![]() |
কবিতার কালিমাটি ১৪৯ |
অসুখের চেতনা ও উড্ডয়ন
যাত্রীদের জোনে বিভক্ত করে বোর্ডিং আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরীক্ষিত পাসপোর্ট নিদ্রার অবকাশ পেলে বাতাসে পদধ্বনির চঞ্চলতার সাথে ঘনীভূত হয় উড্ডয়নের প্রতীক্ষা।
উড্ডয়নের জন্য বিশেষ সুরতরঙ্গ প্রয়োজন। আকাশচারী
রুড লফট থেকে ভেসে আসে সুর, মৃদু ক্যাকফনির ওপর বিস্তৃত হতে থাকে একটি কৌশিক চাদর।
নারীকণ্ঠে ঘোষণা ভেসে আসে—নির্মোহ, অনঙ্গ। বাতাসের
সমস্ত তরঙ্গে বিস্তৃত ওরাকল-আধিপত্য স্মরণ করিয়ে দেয়—ব্যক্তিগত নীরবতার স্বাধীন কোনো
বর্ণ নেই।
যাত্রীরা ওভারহেড বিনে তাদের ব্যাগগুলোর আশ্রয়
নিশ্চিত করছে। প্রতিটি ব্যাগের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আকাঙ্ক্ষাময় দ্বীপের পদ্মধ্বনি।
ভাষার পালক উড়তে থাকে—যাত্রীদের হৃদয় কিংবা মোবাইল
স্ক্রিনে তারা সংকেত পাঠায়। সমস্ত সংকেত থেকে ধ্বনির ব্যাবেল জেগে উঠলেও শুভ্র মসলিনে
দৃশ্যমান হয় বহুস্বর-সঙ্গীতের স্বরলিপি।
সামনে বন্ধ দরজার অন্তরালে অদৃশ্য পাইলট প্রস্তুতি
নিচ্ছেন। আবহাওয়ার গতিবিধি, নোটাম নির্দেশনা, আকাশ-পথের কম্পনীয়তা, জ্বালানির গভীরতা
ও ককপিট সরঞ্জাম পরীক্ষা করতে করতে তিনি গন্তব্যের মানসচিত্র আঁকছেন।
সুসজ্জিত ক্রুরা এগিয়ে যায়, যত্ন নেবার জন্য
তাদের নিপুণ কৌশল দেখে মনে হয় তারা অন্য গ্রহ থেকে অবতরণ করেছেন।
উড্ডয়নের আগে অপেক্ষমাণ বাড়ির কাছে বিচ্ছেদী ধ্বনিপুঞ্জ
ফিরে যায়। একটি ফোনকল অনুপস্থিতি ও উপস্থিতির ভেতর রেশমি সুতোর ব্রিজ নির্মাণ করে।
অনুপস্থিতি কোথাও চাপ সৃষ্টি করে।আমার অনুপস্থিতি
স্ত্রীর কাঁধে প্রতিদিন ঝোড়ো মেঘের চাপ হয়ে নেমে আসবে।
তাকেও চিকিৎসার জন্য দূরবর্তী চিকিৎসকের শরণাপন্ন
হতে হবে। চিকিৎসা ছাড়া অস্তিত্ব অতিভঙ্গুর হয়ে ওঠে।
সুচিকিৎসা সহজপ্রাপ্য নয়। দুষ্প্রবেশ্য অরণ্যের
ঝরনা সুচিকিৎসার উপমান। চিকিৎসকের সন্ধানে ওড়ার কোনো বিকল্প নেই।
অসুখের চেতনার ভেতর তীর্থযাত্রার গোপন সংকল্প রক্ষিত
থাকে। ফলে উড্ডয়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে—এটি কেবল আকাশযাত্রা নয়, দূরের চিকিৎসকের
উদ্দেশ্যে নির্জন অভিযাত্রা।
আকাশ ও একটি যাত্রার মেমোয়ার
মেঘগুলো শুভ্র ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আকাশের অসীম মঞ্চে তারা ধাবকের অভিনয় করে।
তারা অ্যাপোলোর অশ্বদের অনুকরণে অভ্যস্ত। দেবতার
আনুকূল্যে মহাকাশে তারা গড়ে তুলেছে চলিষ্ণু ঘর।
সূর্যাস্তে তাদের শীর্ষদেশ জ্বলে ওঠে—হিলিওসের
চ্যারিয়ট থেকে খুলে পড়েছে হালকা কমলা রঙের একটি চাকা।
দূরে কোথাও সুরমা রঙের পাহাড় ভেসে ওঠে। বাজিকরের
কুহকরঙে আচ্ছন্ন আকাশ।
আকাশের নীল ম্লান হয়ে ধূসরতা ছড়াতে থাকে। পৃথিবীর
অরণ্যের ওপর ঝুলে পড়ে রূপান্তরিত ক্যানভাস।
ধূসরতার ওপর শুভ্র শৃঙ্গগুলো ছুটে যায়। উজ্জ্বল
পাথরের দৌড় প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
বিমান-ডানার প্রান্তভাগে বৈদ্যুতিক বাতি বারংবার
জ্বলে ওঠে, নিভে যায়। কৃত্রিম নক্ষত্রের দিকে চেয়ে থাকে আকাশ।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উড়ন্ত গৃহের দীর্ঘতা চেতনার
ভেতর বিস্তৃত হতে থাকে।
অবিরাম গর্জনে আকাশের পথরেখা আন্দোলিত হয়। অধীর
হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত নীরবতা।
গর্জন অদৃশ্য চিহ্নের স্মারক। আকাশে লিপিবদ্ধ হতে
থাকে আমাদের যাত্রার মেমোয়ার।
কমলা আকাশ আবিষ্কার করে সোনালি পরিচ্ছদ। সময়ের
অস্থির গোড়ালির দিকে দৃকপাত করার সাথে সাথে ঘনিয়ে আসে অবতরণের মুহূর্ত।
অসহনীয় গর্জন কোমল হয়ে ওঠে। অসীম নিস্তব্ধতার
ভেতর উড়তে থাকে আকাশের চুল।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন