কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

দেবাশিস ঘোষ

 

সমকালীন ছোটগল্প


মিসক্যারিজ

এমন কথাও উচ্চারিত হতে পারল মা'র মুখে? হতভম্ব জয়ন্ত তাকিয়ে থাকল মায়ের মুখের দিকে। অফিসের পোশাক তখনও পরনে। মাস-মাইনের খাম, সংসারের জন্য দে'ও টাকা তখনো হাতে ধরা। মা, বিরজা সান্যাল, ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, লাগবে না। অতো আর করতে হবে না আমার জন্য, তোমরা বরং নিজেদের ব্যবস্থা দেখে নাও।

সেই 'আমরা আর তোমরা'। একই সংসারে দুটো পক্ষ। জয়ন্তর কাছে অসহ্য এ সব, এতখানি অসহ্য যে একদা এই কথার জন্য সুচরিতার সাথে তার সম্পর্ক চিরকালের মতন ঘুচে যেতে বসেছিল। তখন, আর কারো কথায় নয়, কেবল মায়ের কথাতেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিরস্ত করেছিল সে। মা বলেছিলেন ভাঙ্গার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, ওটা মূর্খের পথ, অহংকার ভিন্ন যার আর কোনো সম্বল নেই। যা হয় তা হয় বলেই হয়, আবার হয়ও না বটে যদি কারণটার উল্টো পিঠ সামনে থাকে। মা তখন বলেছিলেন উল্টে পাল্টে দেখ, কারণটা একই, একই জায়গায় আছে, সমাধান পেয়ে যাবি।

আজ মা'র মুখেই আলাদা করে দেওয়ার কথা।

ঘামতে শুরু করেছে জয়ন্ত। মা'র ঘরে পাখা চলে তিন পয়েন্টে। বিশেষত সন্ধের পর যখন একটু একটু করে রাত নামতে থাকে। কিন্তু জয়ন্তর গরম লাগে বলে বিরজা দেবী নিজেই রেগুলেটর ঘুরিয়ে পাঁচ পয়েন্টে করে দেন। তাঁর খেয়াল করতে দেরি হলে জয়ন্ত নিজেই পাঁচ পয়েন্টে করে নেয়। বেরোবার সময় আবার খেয়াল করে তিন পয়েন্টে। ভুলে গেলে পিছন থেকে শোনা যায়, 'পাখা পাঁচ পয়েন্টে'। অর্থাত পাঁচ পয়েন্টে যেহেতু সে নিয়ে গেছে অতএব তখনকার মতো তিন পয়েন্ট করে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তার। ঘুরে এসে তা করে দিয়ে যেতে হয়।

কিন্তু এখন সে ঘামছে। তবু রেগুলেটরে হাত দেওয়ার কথা মাথায় এলো না। বিরজা সান্যালও উঠলেন না, রেগুলেটর ঘুরিয়ে দিতে এগিয়ে গেলেন না, ছেলেকে অমন করে ঘামতে দেখেও না। রেগুলেটর ঘুরিয়ে দিয়ে জয়ন্তর জন্য এইটুকু স্বস্তির ব্যবস্থা করার মানে যেন আরো দুদণ্ড তাকে থাকতে বলা। তা হতো তাঁর নিজের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করা। সোজা কথা যা বলার তা তিনি বলে দিয়েছেন, তোমার টাকার দরকার নেই, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নাও।

কথার মানে অতি স্পষ্ট, ভাব প্রকাশে কোনো জড়তা ছিল না। বাড়ি বিরজা সান্যালের নামে। জীবনরতনবাবু, জয়ন্তর বাবা, বাড়ি কিনেছিলেন স্ত্রীর নামে। অতি কষ্টেসৃষ্টে কেনা, ঠিক যেমন কষ্টেসৃষ্টে বিরজা দেবী আগলে রেখেছিলেন সংসার দীর্ঘকাল, কেবল নিজের সাধ্যে। এ ছাড়া আর কীই বা করতে পারতেন জীবনরতনবাবু, আর কী উপায়ই বা ছিল বিরজা দেবীর এহেন জীবনপাতের সাকার স্বীকৃতি জানানোর? বিরজা সান্যাল আপত্তি করেননি। বলেননি এ সম্পত্তি তোমার কেনা, সুতরাং তোমার নামেই হোক। বরং বলেছিলেন, বেশ তাই হোক, তোমার যেমন ইচ্ছে। মনে মনে হয়ত সেটিকে যথার্থ নিজেরই প্রাপ্য বলে জানতেন। জীবনরতনবাবু এখন আর নেই, কিন্তু বাড়িটা আছে। বাড়ি এখন বিরজা সান্যালের, মানে জয়ন্তর মায়ের। সুতরাং আইনি অধিকার তাঁর আছে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলার। যা বলেছেন তার মানে তো সেটাই।

দলিল দস্তাবেজে যার নামই থাকুক, জয়ন্ত ভাবে বাড়িটা কি তার ও নয়! বাড়িটাকে তো এতদিন নিজেদের বাড়ি বলে জেনেছে, নিজের চাকরির অফিস রেকর্ডে বা অন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রে তো ঠিকানা হিসাবে এই বাড়িটার ঠিকানাই দেওয়া আছে, এইটাই পার্মানেন্ট এড্রেস। আজ মা বললেন, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা দেখে নাও। কথাটার মানে কী? সমস্ত জায়গা থেকে ঠিকানা পাল্টে দাও, 'নিজেদের' শব্দটাকে ভেঙ্গে তার মধ্যে থেকে নিজেকে আলাদা করে নাও। জ্ঞান মতে যারা আমার নিজের, যাদের নিয়ে আমরা নিজেরা, তারাই যদি বলে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা দেখে নাও, তাহলে সেই গণ্ডিরেখা আর থাকল কোথায়? কখন কীভাবে পুরনো বৃত্ত মুছে গেল, কখন কে এসে নতুন বৃত্ত এঁকে দিয়ে বলল এখন থেকে এইখানেই তোমার অবস্থান, তা অজানা।

তা না মানলে কী হয়? কী আবার, কেবল মানা হয় না -- এই মাত্র। কিন্তু তাতে তো আর পুরনো বৃত্তে অবস্থান ফিরে পাওয়া যায় না! দূরের কোনো নক্ষত্রের নামাঙ্কনের মতনই তা এক আত্মরতি। কী এসে যায় তা'তে! জয়ন্ত জানে এসব কথা। সরকারি অফিসে পদস্থ আধিকারিকের চাকরি করে সে। নানা বিভাগে চাকরি করার অভিজ্ঞতা আছে তার। তারই কোনো একটিতে এইসব ব্যাপারেরই মীমাংসা করতে হতো, নোট লিখতে হতো, অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতনের কাছে ফরোয়ার্ড করতে হতো। কিন্তু সেসব তো অন্যদের ব্যাপার, বাড়ির বাইরের ব্যাপার। অফিস থেকে বাড়ি আসার সময় সেসব আলমারিতে তালাবন্ধ করে সংস্রব মুক্ত হয়ে আসত। বাড়ির বাইরের ব্যাপারের সাথে নিজের বাড়ির আবার কী সম্পর্ক! কেমন করে যেন দিব্য ভুলে থাকত যে বাড়ির বাইরের সেই ব্যাপারগুলো আসলে বাড়িরই ব্যাপার, তবে নিজের নয়, অন্যদের। বাড়ির বাইরে যা সত্য, তা বাড়ির ভিতরেও সত্য হয়ে উঠতে পারে কিনা তা নিয়ে অকারণ মাথাব্যথা তার  ছিল না।

তাদের বাড়ির সাথে আবার অন্য কোনো বাড়ির তুলনা? তাদের বাড়ির শো-কেসে সাজিয়ে রাখা যে তাম্রপত্র দেখতে এখনও লোক আসে, তেমন আর ক'টা বাড়িতে আছে? তার বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, ব্রিটিশ সরকার ভয় পেত তাঁকে, তাই এক জেল থেকে আরেক জেলে স্থানান্তরিত করা হতো তাঁকে, একের পর এক, পাছে তাঁর মন্ত্রণায় অন্য কয়েদীরা বৃটিশ বিরোধিতায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। একদা যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদের উজ্জ্বল বিবরণ আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। তখনও জন্ম হয়নি জয়ন্তর, গল্প শুনে জেনেছে সে। গল্প শুনেছে বাবার কাছে, মা'র কাছে, দিদির কাছে। দিদি তখন খুব ছোটো, ছোট্ট এইটুকুন, বায়না করত বলে বিরজা সান্যাল নিয়ে যেত জেলখানায়, যেদিন সাক্ষাৎকারের দিন থাকত। গরাদের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দিদির হাত দুটো টেনে নিতেন বাবা, ঘন ঘন চুমো খেতেন সেই হাতে। গল্প বলার সময় নিজের হাত দুটো সামনে মেলিয়ে ধরে দেখাত দিদি , যেন ঐ হাত দুটোই সেদিনের সমস্ত ঘটনার প্রমাণ, বাবার চুমো খাওয়ার প্রমাণ। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে নাকি হাত বাড়িয়ে দিদির চুলে বিলি কেটে যেতেন বাবা, যেমন করে একসময় ঘুম পাড়াতেন দিদিকে। দিদির বুক ঠেলে কান্না উঠে আসত, বাবার কোলে উঠতে পারত না বলে, কিন্তু নিরুচ্চারিত থাকত সেই কান্না। মা যে বারণ করেছিলেন একদিন। বলেছিলেন, তুমি কাঁদলে বাবার অপমান হবে। তোমার বাবা ইংরেজের সাথে লড়াই করছেন, তুমি কাঁদলে ইংরেজ ভাববে হারিয়ে দিতে পেরেছে তোমার বাবাকে। যারা হারে তারাই তো কাঁদে। তুমি কাঁদলে তাই অপমান হবে তোমার বাবার, তিনি দুঃখ পাবেন। অতো কথা তখন বুঝতে পারত না দিদি, শুধু বুঝেছিল যে বাবার কষ্ট হবে। দিদি তাই বুকের মধ্যে চেপে রেখে দিত কান্না। চুপ করে চেয়ে থাকত বাবার মুখের দিকে। দেখা করার সময় যখন শেষ হয়ে আসত, যখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারত না, তখন বাবার কথা থামিয়ে দিয়ে আবদার ধরত গান শোনানোর। ঐ যে ঐ গানটা, বাড়িতে করতে, কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফ্যাল, কররে লোপাট। জীবনরতনবাবু তখন ধরতেন ঐ গানটা। আশেপাশে সব শান্ত হয়ে যেত, চুপ হয়ে যেত অন্য সব মুখ, কিন্তু গান শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সাক্ষাৎকারের সময় শেষ হয়ে যেত। পিছন ফিরে দেখতে পেত দিদি বাকি গানটা তখনও বাবার গলায়, গান করতে করতে ফিরে যাচ্ছেন বাবা।

এমনই বাড়ি তাদের। তাই এত অহংকার জয়ন্তর। মাকে নিয়েও কম গর্ব নাকি তার? বাবা তখন জেলে, সংসার তখন মা'র উপর। কোনো রকমে একটা ছোটখাটো স্কুলে কাজ জুটিয়ে নিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। দিদি তখন ছোটো, উপযুক্ত আহার নেই, পরনে ভাল জামা নেই। মা'র সেজদি, মায়ের যত্নে মা'কে যিনি বড় করেছেন, খবর পেয়ে তিনি আর সহ্য করতে পারেননি, ছুটে এসেছিলেন। বললেন, গৌরী আমার কাছে থাক, তোর এই টানাটানির সংসারে ওর কষ্ট হবে। তা ছাড়া তোকে স্কুলে বেরিয়ে যেতে হয়, তখন মেয়েটা থাকবে কার কাছে? দিদি তখন ছোটো, কথাটা কানে যাওয়া মাত্র ছুটে এসে জাপটে ধরল মা'কে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, দেখো কেমন পাগল মেয়ে! সত্যি সত্যিই নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? জয়ন্তর সেজমাসীমা, বয়েসে তিনি মা'র থেকে অনেক বড়, বললেন, ওঃ, তার মানে পাঠাবি না আমার কাছে? তোর জিদ বলিহারি বিরজা!

--সেজদি, তুমি ভেবো না, দেখো ঠিক পারব। না পারলে তো তোমরা আছই, তোমার কাছে থেকে আমি নিজে বড় হতে পারলাম, আর আমার মেয়ে পারবে না!

এমনই আত্মমর্যাদা বোধ মা'র। তিনি নাকি বলেছিলেন, এইটেই তো আমার সত্যিকারের পরীক্ষার সময় সেজদি, তোমরা নিজে হাতে করে যার হাতে তুলে দিলে তাকে কতখানি মান দিই, কতখানি মেনে চলি তা প্রমাণ করতে না পারলে তোমাদের বিচার বিবেচনাকে ছোটো করা হবে না? লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স করিয়েছ আমায়, সে কি এমনি এমনি? দেখো ঠিক একটা ভাল চাকরি পেয়ে যাব।

একা একা কথা বলতেন মা, দিদিকে সামনে বসিয়ে। দিদি তার কিছুই বুঝতে পারত না, বড় হয়ে বুঝেছে। মা নাকি বলতেন আশ্রয়প্রার্থী হওয়া মানে তো হার মানা। সে হার কার? সে হার তো তোর বাবার। ইংরেজদের সাথে লড়তে গিয়ে হেরে যাওয়া। ইংরেজরা দুয়ো দেবে না, হেরো, হেরো। যেমন জিদ করেছিল, তেমন জব্দ। মেয়ে বৌ খেতে পাচ্ছে না, তাই অন্যের কাছে ছুটছে। ইংরেজদের সেই বিদ্রুপে হেট হয়ে যাবে না তোর বাবার অমন উঁচু মাথাটা?

এমনি তার মা, এমনি তার দিদি। যে সে নাকি তারা! দিন যত যায়, তত বাড়ে তার গর্ব। চারপাশে আর সকলের সংসার তো চোখে পড়ে, দেখতে পায় সবই গড়পরতা মানের, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে আবদ্ধ সেগুলো। সেগুলো যত ছোটো হতে থাকে, নিজেদের সংসারটা তত বড় দেখায় তার চোখে। বাড়ি মানে তো এই সংসারটাও! মায়ের নামে বাবা যে বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন, সেটা তো কেবলই ইট, কাঠ, সিমেন্ট, বালির। সেটা তো কেবলই কতগুলো প্রাণহীন দেওয়ালের বিন্যাস। তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে এই সংসার। বাড়ি মানে তো এই সংসারটারই অভিব্যক্তি। এ বাড়ি তো সম্মিলিত রচনা, কারো নামে কারো লিখে দেওয়া নয়।

অথচ মা বললেন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের দেখে নিতে। মাস খরচের টাকাটা পর্যন্ত হাতে নিলেন না, বললেন, এখন থেকে ওটা আর লাগবে না, আমাদের ব্যবস্থা আমরা যাহোক করে করে নেব, তোমায় তা নিয়ে ভাবতে হবে না।

--মানে?

এই একটি শব্দ উচ্চারণ করেই থেমে গিয়েছিল জয়ন্ত। ভ্রূ কুঁচকে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল শুধু। তাকিয়ে ছিল, মা চোখ সরিয়ে নেওয়ার পরেও। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ নিজেকে ইংরেজদের মতন মনে হতে লাগল তার। তারাও তো এই রকম বিরূপতা আর বিরক্তির দৃষ্টিতেই তাকিয়েছিল তার মায়ের দিকে। স্বামী যার স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ইংরেজ বিরোধিতার জন্য জেলবন্দি, তাকে মিত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। তার প্রতি বিরূপতা বা বিরক্তি কোনোটাই অস্বাভাবিক নয়। ছোটবেলায় যখন শুনত তখন মনে হতো অমন চোখ দুটো গেলে দেওয়া উচিত ছিল। আজ নিজেও কিনা সে সেইভাবে তাকিয়ে আছে! ছিঃ ছিঃ! অমনি সে চোখ মুখ কপাল সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনল। আচরণ স্বাভাবিক করে তোলার জন্য কথা খুঁজতে লাগল সে। না পেয়ে হুট করে বলে ফেলল, চলবে বললেই তো আর হয় না! কেমন করে চলবে শুনি? কিন্তু উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই বুঝতে পারল নিজের প্রশ্নের অনুপযুক্ততা এবং অসাড়তা। বাবা জেলে যাওয়ার পর যিনি তাঁর মাতৃসমা সেজদির কাছ থেকে পর্যন্ত কোনো আনুকূল্য গ্রহণ করতে সম্মত হননি, তাঁর কাছে এই প্রশ্ন!

বিরজা সান্যাল ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, একবার যখন বলে দিয়েছি আমাদের ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না, তখন তা নিয়ে অকারণে মাথা ঘামিও না। তোমাকে নিশ্চিন্ত করার দায় আমার নেই।

জয়ন্ত ঝপ করে বসে পড়ল খাটের উপর। এমন কঠিন উত্তর একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না তার কাছে। সে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল অন্য কারণ। বিরজাদেবী যখন কটমট করে তাকালেন তখন খেয়াল হলো তার, বাইরের জামা কাপড়ে মা'র খাটে বসে পড়েছে সে। এই অনাচার তাঁর কাছে এমনই আপত্তিজনক যে জীবনরতনবাবুর হলে তিনিও রেহাই পেতেন না। অন্যদিন হলে তখনই সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ত, কিন্তু এদিন উঠে পড়া তো দূরের কথা, নড়ে পর্যন্ত বসল না। উপরন্তু মুখের উপর জবাব দিল, যাব না।

-- মানে?

-- মানে আবার কী, যা বললাম সেটাই মানে। বাড়ি কেবল তোমার একার? আমার নয়?

-- এ নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই না জয়। তুমি বাইরের লোক নও যে ব্যাপারটা তোমার অজানা থাকবে!

-- বেশ তো, মানছি যে ব্যাপারটা আমার অজানা নয়, কিন্তু তোমার বাকি কথাটা নিশ্চয় তুমি মানছ যে আমি বাইরের লোক নই।

বিরজাদেবী রাগে জ্বলে উঠলেন। এতখানি স্পর্ধা যে বাইরের জামা কাপড়ে এখনও তাঁর বিছানার উপর বসে আছে! এইটাই একটা গর্হিত অপরাধ, তার উপর আবার মুখে মুখে তর্ক করা? বললেন, এখনও বাইরের লোক নও বলেই তো বাইরের করে দিতে চাইছি।

কোনো উত্তর না দিয়ে খাটের উপর রাখা বইটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিল। পড়তে পড়তে রেখে দিয়েছিলেন মা। যতদূর অবধি পড়া হয়েছিল, সেখানে একটা কাগজের চিপ গুঁজে রেখে দিয়েছিলেন যাতে খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়। কিন্তু জয়ন্ত যখন এলোমেলো পাতা উল্টে চলেছিল, তখন সেই কাগজের চিপ পড়ল খসে, পৃষ্টাঙ্ক গেল হারিয়ে। আর এক প্রস্থ ক্রোধে উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন তিনি। ছেলের ঔদ্ধত্য যেন সীমা ছাড়িয়ে  যাচ্ছে। কঠিন একটা কথার খোঁজ করছিলেন তাঁর ক্রোধকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু তার আগেই জয়ন্ত বলল, বাইরের লোক নই বলেই বাইরের করে দিতে চাইতে পারো তুমি? বাইরের নয় যখন, তখন নিশ্চয় ভিতরের? ভিতরে এলাম কেমন করে? তোমার কাছে আবেদন নিবেদন করে? তোমার অনুমতি নিয়ে?

কখন যে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জয়ন্তর দিদি গৌরী এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল এক কোণে, কেউ তা খেয়াল করেনি। খেয়াল করল যখন সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, চুপ কর ভাই, চুপ কর বলছি। আর একটা কথাও বলবি না। ছিঃ ছিঃ এতখানি নীচে নেমেছিস তুই? কথা শেষ করে হাঁপাতে লাগল গৌরী। জয়ন্ত এবং বিরজা দেবী, দুজনের নজরই তখন তার উপর। ক্রোধের বদলে বিস্ময় আর আর্তি বিরজা দেবীর চোখে। জয়ন্তর চোখেও তাই। ভগ্নস্বাস্থ্য, রুগ্ন চেহারা, স্বভাবে স্বল্পবাক এবং শান্ত প্রকৃতির মানুষটার মধ্যে এমন আকস্মিক বিস্ফোরণে বিহ্বল তারা দুজনেই।

অমনি একেবারে শান্ত হয়ে গেল জয়ন্ত। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দিদির কাছে। দুহাতে দিদির ডান হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করল, তোর কী হলো রে দিদি? গৌরী বলল, কিছু হয়নি। গলায় তার রাগ তখনও। বলেই অন্য হাতে জয়ন্তর হাতটা শক্ত করে ধরে আদেশের সুরে বলল, এদিকে আয়। তারপর টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, একেবারে জানোয়ার হয়ে গেছিস? দয়া মায়া ধর্ম সব বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিস?

কুণাল, গৌরীর একমাত্র ছেলে, যাকে বুকে ধরে সংসার ছেড়ে চলে এসেছিল সে, তখন পড়ছিল ঘরে। সামনে তার পার্ট টু পরীক্ষা। গৌরী বলল, যা না বাবা, মা'র ঘরে গিয়ে একটু বোস না! মন খারাপ করে বসে আছে মা। না হয় বই খাতাপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যা। কুণাল বই খাতা নিয়ে বেরোনোর পথে ওদের সামনে একবার দাঁড়াল। বলল, মানুষটাকে তো তোমরা জানো! কেন মন খারাপ হতে দাও!

সে বেরিয়ে যাওয়ার পর গৌরী ফিসফিস করে বলল, অমন কথা তুই মুখে আনতে পারলি? কথাটা কাকে বলছিস তা একবার ভেবে দেখলি না? মা হয় না?

--- হয়ই তো, কিন্তু খারাপ কথা কী বললাম?

--- বলিসনি? থামিয়ে না দিলে হয়ত বাকি আর সব কথাও বলে ফেলতিস! মরমে মরে যেত মা।

--- খারাপ কথা?

--- খারাপ নয় তো কী? চুরি করে অন্যের ডাইরি পড়াটাই অন্যায়। তারপর আবার সেই কথাগুলো তুলবি? কী চাস? মানুষটাকে একেবারে গুড়িয়ে শেষ করে দিতে?

--- অ্যাঁ...

এমনই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল জয়ন্তর, একটা অভাবিত প্রসঙ্গের এমন আকস্মিক অবতারণার কারণে। স্মৃতি ফিরতে সময় নিয়েছিল। চুরি করে একসময় মা'র ডাইরি পড়ত সে, তাঁর কঠোর নির্দেশ অমান্য করে। সে তো অনেক কাল আগের কথা। নিয়মিত ডাইরি লিখতেন বিরজা দেবী। যত জ্বলছেন, যত পুড়েছেন, সব লিখে রাখতেন। কেন লিখতেন, কার জন্য লিখতেন, কে জানে! জীবনরতন বাবু যতদিন বেঁচেছিলেন, বারণ ছিল তাঁর উপরও, বিরজা দেবীর ডাইরিতে যেন কখনও হাত না দেন। বোধহয় তিনি কোনোদিন অমান্য করেননি সেই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু জয়ন্ত করেছিল। চুরি করে মা'র ডাইরি পড়ার কুবুদ্ধি মাথায় এসেছিল বাবা গত হওয়ার পর। কেন এসেছিল এমন কুবুদ্ধি, তা মনে পড়ে না, মনে হওয়ার তো আর স্মৃতি থাকে না। অনুমান ছাড়া এখন আর উপায় নেই।

জয়ন্তর জন্ম হয়েছিল অনেক পরে। দেশ তখন স্বাধীন, জীবনরতন বাবুর কারাবাসের কোনো প্রশ্ন তখন আর নেই, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন তিনি। অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তেজনা আর নেই, সংসার প্রতিপালনের প্রয়োজনে মা'র সেই প্রাণপাত করার ব্যাপার আর নেই। ভাল লাগত না জয়ন্তর, সে সেসব কিছু দেখতে পায়নি। দিদি কতকিছু দেখেছে, কতকিছুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী সে, কতকিছু জানে দিদি, কিন্তু সে নিজে কিছু দেখার সুযোগ পায়নি, জানার সুযোগ পায়নি। এযাবৎ যা কিছু জেনেছে, সবই গল্প শুনে, কখনও বাবার মুখে, কখনও মা'র মুখে, আর কখনও দিদির মুখে। দিদি আর কতটুকু জানে, সে তো ছোটো ছিল তখন। মা আর কতটুকু বলে, বলতে তো তাঁর বাধা পাছে গল্প করতে গেলে তাঁর শাসনব্যবস্থা আলগা হয়ে পড়ে। খোলা মনে গল্প বলতেন শুধু বাবা। সেই মানুষটা আর নেই, দিদিও এখন চুপচাপ সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার পর ফিরে আসা অবধি, আর কঠোর মূর্তির মা তো এখন ছোটাছুটিতে ব্যস্ত, কার কাছ থেকে তবে সে গল্প শুনবে, ইতিহাস জানবে? তখন এই নিষিদ্ধ পথের আশ্রয়, চুরি করে মা'র ডাইরি পড়া । কালানুক্রমিতা বজায় রেখে পড়ত, প্রয়োজনীয় অংশ খাতায় টুকে রাখত, কিন্তু সতর্ক থাকত যাতে সেই খাতা কারো চোখে না পড়ে।

দিদি জানত, মনমরা দিদিকে সে শোনাত যাতে তার মুখের উপর থেকে অন্ধকার অন্তত কিছুক্ষণের জন্য সরে। দিদি বারণ করত, বলত এটা অন্যায় যেমন সংস্কার সে আয়ত্ত করেছিল। কিন্তু দিদির নিষেধে অত শক্তি ছিল না যে তা কার্যকর হবে। জয়ন্ত বোঝাত, এগুলো তো আমরা কেউ জানতাম না, এখন তো জানতে পারলাম। দিদি বলত দরকার নেই, যা জানায় বারণ আছে তা জানার দরকার নেই। কিন্তু তার কথা যে মানা হতো না তা জানত গৌরী।

পড়তে পড়তে একদিন সেই পর্বে এলো, দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, জীবনরতনবাবু যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। সংসারে তখন অনটন, কিন্তু জীবনরতনবাবু সুখী কারণ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই আনন্দে, যখনই তিনি সুযোগ পান বিরজা দেবীর গা ঘেঁষে থাকেন আর গল্প শোনান জেলখানার দিনগুলোর। সেই মুহূর্তগুলোকে বিরজা দেবী উল্লেখ করেছেন জীর্ণতা আর দীর্ণতার মাঝখানে নতুন এক মধুচন্দ্রিমা বলে। বর্ণনা করেছেন কেমন করে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে বড়শিতে গেঁথে সুখ তুলে আনতেন। পাতার পর পাতা সেই বর্ণনা। হঠাৎ এক জায়গায় এসে সুর কেটে গেল। সেখানে পাওয়া গেল ক্ষোভের গল্প, জীবনরতন বাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ। অনাকাঙ্খিত গর্ভসঞ্চার ঘটেছে বিরজা দেবীর, স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সূচনা। সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার তা নিশ্চিত করলেন। কী হবে এখন? একটি সন্তানকেই যথাযথ যত্নে প্রতিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না, এমতাবস্থায় দ্বিতীয় সন্তান অনাকাঙ্খিত, কোনোমতেই তাকে আসতে দেওয়া যায় না। উপায় তবে কী? গর্ভপাত? অনেক রকম ঝামেলা আছে তার, কিন্তু তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী?  জীবনরতন বাবুর মত ছিল না, কিন্তু অমত জানানোর সাধ্য তাঁর ছিল না কারণ চাকরি নেই তাঁর, সংসার চলে তাঁর স্ত্রীর উপার্জনে। তবু আপত্তি করেছিলেন, বলেছিলেন, ধর্মে সইবে না বিরজা। কোনোদিন যদি অবস্থা ফেরে তখন কি ফিরিয়ে আনতে পারবে তাকে, আজকে যাকে গর্ভেই শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছ? শেষ পর্যন্ত গর্ভপাতের ব্যবস্থা আর সম্ভব হয়নি। জয়ন্তর জন্ম হলো।

এদিনের প্রসঙ্গ অন্য। ঐ যে জয়ন্ত রুক্ষ স্বরে জবাব চাইল মা'র কাছে, ভিতরে এলাম কেমন করে? তোমার কাছে আবেদন নিবেদন করে? তোমার অনুমতি নিয়ে? গৌরী ভাবল এবার বোধহয় সেই প্রসঙ্গটা তুলবে সে, এত বছর পরেও যা তার মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধে আছে যে অবাঞ্ছিত সন্তান সে, বাবা অমত না করলে হয়ত গর্ভপাতেই শেষ হয়ে যেত তার জন্মের সম্ভাবনা। গৌরী জানত কথাটা মনের মধ্যে বাজে জয়ন্তর। তাই আশঙ্কা, হয়ত বলে বসবে, চেয়েছিলে তো গর্ভপাত ঘটাতে, তাই করতে পারতে! তাহলে আর এখন বাড়ি থেকে তাড়াতে হতো না! কথাটা শুনলে মা কি আর বেঁচে থাকতে পারবে? তাই জয়ন্তকে থামাবার জন্য অত জোরে ধমক দিয়েছিল সে।

ভগ্নস্বাস্থ্য, দুর্ভাগ্যপীড়িত দিদিকে শান্ত করার চেষ্টায় বোঝাতে লাগল যে কথা কাটাকাটির উত্তেজনায় সে এমনই আবিষ্ট ছিল যে ডাইরির কথা তার একবারও মনে পড়েনি। সে বরং উল্টোটাই বলতে চেয়েছিল যে তাঁরা চেয়েছিলেন বলেই এসেছি, তাঁরা এনেছিলেন বলেই তার আসা হয়েছে। 'সত্যি কথা বলতে কি, একসময় সত্যিই কষ্ট হতো ভেবে যে আমি অবাঞ্ছিত সন্তান। তারপর ভেবে দেখলাম যে ইচ্ছে করলেই তো অন্যরকম একটা কিছু লিখে রাখতে পারতেন মা। তাহলে সেটাই বিশ্বাস করতাম, কিন্তু তা হতো অসত্য। অকপটে সত্যি কথা বলার সাহস সকলের থাকে না। মা'র ছিল। আমি আরো ভেবেছি যে গর্ভে তখন যে সন্তানটি ছিল, তার জন্ম হওয়ার সত্য মূল্য কতখানি ছিল। বাবা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার বছর খানেক কি বছর দেড়েকের মধ্যে আমার জন্ম হলো। তার মানে একটা র‍্যাশ অ্যাক্ট আর তারই ফলশ্রুতিতে গর্ভসঞ্চার। যে গর্ভসঞ্চারের কথা ভেবে লজ্জিত হতে হয়, শঙ্কিত হতে হয়, সেখানে গর্ভমোচনের চিন্তার মধ্যেই সততা খুঁজে পাওয়া যায়। আমি তা মানি বলেই মা'র উপর দোষারোপ করি না। তাই ঐ কথাগুলো আমি তুলব, তা কখনও হবে না রে দিদি। আজ যখন বলছিলাম তখন এই কথা ভেবেই বলছিলাম, আমাকে যেন চেয়েই আনা হয়েছিল। তা না ভাবতে পারলে যে আমি নিজেই বাঁচতে পারব না রে দিদি। বলেছিলাম, তোমরা এনেছিলে বলেই আমার আসা হয়েছে। এখন বের করে দেবে কেমন করে? আমার কথা হচ্ছে এই যে, আমাকে থাকতেও দিতে হবে, আর আমার কাছ থেকে টাকাও নিতে হবে।

গৌরী বলল, ভাই একটা কাজ করলেই তো সব মিটে যায়। করছিস না কেন?

--- কী? ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছিস? বলতে হবে ক্ষমা করে দাও, এই তো?

--- হ্যাঁ, ধর তাই।

--- বেশ, না হয় তাই হলো। কিন্তু মা যদি জিজ্ঞেস করে বসে কোন অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি, তখন কী বলব?

--- তোর অন্যায়ের কথা বোধ হয় বলছে না মা। কিন্তু এখন তো তুই একা নয়! যারা তোর সাথে জুড়ে আছে, তাদের দায় তো তোকেই বইতে হবে! তুই ছাড়া বইবে কে?

--- আর কারো দায় বইতে হবে না? আর কেউ জুড়ে নেই আমার সাথে? এতদিন যারা জুড়ে ছিল তাদের জুড়ে থাকা কি শেষ হয়ে গেছে?

--- অত কথা আমি জানি না। সুচরিতাকে একবার বল না! মা'র কাছে এসে একবার বলুক, মা ভুল হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে মা।

জয়ন্ত হো হো করে হেসে উঠল। সুচরিতা কেন? ক্ষমা তো চাওয়া উচিত আমার, কারণ সে যখন আমার সাথে জুড়ে আছে তখন তার দায় তো আমাকেই নিতে হবে, তাই তো বললি তুই! আমাকেই তো তাহলে তার হয়ে মুচলেকা দিতে হয়! জানিস দিদি, তোর মুখ থেকেই শুনেছি, বাবাকেও একবার মুচলেকা দিতে বলেছিল ইংরেজ সরকার। মুচলেকা দিলে নাকি বাবা অনেক আগেই ছাড়া পেয়ে যেতেন, অতদিন জেলে কাটাতে হতো না, সংসার চালাতে মা'কে অত দিন ধরে নাকাল হতে হতো না। কিন্তু বাবা রাজী হলেন না। বাবা কি একবারও সংসারের কথা ভাবলেন না? মা'র কথা ভাবলেন না? তোর কথা ভাবলেন না? সংসারের প্রতি কি তাঁর মায়া মমতা কম ছিল? মা'র প্রতি, তোর প্রতি কি ভালবাসা ছিল না বাবার?

--- তা থাকবে কেন? ইংরেজের কাছে মাথা নত করতে চাননি, তাই।

--- শুধু ইংরেজ বলেই? ইংরেজ বলেই কি তার কাছে মাথা নত করা চলে না? তা নয়। মাথা নত করেননি মাথা নত করবেন না বলে। ভিতরে একটা সেল্ফ জেগে থাকে। সেই সেল্ফের অস্তিত্ব যেখানে সুস্পষ্ট ভাবে অনুভূত, সেখানে তা শুধু একাই থাকে, স্ত্রী পুত্র কন্যা বা অন্য আর কেউই থাকে না। তখন আর কারো জায়গা হয় না সেখানে। ইংরেজের প্রতি বিরোধিতা খুব বেশি স্পষ্ট ছিল বলে হয়ত এত প্রবল ছিল তার মুচলেকা দেওয়ায় অসম্মতি। হয়ত সেটাও একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু সেখানেও সেল্ফের ভূমিকা।

--- এসব তুই কী বলছিস ভাই? মা আর ইংরেজ এক হলো?

--- হুবহু এক যে নয়, তা জানি। কিন্তু তা সেই একেরই প্রকাশ। দোষ যেমন নিম্নবর্গীয় প্রবৃত্তির প্রকাশ, কিছু গুণ ও আছে তেমন। জিনিসটা একই, কখনও তাতে দোষ দেখি, কখনও তাতে গুণ -- যখন যার বেলায় যেমন বিবেচনা সুবিধাজনক, সেই অনুযায়ী। শক্তি বা ক্ষমতার দম্ভে ইংরেজ যেমন আনুগত্য দাবী করত, ব্যক্তি মানুষ ও তেমন করতে পারে, তেমন করে থাকে। বাড়ি মা'র নামে, তাই আমাকে চলে যেতে বলতে পারে মা। খুব কি তফাত? তোকে একটা কথা বলি দিদি, আমরা যে ইংরেজকে তাড়িয়েই স্বাধীনতা পেয়েছি তা ঠিক, কিন্তু তাতেই নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না যে ইংরেজ খারাপ। যেমন ধর বাঘের কথা, বাঘ হরিণের বাচ্চার ঘাড় মটকে খায় কিন্তু নিজের বাচ্চাকে পরম আদরে দুধ খাওয়ায়। প্রকার ভেদের এই তীব্রতাই বাঘত্ব। মানুষের মধ্যে তার সমাহার ঘটলে বলি ব্যক্তিত্ব। আমরা না বুঝে পুজো করি।

--- মানে?

--- সে তো আমিও খোঁজ করছি রে দিদি! থাক এসব কথা, আসি রে। উপরে গিয়ে আগে ওদের বলে আসি আজ রাতে তোমরা কেউ খেতে নামবে না। হাজার ডাকাডাকি করলেও না। তারপর বিস্তর সময় যাবে আলোচনায় পর্যালোচনায়, বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে এই কথাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমারই, আর কারো নয়। তখন চোখ তুলে সুচরিতার মুখের দিকে তাকাতে পারব না। তারপর দেখি হোটেলে গিয়ে কী পাওয়া যায়। সেখানেও তো কৈফিয়ত দিতে হবে হাজার গণ্ডা, অন্য সময় তো খাবার অনেক বেশি নিই, আজ মোটে তিনজনের কেন! আর না, আসি রে।

রাত নামল গভীর হয়ে। গৌরীর চোখে ঘুম নেই। এমনিতেই ঘুম আসতে তার দেরী হয়, আজ আরো বেশি। নিজের দুর্ভাবনা যা তাকে নিদ্রাহীন রাখে, আজ তার সাথে নতুন একটা যুক্ত হয়েছে। হঠাৎ নিজের দুর্ভাগ্যে মনোনিবেশ করার সেই নিবিষ্টতায় ব্যাঘাত ঘটল। শব্দ, কিসের যেন শব্দ, উপরতলা থেকে আসছে। হ্যাঁ, আসে, শব্দ আসে উপরতলা থেকে, তার ভাই যেখানে থাকে, রাত নিঃশব্দ হলে তা স্পষ্ট হয়। ভাই ঘুমায়নি? কী করছে এত রাতে? মা বিরজা দেবী, তাকে ডেকে জানানোর সুযোগ নেই। এই ঘরে থাকলেই কি পারত? সাহস হতো না। শব্দ থামার নাম নেই, চলছে তো চলছেই। জয়ন্ত জেগে আছে, আর নীচের তলায় তার দিদি গৌরী রাত জেগে তার জেগে থাকার শব্দ শুনছে। তবু একসময় আপনার থেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

পরের দিন সকালে, ভোর ভোর নাগাদ, বাড়ির সামনে ম্যাটাডোর এসে থামল। ড্রাইভার আর খালাসিদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির এবং বাইরের সকলেই সচকিত হয়ে উঠেছিল। ঠিকানা খোঁজ করার নামে সারা পাড়া জানাতে জানাতে এসেছে ড্রাইভার আর খালাসিরা। কার কাছ থেকে শুনে এসেছে যে বাড়িতে তাম্রপত্র আছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীর বাড়ি -- বললেই নাকি যে কেউ চিনিয়ে দিতে পারবে। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কৌতুহলী চোখগুলো, যারা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে, সব এখন এই বাড়ির দিকে। অন্যদিকে এই বাড়িতে অন্য দৃশ্য। মায়ের ঘরে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল গৌরী। মা, এ তুমি কী করলে? ভাই যে চলে যাচ্ছে?  পাথরের মূর্তির মতন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন বিরজা সান্যাল, গৌরী আর জয়ন্তর মা। কুণাল বাড়ি নেই, সে আরো সকালে বেরিয়ে গেছে টিউশন নিতে। সে থাকলে যে এতক্ষণে একটা বিপত্তি বাঁধত তা উভয়েই অনুমান করতে পারে। তবু আশঙ্কা যায়নি, গাড়িতে মালপত্র তুলে রওনা দেওয়ার আগেই যদি টিউশন থেকে ফিরে আসে সে? কী হবে তখন? এই দুর্ভাবনা ছাড়াও আরো এক দুর্ভাবনা গৌরীর, কুণালের পড়াশোনার কী হবে এবার থেকে, এত খরচ যোগাবে কে! বিরজা দেবীকে অবশ্য অতখানি বিব্রত হতে হয় না, তিনি দাঁত কামড়ে প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করতে জানেন।

গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে এলো জয়ন্ত। কিন্তু গায়ে ঘরে পরার আটপৌরে পাজামা পাঞ্জাবি। ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বেশ চিৎকার করে বলল, 'আমি যে ফোন করে বারণ করে দিলাম? বললাম লাগবে না? তাহলে পাঠালো কেন? যান, যান, ফিরে যান গ্যারেজে’। তারপর ড্রাইভারের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, 'যান, চা নাস্তা খেয়ে নেবেন'।

গাড়ি চলে গেলে জয়ন্ত আবার ফিরে এলো বাড়ির মধ্যে। তখন আর কোনো অপ্রসন্নতার চিহ্ন দেখা গেল না চোখেমুখে। গৌরী যেন স্বস্তি ফিরে পেল দেখে। বিরজা দেবীরও হয়ত তাই। দম মেরে থাকা গুমোট যেন কাটল কিছুটা। নিঃশ্বাস ছেড়ে হালকা করে ফেললেন বুক। গৌরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যেতেই তো বলেছিলাম! আটকাতে তো যাইনি! গৌরী চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল, 'মা'। বিরজা দেবী ধমকে উঠলেন, তুই চুপ কর। তারপর ফিরে গেলেন নিজের কাজে।

কিছুক্ষণ পর আবার আর একটা গাড়ির আওয়াজ। আওয়াজেই বোঝা গিয়েছিল, তবু চোখে দেখে নিঃসংশয় হওয়া গেল, জয়ন্তর অফিসের গাড়ি। এত সকালে কখনও যে আসে না, তা নয়। অফিসের কাজে এইরকম যেতে হয় মাঝে মাঝে। খানিক পরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল নেমে আসার। কিন্তু সে শব্দ অনেকগুলো পায়ের একসাথে। বাইরে জুতো ছেড়ে বিরজা দেবীর ঘরে এসে ঢুকল তিনটি মৌন মূর্তি। জয়ন্ত, সুচরিতা আর ওদের ছেলে জীষ্ণু। দেখতে পেয়ে গৌরীও ছুটে এলো সেই ঘরে। কী হয়েছে জীষ্ণুর? তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। গৌরী ছুটে গিয়ে নিজের দুই হাতে তুলে ধরল তার মুখখানা। গোপন কথা জানতে চাওয়ার মতন চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে? ধরা গলায় সে যখন বলল, 'কিছু হয়নি', তা চাপা পড়ে গেল, যেহেতু মনযোগ তখন সরে গেল অন্য দিকে, অন্য দৃশ্যে। জয়ন্ত মা'কে প্রণাম করে বলল, মা এলাম। তারপর দিদিকেও প্রণাম করল। বলল, দিদি, আসি রে। তারপর বিশেষ কাউকে সম্বোধন না করে যেন নির্বিশেষ সকলকেই শুনিয়ে বলল, উপরের ঘর খোলা থাকল। ঘরও আমার নয়, ঘরের ভিতর যা ফেলে গেলাম তাও আমার হতে পারে না। কোনোটার উপরেই আমার কোনো দাবী নেই। তাই তালা লাগিয়ে অনধিকার চর্চা করতে গেলাম না। যে 'আমি'টা এতদিন ধরে সাধে, আহ্লাদে, হাসি, কান্নায় সমস্ত কিছুর সাথে জড়িয়ে ছিল, সেটাকে মিসক্যারিজ অফ সেল্ফ বলে মনে হলো। তাই নতুন করে জন্ম নিতে চললাম। জন্মগ্রহণ নগ্ন দেহে, তাই সব কিছু ফেলে রেখে চললাম। ফেলে গেলাম সেগুলোও, যা গৌরবের বলে জানতাম। চললাম। গর্ভের আঁধার এখানেই পড়ে থাক।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন