বর্ণমালার সাতকাহন
(পর্ব ২৮)
শ্যামল মামাকে মনে আছে। একটু বেঁটে। খুব ভালো মানুষ হিসেবেই সুনাম ঘরে-বাইরে। ব্যাংকে কাজ করতেন। ওঁর মা আমার দিদিমার সই ছিলেন জ্ঞাতি সম্পর্ক। দিদিমা, মামমামের বাড়ির গায়ে গায়ে তাঁদের বাড়ি। লাল রক। বাঁধানো গলি। মামমাম বলতেন, কলকাতায় আসার পরে তাঁরা এই গলিতেই দাগ কেটে কিৎ কিৎ খেলতেন। সেই গলিতে আমরাও কুমিরডাঙা খেলতাম, যেহেতু অধিকাংশ সময় বালিগঞ্জে মামমামদের ওখানেই থাকতুম। যখন দশ বারো বয়স বিশেষ জ্ঞান জ্ঞম্যি নেই, সকাল থেকেই ওবাড়িতে এঘর ওঘর করি। লতিকা দিদা নয় দি, লতিকাদি শিশুকাল থেকে মামমামের বোল শুনে সেই বোল থেকে গেছিল। বয়স আট_দশ হবে, এই সময় প্রায়ই ফাঁকা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার আধফোঁটা ফুলের কুঁড়ি নিষ্পেষণ করতেন। সেই বয়সে আমরা ব্রা পরতাম না। মামী খুবই সুন্দরী দীর্ঘকায়া সুগৃহিনী। পরে দেখেছি পুরুষের ভেতর এক অদ্ভুত পারভার্সন থেকেই যায় বাহ্যত তার কোনো হেতু ছাড়াই। যাইহোক, ভয়ে কাউকেই সে কথা বলতে পারিনি অনেকদিন। কিন্তু যতই ডানপিটে হই, আসলে তো মেয়েমানুষ, পেটে কথা চেপে রাখতে পারি না। একদিন মা’কে বলেই ফেললাম। একটু মুখটা থমথমে হলো, খানিক চুপ করে থাকলেন। নিজস্ব জন্মগত ইন্সটিংক্টেই একটু দূরে থাকতাম, একা কখনও নয়। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে, তাও দু বছর। ওই বালিগঞ্জ পাড়াতেই। সেবার পয়লা বৈশাখে খুব হৈচৈ। মামা তখনও পঞ্চাশ নয়। দুটো ছোটো ছেলে। শিলিগুড়ি ব্রাঞ্চে বদলি, তাই আসেন উৎসব অনুষ্ঠানে কলকাতা। রাতের ট্রেনে শ্যামলমামাও ফিরে যাবে। দুবাড়ির খাওয়া দাওয়া নমস্কার প্রণাম সেরে বাড়ি ফিরলাম। সকালে লতিকাদির বাড়িতে এন জে পি থেকে ফোন এলো রেল পুলিশের। ট্রেনের আপার বাংকে পড়ে আছে মৃতদেহ। ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যাটাক, ঘুমের মধ্যেই শেষ। জীবনে যে মৃত্যু মিছিল দেখেছি, এই মৃত্যু ছিল অভূতপূর্ব। আছে থেকে নেই হয়ে যাওয়া কী সামান্য! লতিকাদি সেই সময়কার বিজ্ঞানের ছাত্রী গণিতে স্নাতক। আমার প্রাথমিক অঙ্কশেখা তাঁর কাছে।
গভীর রাতে জানলা খুলে বসে থাকতেন।
জিজ্ঞেস করলে বলতেন, "যদি শ্যামল আসে, শুনেছিলুম অনেকসময় দেখা দেয়!” লতিকাদি
বিরানব্বই বছর বয়সে সজ্ঞানে অসুখহীন শরীরে মারা যান, দুই নাতি নাতবউ ও পুত্রবধু সহ
বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে। জীবন এক আশ্চর্য দূরবীন।
তারপর দিন যায় মাস যায়, প্রকৃত মানুষ ছাড়িয়ে তার ছায়া বড় হয়ে ওঠে। শিক্ষা, সংযম, পরিশীলিত আচরণের পরত পড়ে। স্বাধীনতা দিবসের হুল্লোর দেখে নষ্টামি মনে হয়। কতটুকু স্বাধীন আমরা? এখনও কোনও মেয়ে নিরাপদ নয় দিনে অথবা রাতে। শ্বাপদ সংকুল জঙ্গলে সবাই ওঁৎ পেতে আছে খাবলে খাওয়ার জন্য নারীমাংস। দম বন্ধ হয়ে মারা গেল ত্রিশটি নবজাতক, লেখাপড়া শিখে জমাদারের কাজ করছে তরুণ ছেলেরা, দেশের সন্তানরা একটু ভালো থাকার জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে... আমাদের যাপনের স্বাধীনতা ক্রমশ খর্ব হচ্ছে। কুসংস্কার ধর্মান্ধতা আর মিথ্যাচর্চা এখন দেশময়। এই সবের দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের। যৌন বিকৃতি নারী পুরুষ দুজনের মধ্যেই বৃদ্ধি পাচ্ছে মুক্ত পথেঘাটে, মনুষ্যতর জীবের মতো। মনে হয় এইসব বিকৃতি ও অবদমিত যৌনখিদে যাতে সমাজ কলুষিত না করে, সেজন্যই প্রাচীন যুগে কিশোর থেকে যুবক হওয়ার বয়ঃসন্ধিতে বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো ছেলেদের। তবে এ তো নিরুপায় হাতুড়ে চিকিৎসামাত্র! আজও কজন নারী তার নিজস্ব ইচ্ছার ভঙ্গীতে সঙ্গম করতে পারে? যেভাবে স্বামী চায় সেভাবেই। যেদিন স্বামী চায় সেদিন। এমনকি নিজের শখের খাবার শুধু নিজের জন্যই বা পারে কজন নারী! ডিভোর্স কোনও সমাধান নয়। এতো ময়দান ছেড়ে পালানো। নারীও বদলা নেয় এর। দিনগত যাপনে। ওয়েব সিরিজ চলতে থাকে, স্বাধীন হতে পারি না। আমি কি পরব আমি কী বলব আমি কী ধর্মাচারণ করব তা আমি নয় রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়! "Man is born free but everywhere he is in chains"(জঁ জ্যক রুশো)।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন