লুচি-পুরাণ
'লুচি' শব্দটা শুনলেই ধুতি পাঞ্জাবী
পরিহিত বাঙালিবাবু, সামনে লুচির থালা... এই দৃশ্য আজও ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
বিশ্বমানের সব খাবারই এখন বাঙালির
চৌকাঠে। তবুও ভোজনরসিক অনেক বাঙালি পরিবারে এখনও রবিবারের সকাল মানেই ধবধবে সাদা ফুলকো
লুচি আর কালোজিরে দেওয়া আলু-চচ্চরি। এর সাথে আর কোন কিছুর তুলনা চলে না! লুচি বা নুচি
বাংলার একটি খুবই উল্লেখযোগ্য ঘরোয়া খাবার। 'বাঙালির খাদ্যকোষ' রচয়িতা মিলন দত্তের
মতে, লুচি হল বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় নোনতা খাবার। সাদা ময়দাতে ঘি-এর ময়ান ও অল্প
নুন মিশিয়ে জল দিয়ে মণ্ড করে তার থেকে লেচি কেটে গোল আকৃতি করে বেলে ঘিয়ে ডুবিয়ে
ভেজে তুলে লুচি পাওয়া যায়।
লুচি বাঙালির অন্যতম একটি প্রিয়
খাবার হলেও লুচি বাংলা শব্দ নয়। এমনকি সংস্কৃতেও এই পদের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
এটি একটি হিন্দিশব্দ। হিন্দিতে হাত থেকে পিছলে যাওয়াকে লুচ বলে। হাতে লুচি নিলে ময়ানের
জন্য পিছলে যায়। তাই লুচ থেকে লুচি এসেছে মনে করা হয়। আর একটি মতে, সংস্কৃত শব্দ
লোচন থেকে লুচি এসেছে। লোচন অর্থ চোখ। চোখের মত গোল বলে একে লুচি বলে।
লুচির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়
পালযুগে। পাল যুগের বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের লেখা 'দ্রব্যগুণ' গ্রন্থে লুচির
উল্লেখ আছে। ভারতীয়রা তিন প্রকারের লুচি খেত। খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। ময়দায় বেশি
ময়ান দিয়ে তৈরি হয় খাস্তা লুচি, ময়ান ছাড়া ময়দা দিয়ে তৈরি লুচি হয় সাপ্তা,
আর ময়দার পরিবর্তে আটা দিয়ে তৈরি লুচি হয় পুরি।
পালযুগে খাস্তা লুচির প্রচলন বেশি
ছিল। অনেকে আটা ময়দা মিশিয়ে লুচি করলেও বাঙালি পরিবারে ধবধবে সাদা লুচির কদর বেশি।
সাদা ময়দার সঙ্গে আটা মিশিয়ে যে পুরি তৈরি হয় তা এখন বাজার ছেয়েছে। ভেতরে রকমারি
পুরও থাকে।
স্বাদ ও উপকরণের পার্থক্য যেমন
আছে, আকারেরও পার্থক্য দেখা যায় অঞ্চল ভেদে। গ্রামবাংলা থেকে যত কলকাতার দিকে যাওয়া
যায়, লুচির আকার ছোট হতে থাকে। গ্রামের দিকে লুচির ব্যাস ৬-৮" সেখানে কলকাতার
লুচির ব্যাস ৩-৪"।
শিক্ষিত অভিজাতরা ছোট লুচিকে বাবুয়ানির
নিদর্শন ভাবতেন। একসময় সবচেয়ে বড় লুচি পাওয়া যেত বাংলাতে। দিনাজপুরের কান্তনগরের
কান্তজিউ মন্দিরে ঠাকুরের ভোগ দেওয়া হত সেই বৃহৎ লুচি। একেকটা বড় থালার মত। বর্তমানে
মালদহ জেলার ইংরেজ বাজারের সাদাল্লাপুর শ্মশানের
কাছে হাতির পায়ের মত বড় লুচি পাওয়া যায়। যার ব্যাস ১০ ইঞ্চি। আবার অন্যদিকে সবচেয়ে
ছোট লুচিও পাওয়া যায় এই বাংলায়। মেদিনীপুরের রাধামোহনপুরের পলাশীগ্রামের নন্দীপরিবারের
ঠাকুর পরিবারে ভোগ হিসেবে যে লুচি দেওয়া হয়, তার ব্যাস ১-১.৫ ইঞ্চির মত। মনে করা
হয়, এটিই বাংলার সবচেয়ে ছোট লুচি। মহাদেশীয় যতরকম খাবার বাঙালির হেঁশেলে প্রবেশ
করুক না কেন, লুচির কোন বিকল্প নেই। আগে তীর্থযাত্রায় বা দূর দেশ ভ্রমণে খাবার সঙ্গে
নিতেই হত। সেখানে লুচি ছিল অপরিহার্য। গরম ফুলকো লুচি যেমন স্বাদে অতুলনীয়, তেমনি বাসি
লুচিরও জুড়ি মেলা ভার। আবার অম্বুবাচী, শীতলা পুজো প্রভৃতিতে লুচি করে রাখা হত।
পাকরাজেশ্বর প্রণীত রন্ধন প্রণালী থেকে জানা যায় 'দধি ঘৃতমর্দিতোষ্ণোদক সহিত দালিত মণ্ডলাকার নির্মিত ঘৃতভৃষ্ট সমিতা'-ই হচ্ছে লুচি। আবার লেখিকা কিরণলেখা রায়ের 'বরেন্দ্র রন্ধন'এ লুচির প্রস্তুত প্রণালীতে দধি বাদ দিয়ে শুধু ঘি দিয়ে ময়দাতে ময়ান দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর উষ্ণোদকের পরিবর্তে সাধারণ তাপমাত্রার জলেই ময়দা 'দলিত' বা 'ঠাসা' হইয়া 'পিষ্ট' বা 'পিটি' প্রস্তুত হয় ময়দা মেখে লেচি কেটে দু হাতের সাহায্যে গোল্লা পাকিয়ে বেলে গরম ঘিয়ে ডুবিয়ে ভেজে তুললে লুচি বা লোচিকা হবে। বিশেষ লুচি বলতে বোঝাচ্ছেন দইয়ের ময়ানে মাখা ময়দা ৭/৮ ঘণ্টা ভিজে কাপড়ে ঢেকে তা দিয়ে তৈরি লুচি 'মোচক' অর্থাত রসনার তৃপ্তি বৃদ্ধি করে। বেশ কয়দিন লুচি নরম, স্বাদু আর ভাল রাখার জন্য আগেকার দিনে জলের বদলে দুধ দিয়ে ময়দা মাখা হত। আরও শোনা যায়, সেকালের লুচিতে দাগ, চরিত্রের দাগ থাকার তুলনীয় ছিল। তাই প্রচেষ্টা থাকত লুচি ধবধবে সাদা ও নিখুঁত গোল করার। লুচি বেলার জন্য সাধারণ ঘরে থাকত পৃথক কাঠের চাকি ডলনা এবং অবস্থাপন্ন ঘরে মার্বেলের চাকি ডলনা। অর্থাত লুচি যে বাঙালির অন্দরমহলে এক বিশেষ স্থান অধিকার করত সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব লুচি হত পাতলা, তিন চার ইঞ্চি ব্যাসের আর ফুলকো। কলকাতার বাইরে এই লুচির আকার ও স্বাদের ভিন্নতা দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের কোন কোন অঞ্চলে লুচি হত পদ্মপাতার মত বড়। আগেকার দিনে পুজোর প্রসাদী হিসেবে লুচি-মণ্ডা কথাটির বহুল প্রচলন ছিল। ঠাকুরের এই প্রসাদী লুচি ছিল মোটা এবং আঠারো ইঞ্চি ব্যাসের। অনেক মন্দিরে হালুয়াও হত এর সঙ্গে। প্রসাদ বিতরণের সময় লুচি টুকরো করে এর সাথে মণ্ডা ভেঙ্গে একটু হালুয়া দিয়ে বিতরণ করা হত। এরকম প্রসাদ মায়াপুর, নবদ্বীপ অঞ্চলে, পাঞ্জাবের মন্দিরে এখনও দেখা যায়। তবে ভাজার উপকরণে আগে শুধু গাওয়া ঘি ব্যবহৃত হত। পরে ভাদুয়া ঘি’তে ভাজা হত যা মোষের দুধের তৈরি। এরপর এল খুরজা, লক্ষ্মী, শ্রী ঘি। তারপর এল বাদাম তেল, পোস্টম্যান, পামতেল, ডালডা; আরও পরে সূর্যমুখী, রাইসব্র্যান অয়েল।
পূর্বোল্লিখিত মুর্শিদাবাদ ছাড়াও
বর্তমানে বাংলাদেশের কান্তনগরে বেশ বড় মাপের লুচি হত। দিনাজপুর শহরের ১২ মাইল উত্তরে
কান্তনগর। তবে এখানকার লুচি দিনাজপুর রাজবাড়ির
মত 'বগিথালা'র সাইজের হত না। নদী পার হলেই একটি গ্রামে যে কান্তজীরমন্দির, আগের মত
এখনও হয় ঐ ঠাকুরবাড়িতে সকালে বাল্যভোগ, দুপুরে অন্নভোগ, সন্ধ্যায় আরতি আর পুজো।
দুর্গাপূজার কদিন আগে নদীপথে কান্তজীকে দিনাজপুরে
এনে ধূমধাম সহকারে কাঞ্চন নদীর ঘাট থেকে প্রায় তিনমাইল পূর্বে রাজবাড়ীতে নেওয়া হত।
বর্তমানেও এই প্রথার চল আছে। ঐ
রাজবাড়িতে কান্তজীর পুজোপার্বণ চলে রাসপূর্ণিমার আগে পর্যন্ত। ঐ সময়ে রাজবাড়িতে
প্রতিদিন কান্তজীর ভোগ হিসেবে লুচি তৈরি ও বিক্রি হত। এই লুচি ছিল আরেক রকমের। এর বৈশিষ্ট্য
হল না ভাঙা পর্যন্ত এই লুচি ফোলা অবস্থায় থেকে যেত। মাটির সরা বা পাতলা বাঁশের খাঁচায়
করে ঐ লুচি এপার বাংলাতেও এসেছে।
উৎস যেখানেই হোক যুগ যুগ ধরে এই লুচি মিশে আছে বাঙালির রসনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যার প্রতিফলন দেখা যায় সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রেও। খুব ছোটতেই দেখা ‘চারমূর্তি’ সিনেমাতে টেনি মুখুজ্যের খাওয়া পর্বে লুচির পাতে পড়তেই উড়ে যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন ভাজা সহকারে... আবালবৃদ্ধর হৃদয়ে এক গভীর দাগ কেটে যাওয়া, পরিচালকের এ এক প্রশংসনীয় কীর্তি। তেমনই ‘গুপিগাইন বাঘা বাইন’ গল্পে ভূতের রাজার বরে থরে থরে লুচি মণ্ডা মেঠাই নামতে দেখা যায়। লুচি ছাড়া বাঙালি অচল, তা তৎকালীন চলচ্চিত্রে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু উদর পূর্তি ও রসনা তৃপ্তি নয়, লুচি যেন খাস বাঙালির ঐতিহ্য। তখনকার দিনে কোন উৎসব পার্বণী, ব্রত পালন, অতিথি আপ্যায়ন লুচি ছাড়া ভাবা যেত না।
দুর্গাপুজোর অষ্টমীর অঞ্জলির পরে
লুচি ছোলারডাল, কুমড়োর ছক্কা, আলু-ফুলকপির ডালনা শেষপাতে চাটনি ও মিষ্টি সহযোগে লুচি
এখনও আছে।
জামাই ষষ্ঠীতে রাতে জামাইয়ের পাতে
লুচি-মাংস ছিল অবশ্যম্ভাবী পদ। এছাড়াও বিয়েবাড়িতে প্রথম পাতে লুচি ডাঁটি সমেত বেগুনভাজা,
ছোলারডাল ছিল অপরিহার্য। খাওয়ার ধরনে তখনকার দিনে একটি মানুষের পারিবারিক, সামাজিক
অবস্থান এমনকি তার রুচি, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র নিরূপণ করা হত। সত্যজিত রায়ের বহু ছবিতে
তা ফুটে উঠেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ 'চারুলতা'তে ভূপতির খাবার দৃশ্য। লুচি এতোটাই ঘরোয়া
খাবার ও সুস্বাদু যে, বহু তরকারি এবং ভাজার সঙ্গে দিব্যি লুচি খাওয়া যায়। এমনকি আগেকার
দিনে শুধু একটু নুন ছড়িয়ে বয়স্ক মানুষরা খানকতক লুচি খেতেন। 'নুন দিয়ে খাই নুচি'
শব্দবন্ধটি শুধু আক্ষরিক নয়, তখন ব্যবহারিক অর্থেও প্রচলিত ছিল। ভাল উপকরণে তৈরি লুচি
শিশু, বৃদ্ধ এমনকি পেটরোগা মানুষও খেতে পারেন। ঈশ্বর গুপ্ত থেকে ভারতচন্দ্র, হেমচন্দ্র
থেকে রমেশচন্দ্র, সুকুমার থেকে সত্যজিত, রবীন্দ্রনাথ থেকে অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতি বহু
লেখকের রচনায় স্থান পেয়েছে লুচি। স্থান পেয়েছে ছোটদের ছড়াতেও--
"ফুলকো লুচি, ফুলকো লুচি
পেটটা ফুলে ঢাক।
ফুলকো লুচি ফুলকো লুচি
পেটের ভেতর ফাঁক।
ফুলকো লুচি, একটু সুজি,
একটু আলুরদম।
কেল্লাফতে তার সনেতে
পাই যদি চমচম।"
আবার কবিদের সরস্বতী বন্দনায় পাওয়া যায়--
“লুচি, কচুরি, মতিচূর শোভিতং।
জিলেবি সন্দেশ গজা বিরজিতং।
যস্যা প্রসাদেন ফলার মাপ্লমঃ।
সরস্বতী মা জয়তান্নিরন্তরম”।
আবার লেখিকা কল্যাণী দত্তের লেখা 'জলখাবার লুচিপর্ব' আর 'বাসি লুচি' প্রকৃতই 'শব্দে রসনা তৃপ্তি' ঘটায়। কমলকুমার মজুমদার তাঁর শ্বশ্রূমাতার লুচিভাজা দেখে ও খেয়ে তাঁর কন্যা দয়াময়ী দেবীকে বিবাহ করে ফেলেন। শত বছর আগেও অভিজাত থেকে মধ্যবিত্ত যে কোন পরিবারে সকাল বিকাল অথবা সান্ধ্যকালীন জলখাবারের মেনু ছিল 'সুধারুচি মুচমুচি লুচি'। লুচি খেয়ে কীর্তন গাইতেন রসিক মহল--
"ওগো লুচি নন্দিনী ঘৃতে ভর্জিনী,
প্রেয়সী মহিষী প্রিয়ে।
এসো চক্রাকারে বদন মাঝারে
জুড়াই তাপিত হিয়ে"।
কয়েকদশক আগেও কাছে দূরে ভ্রমণে পারিবারিক অন্যতম সঙ্গী ছিল লুচি। এমনকি প্রবাসী বাঙালিরাও লুচিকে ভুলতে পারেনি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঘরোয়া খাবারের চল কমছে। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় বাড়ছে নানা দেশী বিদেশী খাবার গ্রহণের প্রবণতা। স্বামী স্ত্রীর এককেন্দ্রিক পরিবারে উভয়েই কর্মরতা হওয়ায় সময় কম। তাই খাদ্য বিক্রেতা দোকান, গৃহ সরবরাহসংস্থাগুলি লুচিও প্রস্তুত করছে। শুধু জমিদার বা অভিজাত পরিবারের শ্বেত পাথরের টেবিলে নয়, ভাঙাছাদের বিলাসিতাতেও ছিল লুচি। আগে যেমন তালের ক্বাথের সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে তালের লুচি হত, এখন অনেক কিছুর সঙ্গেই ময়দা মিশিয়ে লুচি তৈরি করছে। এমনকি সুজি দিয়েও লুচি।
সবশেষে এটাই বলতে হয়, লুচি নিয়ে
যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলুক না কেন, সাবেকী সাদা ময়দার ধবধবে লুচির কোন বিকল্প নেই।
আর লুচি ছাড়া বাঙালি আজও জলছাড়া মাছের মত।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন