![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
একরাত্রি ২০১৫
শুভ্রাংশুদা আর আমি একসাথে স্কুলে গিয়েছি, না বুঝেই বর-বউ খেলেছি। আমি ক্লাস ওয়ানে আর উনি ক্লাস ফোরে। তাদের বাসায় গেলে শুভ্রাংশুদা’র মা আমাকে খুব আদর করতেন এবং আমাদের দু’জনকে একসাথে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বা বসিয়ে নিজে নিজেই বলতেন, ‘ইসশ, ঠিক যেন পত্রিকার বিজ্ঞাপনের মতো - দু’জনে দু’জনার!’
ছোট ছিলাম তবে কথাটার মানে একদম যে বুঝতাম না তা’ নয়।
শুভ্রাংশুদা’র প্রতি স্কুলের অন্য সব বাচ্চাদের চেয়ে আমার যে কিছু বেশি দাবি ছিল
সে ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছিল। সেই ভাসা ভাসা অধিকারবোধে আমি তাঁর বই-খাতার
পাতা ছিঁড়তাম, পাশের বাসায় শুভ্রাংশুদা’র পড়ার ঘরে গিয়ে তাঁর খেলনা উড়োজাহাজ বা
গাড়ি ভাঙ্গতাম। তিনি আমার সব ফরমাশ খাটতেন এবং আমার সব অত্যাচার মেনে নিতেন। গোটা
পাড়ায় বা স্কুলেও তাড়াতাড়ি লম্বা হয়ে ওঠা এবং টকটকে ফর্সা রঙ্গের জন্য সুদর্শন
বালক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল, তবে দুষ্টু বালিকার চোখে সে সৌন্দর্যের কোন গৌরব ছিল
না, আমি শুধু জানতাম শুভ্রাংশুদা আমার সব কথা শোনার জন্য জন্মেছেন, এজন্য তিনি
আমার বিশেষ তাচ্ছিল্যের পাত্র।
আমার বাবা ভাগ্যধন বড়ুয়া চট্টগ্রামের বাঁশখালির মত উপজেলা শহরে খুব ছোট-খাট একটা জুয়েলারির দোকান চালাতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল একটু বড় হতেই আমাকে কোন ভাল ব্যবসায়ী পাত্র বা চেনা-জানা কোন ঘরে আমার বিয়ে দেবেন। তবে, আমি মনে মনে তেমনটা চাইনি। আমাদের পাড়ার শেফালী ইয়াসমীন আপা যেমন ঢাকায় গিয়ে পড়া-শুনা করে লেডি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন, আমারও জীবনের উদ্দেশ্য তেমনি বড় কিছু ছিল। লেডি ম্যাজিস্ট্রেট না হতে পারি কিছু একটা ত’ হব, এটা আমি মনে মনে স্থির করে রেখেছিলাম।
চট্টগ্রামের এই গণ্ডগ্রাম বাঁশখালি উপজেলায় যেখানে সব মেয়েদের স্কুল কি কলেজ পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যায়, সেখানে থেকেই শেফালী ইয়াসমীন আপার দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সন্ধ্যায় ‘সোহাগ’ বাসের রাতের টিকিট কেটে ঢাকায় পালিয়ে গেলাম। শেফালী আপার এক বিবাহিতা মামাতো বোনের বাসায় প্রথমে কয়েকদিন থাকলাম। তারপর ফার্মগেটে একটি লেডিস হোস্টেলে উঠলাম যেখানে মফস্বলের মেয়েরা ঢাকায় মেডিকেল-ইঞ্জিনীয়ারিং-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য এসে উঠে শহরের নামী সব কোচিং সেন্টারে পড়ে ভর্তি পরীক্ষা ভালভাবে দেবার জন্য। আমি আমার কানের সোনার দুল জোড়া এবং গলার চেন বিক্রি করেছিলাম। আমার পড়া-শুনার এত আগ্রহ দেখে বাবাও আপত্তি করলেন না এবং কিছুদিন পর বাবার কাছ থেকেও পড়ার জন্য কিছু কিছু খরচ পাওয়া শুরু করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। লেখাপড়া যথা নিয়মে চলতে লাগলো।
ধীরে ধীরে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের
টি,এস,সি, বা ‘অপরাজেয় বাংলা’ চত্বর, ‘মধুর ক্যান্টিন’ কি খানিকটা দূরের শাহবাগে
বা চারুকলায় নানা সভা-সমিতি এবং আন্দোলনে যোগ দেয়া শুরু করলাম। দেশের গণতন্ত্র
পুনরুদ্ধারের পরেও কখনো বস্তি উচ্ছেদ, কখনো নারী দিবস পালন, কখনো দেশের সম্পদ
তেল-গ্যাস-বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা, কখনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার আবার কখনো সুন্দরবন
রক্ষা ইত্যাদি নানা কাজে প্রাণ বিসর্জন করা যে অতি জরুরি, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল
না। কিন্তু, কি করে অত সব কঠিন কাজ করা যেতে পারে আমি জানতাম না, আর সামনে কোন
উদাহরণও ছিল না।
তাই বলে আমার আগ্রহের কোনো ত্রুটি ছিল না। আমরা
মফস্বলের মেয়ে, ঢাকার হলিক্রস-অগ্রণী-উদয়নে পড়া, নাক উঁচু মেয়েদের মতো সব জিনিস
নিয়ে ঠাট্টা করতে শিখিনি, সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা খুব দৃঢ় ছিল। আমাদের সভার
কর্তৃপক্ষীয়েরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা কখনো ক্লাসের ক্যান্সারাক্রান্ত বন্ধু বা
কখনো শৈত্যপ্রবাহে উত্তর বাংলার শীতার্ত মানুষের শীতবস্ত্র কেনার জন্য একটি কাগজের
বাক্স নিয়ে ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলোতে খেয়ে না-খেয়ে দুপুর-রোদে টো টো করে সব প্রাইভেট
কারের সামনে দাঁড়াতাম, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন বিলি করতাম, সেমিনার বা
ওয়ার্কশপে টেবিল-ডায়াস ঠিক করতাম, আমাদের নারীবাদী নেত্রীদের নামে কেউ একটা কথা
বললে চুলোচুলি করতে উদ্যত হতাম। ঢাকার মেয়েরা এসব লক্ষণ দেখে আমাদের ‘মফস্বলী’
বলতো।
লেডি ম্যাজিস্ট্রেট হতে এসেছিলাম, কিন্তু ইলা
মিত্র-বেগম রোকেয়া-মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট-মাদার তেরেসা-ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল-সিমন
দ্য ব্যুঁভোয়া-শুলামিথ ফায়ারেস্টান হবার আয়োজন শুরু করলাম।
এমন সময়ে আমার বাবা ভাগ্যধন বড়ুয়া এবং শুভ্রাংশুদা’র
বাবা সুরেশ বড়ুয়া একমত হয়ে শুভ্রাংশুদা’র সাথে আমার বিয়ের জন্য উদ্যোগী হলেন। আমি
আঠারো বছর বয়সের সময় ঢাকায় পালিয়ে আসি, তখন শুভ্রাংশুদা’র বয়স একুশ; এখন আমি
চব্বিশ আর উনি সাতাশ। বাবার মতে আমার বিয়ের বয়স দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। কিন্তু,
এ দিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি যে আজীবন বিয়ে না করে মাদার তেরেসা-ফ্লোরেন্স
নাইটিঙ্গেলের মত স্বদেশ এবং সমাজের সেবা করে মরব। বাবাকে বললাম, সেশন জটে
মাস্টার্স শেষ হতে আরো এক বছর বাকি। পড়া-শুনা শেষ না করে বিয়ে করব না।
দু-চার মাসের মধ্যে খবর পেলাম, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নী ডাক্তার শুভ্রাংশু বড়ুয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ও সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী দীপ্তি বড়ুয়াকে বাবার পছন্দে বিয়ে করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের নারীবাদী পাঠচক্র ‘বেগম রোকেয়া থেকে সিমন দ্য ব্যুঁভোয়া’র জন্য নানা বই কেনা এবং লেকচার সিরিজ সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম, খবরটা কানে নিতান্ত তুচ্ছ বোধ হলো।
অনার্স পাস করেছি, মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হবার আগে
বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার কোন দাদা বা ভাই নেই। মা আর ছোট দু’টো বোন।
কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের পড়া ছেড়ে চাকরির খোঁজ শুরু করলাম। বেশ খানিকটা
চেষ্টার পর নোয়াখালীর রামগতিতে উপকূলীয় এলাকায় ‘সেভ দ্য চিল্ড্রেন’-এর একটি
প্রকল্পে ‘জেন্ডার ওয়েলফেয়ার অফিসার’ পদ প্রাপ্ত হলাম।
মনে করলাম, আমার উপযুক্ত কাজ পেয়েছি। উপদেশ এবং
উত্সাহ দিয়ে প্রত্যন্ত রামগতির প্রত্যেক নারীকে আগামী বাংলাদেশের এক-একজন
সেনানায়িকা করে তুলব।
কাজ শুরু করে দিলাম। দেখলাম, আগামী বাংলাদেশের চেয়ে
প্রতি মাসে রামগতির বিবাহিতা যুবতী নারীরা ঠিকঠাক মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী
ব্যবহার করছেন কিনা তার তাড়া ঢের বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার আর বাচ্চাকে
পোলিও-ডিপথেরিয়ার টিকা দেয়া হয়েছে কিনা এর বাইরে রোকেয়া বা ব্যুঁভোয়াকে নিয়ে কথা
বললে আমাদের প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর রাগ করেন। মাস-দুয়েকের মধ্যে আমারও উত্সাহ
নিস্তেজ হয়ে আসলো।
আমাদের মতো প্রতিভাহীন মেয়েরা ঘরে বসে ফ্লোরেন্স
নাইটিঙ্গেল বা মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট হবার নানা অদ্ভুত কল্পনা করে, অবশেষে কাজের
জগতে পা রেখে ঘাড়ে লাঙল বয়ে আর পেছন থেকে লেজে মোচড় খেয়ে, মাথা নিচু করে সারা
দিনের কামলা খেটে সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জাবনা খেতে পেলেই সন্তুষ্ট থাকে; লাফ-ঝাঁপে
আর উত্সাহ থাকে না।
আমাদের প্রজেক্ট অফিস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন স্টাফ অফিসে থাকার নিয়ম ছিল। আর সবার সংসার আছে। আমি একা নারী, আমাকে দু’জন গার্ড আর এক রান্না করে দেবার খালা (মাসী) সহ প্রজেক্ট অফিস রাতে পাহারা দেবার দায়িত্ব দেওয়া হলো। প্রজেক্ট অফিসের দোতলা বিল্ডিংয়ের পাশে একটি দুই রুমের একতলা বিল্ডিংয়ে রান্না করে দেবার খালা ময়নার মা’র সাথে আমি বাস করতাম।
আমাদের প্রজেক্ট অফিস রামগতির মূল লোকালয় থেকে কিছু
দূরে। একটি বড় পুকুরের পাড়ে। চার দিকে সুপারি, নারকেল আর মাদারের গাছ, এবং
প্রজেক্ট অফিসের প্রায় গায়েই দু’টো খুব বড় নিমগাছ ছায়া দান করছে।
একটা কথা এতটা সময় বলিনি বা বলার মত মনে হয়নি।
রামগতির উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার শুভ্রাংশু বড়ুয়ার বাসা আমাদের
প্রজেক্ট অফিস থেকে কাছেই। তাঁর স্ত্রী দীপ্তি বড়ুয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হলো।
শুভ্রাংশুদা’র সাথে ছোটবেলায় আমার চেনা-জানা ছিল কিনা তা’ দীপ্তি জানতেন কি না
জানি না, আমিও নতুন এই পরিচয়ে সে বিষয়ে কোন কথা বলা ঠিক বলে মনে করলাম না। সত্যি
বলতে শুভ্রাংশুদা যে কোনো দিন আমার জীবনের সাথে কোনোভাবে জড়িত ছিল, সেটাই আমার ঠিক
মতো মনে পড়ে না।
একদিন ছুটির দিনে কি মনে করে দীপ্তির সাথে দেখা করতে গিয়েছি। আসলে কয়েকদিন আগে ভদ্রমহিলা বা মেয়েটি আমার দুই রুমের কোয়ার্টারে নিজে থেকে এসে যেচে পরিচয় করে গেছে। আমাকে তাদের বাসায় যেতেও বলেছে। বলেছে এখানে সারাদিন তার বড় একা একা লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ না হতেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য খুব ভাল বিষয়ে চান্স পায়নি। সংস্কৃতে পড়ে আজকাল কি আর চাকরি হয়? মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে রেজাল্ট ভাল হয়নি। তা’ দীপ্তির বাসায় গিয়ে ঠিক কি বিষয়ে গল্প শুরু হলো মনে নেই। বোধ করি বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে। দীপ্তি যে সেজন্য খুব চিন্তিত বা মনমরা ছিল তা’ নয়, তবে বিষয়টা এমন যে চা আর বিস্কিট-চানাচুর খেতে খেতে ফেসবুকে দেশের নানা ভয়ানক খবর নিয়ে ঘণ্টাখানেক-দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যেতে পারে।
এমন সময় পাশের ঘরে একটি হাল্কা পুরুষ গলার কাশি, শার্টের ফুল হাতা গোটানোর সূক্ষ্মতম শব্দ ব্যঞ্জনা এবং খুব চেনা কোন পায়েরও একটু শব্দ শুনতে পেলাম; মাথা নিচু করেই বেশ বুঝতে পারলাম মুখোমুখি ঘরের জানালার গরাদ থেকে ফ্রেঞ্চকাটি দাড়ির আড়ালে ফর্সা মুখের দীর্ঘকায় এক যুবকের একজোড়া চোখ আমাকে এক ঝলক দেখে চলে গেলো।
সাথে সাথে একজোড়া চোখ আমার মনে পড়ে গেল। আস্থা,
সারল্য আর স্কুলে যাবার দিনগুলোয় অপার মমতায় ভরা দু’টো বড় বড় চোখ, কালো মণি,
ছেলেদের তুলনায় খানিকটা দীর্ঘ চোখের পাঁপড়ি আর স্থির, অতল চোখ। হঠাত্ আমার
হূিপণ্ডকে কে যেন একটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরলো আর অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় ভেতরটা টন টন
করে উঠলো।
বাসায় ফিরে আসলাম কিন্তু সেই ব্যথা আর মোছে না। এলিস
ওয়াকার কি টরিল ময় যার বইই পড়ি, ফেসবুকে যত স্ট্যাটাস দিই, কিছুতেই মনের ভার আর
দূর হয় না; মনটা হঠাত্ একটা প্রকাণ্ড বোঝার মতো হয়ে বুকের শিরা ধরে কাঁপা শুরু
করলো।
সন্ধ্যার পরে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা শুরু করলাম, এমনটা হলো কেন। কে যেন ভেতর থেকে জবাব দিল, তোমার সেই শুভ্রাংশুদা কোথায় গেল।
উত্তরে বললাম, ওমা- আমি ত’ তাকে স্বেচ্ছায় ছেড়েছি।
উনি কি চিরদিন আমার জন্য বসে থাকবেন?
কে যেন আবার ফিসফিস করে আমাকে বললো, তখন যাকে ইচ্ছে
হলেই পেতে পারতে এখন মাথা খুঁড়ে মরলেও চোখে চোখ রেখে তাকানোর অধিকারও আর এ সমাজ
তোমাকে দিতে চাইবে না। সেই ছোটবেলার শুভ্রাংশুদা তোমার যত কাছে থাকুক, তার কাশির
শব্দ শুনতে পাও, তার অডিকোলনের গন্ধ নাকে লাগুক, তার সাথে তোমার একটি গ্লাস ওয়্যাল
এখন থেকে থাকবেই।
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম, তা হোক্-না, শুভ্রাংশুদা আমার
কে?
সেই ফিসফিস গলাটা আবার বললো, শুভ্রাংশু দা আজ তোমার
কেউ নয় মেয়ে, অথচ উনি তোমার কী না হতে পারতেন?
সে ত’ ঠিক কথাই। শুভ্রাংশুদা আমার কী না হতে পারতেন।
আমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে বেশি চেনা, আমার জীবনের সব আনন্দ-কষ্টের শেয়ারিং তাঁর
সাথে হতে পারত, আজ উনি এত দূরের, এত পরের, আজ তাঁকে দেখা নিষেধ, তাঁর সাথে বেশি
কথা বলা ঠিক না, তাঁর সম্বন্ধে চিন্তা করা এ মনোগ্যামিস্ট সমাজের ইয়ার্ড-স্টিকে
এডাল্টরি। আর, একটা দীপ্তি, কোথাও কিছু নেই হঠাত্ উড়ে এসে জুড়ে বসলো; ভান্তের
সামনে ত্রিপিটক থেকে গোটা-দুয়েক মুখস্থ মন্ত্র পড়ে শুভ্রাংশু দা’কে পৃথিবীর
আর-সবার কাছ থেকে একমুহূর্তে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল।
আমি হিউম্যান সোসাইটিতে নতুন কোন ডক্ট্রিন প্রচার করতে বসিনি, সমাজ ভাঙ্গতে আসিনি, রিলেশনশীপের বন্ডেজ ছিঁড়তে চাই না। জাস্ট আমার মনের ঠিক এখনকার অবস্থাটা আপনাদের কাছে এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি আসলে। নিজের মনে কত চিন্তা আসে। তার সব কি লজিক্যাল? দীপ্তির ঘরে জানালার ওপাশে যে শুভ্রাংশু দা সে যে দীপ্তির চেয়েও বেশি করে আমার, এ কথা আমি কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না। এমন চিন্তা খুব অসঙ্গত এবং অন্যায় তা’ স্বীকার করি তবে একদম কি অস্বাভাবিক?
আজকাল আর কোনো কাজে মন দিতে পারি না।
দুপুরবেলায় যখন উপজেলা আর আশপাশের গ্রামগুলোর মেয়েরা আমাদের প্রকল্প অফিসে ‘লিগ্যাল এইড সেন্টার’-এ তালাক আর দেনমোহরের সমস্যা নিয়ে আসে তখন বাইরে রোদ যেন ঝাঁ ঝাঁ করতো, খানিকটা গরম বাতাসে নিমগাছের ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসত, তখন মন চাইত, কী চাইত জানি না, এটুকু শুধু বলতে পারি যে স্বামীর লাথি-ঝাঁটা খেয়েও স্বামীর বাড়িতে ফিরতে চাওয়া মেয়েদের ‘নারীর অধিকার’ বা ‘নারীর আত্মসম্মান’ বোঝাতে ইচ্ছা করত না।
অফিস ছুটি হয়ে গেলে আমার একার ঘরে থাকতে মন টিকত না,
অথচ এলাকার কোন ভদ্রমহিলা দেখা করতে আসলেও অসহ্য লাগত।
সন্ধ্যাবেলায় পুকুরের পাড়ে সুপারি-নারকেল গাছের
মিনিংলেস সব ফিসফাস শুনতে শুনতে ভাবতাম, হিউম্যান সোসাইটি একটি খুব কমপ্লেক্স সব
ভুলের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে আমাদের কারোরই মনে থাকে না, আর পরে ভুল সময়ে ভুল
ডিজায়ার নিয়ে অস্থির হয়ে যায়।
তোমার মত একটি মেয়ে শুভ্রাংশুর বউ হয়ে একটা জীবন বেশ ভালই কাটাতে পারত, তুমি হতে চাইলে কিনা মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট আর শেষে হলে ‘সেভ দ্য চিল্ড্রেনে’র উপকূলীয় অঞ্চলে ধ্যাধধেড়ে রামগতির একটি প্রকল্পে জেন্ডার উন্নয়নের অফিসার। আর দীপ্তি বড়ুয়া, রাউজান কলেজ থেকে এইচ,এস,সি, পাশ; বিয়ের আগ অবধি তার জন্য শুভ্রাংশু যেমন, পার্থশঙ্করও তেমন, সে কিনা কিচ্ছু না ভেবে-টেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারের বউ হয়ে দিব্যি সংসার করছে, মন খারাপ থাকলে তরকারিতে লবণ কম হয় বা বরের সাথে ঝগড়া করে, যেদিন মন ভাল থাকে সেদিন বরের জন্য নতুন আইটেমের রান্না করে, শার্ট আয়রন করে। বেশ গোলগাল, কোন বেদনা নেই। পুকুরের পাশে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে কোনদিন হাহুতাশ করে একা একা সন্ধ্যা বইতে হয় না তার।
দীপ্তির বাবা অসুস্থ বলে সে রাউজানে গেছে সপ্তাহ
খানেকের জন্য।
মা বাঁশখালিতে বাবার দোকান বিক্রি করে ঢাকায় ছোট
মামার সাথে একটি এপার্টমেন্ট শেয়ারে কিনেছেন। আমার ছোট দুই বোন ঢাকায় হলিক্রস কলেজ
আর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমার মাসের বেতন থেকে শুরুতেই অর্দ্ধেকটার বেশি ওদের ঢাকায়
পাঠিয়ে দেই। চেষ্টা করছি ঢাকায় ‘সেভ দ্য চিল্ড্রেন’-এ কোন ইউনিটে চলে যাবার।
ভাগ্যক্রমে এর ভেতর একদিন ঢাকা অফিস থেকে চিঠি এলো। একটি পরীক্ষা আছে। অভ্যন্তরীণ
পরীক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। বেতনও হাজার পাঁচেক বেশি। পরীক্ষা হবে
শনিবার। আমি বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করেই রাতের বাসে উঠে বসলাম। শুক্রবার সকালেই
পৌঁছে যাব।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ছিল। দশটা থেকেই টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আকাশের ভাবগতিক দেখে আমাদের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আগে আগেই ছুটি দিতে চেয়েছিলেন। তবে একাউন্টস বিভাগের দু’জন আর আমরা জেন্ডার বিভাগের দু’জন কাজ শেষ করতে সন্ধ্যাই হয়েছিল। রাত দশটায় রামগতি থেকে বাসে উঠেই দেখি আমার সিটের পাশে শুভ্রাংশু দা উঠলেন। সামনের সিটে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন,
‘শুভ্রাংশু - ঢাকা যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ- কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।’
দু’জনেই কাঁটা হয়ে পাশাপাশি বসে রইলাম।
‘ড্রাইভার- আজ কি বাস যাবে? জোরে বৃষ্টি অইদ্দে!’
‘যাইয়ুম- আল্লাহ ভরসা!’
একে ত’ খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ যেন একটা কী মহা আয়োজনে
সারাটা দিন আকাশ জুড়ে আনাগোনা করে বেড়িয়েছে। রাত এগারোটা থেকে বাসে যেতে যেতে
মুষলধারে বৃষ্টি এবং সাথে ঝড় আরম্ভ হলো। যত রাত হতে থাকল বৃষ্টি এবং ঝড়ের বেগ বেড়ে
চললো। প্রথমে পূব দিক থেকে বাতাস বইছিলো, ধীরে ধীরে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিয়ে
বইতে শুরু করল।
অনেক সময় রাতের বাসে ঘুমাই। তবে এ রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করা মিনিংলেস। শুধু ভয় হচ্ছে আজ রাতে কোন বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি না হই! পাশেই শুভ্রাংশুদা। অন্ধকার বাসে কেউ কোন কথা বলছি না। একবার কি ঘুম নয়— তবে তন্দ্রার ঘোরে আমার মাথা তার কাঁধ ছুঁয়ে গেছিল?
রাত যখন তিনটার মত হবে যেন বাসের ভেতরে বসেই বাইরে
থেকে হু হু বাতাসের জোর শব্দ শোনা গেল। গোটা বাসটা হঠাত্ যেন শক্ত কিছু
একটায়...একটা কাটা গাছের আস্ত গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।
‘টায়ার পাংচার অইদ্দে। গাড়ি ন যাইয়ে।’
সামনের সিট থেকে ড্রাইভারের গমগমে গলা।
‘কন কি মিঞা? গাড়ি ঠিক অইয়ে কখন?’
‘কইতাম না পারি। কম্পানীরে ফোন দিতে অইব। ভোরের আগে
ঠিক ন অইয়ে।’
বাসের ভেতর বসেই শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ পাচ্ছি। এটা
এসি বাস নয়। বৃষ্টির দিন বলেই এসি বাসের টিকিট কাটা হয়নি। মুষলধারে বৃষ্টি না হলে
হয়তো জানালা খোলা থাকত। এসি বাসের টিকিট আমি গরমেও পারত:পক্ষে কিনি না। আমার বমি
পায়। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বসে থাকার পর ঝড়-বৃষ্টি কমলে বাসের যাত্রীরা এক/এক করে
নামতে শুরু করলো। সামনেই একটি ব্রিজ। ব্রিজের নিচে একটি নদী জোরে ছুটে চলেছে।
ব্রিজটা পার হলেই কয়েক হাত সামনে একটি চায়ের দোকান। এই ভোর রাতে তারা ঝাঁপ খুলে
জেগে উঠেছে বাসের যাত্রীদের কাছে চা-সিগারেট-রুটি-বিস্কুট বিক্রির আশায়। বাসে অন্য
যে দু/চারজন মহিলা সবাই তাদের স্বামী বা পুরুষ সঙ্গীর সাথে এসেছেন। একা নারী
যাত্রা করছি শুধু আমিই। ব্রিজ পার হয়ে চায়ের দোকানের দিকে যেতে ব্রিজ থেকে নেমে
মাটির একটি হাত-পাঁচ-ছয় উঁচু জায়গায় দু’জনেই কেন জানি দাঁড়িয়ে পড়লাম। অন্য
ত্রিশ-চল্লিশ জন নারী-পুরুষ সামনের চায়ের দোকানের দিকে হাঁটছে।
এ ছিল সংহারকাল, তখন আকাশে নক্ষত্রের আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সব দীপ নিভে গেছে, তখন একটা কথা বললেও ক্ষতি ছিল না, তবে একটা কথাও বলা গেল না। শুধু দু’জনে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলাম। ব্রিজের সামনে নদীর উঁচু আর কাঁচা পাড়ের নিচে ঘোর কালো নদীর জল উন্মত্ত ছুটে চলেছে। কেউ কোন কথা বললাম না। নিঃশব্দে দু’জনে শুধু অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলাম।
আজ গোটা বিশ্বজগত্ ছেড়ে শুভ্রাংশু দা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। আজ আমি ছাড়া শুভ্রাংশু দা’র আর কেউ নেই। কোন্ শৈশবের শুভ্রাংশু দা, কোন্-এক জন্মান্তর, কোন্-এক পুরনো ঘোর রহস্যের অন্ধকার থেকে ভেসে, এই রোদ-বৃষ্টি ভরা ঘনবসতি পৃথিবীর উপরে আমারই পাশে এসে তিনি সংলগ্ন হয়েছিলেন; আর, আজ কতদিন পরে রোদ ভরা হাজার মানুষের পৃথিবী ছেড়ে এই ভয়ানক অন্ধকার উপদ্রুত নদীর পাশে শুভ্রাংশু দা একাকী আমারই কাছে এসেছেন। জন্ম তরঙ্গে সেই তরুণ কিশলয়কে আমার কাছে এনেছিল, আজ মৃত্যু তরঙ্গে সেই শক্ত শালপাংশু মানুষটিকে আমারই কাছে এনে ফেলেছে, এখন শুধু আর-একটি ঢেউ আসলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু থেকে ছিন্ন হয়ে আমরা দুজনে এক হয়ে যেতে পারতাম।
সে ঢেউ না আসুক। স্ত্রীপুত্রঘরটাকাকড়ি নিয়ে শুভ্রাংশু
দা চিরদিন সুখে থাকুক। আমি এই একটা রাতে নিঃসীম ধ্বংসের পাড়ে দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দের
স্বাদ পেয়েছি।
রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো, ঝড় থেমে গেল, জল নেমে গেল।
ড্রাইভার আর কন্ডাকটরের গলা শোনা গেল, ‘এ বাস আর ন
যাঁইয়ে। আমনেরা টেম্পো করিয়া সামনের বাস স্টপেজে চলি যান। সেখানে ইউনিক আর শ্যামলী
কোম্পানীর বাস পাবেন যে!’
সকাল হয়েছে। একটা/দু’টো করে টেম্পো, রিক্সা বা ভ্যান গাড়ি এসে মাঝপথে থেমে যাওয়া বাসের যাত্রীদের ঢাকায় যাবার জন্য অন্য বাসে তুলে দিতে সামনের বাস স্টপেজে যাবার এক মাইলের ভাড়ার দাম-দস্তর করছে।
শুভ্রাংশুদা কোন কথা না বলে একটি টেম্পোতে উঠে সামনের
বাস স্টপেজে গিয়ে ‘ইউনিক’-এর কাউন্টার আর আমি অন্য একটি টেম্পোতে উঠে সামনের বাস
স্টপেজে গিয়ে ‘শ্যামলী’র কাউন্টার থেকে ঢাকায় যাবার বাকি পথের টিকিট কিনলাম।
ঢাকায় সেবার আমার অফিসের হেড ব্রাঞ্চেই কাজ হয়ে গেল।
পরীক্ষা দেবার পরপরই কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়। ছোট মামা রামগতি গিয়ে আমার বাসার
জিনিসপত্র নিয়ে আসে।
আর কখনো শুভ্রাংশুদা’র সাথে আমার দেখা হয়নি।
ভাবছি, আমি লেডি ম্যাজিস্ট্রেট হইনি, বিদেশে পিএইচডি করতে যাইনি, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলও হইনি, আমি একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর প্রজেক্টে হাড় ভাঙ্গা খাটুনির প্রজেক্ট অফিসার, আমার গোটা জীবনে নিছক একটি মুহূর্তের জন্য একটি নিঃসীম রাত্রি দেখা দিয়েছিল, আমার অস্তিত্বের সব দিনরাতের ভেতর সেই একটিমাত্র রাতই আমার এ অর্থহীন জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন