেনেছো বলেই তো ছেলে মানুষ হয়েছে। নয়তো রাখতে আঁচলের তলায়, “রেখেছো বাঙালি ক’রে মানুষ করনি”।
অমলা : মেয়েটাকে নিয়েও হয়েছে জ্বালা! নিজে ভালোবেসে বিয়ে করলি, দু’বছর যেতে না যেতেই ডিভোর্স-টিভোর্স ক’রে সবশেষ। এখন ঐটুকুন একরত্তি মেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে নিজে চাকরি করছে।
রমলা : উঃ দিদি, আর কত চিন্তা করবে? আর যাকে নিয়ে তোমার এত দুঃশ্চিন্তা, সে কিন্তু দিব্যি আছে।
অমলা : থাম তো, দিব্যি আছে না কচু আছে! আমি মা, আমি বুঝি না, আর তুই বেশি বুঝছিস!
রমলা : (হেসে) দেখ দিদি, আমি যদি মা হতাম তাহলে হয়তো আমিও দুঃশ্চিন্তায় ছটফট করতাম। কিন্তু মা নই বলেই একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছি, চিন্তা করতে পারছি। (একটু থেমে) দিদি, প্রত্যেকেরই নানা দুঃখ নানা যন্ত্রণা। সেই তত বেশি সুখী যে যত বেশি দুঃখ সহ্য করতে পারে, আর তার সঙ্গে লড়াই করতে পারে।
অমলা : ভাব তো রুমি, মেয়েটা একা একা সারাটা জীবন কী ক’রে কাটাবে! আর ঐ যে দুধের শিশু মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ সবকিছু হারিয়ে একটা বোর্ডিং স্কুলে অনাথ বাচ্চার মতো প’ড়ে আছে! আমি যে ভাবতেই পারি না – সারারাত ঘুমোতে পারি না।
রমলা : (সামান্য হেসে) দিদি, একটু স্থির হও। শান্ত হও। আবার বলছি, ওরা দুঃখে নেই। ওরা শুধু আর সকলের মতো বিভিন্ন অসুবিধের সঙ্গে লড়াই করছে মাত্র। আচ্ছা বলো তো, আজ তোমার কাছে কে আছে? কোথায় তোমার স্বামী! কোথায় বা তোমার ছেলেমেয়ে!
অমলা : আমার কথা বাদ দে! আমার নিজের কোনো অসুবিধা নেই। তুই আছিস কাছে – আমাকে তো কুটোটাও নাড়তে হয় না। একটু এদিক থেকে ওদিক হবার যো নেই – সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার।
রমলা : কী যে বলো তুমি! আমি থাকা আর নিজের স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা কি এক হলো? আর ধরো, আমিই যদি না থাকতাম তোমার কাছে, তাহলে?
অমলা : তাহলে আবার কি? যা হবার তা হতো। আচ্ছা রুমি, তুই এত একগুঁয়ে জেদি কেন বল তো? গোঁয়ার্তুমি ক’রে কিছুতেই বিয়ে করলি না। আজ আমি আছি, কাল যখন থাকব না, তখন তোকে কে দেখবে?
রমলা : (হেসে) এই রে, আবার আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? এই তো বেশ আলোচনা চলছিল।
অমলা : হাসিস না তো! সবেতেই তোর হাসি দেখলে না আমার গা জ্বালা করে।
রমলা : কী মুশকিল! যার উত্তর আমার জানা নেই, তা আমি দেব কী ক’রে? তোমার না আসলে দিদি, দুঃশ্চিন্তা করাটা একটা বিলাসিতা হয়ে গেছে। দেখ দিদি, শেষ বয়সে কেউ দেখবে কিনা এই দুঃশ্চিন্তায় আমি যে কোনো একজন মানুষকে নিয়ে তো ঘর করতে পারি না!
অমলা : আহা, যে কোনো লোককে কেন বিয়ে করবি? যাকে তোর ভালো লাগবে তাকে বিয়ে করলেই হলো। কেন, সে লোক কি তোমার ছিল না নাকি – ন্যাকা!
রমলা : কাউকে ভালো লাগাটাও আর দশটা জিনিসের মতো একটা প্রাকৃতিক নিয়মে মনের মধ্যে ওঠে আবার মিলিয়েও যায়। চিরস্থায়ী তো হয়ই না, বোধহয় খুব একটা দীর্ঘস্থায়ীও হয় না।
অমলা : (হেসে উঠে) দেখ রুমি, মুশকিলটা কি জানিস – বেশি পড়াশোনা করলে অনেক সময় নিজের স্বাভাবিক চিন্তাটাও ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যায়। যেটা বোধহয় তোর হয়েছে। দেখ শুধু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে মানুষ পাগল হয়ে যাবে। সব কাজ তুচ্ছ, পন্ডশ্রম, নিরর্থক বলে মনে হবে। জেনে রাখ, প্রকৃতি যেমন আমাদের বুদ্ধি দিয়েছে, তেমনি হৃদয় মন বলেও কিছু দিয়েছে।
রমলা : দিদি শোনো, আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ শত চেষ্টা করেও জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে পায়নি। তাই সব চিন্তাশীল মানুষ শেষ পর্যন্ত কনফিউসড থেকে যায়। (হেসে) তবে তুমি ঘুরিয়ে আমাকে হৃদয়হীন ব’লে বোধহয় আমার ওপর একটা অবিচার করলে।
অমলা : দূর পাগলী! আমি তোকে হৃদয়হীন ভাবতে যাব কোন্ দুঃখে! হৃদয়হীন হলে কি আমার কথায় তোর অভিমান হতো, না আমার মতো এক বুড়িকে এতকাল ধরে সারাক্ষণ এভাবে আগলে রাখতিস? আসলে তোর যোগ্য তোর মনের মতো মানুষের মুখোমুখি তুই আজও...। হয়তো কোনো একদিন হবি, হয়তো বা হবি না, কিংবা হয়তো কোনোদিন হয়েছিলি, খেয়ালই করিসনি।
রমলা : একসেলেন্ট! একসেলেন্ট! এই না হলে আমার দিদি! ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথরের এমন অসাধারণ ব্যাখ্যা অকল্পনীয়!
অমলা : ঠাট্টা করছিস? কর। কিন্তু যতই পন্ডিত হোস না কেন, মনকে কিছুতেই বশে আনতে পারবি না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন কর, ঠিক উত্তর পাবি।
রমলা : দেখ দিদি, আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি, প্রত্যেক মানুষেরই একটা সময় আসে যখন সে বুঝতে পারে, যতই স্বামী-পুত্র-কন্যা থাক না কেন, সে কিন্তু আসলে একেবারে নিঃসঙ্গ, সম্পূর্ণ একা। আর এই বিশ্ব সংসারে কারও কাছেই তার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এই উপলব্ধির আবার দুটি দিক আছে, একদিকে যেমন তার স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা লাগে, তেমনি অন্যদিকে ভারি নিশ্চিন্তে সে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে। মনে হয়, সমুখে শান্তি পারাবার।
অমলা : রুমি, তোর সব কথা হয়তো একেবারে ঠিক, কিন্তু এই পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় শব্দটা কি জানিস – ভালোবাসা। এর তল খুঁজতে গেলে অনেক হাবুডুবু খেতে হবে, কিন্তু কিছুতেই তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি এক অতি সাধারণ অশীতিপর রুগ্ন বৃদ্ধাকে বলতে শুনেছি – তাঁর অতিবৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যু যেন তাঁর মৃত্যুর আগে হয়। তাঁর চিন্তা, তাঁর নিজের মৃত্যু আগে হলে, এই অসহায় বৃদ্ধকে কে দেখবে! এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর নিজের যে কী হবে, সে কথা একেবারেই ভাবছেন না। এটা দেখার পর মনে হয়েছে, ভালোবাসার অতিরিক্ত এই ব্রক্ষ্মান্ডে আর কিছুই নেই।
রমলা : আঃ দিদি, একথা শুনলেও মনটা জুড়িয়ে যায়। আবার মনটা ভারী বিষণ্নও হয়ে যায়। মনে হয়, কাউকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, কারোর কাছে পরম নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পণ করতে পারলে বোধহয় দেহ মন জুড়িয়ে যেত! কিংবা যদি এর উল্টোটিও হতো, যদি আমার মনের মতো কেউ আমার কাছে আসতো – অসহায় – আশ্রয়ের খোঁজে – যেমন –
সব পাখি ঘরে আসে,
সব নদী। ফুরায় এ জীবনের
সব লেন দেন।
থাকে শুধু অন্ধকার
মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
অমলা :
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
রমলা :
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,অমলা :
নিভৃত নির্জন চারিধার।
দু’জনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,আকাশে জল ঝরে অনিবার
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
সমাজ সংসার মিছে সব,(সামান্য নীরবতা)
মিছে এ জীবনের কলরব
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি – অনুভব –
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।
রমলা : দিদি, রাত হলো। ওঠো, খাবে চলো।
অমলা : ওমা, সত্যিই তো! অনেক রাত হলো। চল চল, খাবি চল।
(দূর থেকে সুর ভেসে আসে)
অশ্রুনদীর সুদূর পারে(ধীরে ধীরে শব্দ মিলিয়ে যায়)
ঘাট দেখা যায়
তোমার দ্বারে
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন