কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

এক হারিয়ে যাওয়া ভাষার অন্বেষণে, যে ভাষা সংগীতের

 


বহু বছর আগে যখন সেভাবে কোনও যোগাযোগের মাধ্যম গড়ে ওঠেনি, তখন একমাত্র অবলম্বন ছিল শিস ধ্বনি। একেবারে বিলুপ্ত প্রায় বলা না গেলেও কিছু কিছু জায়গায় এখনও শিস ধ্বনির ব্যবহার আমরা শুনতে পাই।

ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপ 'লা গোমেরায়'-এর মানুষজন কথা বলতেন শব্দে নয়, শিস দিয়ে। এই দ্বীপপুঞ্জ বিখ্যাত সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র কার্নিভাল আর পর্যটনের জন্য। আরেকটা কারণে বিখ্যাত এখানকার সুরেলা ভাষার জন্য। ভাষাটি হল-- 'এল সিলবো গোমেরো'। বহু যুগ ধরে এই ভাষা চলে এসেছে ইউরোপের এই দ্বীপাঞ্চলের নানান দ্বীপে। বর্তমানে একে বাঁচিয়ে রেখেছে একমাত্র এই গ্রামের বাসিন্দারাই।

সুরে সুরে এখনও কথা বলেন উচ্চারণ ছাড়াই। কথা বলা হয় শিস দিয়েই। যা পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায়। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, গভীর গিরিখাত পেরিয়ে অতীতের গোমেরায় গ্রাম থেকে গ্রামে দ্রুতগতিতে খবর পৌঁছানোর সহজ রাস্তা ছিল এই ভাষা।

আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, এই শিস ধ্বনি বহু প্রাচীন ভাষা। যোগাযোগের শুরু সেই রোমান যুগ থেকে। শুধুমাত্র গোমেরায় কেন, পৃথিবীর আরও কিছু জায়গায় এই শিস ভাষাতেই কথা বলা হয় এখনও। তবে প্রযুক্তির কারণে ধীরে ধীরে এই ভাষা অবলুপ্তির পথে।

১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এখানকার মানুষ অন্য জায়গায় সরে যেতে থাকে। ষাটের দশকে অনেকটাই হারিয়ে যায় এই ভাষা। তবে গোমেরায়ের শিস ভাষা একেবারেই স্বতন্ত্র। তার একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা কাঠামো আছে। ফোনেটিক ট্রানস্ক্রিপশন আছে প্রায় বাইশ হাজার মানুষের বেশি সংখ্যক মানুষ এখনও এই ভাষায় কথা বলেন। ২০০৯ সালে এই ভাষাকে মাস্টারপিস অফ দ্য ওরাল অ্যান্ড ইনটেনজিবল, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি সম্মান দেয়। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ সরকারের উদ্যোগে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই ভাষা। এখন শিশুরাও এই ভাষা শিখছে। ১৯৯৭ সালে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ সরকার এই ভাষাকে পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

তুরস্কের অনেক জায়গায় এখনও পাখিদের মতো এই সুরের ভাষায় কথা বলার মাধ্যম বিচ্ছিন্ন কোনও ভাষা নয়, অনেক বেশি কাঠামোবদ্ধ এবং ব্যাকরণসম্মত। তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রায় সত্তরটি স্বীকৃত শিস ভাষা নথিভূক্ত আছে। যদিও তা বিলুপ্তির পথে।

কথার চেয়ে শিসের কম্পাঙ্ক অনেক বেশি হওয়ার কারণে, শিসের আওয়াজ সহজেই আমাদের কানে পৌঁছয়। এমনকি তীব্র শিসের শব্দ চার কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছয় বলে জানা গেছে। ইতিহাস বলছে, মরক্কোর অ্যাটলাস, লাওসের মালভূমি, ব্রাজিলের অ্যামাজন এবং খরা বিদীর্ণ ইথিওপিয়াতেও মানুষ শিসের সাহায্যে যোগাযোগ করত একসময়। বর্তমানে তুরস্ক স্পেন্সের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে পাখিদের এই শিসধ্বনি।

তুরস্কের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম কুষ্কয়। এখানকার মানুষরাই পাখির ভাষা অর্থাৎ শিসের সাহায্যেই পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। এই ভাষার নাম 'কুসদিলি'। এর অর্থ-- পাখির শিস। এটি মূলত তুর্কি ভাষা। এই ভাষার প্রতিটি বর্ণকে আলাদা আলাদা শিস ধ্বনির সাহায্যে উচ্চারণ করা হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়শীকে  অথবা নিজের আত্মীয়কে কুশল সংবাদ জানাতেও হয় এই সুরেলা ভাষায়। এই ভাষা শোনা যায় প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত। যখন প্রযুক্তির এত রমরমা ছিল না, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও এতটা উপযুক্ত ছিল না, তখনও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই ভাষা।

কিন্তু প্রযুক্তির সুপারফাস্ট যুগে এই সংস্কৃতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছে কুসদিলি ভাষা। কয়েক বছর আগে গ্রামটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কুসদিলি ভাষাটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেখানো শুরু হয়।

এরপর আসি গ্রিসের কথায়। এখনও এখানে শিস ভাষা জীবিত রয়েছে। মধ্যগ্রিসের ইউবিয়ার আন্তিয়া গ্রামের লোকজন এখনও এই ভাষাতেই কথা বলেন। যদিও সেই সংখ্যাটা নেহাতই কম। এর ভাষাটির আঞ্চলিক নাম-- স্ফিরিয়া। যার উৎপত্তি স্ফিরিজা থেকে। এটি মূলত গ্রিক ভাষার সাংকেতিক রূপ।

পৃথিবীর বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনোও এই ভাষা বিলুপ্ত প্রায় হলেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। সরকারের দিক থেকেও কোনও খামতি নেই। প্রাচীন ঐতিহ্য বা ইতিহাসকে বাঁচতে রাখার জন্য এই ভাষাকে অনেক জায়গায় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে আজও আমাদের দেশে এই ধ্বনিকে সাংগীতিক ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। অবহেলিত থেকে গেছে। কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে অনেক আগেই শিসকে স্বীকৃত ভাষা হিসেবে সেই মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন একাডেমী বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে, যাতে শিশুরা প্রথম থেকেই এই ভাষা সম্পর্কে সম্যক জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে এই ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হতে পারে। একজন ভাল পারফর্মার বা শিল্পী হতে গেলেও এই ভাষা সম্পর্কে জানা উচিত এবং শিস ধ্বনির অনুশীলন করতে। গেলে অ্যাকাডেমিক দীক্ষা প্রয়োজন। যেমন আমেরিকান স্কুল অফ হুইসলিং খুবই স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে শিশু বয়স থেকেই হুইসলিং-এর ট্রেনিং দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বা কার্নিভাল বা উৎসবে কিংবা কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে হুইসলিং যেন বিনোদনের মাধ্যম। উৎসবে ও আনন্দে এক শাস্ত্রীয় আমেজ হয়ে ওঠে। শিস দিয়ে গান গাওয়া এক সুন্দর সাংগীতিক আর্টফর্ম। যার জন্য আলাদা স্কেল থাকে। সেই স্কেল অনুযায়ী শিস বাজানো হয়। কলকাতার এক বিশিষ্ট শিল্পী তরুণ গোস্বামী বলেন, শিস বাজানোর জন্য তাঁর সাজানো দাঁতকে বিভিন্ন স্কেল হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন। সেইসঙ্গে অর্কেস্ট্রা সহযোগে শিস দিয়ে গান করেন। বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় তিনি পারফর্ম করেছেন। তার নিজস্ব একটি ব্যান্ড আছে। শিস যেখানে প্রধান মাধ্যম। তবে তাঁর আক্ষেপ কলকাতা তথা এই বাংলায় কোনও কিংবদন্তি শিল্পীর জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলে, গায়ক গায়িকাদের ডাক পাঠানো হয়। কোনও Whislerকে গায়ক ভাবা হয় না।

তবে বাংলা চলচ্চিত্রে শিসের ব্যবহার নান্দনিক ভাবে করা হয়েছে বারবার। ‘ধন্যিমেয়ে’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, নচিকেতা ঘোষের সংগীত পরিচালনায় অনবদ্য জমজমাট বাংলা ছবি। শুধু গল্পের জন্য নয়, গানের জন্য ছবিটি যেন আমাদের মনের মণিকোঠায় আজও রয়ে গেছে। নায়িকা জয়া ভাদুড়ী দোলনায় দোল খেতে খেতে 'বউ কথা কও' পাখির সঙ্গে কথা বলছেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই গান, 'যা যা বেহায়া পাখি যা না, অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা, অন্য কোথা যা না'... গানটি গেয়েছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়।

গানটির সঙ্গে পাখি শিস দিয়ে কথা বলছে। শুধু কথা নয়, সুর অনুকরণ করছে শিস ধ্বনি দিয়ে। পাখির সঙ্গে নায়িকার মিষ্টি কথোপকথন বা আলাপচারিতা। এক অনবদ্য সৃষ্টি।

শুধু ধন্যিমেয়ে কেন, বাংলা হিন্দি মিলিয়ে অনেক ছবিতেই আমরা শিসের ব্যবহার দেখেছি। যেমন 'দ্বীপ জ্বেলে যাই'। সেই মনকাড়া গান, 'এই রাত তোমার আমার, এই চাঁদ তোমার আমার' সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য সুরে সুরারোপিত এই গানটির প্রথম লাইনটি শুরুই হচ্ছে শিস দিয়ে।

অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি 'ছদ্মবেশী'তে সুধীন দাশগুপ্তের অসাধারণ সুর 'আরো দূরে চলো যাই' গানটিতে শিসের যথার্থ ব্যবহার বাংলা গানকে আরও আধুনিক ও সমৃদ্ধ করেছে।

এবার হিন্দি ছবির কথায় আসি। মনে করে দেখুন, 'কটিপতঙ্গ' ছবিতে রাজেশ খান্নার লিপে কিশোর কুমারের কন্ঠে সেই মনমুগ্ধকর গান 'ইয়ে সাম মাস্তানি', এখানেও শিসের মনকাড়া প্রয়োগ গানটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

খুঁজলে আরও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। আমরা দেখি ঠিকই, কিন্তু অনেক ডিটেলিং হয়তো নজর কাড়ে না।

ছবির গল্প কীভাবে এগোচ্ছে সেই দিকে সাধারণত নজর থাকে এবং মিউজিক আকর্ষণীয় কি না আমাদের মন থাকে সে দিকে। কিন্তু শিস বা হুইসলিং গানটাকে কীভাবে জুড়েছে, কতটা উচ্ছতায় নিয়ে গেছে সেটা নিয়ে ততটা ভাবি কি? সংগীত পরিচালকদের মধ্যে অনেকেই ভেবেছেন। যেমন সত্যজিৎ রায়। তিনি সিনেমায় সংগীতের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। প্রসঙ্গান্তরে বলা যায়, 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিতে একটি বাচ্চার কণ্ঠে ভেসে এসেছিল পাহাড়ি সুর।

পাখিরা শিস দিয়ে গান গায়। অবশ্য সব পাখি গান গায় না। তারা কথাও বলে, তাদের স্বাভাবিক ভাষায়। যার নাম হচ্ছে শিস ধ্বনি।

তিন ধরনের ধ্বনি আছে। যেমন ১. ফিঙ্গার হুইসেল ২. টিউন হুইসেল ৩.সিঙ্গিং হুইসিল। যে পাখি গান গায় তাদের ধ্বনিকে সিঙ্গিং হুইসল বলা হয়, বা গান পাখিও বলতে পারেন। বউ কথা কও বা কোকিল বা কোকিল গোত্রীয় পাখি পরিবারের সদস্য এদের সচরাচর এশিয়া মহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা পূর্বাঞ্চল থেকে ইন্দোনেশিয়া, চিনের উত্তরাঞ্চল, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে দেখা যায়। বসন্তের কোকিলের ডাক শুনলে মনটা যেমন হুহু করে, আবার এক অনাবিল আনন্দে মেতেও ওঠে। কাকাতুয়া, ময়না, টিয়া, কাক কথা বলতে পারে। আসলে কথা বলে না, মানুষের কথার অনুকরণ করে মাত্র।

মানুষের স্বরতন্ত্রী বা স্বরযন্ত্রের মতো কোনও অঙ্গ পাখির নেই। সবচেয়ে ভাল ও সুন্দরভাবে কথা বলে কঙ্গো জাতীয় আফ্রিকান তোতাপাখি। ওরা আসলে গলা দিয়ে শব্দ করে এবং ওই শব্দতরঙ্গ এমনভাবে ওঠায় নামায়, যা মানুষের কথার মতোই শোনায়।

এ রকম শব্দ তৈরির জন্য শ্বাসনালীর শেষের দিকে যুক্ত সিরিনক্স ব্যবহার করে সিরিনক্স শ্বাসনালীর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্যঙ্গ। যেমন ময়না, শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহৃত শ্বাসনালী দিয়ে বাতাস বের করার সময় নালীর পেশিগুলিকে প্রয়োজন অনুযায়ী সংকুচিত ও প্রসারিত করে, মানুষের কথার মতো শব্দ সৃষ্টি করতে পারে।

সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া জাতীয় পাখি কথা বলার সময় বাতাসের শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য জিহ্বা ব্যবহার করে। ময়নার বিরল ক্ষমতা হল, অনেক সময় শব্দ যোগ করে সরল বাক্য গঠন করতে পারে এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি পাখিদের কথা বলা যারা বুঝতে পারে তারাই তো পাখিদের ভাষা বুঝতে পারে। পাখিদের কথা বা গান বুঝতে হলে ওই শিস ভাষাটিকে অনুধাবন করতে হবে। ওই ভাষায় কথা বলতে হবে। অর্থাৎ শিস দিয়ে গানও গাইতে হবে।

পাখিদের কথা অনুকরণ এবং অনুসরণ করতে পারে এ রকম মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। মুষ্টিমেয় যাঁরা আছেন তাঁদের এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে ক'জন জানতে পারেন!

একসময় পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা আনন্দ হইহুল্লোড় করার সময় শিস দিত বা অনেকে বলেন সিটি দিত। পরিবারেও দাদা, কাকা, মামা, খুড়তুতো ভাই, পিসতুতো দাদা শিস দিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করত বা মজা করত। তারপর এই নিয়ে আলাদা করে কেউ আর কখনও ভাবেনি। পেশা কখনও শিসের শিক্ষক হতে পারে? বরং উল্টোটাই দেখা গেছে। বেশি শিস দিলে বাবা-মা বা পাড়ার বড়রা মানে অভিভাবকেরা বকাবকি করতেন। কারণটা হল, কানে আরাম দিত না।

দেবে কী করে? গানও যদি শ্রুতিমধুর না হয় তা হলে কি শুনতে ভাল লাগে? ঠিক সে রকমই শিস যদি বেসুর হয় তা হলে সেটা কর্ণ বিদারক। যথার্থ শিসকে পাখির মতো সুরেলা হতে হবে।

শিস দেওয়ার একটা ধরন আছে। সেটাও শিখতে হয়। অনুশীলন করতে করতেই আপন বেগে সেটা সুরেলা নদী হয়ে ওঠে। শিস যে মিউজিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ হতে পারে এই ধারণাটা ছেলেবেলা থেকে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা থেকে এবং সংগীত সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে ও বিভিন্ন সংগীতজ্ঞ বা সংগীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি শিস ধ্বনি আসলে মিউজিক্যাল বা সাংগীতিক ভাষা।

শিস ধ্বনি এক প্রাচীন ভাষা। এখনও বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ভাষা বিলুপ্তপ্রায় হলেও বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। সরকারের তরফে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। যা খুবই উল্লেখযোগ্য। তবে আমাদের দেশে আজও এই ধ্বনিকে সাঙ্গীতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে অনেক আগেই স্বীকৃত ভাষা হিসেবে শিসকে সেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন আকাডেমি তৈরি করা হয়েছে। শিশুদের এই ভাষায় শিক্ষিত করার জন্য। আবার বেলজিয়ামে এমন একটি খেলা আছে, যেখানে একদিকে পাখিরা থাকে অন্যদিকে হুইসলাররা। একদিক থেকে পাখিরা শিস দেয়। আর সেটি শুনে হুইসালররা বাজায়। যিনি প্রকৃত সুর যথোপযুক্ত অনুসরণ করতে পারেন, তিনি পুরস্কার পান। চমৎকার এই খেলাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সেখানে।

চলমান সংগীতের ধারায় শিস ধ্বনিও জায়গা করে নিয়েছে স্বমহিমায়। এই শিস ধ্বনি স্বতন্ত্র সুরের মর্যাদা পাক সেটাই আমাদের আশা। বিশ্ব সংগীতের ইতিহাসে এই হারিয়ে যাওয়া ভাষাকে বিশেষ স্থান দেওয়া হোক। প্রশাসনের কাছেই এটাই আর্জি, একজন সাংগীতিক মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে।

ভারতীয় সরকার বা আমাদের বাংলার সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিক এই সংগীতকে। এবং যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা শিস ধ্বনি দিয়ে সুর তুলতে পারে, সুরের ঝড় তুলতে পারে, তারাও যেন মঞ্চে নিজেদের জায়গা নিতে পারে। তাদেরও দেওয়া হোক একজন স্বতন্ত্র শিল্পীর মর্যাদা। তাদের এই মিউজিক্যাল সাঙ্গীতিক ধ্বনি যেন নিজেই অর্কেস্ট্রা হয়ে উঠতে পারে। এই আশাতেই বুক বাঁধি আমরা।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন