দোমোহনির
একদিন প্রতিদিন
সুবর্ণরেখা নদী, রাঁচি থেকে প্রায় ১৫
কিলোমিটার দূরে নাগরি গ্রামের কাছে বেরিয়ে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার মধ্য দিয়ে প্রায় ৪৭৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বালাসোর জেলার তালসারির কাছে বঙ্গোপসাগরে
মিশে গেছে। আমার সৌভাগ্য সুবর্ণরেখা আমার বসতির গা ঘেঁষে গেছে। আর এখানেই খরকাই নদী মিশে গেছে সুবর্ণরেখায়
যা দোমোহনি নামে পরিচিত।
তখনো ডোবো ব্রিজ তৈরি হয়নি। নদী পারাপারের জন্য নৌকাই ছিল ভরসা। আমার স্মৃতির দোমোহানি, কীসব
মন আনচান করা দৃশ্য। আজ ছবি হয়ে গেছে। দোমোহানি আজও আছে। কিন্তু মানুষেরা সব হারিয়ে গেছে। ওরা আজ সবাই ডোবো ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত
করে। কিন্তু
একসময় শহরবেরা, কামারগোড়া, ডোবো গ্রাম
থেকে মানুষ নৌকায় নদী পার করে দোমোহানী আসতো।
ছড়িয়ে পড়তো শিল্প নগরীর বাজার হাট অফিসে। আবার সন্ধ্যেবেলায় নৌকায় পাড়ি দিয়ে
বাড়ি ফেরা।
যখন জল কম থাকতো, হেঁটে হেঁটে নদী পেরিয়ে মানুষ আসা যাওয়া করতো।
কাকভোরে উঠে সবজির বোরা আর ঝুড়ি নিয়ে নৌকায় পারাপার। কেউ বা সাইকেল নিয়ে। নদী পারাপার প্রান্তিক মানুষদের প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের এক বৃত্তান্ত। রাত্রিবেলায় উঠে সব জোগাড়যন্ত্র ঠিকঠাক করে তল্পিতল্পা নিয়ে কাকভোরে সুবর্ণরেখার ঘাটে। তারপর হাবু সরদারের নৌকায় চড়ে পারাপার। কেউ সবজির বস্তা বা ঝুড়ি মাথায় নিয়ে, কেউ বা সাইকেলে চাপিয়ে।
গামারিয়া শহরবেড়া থেকেও বহু লোক আসতো। সারাদিন ধরে চলতো এই আসা-যাওয়া। তবে সকালবেলায় আসার ভিড়। আর দ্বিপ্রহরে বাড়ি ফেরার।
নদী পারাপারের জন্য গাড়ির টিউব ব্যবহার করা, এও এক অনন্য দৃষ্টান্ত, এই দোমহনীতেই দেখতে পাওয়া যেত।
যখন জল খুব কম হয়ে যায় তো তখন এভাবেও লোকে হেঁটে হেঁটে ও নদী পেরিয়ে আসতো। নদী পারাপারের পর আরেক পরীক্ষা। খাড়া চড়াই ঠেলে উপরে উঠতে হবে। লটবহর সব শহরের রাস্তায় তুলতে হবে।
সবশেষে শাল বনের মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা দিয়ে হাটের
দিকে রওনা। ডালা টেম্পু চড়ে চাপাচাপি করে শেষ গন্তব্য সোনারি হাট।
ডোবো ব্রিজ তৈরি হয়ে যাবার পর এই সব দৃশ্য আজ আর দেখা যায় না। নৌকার মাঝি হাবু সরদার এভাবেই বেশ কিছুদিন
একা একা নৌকো নিয়ে ব্রিজের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতো। যদি কোন যাত্রী আসে! কিন্তু সবাই তো ডোবো
ব্রিজ দিয়েই এখন আসা-যাওয়া করে। বেচারা হাবু সরদার! ক্বচিত কখনো কেউ চলে আসে। শুধু চেয়ে থাকাই সার।
এভাবেই হাবু সরদার তার নৌকা নিয়ে একদিন কোথায় যে হারিয়ে গেল!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন