কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

ছেঁড়া শেকড়ের অন্তরাখ্যান

 


(৬)

বুকের ভিতর আমি আগলে রাখি ভাঙা বুক

রমলা ফিরে যাওয়ার ক-দিন আগে তারাসুন্দরীর শরীর বেশ খারাপ করেছিল। মাথাঘোরা, বমিভাব, পেট গণ্ডগোল। একটামাত্র পায়খানা-ঘর। বাঁশের কাঠামো, বাঁশের পাদানি, অনেক নীচে কুয়ো খোঁড়া। উঠোন থেকে টিউবওয়েল পাম্প করে বালতি ভরে নিয়ে যেতে হয়। তাদের উঠোনে টিউবওয়েল আছে। রমলা আসার আগে তড়িঘড়ি চানঘরের দেওয়াল ইটের হল। মাথায় তেরপল সরিয়ে বসল টিন। জল পড়ে-পড়ে বাথরুম পেছল সারাক্ষণ। প্রস্রাবের দাগে হলুদ হয়ে-থাকা নর্দমা দিয়ে ঋতুস্রাবের রক্তও বেরিয়ে গিয়ে বাইরে খোলা জমিতে পড়ে। তারাসুন্দরী পা পিছলে পড়েছিলেন না, মাথা ঘুরে গিয়েছিল বলতে পারেন নি। ভাগ্য ভালো যে হাড়গোড় অটুট আছে। রমলা মা-কে ছুটি দিয়ে সংসারের দায়িত্ব নিল। মুখের সামনে মুড়ি-জল এনে ধরল। জল-দেওয়া ভাতে লেবুপাতা চটকে খাওয়াল। তারাসুন্দরী বিশ্রাম পেলেন।

তাদের সরু গলিটা থেকে বেরিয়ে যে রাস্তা, সে রাস্তা পেরোলে বড়ো গাড়ির রাস্তা। সারাদিনে খানকতক বাস আসা-যাওয়া করে। ওদিকে বাজারে ওষুধের দোকানে একজন অ্যালোপ্যাথ বসেন। রোগা, জিরজিরে চেহারা। তাঁর কাছে প্রেশার-মাপা যন্ত্র আছে। নিরু গিয়ে বাড়তি ভিজিট দিয়ে ডেকে আনল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন রোগিনীর ব্লাড-প্রেশার বেশ কম। বিশেষ পথ্যের নির্দেশ দিয়ে গেলেন। রমলা নীরবে ভাবছিল, ইনি নিজে কি ওসব খাবার পান? অমলা এই ক-দিন ছোড়দিদির সঙ্গ ছাড়েনি। ছোড়দিদি বয়সে অনেক বড়ো। ছোটোবেলায় বড়দিদি, ছোড়দিদিকে মা-র কাছাকাছি মনে হত। ভয় পেত, খুব একটা কাছে ঘেঁষত না। এখন ছোড়দিদি অন্যরকম। তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। কেমন জামাই পছন্দ হবে জানতে চেয়েছে। মনে মনে কাউকে পছন্দ করে কি না তাও জিজ্ঞেস করেছে। অমলা শুধু হেসেছে। মা ছাড়া কারও সঙ্গে বেশী কথা বলতে পারে না। রাতের রান্না বসিয়েছিল রমলা। অমলা অবাক হয়ে দেখছিল খুঁতো একহাতে অসাধারণ নিপুণতায় সামলাচ্ছে ছোড়দিদি। সে মা-র বকুনি সত্বেও বিশেষ কিছু শেখেনি। কাজ করতে একেবারে ভালো লাগে না। সারাদিন গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে পারলে খুশী হয়। আবছা মনে হল কোথায় যেন পড়েছে, মানুষ ইচ্ছে করলে সব পারে। সে রুটি বেলে দিচ্ছিল। রমলা বলল,

এইত্ত বেশ গোল হচ্ছে অমু। শ্বশুরবাড়িতে সুখ্যাত করবে। জামাই সোহাগ করবে।

অমলা লজ্জা পেল। তারপর সাহস করে জিজ্ঞেস করল,

দাদাবাবু তোমারে খুব ভালো, মানে ইসে, খাতির-যত্ন করে, না ছোড়দিদি?”

রমলা বোনের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। উনুনে গরম তাওয়া। চিমটে দিয়ে রুটি উলটে দিল। গনগনে আঁচে মুখ লাল। অদূরে কুপি জ্বলছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক। বাড়ির ভেতর থেকে ধুনোর গন্ধ আসছে উঠোন পেরিয়ে। তারাসুন্দরী ঘরে-ঘরে ধুনো দিচ্ছেন। ধীরেন্দ্রনাথ হয়ত নাতিকে নিয়ে খাটে শুয়ে আছেন। নিরঞ্জনের ফিরতে রাত হয়। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল রমলা। অমলার ভয়-ভয় করছিল, ছোড়দিদি নির্ঘাৎ রেগে গেছে! ছোটো মুখে বড়ো কথা বলা উচিত হয়নি। রমলা রুটি সেঁকতে সেঁকতে নীচু গলায় বলল,

দিদির মৃত্যু মনে পড়ে তোর? তুই আর নিরু কত ছোটো ছিলি।

অমলা মাথা নাড়ল, মনে আছে। এমন কিছু ছোটো ছিল না সে। রমলা যেন নিজেকে বলতে লাগল,

জুনমাসের শেষে মা আর বাবা কলকাতায় আসল। জুলাইমাসের সাতাশ তারিখ দিদির ছেলে হয়েছে বলে বাবা তার পাঠাল। অগস্টমাসের পয়লাতে মধু গিয়ে উপস্থিত। বলল, ছোড়দিদি, বাবা তোমাদের নিয়ে যেতে কইছে। তেসরা আমরা চারজন কলকাতায় আসলাম। মনু গেল হোসটেলে। মনে আছে?”

অমলা চুপ করে রইল। ছোড়দিদির মুখের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। নাকের পাশ বেয়ে হীরের কুচির মতো চোখের জল নামছে। ধীরেন্দ্রনাথ মধুসূদনের হাতে রমলাকে চিঠি দিয়েছিলেন।

স্নেহের রমু,

পত্রপাঠ মধুর সহিত সত্বর আসিবা। মনুর ক্লাস আরম্ভ হলে সে হয়ত এখন আসিতে পারবে না। তোমাদের দিদি তোমাদিগকে দেখিতে চাইতেছে।

ইতি আং তোমাদের বাবা।

পুনঃ – তুমি এখন সকলের বড়। ভাইবোনেদের দায়িত্ব তোমার উপর অর্পণ করিলাম। চিন্তা করিয়া কাজ করিও।

কলকাতায় তাদের প্রথম আসা। এর আগে কমলার বিয়ের সময়ে ধীরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের সঙ্গে বড়ো দুই ছেলে এসেছিল। অমলা ও নিরঞ্জন তখন প্রায় শিশু। তারাসুন্দরী তিন সন্তান আগলে বাড়িতে থেকে গেলেন। কমলার শ্বশুরঘর দেখতে যেতে পারেন নি। এবার ছোটো ভাইবোনকে আগলাতে আগলাতে মধু আর রমু এসে পৌঁছল। শহরের ভীড়, গাড়ি, ধুলো, ধোঁয়ায় ধাঁধাঁ লেগে যায়। মাঝে-মাঝে লালমুখো গোরা পুলিশ। মুরারীর ভাড়ার বাসাতে দু-খানা মোটে ঘর। একখানায় মুরারী থাকে, অন্যটাতে ধীরেন্দ্রনাথ ও তারাসুন্দরী। রমলাকে দেখে তারাসুন্দরী ডুকরে উঠেছিলেন,

নাতির মরামুখ ক্যান দ্যাখলাম রমু? কী পাপ করছিলাম?”

কী কও মা? কী কও? বাবায় ত পত্তরে লিখে নাই!”

আঁতকে উঠেছিল রমলা। দিদি তার প্রাণ, তার সন্তান ধারণের খবরে সে যে কতখানি নিশ্চিন্ত হয়েছিল কাকে বোঝাবে! তার বিবাহের সম্ভাবনা হয়ত নেই, মেনে নিয়েছিল সে। দিদির সন্তান দেখার আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল মনের মধ্যে। তারাসুন্দরীর আর্তনাদ তাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছিল। তখন দেখল মুরারীকে। উসকো-খুসকো, অবিন্যস্ত, হাসপাতাল থেকে ফিরল। রমলা পথ আটকে জানতে চেয়েছিল,

মুরারীদাদা? এইগুলা কেমন আজাইরা কথা কয় মা?”

বিকালে ভিজিটিং আওয়ার। তখন নিয়ে যাব। তোর দিদিকে বলিস না তার খোকা বেঁচে নেই।

রমলা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধেবেলা গিয়েছিল কমলাকে দেখতে। আচ্ছন্নের মতো বেডে শুয়ে, চোখ বন্ধ। চেহারা দেখে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, দিদিও কি তবে? রমলা কান্না চেপে পাশে বসে ডেকেছিল। তাকে দেখে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কমলা,

আমাকে নিয়ে চল রমু। এরা আমার খোকাকে দেয়না আমার কাছে। বলে সেরে উঠলে দেবে। আর সে আমাকে ঘরে নেওয়ার নামও করে না। আমি ঘরে যাব রমু।

কমলার চোখের জল পড়ে বালিশ ভেজে। রমলা শক্ত করে ধরল তার হাত। চোখ খুঁজছিল মুরারীকে। দরজার গায়ে মিশে সে দাঁড়িয়ে আছে। কমলার হাত নামিয়ে রেখে মুরারীর মুখোমুখি দাঁড়াল,

বাচ্চার কী হইছিল মুরারীদাদা?”

আম্বেলিক্যাল কর্ড মানে মা-র নাড়ি গলাতে পেঁচিয়ে গিয়েছিল। আরও ছিল কিছু। তুই বুঝবি না।

কমলা বাঁচল না। ত্রিশ পূর্ণ হওয়ার দু-বছর আগেই আলো নিভে গেল। নানান জটিলতায় সেপটেসেমিয়া হয়েছিল শরীরের অভ্যন্তরে। বাড়ি আসতে চেয়েছিল বারবার, আনা যায়নি। শেষ ক-দিন ধূম জ্বর, প্রবল শীতভাব, বমি। শেষবারের মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে রমলাকে অস্ফুটে বলেছিল,

খোকাকে আমার কোলে দিবি না রমু?”

প্রবল অশান্ত সেই সময়। সমস্ত কিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কোন অদৃশ্য ধুনুরি যেন দেশ জুড়ে প্রচণ্ড শব্দে ধুনে চলেছে মানুষের ভাগ্য। বছরের প্রথমভাগে বিদেশী শাসকের বিশিষ্ট দল এসে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করে গেছে। তারপর থেকেই ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে দর কষাকষি শুরু হয়েছে তাবড়-তাবড় দেশীয় রাজনীতিক নেতাদের। পত্র-পত্রিকার সমস্ত খবরে সাধারণ মানুষ সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে গড়াবে, বোঝা যায় না। কোন খড়্গের আঘাত আসতে চলেছে ধারণা নেই। ঠিক একবছর আগে ঘটে-যাওয়া প্লেন দুর্ঘটনার নেতাজীর মৃত্যুর খবর হজম করতে পারেনি বাঙালি। আশায় আছে তিনি ফিরে এলে উজ্জ্বল দিন আসবে, সোনা ফলবে, শান্তি ফিরবে।

এসব বুঝত না অমলা আর নিরঞ্জন। শোকের পরিবেশেও দু-টিতে যেন আলাদা। অচেনা শহরে ভালো লাগছিল না তাদের। বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই, মাঠ নেই, পুকুর নেই এমন কী খোলা উঠোন নেই। ইশকুলের সঙ্গীদের জন্য মন কেমন করে। বছর দশ-এগারোর নিরঞ্জন একা বেরোতে চেয়ে প্রচণ্ড ধমক খেল ধীরেন্দ্রনাথের কাছে। অমলা চুপিচুপি রমলাকে জিজ্ঞেস করেছিল,

ছোড়দিদি, বাড়িত যামু না?”

রমলা জবাব দেয়নি। বদলে তার বড়ো চোখের কড়া দৃষ্টিতে অমলা ভয় পেয়েছিল।

কমলার মৃত্যুর দুদিন পর দেশ জুড়ে সশব্দ আগুন জ্বলল। আগুনের ধোঁয়া যে কত দূষিত হতে পারে আগে কেউ কল্পনা করেনি। ধর্মে-ধর্মে ভেদাভেদ আবহমান কালের। বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতো ফুলকি উঠেছে, আবার ঠাণ্ডাও হয়ে গেছে। এভাবেই যুগ-যুগ ধরে পাশাপাশি কেটেছে। কিন্তু এবারকার বীভৎস চেহারা মানুষের বুকের খাঁচা নাড়িয়ে দিল। ধর্মের জিকির তুলে মানুষ অন্ধের মতো যেভাবে রক্তাক্ত হত্যালীলায় মেতেছিল, তা আগে ঘটেনি। এবং সেই শুরু।

কমলার সৎকার মিটিয়ে মধুসূদন ফিরল মেসবাড়িতে। সে এবং বাকি যে ক-জন বোর্ডার তখনও সেখানে ছিল, ছাদে গিয়ে লুকিয়ে বসেছিল। হাতিয়ার বলে তেমন কিছু নেই। ভাঙা কার্নিশ থেকে খুলে-নেওয়া খানকতক ইট, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা ঢিল, দু-চারটে বাড়তি লাঠি, রান্নাঘরের বঁটি, কাটারি সম্বল। বাইরে বেরোনো বন্ধ। কে জানে কখন বিপদ আসে।

কমলার শ্রাদ্ধশান্তির নিয়ম শাস্ত্রে নেই। গোত্রান্তরিত কন্যার মৃত্যুতে পিতার পরিবারে অশৌচ লাগে না। স্বামীও মুক্ত, করণীয় বিধি কিছু নেই। কমলার খবর দিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে টেলিগ্রাম করেছে মধুসূদন। কবে পৌঁছাবে কেউ জানেনা। কমলার শাশুড়ি নেই। সংসারের দায়িত্ব বিধবা পিসি-শাশুড়ি সামলান। মুরারীর ঠাকুরদাদা জীবিত। পরপর চারবোনের তিনটি বিবাহিত, সবার ছোটো এক ভাই।

দু-তিনদিন পর মধুসূদন লুকিয়ে খুব সন্তর্পনে দেখা করতে এল। চিন্তাচ্ছন্ন করুণ মুখ, পরণে আধময়লা চেক-লুঙ্গি, ময়লা ফতুয়া। সঙ্গে কামরান নামে এক যুবক, প্রায় মধুসূদনের বয়সী। দেখে আঁতকে উঠেছিলেন তারাসুন্দরী। ছোটো দুই ছেলেমেয়েকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে সভয়ে বলেছিলেন,

আমরা কিছু করি নাই বাবা, আমগ মাইর না।

মধুসূদন তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল,

মা, হে আমার বন্ধু। আমারে লইয়া আইছে, য্যান কুনও বিপদ না ধরে।

কামরান মাথা নীচু করেছিল। অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে গভীর গলায় বলেছিল,

মাসিমা, ভয় পাবেন না। সবাই একরকম না। আপনি আমার আম্মার মতো। আম্মাকে অনেকদিন দেখিনি।

তাইন কই থাহে?”

মালদা জেলায়, গ্রামের বাড়িতে।

এইহানে মানুষ নাকি মাইনষেরে কাইড্যা ফালায় শুনতাছি, হেইডা কি সইত্য কথা?”

কামরান কথা বলতে পারল না। তারাসুন্দরীর সামনে হাঁটু গেড়ে পা ছুঁয়ে কদমবোশী করল। তারাসুন্দরী গলে গেলেন। তখন মনে হল বাড়িতে অতিথি, শুধু-মুখে বিদায় দিলে ঘোর অমঙ্গল। এমনিতেই দুঃখের চাদর আষ্টেপৃষ্ঠে তাঁদের জড়িয়ে রেখেছে। মা-সুলভ উদ্বেগে বললেন,

খিদা লাগে নাই? কী দিমু বাবা? কিছুই নাই। ফ্যানাভাত রানছি, ঘী দিয়া দুগগা খাইয়া যাও।

মধুসূদন খেয়ে নিল। কামরান ভাত খেল না। টিনের কৌটোয় তলানি পড়ে-থাকা দু-খানা তিলের নাড়ু মুখে দিয়ে মধুসূদনকে টেনে নিয়ে অন্ধকারে পেছনের পথ ধরে বেরিয়ে গেল। বাড়ির অবস্থা দেখে মধুসূদনের গলায় তখন কান্না জমেছে। কতই বা বয়স তার? তার ছোড়দিদি একবার পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আবার ঢুকে গিয়েছিল। তারাসুন্দরীর কাছে শুনল, মুরারী নাকি ক-দিন ধরে জ্বরে বেঁহুশ। ওষুধ নেই, পথ্যি নেই। রমলা জলপটি আর পাখার বাতাস দিয়ে নিরলস সেবা করে চলেছে। অন্ধকার পথে মধুসূদনের রুদ্ধস্বর ফুঁপিয়ে-ওঠা টের পেল কামরান। তার হাত চেপে ধরে শান্তভাবে বলল,

মনে সাহস রাখ ভাই। ভেঙে পড়লে চলবে না।

দুপদুপাইয়া হাটে নারী চখ পাকাইয়া চায়

লকখী বলে সেইও নারী পতি ধইরা খায়।

রাইন্দা-বাইরা যে বা নারী পতির আগে খায়

ভর না কলসের জল গ, তরাসে শুকায়।

ছান করিয়া যে বা নারী দেয় গ মুহে পান

লকখী বলে সেইয়ো নারী আমারও সমান।

তারাসুন্দরী সুর করে গাইছিলেন একদিন। তাঁর স্মৃতি বেশ প্রখর। দেশের বাড়িতে নাকি এই গান গেয়ে ভিক্ষে নিতে আসত। রমলা আর অমলা মিলে খুব হাসে। তারাসুন্দরী বললেন,

হের লাখান অইলে সংসারে লকখী বাস করে। অমুর কাম করনের মনও নাই, দিশাও নাই। খালি চোপা! বিয়াতী মাইয়া, রমু বুঝা দেহি অরে।

রমলা বোনকে জড়িয়ে ধরে,

এত চিন্তা কর কেন মা? এমন সুন্দর লক্ষ্মীমন্ত বোন আমাদের, ছেলের বাড়ি মাথায় করে রাখবে। কাজ করতে লাগবে না।

! তর যা কথা। মাইয়া জন্ম যখন অইছে, সারাজীবন মাথা নীচু রাইখ। হেইডাই নিয়ম।

দেখে-শুনে ভাল ঘর দিয়ো মা, আদরে থাকবে।

তারাসুন্দরী কী বলতে গিয়ে রমলার দিকে চেয়ে চুপ হয়ে গেলেন। হ্যারিকেনের আলোতে মশারির ভেতর ঘুমন্ত নাতির মুখখানা দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ। তার ঠাকুর্দা নাম রেখেছেন সন্দীপন। তারাসুন্দরী পা টেনে-টেনে নিজের ঘরে চলে গেলেন। রমলা দেখল। বলল,

হ্যারে শোন, শোবার আগে মা-র পায়ে রোজ রসুনতেল মালিশ দিবি। বাতে কিরম কষ্ট পায় দেখিস না?”

মা খালি আমারে বকে ছোড়দিদি।

অমলা রমলার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। রমলা ছোটোবোনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বোঝে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা। অন্ধকার নির্জনতায় রমলা ক্রমশঃ বড়ো হতে থাকে। নিজের বয়সের তুলনায় অনেক বেশী বড়ো। ভাইবোনদের চেয়ে, মা-র চেয়ে, এমনকী বাবার চেয়েও অনেক বড়ো। যেন বিরাট দু-টি ডানামেলা আশ্চর্য প্রাণী। একপাশে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে অমলা। অন্যপাশে বুকের কাছে খোকন। বিছানায় শুয়ে সে এপাশ-ওপাশ করে। পুরোনো দিন মনে পড়লে শরীরে অস্বস্তি হয়। ইদানিং প্রায়ই ভাবে, আসলে কার সন্তান খোকন? তার না দিদির? মনের কাছে উত্তর খোঁজে।

মুরারীর প্রবল জ্বর ঘুরপথ নিচ্ছিল। অজানা শহরে সহায়-সম্বল নেই, ডাক্তার ডাকার পরিস্থিতিও না। মুরারীর বাবার কাছ থেকে টেলিগ্রামের জবাব না আসায় অসহায় হয়ে পড়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। সে সময়ে রমলা প্রাণপাত সেবা না করলে বুঝি মুরারী ভালো হত না। একদিন অল্পরাতে জ্বর কিছুটা নেমেছে, মুরারী চোখ মেলল। টিমটিম-করা ইলেকট্রিক বাল্বের হলদে আলোতে ঘর জুড়ে অসুস্থ বিমর্ষতা। তক্তপোশের পাশে মেজেতে দুধ-সাবুর বাটি, হাতপাখা, জলপটির সরঞ্জাম। সেখানে বসে ক্লান্তিতে রমলার চোখ বুজে আসছিল। হঠাৎ বাহুতে উষ্ণ হাতের চাপে সে চোখ খুলল। অবাক হয়ে কিছু বলতে যেতেই মুরারীর প্রসারিত হাত তার স্তন খামচে ধরল। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল। মুরারী কঠোর গলায় নির্দেশ দিল,

উঠে আয়!”

তার অস্ফুট আর্তনাদ মুরারী গ্রাহ্য করল না। সাময়িক অসুস্থ হলেও দেহ বলিষ্ঠ। দু-হাত বাড়িয়ে রমলাকে বিছানায় টেনে নিল। রমলা বাধা দেওয়ার জোর পাচ্ছিল না। মুরারী স্থান-কাল-পাত্র তোয়াক্কা না করে নিজের ঘাম-জবজবে শরীরের নীচে প্রবল রিরংসায় দলিত করতে লাগল ভরন্ত যুবতী শরীর। বলতে লাগল,

রমু আমার খোকাকে ফিরিয়ে এনে দে।

অবশ্য কয়েক মিনিটেই হাঁপিয়ে গিয়ে রমলাকে ছেড়ে সে অবসন্নের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। রমলা চটকানো শাড়ি-জামাতে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। অনাঘ্রাত শরীরে জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শ, যদিও চরম কিছু ঘটেনি। দেহ অদ্ভুতরকম ঝিমঝিম করছিল। ভাবল কাপড় ছেড়ে দু-মগ জল ঢেলে এলে হয়ত স্বাভাবিক লাগবে। দেখে দরজার কাছে তারাসুন্দরী। সকলের খাওয়ার শেষে মা-মেয়েতে খাবেন বলে তাকে ডাকতে এসেছেন। রমলা মাথা নীচু করে বলতে গেল, ‘আমার দোষ আছিল না মা।

সে মুখ খোলার আগেই তারাসুন্দরী চুপিচুপি শুধু বললেন,

কাউরে কওন নাই।

মা! কারে কমু এমন কথা?”

তারাসুন্দরী জেনে-শুনে নীরব রইলেন। মনের ভাবনা চালিত হচ্ছিল অন্যপথে। ধীরেন্দ্রনাথকে বলতে সাহসে কুলাল না। সঙ্কোচ কাটিয়ে জামাতাকেও জিজ্ঞেস করতে পারলেন না, ‘আমার রমুরে তুমি নিবা?’ একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য তীব্র প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুরারীর বিকার কাটল। ক্রমে সে অপেক্ষাকৃত সুস্থ। রমলা আগের মতোই মুরারীর ঘরে যায়, তারাসুন্দরী বাধা দেন না। একদিন অসুস্থ অবস্থার মতো অজ্ঞানে নয়, সচেতনে রমলাকে বিছানায় চাইল মুরারী। আদেশ করল,

দোর বন্ধ করে আয় যা।

রমলা নীরবে আদেশ পালন করল। ভ্যাপসা ভাদ্রে তার নগ্ন কুমারীদেহ জলকন্যার, ফোঁটা-ফোঁটা নোনতা ঘাম। অভিজ্ঞ পুরুষের আশ্লেষের লজ্জা, যন্ত্রণা ও অপরাধবোধ তার বুক তোলপাড় করে দিল। পরপর ক-দিন ঘটল এমন ঘটনা। তবে মুরারী সতর্ক ছিল। গর্ভাধান করে রমলার কুমারিত্ব নষ্ট করা তার উদ্দেশ্য নয়। রমলাকে সে আন্তরিক স্নেহ করে। এর মধ্যে মুরারীর বাবার চিঠি এসে পড়ল। তিনি ছেলেকে নিয়ে যেতে আসছেন। তিনি আসার আগের রাতে মুরারী রমলাকে বলল,

কাল আমি বাবা এবং শ্বশুরমশাই দু-জনার সামনে বিয়ের প্রস্তাব রাখব। বুঝলি? তৈরি থাকিস।

মুরারীর মুখের দিকে না তাকিয়ে রমলা বলেছিল,

তালুইমশাইরে কইয়েন আপনের লগে অন্যখানে সম্মন্দ আনতে।

কথা শুনে চমকে উঠেছিল মুরারী। রমলাকে সিধেসাদা, ব্যক্তিত্বহীন ভেবেছিল। স্বপ্নেও ভাবেনি, এই মেয়ে এভাবে ফিরিয়ে দেবে তাকে। দমিতস্বরে জিজ্ঞেস করল,

তোর মত নেই?”

না নাই।

কেন নেই?”

আপনে আমার দিদির জামাই, দাদা বইল্যাই আপনেরে জানছি। আমি পঙ্গু অবিয়াতী মাইয়া। বিয়া না অইলেও দুক্ষু নাই। আপনে অসুক-শরীরে আমার সেবা চাইছেন। সেবা দিছি। হের লাইগ্যা দাবী লইয়া নিজেরে অপমান দিমু? আর দিদি যে আমার কী আছিল আপনেরে ক্যামনে বুঝাই! তাইর সংসারে গিয়া দখলদারি, হেইডা কি হয়? আপনে ত অনেক ল্যাখাপড়া করেন, বুঝাইয়া কন আমারে।

অঝোরে কাঁদছিল রমলা। মা-বাবার মুখ চেয়ে যে কান্না বরফ-কঠিন করে রেখেছিল, সমস্ত ঝরিয়ে দিল মুরারীর সামনে। মুরারীও কেঁদেছিল সেদিন। করুণভাবে বলেছিল,

আপত্তি করিস না রমু। এই বিয়ে হলে তোর দিদিও সুখী হবে দেখিস।

লাখ-কথা হওয়ার আগে বিয়ে স্থির হয়ে গেল দুই পরিবারের কর্তার সম্মতিতে। তারাসুন্দরী নিশ্চিন্ত। রমলার হয়ে কথা বলার কেউ ছিল না। লজ্জা সরিয়ে রেখে নিজেই ধীরেন্দ্রনাথের কাছে গেল,

বাবা,”

কিছু কবা? বিয়া লইয়া কইও না মা। একবার ছ্যাপ ফালাই দিছি, ফিরান যায় না। অইন্য কথা থাইকলে কও।

অঘ্রাণ মাসের প্রথম শুভদিনে মুরারীর বউ হয়ে শান্তিপুরে গেল রমলা। ততদিনে দেশজোড়া অশান্তি সহস্রধারায় প্রবাহিত।

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে চিত হয়ে শুল রমলা। সাতবছরের বেশী সময় পেরিয়ে গেলেও অতীত দিনক্ষণ ভুলতে পারেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত অমলার দিকে তাকাল। সরল, মায়াবী মুখ। ফিসফিস করে অশ্রুতভাবে বলল,

সেদিন জানতে চেয়েছিলি না তোদের দাদাবাবু আমাকে ভালোবাসে কিনা? বাসে, যখন দিদিকে খোঁজে। কিন্তু সে অসৎ মানুষ না।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন