বড় পর্দায় দেখা হিন্দী ছায়াছবি (পর্ব সাত, ২০০৫ থেকে মাল্টিপ্লেক্সে
– ব্ল্যাক ও তার বিপরীতে কিছু ‘বাজে’ ছবি)
আগের পর্বেই বলেছি যে ১৯৯৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত
কিন্তু তার কিছু পরে পুনর্মুক্তির সময় দেখা সূর্যবংশম ছবির পর দীর্ঘ পাঁচ-ছ’বছর কোন
হিন্দী ছবি বড় পর্দায় দেখিনি। এও বলেছি যে ২০০৫ সাল থেকে স্থানীয় মাল্টিপ্লেক্সে অমিতাভ বচ্চন-রাণী মুখোপাধ্যায়-ধৃতিমান
চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ব্ল্যাক দিয়ে আবার হলে গিয়ে হিন্দী ছবি দেখা শুরু হয়। এবার, প্রতি
বছরে দেখা সমস্ত হিন্দী ছবির কথা না বলে, একদিকে যেগুলি বিশেষভাবে মনে দাগ কেটেছে,
এবং অপর দিকে যেগুলো মনে হয়েছে বিশেষভাবে খারাপ ছবি, সেগুলির সম্বন্ধেই আলোচনা থাকবে,
নতুবা আপনাদের এই লেখা ক্লান্তিকর বা বিরক্তি-উদ্রেককারী মনে হতে পারে।
২০০৫ সালের অষ্টম সফলতম বলিউডি ছবি সঞ্জয় লীলা ভানশালী পরিচালিত ব্ল্যাক। মহর্ষি হেলেন কেলারের জীবনী, তার থেকে হওয়া আর্থার পেন পরিচালিত ১৯৬২ সালের ছবি The Miracle Worker এবং তার ওপর আধারিত প্রকাশ কাপাডিয়ার গুজরাটী নাটক অনুপ্রাণিত (ভানশালী যতই পরবর্তী এই দুই উৎসের কথা অস্বীকার করুন) এই ছবিটি দেখা, চিত্রনাট্য, পরিচালনা এবং একাধিক কুশীলবের অভিনয়গুণে, এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শৈশবে ব্যাধি-আক্রান্ত হয়ে সিমলার মিশেল ম্যাকন্যালি (আয়েষা কাপুর) দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি এবং বাকশক্তি হারায়। তার মা ক্যাথারিন (শেরনাজ প্যাটেল) দ্বিতীয় কন্যাসন্তান সারার (নন্দনা সেন) জন্ম দেবার পর মিশেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অর্ধোন্মাদ, প্রায় হিংস্র হয়ে পড়ে। এই মানসিক অন্ধকার – যার রং কালো, ব্ল্যাক – থেকে তাকে ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখান বয়স্ক দৃষ্টিহীন-বধিরদের শিক্ষক দেবরাজ সহায় (অমিতাভ বচ্চন)। অবশেষে তাঁর এবং বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজের অধ্যক্ষের সহযোগিতায় প্রাপ্তবয়স্কা মিশেল (রাণী মুখোপাধ্যায়) স্নাতক হয়। ইতিমধ্যে দেবরাজ দুরারোগ্য অ্যালজাইমার-রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় তাঁরই ছাত্রী মিশেল। ব্ল্যাক ফিল্মফেয়ারের পক্ষ থেকে, শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (বচ্চন) এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (রাণী মুখোপাধ্যায়, যদিও মায়ের ভূমিকায় শেরনাজ প্যাটেল কিছু কম নন) – চারটি পুরস্কারেই ভূষিত হয়।
২০০৫ সালে বড় পর্দায় দেখা ব্ল্যাক আমার একমাত্র হিন্দী ছবি। এবার ২০০৭ থেকে দেখা অন্যান্য ছবি নিয়ে কথা হবে। প্রথমে বলি কিছু ছবির কথা যেগুলি বিভিন্ন কারণে বিশেষভাবে খারাপ লেগেছে, মনে হয়েছে সেগুলি দেখতে গিয়ে একাধারে অর্থ এবং সময়ের অপচয় করেছি। ২০০৭-এ কন্যার ইচ্ছেয় দেখতে বাধ্য হই অত্যন্ত পীড়াদায়ক heist ছবি ক্যাশ, অভিনয়ে অজয় দেবগণ, দিয়া মির্জা ও অন্যান্য। ২০০৯ সালে নিজের ইচ্ছেয় দেখে বিরক্ত হই অক্ষয়কুমার, মিঠুন চক্রবর্তী ও দ্বৈত ভূমিকায় দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ভারত-চীনের যৌথ প্রয়াস চাঁদনী চৌক টু চায়না – আরেকটি নিকৃষ্ট ছবি, যদিও বাণিজ্যিক হিসেবে এটি বছরের দশম সফলতম। ছবির শুরু আশা জাগিয়েছিল চীনের প্রাচীরের ওপর যুদ্ধের দৃশ্য দিয়ে, কিন্তু তারপর, কিংবদন্তী যোদ্ধা লিউ শেং-এর তথাকথিত ‘অবতার’ হিসেবে সব্জিওয়ালা সিধুর (অক্ষয়কুমার) ভাঁড়ামি আর বর্তমানে ঝাঙ্গে নামক গ্রামকে অত্যাচারী চোরাচালানকারী হোজোর হাত থেকে মুক্ত করতে সিধুকে ব্যবহার দেখে ১৯৮৬ সালের ইংরেজী ছবি Three Amigos-এর ক্লান্ত অনুকরণ মনে হচ্ছিল। ঠিক যেমন জাপানী পরিচালক কুরোসাওার Seven Samurai থেকে হলিউডের Magnificent Seven হয়ে শোলে, ঠিক তেমনই কুরোসাওার উৎস-কাহিনিকে ব্যঙ্গ করে Three Amigos, এবং তার অক্ষম নকল চাঁদনী চৌক টু চায়না, সংক্ষেপে CC2C! কুরোসাওার সাতজন বলিউডে কমে দাঁড়িয়েছিল দুজনে – ধর্মেন্দ্র আর অমিতাভ বচ্চন। Three Amigos-এর সংখ্যাটা CC2C-তে কমে হয়েছে এক! শোলে প্রায় সার্বিকভাবে সফল ছবি। CC2C, বিদেশী সমালোচকের ভাষায়, একটি ‘galumphing elephant of a chopsocky revenge-of-the-nerd quasi-musical lack[ing] the lyrical choreographic beauty that has marked such Stateside Bollywood releases as the gorgeous Lagaan.’
প্রসঙ্গত, ২০০৫ থেকে ২০১৩ অবধি বছরে হিন্দী ছবির সংখ্যা ওঠা-নামা করত ১ থেকে ৪-এর মধ্যে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ অবধি এই সংখ্যাটা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। এর ফল, ২০১৬-তে দেখা তিনটে তিনরকম ‘বাজে’ ছবি। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের Great Expectations, তার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ এবং অবাস্তব মিলনান্তক উপসংহার বাদ দিলে, লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। হিন্দী ছবি ফিতূর যে শুধু এই শৈল্পিক দিক দিয়ে চরম আপত্তিকর পরিণতিটি শুধু বজায় রেখেছে তাই নয়, উপন্যাসটি থেকে হওয়া ১৯৯৮ সালের Alfonso Cuarón পরিচালিত ছবিটিই উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৯৭-এর টাইট্যানিক ছবির অনুপ্রেরণায় নায়ক (উপন্যাসের ‘পিপ’ এখানে মার্কিনী ‘ফিন’, রূপায়নে আদিত্য রায় কাপুর) কর্তৃক নায়িকা এস্টেলার নগ্ন প্রতিকৃতি অঙ্কন! হিন্দীতে অবশ্য এতটা দেখানো সম্ভব হয়নি, দুজনের শয্যাদৃশ্য দেখিয়েই ক্ষান্ত দিতে হয়েছে। তার ওপর এস্টেলা-ফিরদৌস চরিত্রে রূপদান করেছেন ক্যাট্রিনা কাইফ! আমার যত পছন্দের অভিনেত্রীই তিনি হোন, এস্টেলা-রূপায়নে তিনি অক্ষম! এর ওপর জগাখিচুড়ির মতো এসেছে ২০১৪ সালে বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের রূপান্তর হায়দার-অনুপ্রাণিত কাশ্মীরের প্রেক্ষাপট। একমাত্র প্রশংসনীয় লেগেছে মিস হ্যাভিশ্যাম-বেগম হজরত চরিত্রে টাবুর অভিনয় (প্রসঙ্গত, এখানেও হায়দার-এর ছায়া; তাতেও অন্যতম মুখ্য চরিত্রে ছিলেন ওই একই অভিনেত্রী)। এবেল ম্যাগুইচ-মোয়াজ্জাম চরিত্রে অজয় দেবগণ মন্দ করেননি। আইনজীবী জ্যাগার্সের চরিত্রকে একেবারে পার্শ্বভূমিকায় ঠেলে দেওয়া আরেকটি বড় খামতি।
বছরের আরেকটি চমকপ্রদ ভাবে খারাপ ছবি অতিপ্রাকৃত রাজ সিরিজের রাজ রিবুটঃ কারণ নায়িকার (রূপায়নে কৃতি খারবান্দা) মুখে একটি অবিস্মরণীয় সংলাপঃ আপাতদৃষ্টিতে নায়ক, আদতে খলনায়ক দুষ্ট-প্রেতাত্মার (রূপায়নে এমরান হাশমী) প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ‘বাঙালি’ নায়িকা ইংরেজীতে বলছেন, “আমরা বাঙালিরা এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলি, “তুমি কোন ভাঙ্গড়ের পথে এলে!”
এরপর আসবো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা-পাওয়া আলিয়া ভট্ট অভিনীত ডিয়ার জিন্দেগী-র প্রসঙ্গে। কাহিনির কেন্দ্রে দাদু-দিদার ‘আদরে বাঁদরী’ দুঃখবিলাসিনী কাইরা (আলিয়া ভট্ট)। যেহেতু তার বাবা-মা নিজেদের জীবনযাত্রা স্থিতু করার উদ্দেশ্যে মেয়েকে দাদু-দিদার তত্বাবধানে রেখে ‘মানুষ’ করার চেষ্টা করেছেন, আবার, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হতেই কাইরাকে সরিয়ে নিয়ে নিজেদের কাছে গোয়ায় আনিয়েছেন, কাইরা তাদের প্রতি চরম বিরূপতা পোষণ করে, এবং কারোর সঙ্গেই স্থিতিশীল সম্পর্ক গঠনে সে অপারগ। ছবির শুরুতেই সে তার বাল্যকালের প্রেমিক সিডকে (অঙ্গদ বেদী) জানাচ্ছে যে সে, কাইরা, চলচ্চিত্র-প্রযোজক রঘুবেন্দ্রের (কুণাল কাপুর) সঙ্গে শয্যাবাস করেছে। সিডকে ফুটিয়ে দেবার পর কাইরা অবশ্য রঘুকেও সমানে ল্যাজে খেলাতে থাকে আর রঘুর স্পষ্ট জিজ্ঞাসার – কাইরা তাকে বিয়ে করবে কিনা – কোন সঠিক উত্তর দেয় না। রঘু প্রত্যাশিতভাবেই যখন অপর কাউকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিন্তু কাইরা রাগে ফেটে পড়ে, কিন্তু রঘুর প্রশ্নের – “তোমার জীবনে আজ অবধি এমন কী ভয়ঙ্কর ‘ট্রাজেডি’ ঘটেছে?” – কোন সদুত্তর দিতে পারে না। এরপর গোয়ায় তার বাবা-মার কাছে পৌঁছে কিয়ারা অনিদ্রারোগে আক্রান্ত হয় এবং ডাঃ জাহাঙ্গীর খান (শাহরুখ খান) নামক মনস্ত্বত্ববিদের কাছে ‘কাউন্সেলিং’ শুরু করে। ডাঃ খান কাইরাকে বোঝান যে বাবা-মা তাকে দাদু-দিদার কাছে পাঠানোর ফলে সে পরিত্যক্ত বোধ করেছিল এবং তার থেকে উৎপন্ন হয়েছে তার কোন মানুষের সঙ্গে মানসিক এবং ভাবগত সংযুক্তির প্রতি এক ধরনের ভয় – পাছে তাকে আবার পরিত্যক্ত হতে হয়। এই জন্যই সে একের পর এক সম্পর্ক স্থাপন করেও ভেঙে ফেলে। ডাঃ খান কাইরাকে শেখান বাবা-মাকে কোন আদর্শ caregiver-এর উচ্চাসনে না বসিয়ে তাঁদের দোষে-গুণে গড়া সাধারণ মানুষরূপে দেখতে।
বোধহয় ডাঃ খান এও কাইরাকে বলতে
পারতেন যে সে নিজেও অনেক গুণের সঙ্গে – কাইরা একটি স্বল্প দৈর্ঘের চলচ্চিত্র তৈরি করার
চেষ্টা করছে – অনেক চারিত্রিক ত্রুটি মেশানো এক ব্যক্তিত্ব, এবং সে একাধিক পুরুষকে
আহত করেছেঃ সিড, রঘু, এবং সঙ্গীতকার রুমি। সে পুরুষদের এতটাই taken for granted হিসেবে
ব্যবহার করে যে তার ল্যাজে খেলানো সহ্য না করে রঘু অন্য মেয়ে পছন্দ করলে, ক্ষেপে গিয়ে
কাইরা একটি দোকানে ভাঙচুর চালায়, রাস্তায় লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, যা একেবারেই
সমর্থনযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, কাইরার নিজের বাবা-মা
সম্বন্ধে ধারণায় সংশোধনের প্রয়োজন আছে। চাকরীর সুবাদে বিদেশে যাবার জন্য তাঁরা কাইরাকে
দাদু-দিদার কাছে রেখে গেলেও, যে মুহূর্তে তাঁরা জানতে পারেন যে দাদু-দিদার আদরে মেয়ে
পরীক্ষায় ফেল করছে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ কাইরাকে সরিয়ে আনেন নিজেদের কাছে, দাদু-দিদার সঙ্গে
সম্পর্ক ভাঙার উদ্দেশ্যে নয়, মেয়ের নিজের ভালোর জন্য! এগুলো সম্বন্ধে কাইরাকে সচেতন
করা কি একজন মনোবিদের কর্তব্য নয়? তার বদলে ডাঃ খান কাইরাকে নিয়ে সাইকেলে বেড়িয়ে বেড়ান
আর তাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে কাবাডি খেলতে শেখান! এগুলো নিশ্চয়ই কাজের, কিন্তু আগের
কথাগুলোও কম প্রয়োজনীয় নয়।
প্রত্যাশিত ভাবেই কাইরা ঘোষণা করে
যে সে এবার ডাঃ খানের প্রতি আকৃষ্ট! ডাঃ খান তাকে দয়াদ্রচিত্তে বোঝান যে থেরাপিস্টের
প্রতি তাঁর রুগীরা এমন ভাব বোধ করতেই পারে কিন্তু তাকে পরিণতি দেওয়া অনৈতিক হবে। অত্যধিক
অধিকারবোধে আক্রান্ত কাইরা ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে প্রথমে কান্নায় ভেঙে পড়লেও ডাঃ খানের
কথার যাথার্থ বোধ করতে অবশেষে সক্ষম হয়।
অবশ্য, ডাঃ খান যদি এখানে অনৈতিকভাবে
রুগীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতেন, তাঁর কপালেও সিড, রঘু, বা রুমির পরিণতিই ঘটত। কাইরা সেই
জাতীয় মেয়ে যে কখনোই কোন পুরুষের প্রতি নিজেকে commit করবে না, কিন্তু আশা করবে যে
পুরুষেরা নিজেদের তার কৃপাধন্য মনে করে পরম অনুগত পুরুষ মৌমাছির মতো তাকে মক্ষীরাণীর
সম্মান দেবে । কাহিনির লেখিকা এবং ছবির পরিচালিকা যে একজন মহিলা – গৌরী শিণ্ডে – তা
খুবই অর্থবহ!
অনেকের কাছে কুখ্যাত অ্যানিমাল (২০২৩-এর তৃতীয় সফলতম) ছবিটি দেখে আমার ডিয়ার জিন্দেগীর কথা মনে পড়েছিল। অ্যানিমাল-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রণবিজয় / বিজয় সিং (রণবীর কাপুর) নিজের বাবা বলবীর সিং (অনিল কাপুর)-এর প্রতি নিবেদিত-প্রাণ। কিন্তু কর্মব্যস্ত বলবীর তাঁর পরিবারের সদস্যদের ‘যথেষ্ট’ সময় দেন না বলে বিজয় নিজের বোন রীতকে (সালোনী বাত্রা) ইস্কুলের যে ছেলেরা উত্যক্ত করছিল তাদের বাবার একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে ইস্কুলের মধ্যেই আতঙ্কিত করে। ক্রুদ্ধ বলবীর ছেলেকে সঙ্গতভাবেই ‘অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে ইস্কুল থেকে বার করে নিয়ে আমেরিকায় ‘বোর্ডিং’-এ পাঠিয়ে দেন। এতে বিজয়ের মধ্যে বাবার প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিদান না পাওয়ার ক্ষোভ আরও বেড়ে ওঠে এবং এই থেকেই কাহিনির ভবিষ্যৎ গতির দিক নির্ধারিত হয়ে যায়। আমার মনে হয়, কাইরা লিঙ্গ-পরিবর্তিত হলে একটি রণবিজয়েই পরিণত হত। দুটি ছবিই আমার কাছে ‘বাজে’ ছবি – কেন্দ্রীয় চরিত্রদুটির প্রতি বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা বোধ করতে পারিনি, কিন্তু দুটি ছবির নির্মাতারাই দাবী করেন যে কাইরা আর রণবিজয়কে দর্শক সমর্থন করুক। নির্মাতাদের নৈতিকতার সঙ্গে আমার নীতিবোধ মেলে না।
২০১৭-র বদ্রীনাথ কী দুলহানিয়া (সেই দিলওয়ালে দুলহানিয়ার আরেকটি ‘ক্লোন’) ছবির একটি দৃশ্য আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কোন এক বিদেশের শহরে রাতে নায়ক (বরুণ ধাওয়ান) এবং তার বন্ধুরা একদল দুষ্কৃতিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ব্যাপারটা গণধর্ষণের দিকেই যাচ্ছিল, এমন সময় নায়িকা (আলিয়া ভট্ট) এবং তার সখীরা এসে পড়ে দুষ্কৃতিদের মেরে তাড়ায়। এখন অবধি সব ঠিক ছিল। এবার রাস্তায় পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত নায়কের দিকে থাকিয়ে নায়িকা খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েন, দর্শকদের মধ্যেও হাসির রোল ওঠে। যদি নায়কের বদলে নায়িকা এবং তার সখীর দল আক্রান্ত হত এবং তাদের বাঁচানোর পর নায়ক তাদের দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ত, দর্শক তখন সেই হাসিতে যোগ দিতেন তো?একই কারণে দারুণ জনপ্রিয় স্ত্রী
২ (২০২৪-এর সফলতম ছবি) সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হতে পারিনি। শহরের প্রেতাত্মা বেছে বেছে
পুরুষদেরই অপহরণ করে তাদের ওপর শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক নির্যাতন চালায়, এবং
সেটাই এই ‘কমেডি’-র হাস্যরসের মূল উৎস। আবার বলি, লিঙ্গটা পাল্টে দিন; মজা পাবেন তো? হ্যাঁ, অনেক নারী এবং নারীবাদীরা মজা পাবেন,
বলবেন, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারী নির্যাতনের এইই তো সঠিক উত্তর! তবে সেই ১৯৬৩ সালের
ভ্রান্তিবিলাস ছবিতেও হতভাগ্য কিঙ্করকে বাড়ির মহিলা রাঁধুনি যেভাবে উঠতে-বসতে প্রহার
করার শাসানি দিয়েছে, তা নির্মাতারা ‘হাসির’ মনে করলেও, আমার গ্রহণযোগ্য লাগেনি, যেভাবে
চিরঞ্জীব ও চিরঞ্জিৎ কথায় কথায় দুই কিঙ্করের গায়ে হাত তোলেন তাও ঠিক লাগেনি। জানি,
সে যুগে চাকরের গায়ে মনিবরা প্রায়ই হাত তুলতেন, কিন্তু তাকে ‘মজার’ হিসেবে দেখানো ঠিক
মনে হয় না।
এদিকে ফুলকুমারী অন্য কোন স্টেশনে নেমে পড়ে সেখানে একটি কিশোরের সাহায্যে আশ্রয় পায়। সেই কিশোর ফুলকে নিয়ে যায় স্টেশনে চায়ের স্টলের মালিক মঞ্জু মাইয়ের কাছে। এই আগুনখোর নারীবাদী তার অপদার্থ স্বামী এবং সেই স্বামীর ঔরসে জাত অপদার্থ পুত্রসন্তানকে নিজের জীবন থেকে ফুটিয়ে দিয়ে একা (একেবারেই একা নয়, পূর্বোক্ত কিশোরটির সাহায্য – সে একজন পুরুষ – তার নিত্য লাগে) চায়ের দোকান চালায়। সে ফুলকে নারীর জীবনে পুরুষের নিস্প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তৃতা দেয়। অবশ্য প্রথম দিন সে ফুলকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছিল! কিশোর আর তার পুরুষ বন্ধু না থাকলে হতভাগ্য মেয়েটি কোথায় যেত? আর সারা স্টেশনচত্ত্বরে তো মাইয়ের দোকান থেকে চা-খাবার কিনতে মূলত পুরুষ যাত্রীই চোখে পড়ল! যে মহিলা জীবনযাত্রা নিয়ে অপরকে জ্ঞান দেয়, সে কিন্তু তার নিজের পেটের ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি! আর পুরুষ খদ্দের ছাড়া তার দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ আদৌ সম্ভব হবে? প্রসঙ্গত, ফুলের দুর্দশার মুখ্য দায় তার মার অসম্পূর্ণ শিক্ষা। মেয়েকে ঘোমটা দিতে তিনি শিখিয়েছেন – যার সুবাদে ফুল – এবং জয়ার – দুরবস্থা – কিন্তু নিজের গ্রামের নাম বা বাড়ি থেকে বাইরে গিয়ে পড়লে কিভাবে পথ চিনে বাড়ি ফিরতে হয়, এসব কিছুই শেখাননি। ওসব তো ফুলের স্বামী – পুরুষ – সামলে নেবে! আর জয়াকে জোর করে অযোগ্য পাত্রস্থ করেছিলেন কে? সেই পাত্রের অত্যাচার থেকে তাকে উদ্ধার করলই বা কে? মঞ্জু মাইয়ের মতো কোন নারীবাদী? কিরণ রাওয়ের মতো দৃপ্ত নারীবাদীরা তাঁদের কাহিনির মধ্যেই তাঁদের আদর্শবাদের ভেলার ফুটোগুলো বড্ড প্রকট করে রাখেন। সজ্ঞানে কিনা কে জানে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন