ধারাবাহিক
উপন্যাস
ছেঁড়া শেকড়ের অন্তরাখ্যান
(৪)
যেমতে গেলাম ফুল টোকাইতে হেমতে অইল বিয়া
অমলার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। যা ভয় পেয়েছিল সেটাই, ইংরেজিতে ব্যাক। মন খানিক খারাপ যদিও বাড়িতে কেউ কিছু বলেনি। কলেজ যাওয়া শেষ। শহরের মধ্যে দিয়ে ধোওয়ানো রাস্তা, ভোরবেলার ডিপো থেকে বেরিয়ে ফাঁকা ট্রামের টিংটিং, রাস্তা দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়ে স্টপেজ এলে টুক করে নেমে পড়া। এসবের জন্যও মন খারাপ বৈকি। অমলা যদি আবার পরীক্ষা দেয়ও প্রত্যেকদিন কলেজ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্য বাইরে ভারী মুখচোরা সে। তার কথায় ওবঙ্গের টান অনেক চেষ্টাতেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাড়িতে সারাক্ষণ বাবা-মা ওই ভাষাতে কথা বলেন। তাই নিয়ে সহপাঠিনীদের চোখঠারা হাসি, খোঁচানো প্রশ্ন সহ্য করতে হয়েছে। অমলা মিশতে পারেনি। এই মেয়েরা থাকে ভবানীপুর, রাসবিহারী, বালীগঞ্জ। তাকে কেউ কখনও যেতে বলেনি। কয়েকটি মেয়ে তার মতো ওপার থেকে আসা। তাদের সঙ্গেও অমলার তেমন ভাব হয়নি। অমলার ফুটফুটে চেহারার পাশে ওই মেয়েদের চেহারাতে রুক্ষতা, অযত্ন, লড়াই স্পষ্ট। অমলাকে ওরা আলাদা চোখে দেখেছে। শ্যামা নামের কালো মেয়েটি রাজ্যের বিরসতা মেখে কলেজে আসত। জিজ্ঞেস করেছিল,
“তগো কি অই দ্যাশে জমিদারি আছিল?”
“না না।”
“সম্পত্তি অদলা-বদলি কইরা ট্যাহা পাইছস নিশ্চয়ই।”
“কী জানি! ক্যান?”
“জীবনে রিফিউজি ক্যাম্প চক্ষে দ্যাকছস? থাকতে হইছে?”
“না।”
“তয় ত ঠিকই বুঝছি। কষ্ট কারে কয় জীবনে দ্যাখ নাই মনু, কী কইরা
বুঝবা? পাশ দিলে নার্সিং ট্রেনিং নিমু। চাকরি একখান জুগার করন লাগবই।”
অমলা এমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারে না। ঘরে চাকরি নিতে তাকে কেউ স্পষ্ট করে বলেন না। ধীরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বি-এ পাশ করলে টিচার্স বেসিক ট্রেনিং কোর্সে-এ ভর্তি হয়ে যেতে। কলেজে একটিই মাত্র বন্ধু তার, অশ্রুকণা, চেতলা থেকে আসত। তারও ইচ্ছা শিক্ষকতা করে।
স্পষ্ট না হলেও অমলা বুঝত, তাদের অবস্থা তুলনায় সচ্ছল। পরিবার
ছোটো। বড়দাদা মধুসূদন রেলে চাকরি করছে। নিরঞ্জনও মাসছয় আগে চেষ্টাচরিত্র করে কাপড়ের
কলে কাজ পেয়েছে। ওদেশে গ্রামের দিকে অল্পবিস্তর জমিজমা আছে। ধীরেন্দ্রনাথের দাদা-ভাই-জ্ঞাতিরা
থাকেন। ছ-মাসে, ন-মাসে কখনও ধীরেন্দ্রনাথের নামে মনিঅর্ডার এসেছে, যদিও টাকার পরিমান
সামান্য। দেশের বাড়ি থেকে কেউ-না-কেউ বিশেষত ধীরেন্দ্রনাথের দুই ভাইপো তাঁদের বাসাতে
আসত। অমলা এই দাদাদের খুব ছোটোবেলায় ওদেশে থাকতে দেখেছিল, মনে ছিল না। এই বাসাতে তখন
সদ্য থাকা শুরু করেছে তারা। ঝোপ-জঙ্গল, নোংরা, স্যাঁতস্যাঁতে অচেনা জায়গা, সকলেরই মন
খারাপ। দেশের মানুষ এলে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠতেন ধীরেন্দ্রনাথ। যথাসাধ্য খাবারের আয়োজন।
লুচি খাওয়ার চল ছিল না গ্রামদেশে। তারাসুন্দরী লুচি ভেজে খাওয়াতেন। এক ভাইপো আসত নাম
সনাতন, বিশ্রী রুক্ষ ব্যবহার। মূলতঃ জমি-বিক্রি, টাকাপয়সা ভাগ-বাঁটোয়ারা-সংক্রান্ত
আলোচনার জন্য আসত। ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর গ্রামের পরিবারের সঙ্গে কমই থেকেছেন। তাছাড়া আজীবন
এসব ব্যাপারে উদাসীনও। হালে আরও বেশী। কোন শৈশবে সংসারে এসেছেন তারাসুন্দরী। সংসারের
যাবতীয় ঝক্কি-ঝামেলা সামলেছেন। ছেলেমেয়েরা বোঝে, মা তাদের নির্ভরতার জায়গা। অথচ ধীরেন্দ্রনাথের
সঙ্গে আলোচনার সময়ে তারাসুন্দরী থাকা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছে সনাতন। কথা বলতে গেলেই ধমকে
উঠেছে,
“আপনে কী করতেন? খুড়া-ভাইপোর বাইক্যালাপে আপনের থাকন লাগে না!”
বিব্রত ধীরেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে বলতেন চলে যেতে। তারাসুন্দরী শোনেন
নি। বড়ো ভাসুরপো, বয়সে প্রায় সমান হলেও সম্পর্কে তিনিই গুরুজন। সেই সুবাদে মাথা ঠাণ্ডা
রেখে বলতেন,
“কী করি কও সোনা? তোমার খুড়ায় আইজকাল কিস্যুই বুঝে না! বুড়া হইছে—।”
তারাসুন্দরীর সঙ্গে পারা যাবেনা বুঝে সনাতন আসা বন্ধ করেছে।
আর আসত নবকুমার। ধীরেন্দ্রনাথের জ্ঞাতি ভাইপো। বেশ হাসিখুশী, হাতে উপহার না নিয়ে আসত
না। দু-একবার শাড়িও এনেছে।
“ন্যান কাকিমা দ্যাশের মাল। এহানে পাইতেন না।”
টাকাপয়সার আলোচনা সে করত না। ধীরেন্দ্রনাথ জানতে চাইলে মাথা
চুলকে বলত,
“আপনেরে কী আর কমু মেজখুড়া, অই জমিখান অইল ভাগের মা। এতগুলা মানুষ!
কির’ম কইরা যে জীবন চলে কী কমু!
এই কাপরখান লুকাইয়া নিছি। কাকিমা পইরেন। রঙ দ্যাখেন, কেরম সরেস জমিন কন!”
“ক্যান আনছস? দরকার আছিল না।”
“দাম আমি কম দিছি।”
“দাম নিবা? ছ্যামড়ার পাটয়ারি বুদ্ধি দ্যাহ! আনতে কেডা কইছে?”
“আপনেরা বড় শহরে থিতু হইছেন, হেই কয় ট্যাহা দিবার পারবেন।”
“কুলাঙ্গার—!”
সেদিন খুব রেগে গিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। তারাসুন্দরী তাড়াতাড়ি
সংসার-খরচ বাঁচিয়ে রাখা টাকা থেকে দাম দিয়ে দিয়েছিলেন নবকুমারকে,
“ভবিষ্যতে আর আনবা না নবু।”
“ইসে, কিছু মনে নিয়েন না। ব্যবসার চ্যাষ্টায় আছি। মূলধন যদি পাইতাম—।”
ইঙ্গিত বুঝে তারাসুন্দরী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার সে
শাড়ি এনেছিল অমলার জন্য। সেই শাড়িরও দাম দিয়েছিলেন তারাসুন্দরী। পরে আনা বন্ধ করেছিল।
এসে দু-একদিন থেকে চলে যেত। বলত ব্যবসার কাজে আসে। তারাসুন্দরী বিরক্ত হলেও কিছু বলতেন
না। কিন্তু সমস্যা বাড়ল। অমলা একদিন চুপিচুপি বলল,
“নবুদাদারে ভয় করে মা। হে ভাল মানুষ না। আকথা-কুকথা কয়—, আর—!”
“কী কইছে?”
“কয়, তরে ইলোপ কইরা নিমু ওই দ্যাশে। আর আইতে দিমু না। আর—,”
“আর কী?”
“গাল দাবাইয়া টিপ্যা ধরে, পিঠে হাত বুলায়। কয় কী নরম, কী ভালা—!”
অমলার স্বর ক্ষীণ, চোখে জল। জেনেশুনে আগুন হয়েছিলেন তারাসুন্দরী।
পরের বার নবকুমার যখন এল, দরজা থেকে বের করে দিলেন,
“শুন নবু, অমু তুমার বুইন। বয়সে অনেক ছুটো। হেই মুইল্য রাখবার
না পার, আমগ দুয়ারে জীবনে পা রাইখ্য না। বাইরাইয়া যাও। তোমার খুড়ারে আমি কইয়া দিমু।”
গ্রামে ফিরে নবকুমার কী বলেছে জানতে পারেন নি। তবে আর কখনও আসেওনি।
এরপর দেশ থেকে সামান্য টাকা আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কড়া ভাষায় নানা অভিযোগ ও তারাসুন্দরীকে
দোষারোপ করে চিঠি লিখেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথের বড়দাদা।
ঘন মেঘ করেছে। বাইরে দড়িতে কাপড় মেলা। তারাসুন্দরীর শরীর ঠিক নেই, ম্যাজম্যাজ করছে। মাসিকের সময়টা তাঁর এরকম হয়। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন। পরপর ছ’টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। নিরঞ্জনের পরে আরও একবার প্রসব হয়েছিল, মৃত সন্তান। প্রায়ই বড়ো ভার বোধ হয়। মনে-প্রাণে চান প্রতিমাসের রক্তপাতের ঝঞ্ঝাট থেমে যাক। দু-একমাস বন্ধ থাকলে ভাবেন এবার বুঝি শেষ হল, বাঁচলেন। পরের মাসে এমন অতিরিক্ত হতে থাকে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। এখন পুরানো ছেঁড়া কাপড় পাওয়াও সমস্যা। গোনাগুনতি শাড়ি তাঁর, অমলারও। কেচে-ধুয়ে মাড় দিয়ে যত্ন করে রাখেন, যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয়। তিনি পরিপাটি গোছানো হিসেবি মানুষ। পায়ের তলা শক্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন। তারাসুন্দরী সাবধানে উঠলেন। মাথা ঘোরাচ্ছে অল্প অল্প। ধীরেন্দ্রনাথ ঘুমোচ্ছেন। অমলা হয়ত বই মুখে করে শুয়ে আছে বা গভীর ঘুমে। বেশ রাগ হল, পরক্ষণেই মায়া হল। ক-দিন পর চলেই যাবে। বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। তিনি দরজা খুলে উঠোনে পা রাখলেন। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির সঙ্গে পাগলা হাওয়া। শাড়ি-কাপড়, গাছের ডাল সব দুলছে। আকাশে একবস্তা ছাইরঙের মেঘ। চোখের পলকে মেঘটা ফেটে গেল। তাঁর চোখের সামনে পাঁচিলঘেরা হলুদরঙের দালান বাড়ি। তাঁদের শহরের সেই বাড়িখানা! বাগানের কামিনীফুলের ঝাড় থেকে সুগন্ধ আসছে। বাদল বাতাসে দুলছে ফুলফল, গাছগাছালি। বাঁধানো উঠানের তারে আধভেজা কাপড় মেলা। তিনি ছুটে গেলেন তুলে আনতে। তাড়াহুড়োতে হোঁচট খেলেন, পায়ের আঙুলে খুব জোরে লাগল। ব্যথায় জল এল চোখে। তখুনি দু’হাত ধরে সামলে নিল কে যেন। তাকিয়ে দেখেন কুমু, কমলা। ছিপছিপে চেহারায় সবুজ-লাল ডোরাকাটা শাড়ি। কুমুর খুব প্রিয় ছিল শাড়িটা। মাথায় আলগা খোঁপা। সস্নেহে বলল,
“সাবধান মা! পইরা যাইও না।”
“কুমু, তুই?”
শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। তালগোল পাকিয়ে গেল বাস্তব। বন্ধ চোখে
দু-হাত ছড়িয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন। আবার কেউ শক্ত করে জড়িয়ে
ধরল তাঁকে। শঙ্কিত গলায় বলল,
“ও মা, মা! কী হল?”
চোখ না খুলে বুঝলেন নিরঞ্জন, তাঁর ছোটো ছেলে। শক্তপোক্ত দীর্ঘকায়
তরুণ। নিজের মাথাটি ছেলের বুকের ওপর রেখে ভারী আরামবোধ হল। ছেলেমেয়েরা বড়ো হওয়ার পর
এমন গায়ে লাগিয়ে কখনও আদর করেননি তিনি। ছিল সেই একজন, মনু। এসে ‘মা-মা’ করে জড়িয়ে ধরত। চোখের জল
ছেলের জামায় না মুছে সরে গিয়ে নিজের আঁচলে মুছলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বললেন,
“কিছু না। মাথাডা ঘুরাল দিছিল। তুই আইজ অসময়ে আইলি? কী অইছে?”
“ভালো খবর দিমু মা। আমার চাকরি পাকা হইছে। কাল থেকে ট্রেনিং হবে
সাতদিনের। মালিক কই জানি পাঠাইব।”
সেদিন সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়ে শেফালী বলেছিল,
“অমলারে য্যান এই বইয়ের নায়িকার মতো দ্যাখায়! না ছোড়দিদি?”
“হ—ঠিকই। হাসি দিছে এক্কেরে ওই রকমই! দাতগুলা ধপধইপ্যা, সমান! কী
দিয়া মাজস রে?”
“ধ্যাৎ কী কও যে তোমরা।”
খুব লজ্জা পেয়েছিল অমলা। অথচ তারপর থেকে কথাটা মাথায় গেঁথে গেছে।
পথে ইদানিং বেরোনো হয় কমই। তবু বেরোলে তার চোখ ওই সিনেমার পোস্টার খুঁজে বেড়ায়।
রেজাল্ট বেরোনোর আগেই কয়েক জায়গা থেকে অমলার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে।
তারাসুন্দরী উদ্যোগ নিয়েছেন বেশী। পাত্রপক্ষের কাছে মেয়ের ফোটো পাঠিয়েছেন। কালীঘাট
মন্দিরের পাণ্ডা ভোলা-ঠাকুর ঘটকালিও করে। অমলার বিয়ে হয়ে গেলে তিনি বড়ো ছেলের বিয়ে
দিতে চান। মধুসূদন চিত্তরঞ্জনে থাকে। লোকোমোটিভে চাকরি। খুবই পরিশ্রম, খাওয়াদাওয়ার
অসুবিধাও আছে। এতদিনে ছোটো কোয়ার্টার পেয়েছে সেখানে। বউ নিয়ে গেলে যত্ন-আত্মি করতে
পারবে। কথাটা ছেলের কানে দু-চারবার তুলে বুঝেছেন, এখন তার বিশেষ মত নেই। ‘মত না থাকা’ খানিক চিন্তিত করলেও একটা
চোরা-স্বস্তিও যে আছে অস্বীকার করতে পারেন না। এযুগের ছেলে, বিয়ে হলেই পর। তাঁর এক
দিদি বলতেন, ‘মাইয়ারে দেই জামাইর হাতে, পোলারে দেই বৌ-র হাতে’! মধুসূদন তাঁদের ভালো ছেলে।
শ্রদ্ধাভক্তি করে, ভাইবোনদের জন্য মায়া আছে। বিয়ে হলে কতটা থাকবে কে জানে? অমলার বিয়ের
জন্য তারাসুন্দরীর তাড়া থাকলেও ধীরেন্দ্রনাথের সম্মতি ছিল না। চেয়েছিলেন বি-এ পাশ করুক,
তারপর দেখা যাবে। মেয়ের রেজাল্ট দেখে দমে গিয়েছেন। মুখে না বললেও স্ত্রীর ইচ্ছাতে আপত্তি
করেন নি। তারাসুন্দরী বুঝিয়েছেন,
“ভাল ঘর-বরে দিমু। তারা অমুরে যত্নে থুইব।”
“পড়া বন্ধ দিয়া ভাল ঘরে দিছিলা না—?”
“দিছিলাম। তাই ভালা আছিল না, কইয়েন না। তাইর ভাগ্য যদি--!”
তারাসুন্দরী দীর্ঘশ্বাস চাপেন। সাত-আটবছর পর যন্ত্রণার সেই তীব্রতা
আর নেই। যন্ত্রণার স্মৃতি আছে ক্ষতের হালকা হয়ে-যাওয়া দাগের মতো। ধীরেন্দ্রনাথ নিজের
হাতের পাতার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন,
“দ্যাশভাগ—! একখান প্রহসন—! ফার্স—! পুরা দ্যাশ ভাগ হইল কই? ভাগ করল আমগ, বাঙ্গালিগ! উফ উফ—।”
মনে পড়ে পনেরো বছর পিছিয়ে আলোময় দিনটি যেদিন কমলার বিয়ে হয়েছিল।
শহরের বুকে তাঁদের বাগানঘেরা হলুদরঙা নিজস্ব দালানবাড়ি। শিক্ষক হিসাবে শহরে তাঁর খ্যাতি
যথেষ্ট। পাত্র মুরারীমোহন শিক্ষিত, সুপুরুষ, উপযুক্ত। কলকাতার কলেজ থেকে বি-এস-সি পাশ
দিয়ে শান্তিপুরে পৈতৃক ব্যবসাতে নিযুক্ত। পালটিঘর, অর্থবান পরিবার। কমলা সবে কলেজে
ভর্তি হয়েছে। একেবারে মত ছিল না ধীরেন্দ্রনাথের। বলেছিলেন,
“বিদুষী মাইয়া আমার। বি-এ পাশ দিয়া পরিবারের মুখজ্জ্বল করব—।”
“আমাদের বাড়ির বড়বৌমা, রাণির মতো থাকবে।”
না-ছোড় ছিলেন মুরারীর অভিভাবকরা। তারাসুন্দরী জোর দিয়ে ধীরেন্দ্রনাথকে
বলেছিলেন,
“দ্বিমত কইরেন না। এমুন সম্মন্ধ সাইধ্যা আইছে। তাই সুখী অইব।”
মুরারীমোহন তাঁকে প্রণাম করে বলেছিল,
“আপনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি।”
“তমাগ অবস্থাপন্ন ঘর, ধনীগৃহ। আমি অতি সাধারণ ইস্কুলমাস্টার—। কুমু আমার মা-লক্ষ্মী।
তারে দেইখ।”
“চিন্তা করবেন না। আপনার কন্যা আমাদের বাড়িতে সম্মান আর মর্যাদা
নিয়ে সারাজীবন থাকবে।”
চোখের জল চেপে তিনি কন্যা-জামাতাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। অমলা
তাঁর প্রাণ, কিম্বা প্রাণের চেয়েও বেশী।
বিয়ের ক-বছর পরও সন্তান এল না কমলার। বুদ্ধিমতী মেয়ে, গভীর আত্মমর্যাদা। বাবার বাড়িতে এসে বেশী থাকতে চাইত না। তারাসুন্দরী জিজ্ঞেস করলে হাসত। বলত,
“ভাইব্য না মা, আমি ভাল আছি। খুবই ভাল আছি।”
দেশের পরিস্থিতি খানিক টালমাটাল। খবরের কাগজে কিছু কিছু খবর
আসে। দেশীয় নেতাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভোগদখল নিয়ে দর-কষাকষি।
ধীরেন্দ্রনাথের মতো সচেতন মানুষেরা উদ্বিগ্ন। আলোচনা হয়, তর্কাতর্কি। আবার শান্ত হয়ে
সমাধান করেন, ‘দুর্যোগের ম্যাঘ অ্যাকখান আইছে, কাইট্যা যাইব।’
কমলার বিয়ের বছর না ঘুরতেই পৃথিবীর শক্তিধর দেশেরা মেতে উঠল
যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে ধীরেন্দ্রনাথের, গায়ে কাঁটা দেয়। যুদ্ধের
মধ্যেই গান্ধীজী নামলেন বৃটিশ তাড়ানোর দেশজোড়া আন্দোলনে। যুদ্ধের কারণে বঙ্গদেশে খাদ্যের
অনটন শুরু হয়েছিল আগেই। পরের বছর হল ভয়ানক আকাল। মনোরঞ্জন সেবারই ইন্টারমিডিয়েট পাশ
করল, ফল অত্যন্ত ভালো। বলল,
“বাবা আপনের মত হইলে আমি কলিকাতার কালেজে অ্যাডমিশন নিমু।”
এই ছেলেটিকে নিয়ে চাপা গর্ব ধীরেন্দ্রনাথের শুধু মেধাবী ও প্রাণবন্তই
নয়, মনোরঞ্জনের চোখে অন্যরকম আলো। সংবেদী, উজ্জ্বল, গভীর দীপ্তি। ধীরেন্দ্রনাথ চিন্তিতভাবে
বললেন,
“যাইবা ত! কিন্তু—, মধু এই জাগাতেই পরতাছে।”
“কত বড় শহর বাবা। বড় বড় নেতারা আসেন। দুইডা বছর মোটে। পাশ দিয়া
আইয়া পড়মু। এইহানেই পড়মু ইউনিভার্সিটিতে—।”
“পরিস্থিতি যে ভালা না মনু! থাকবা কোথায়? খাইবা ক্যামনে?”
বললেন বটে, কিন্তু বাধা দিলেন না। মনে বুঝলেন ছেলে নিজের ভবিষ্যতের
ছক কষে নিয়েছে। ক-মাস আগে চাল আনতে দুই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের দেশের বাড়ি। খবর
পেয়েছেন চালের বস্তা দেখলেই লুঠতরাজ করছে ক্ষুধার্তরা। ট্রেন, গোরুর গাড়ি, নৌকা কিছুই
নিরাপদ নয়। মধু ভয় পাচ্ছিল। মনু সাহস দিল,
“ভয় নাই দাদা, আমি আছি পাশে।”
অনেক পরে মধু জানিয়েছিল, লুকিয়ে সঙ্গে ভোজালি রাখত মনু। বাড়িতে
কাউকে বলেনি।
কলকাতা পৌঁছে দিনরাতের ঘটনা লিখে চিঠি পাঠাত। ভয়াবহ অবস্থা!
গণ্ডগ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল। খাবার আশায় এসে রাস্তায় পড়ে মরে থাকছে কঙ্কালসার
মানুষ। এইসব খবর আর ছবি তখন খবরের কাগজে পৃষ্ঠাতেও। যারা সচ্ছল, তাদের বাড়ি ঘিরে অসংখ্য
বুভুক্ষুর আর্তনাদ। অর্থ আর সমাজের ভারসাম্য তছনছ করে একদিন পৃথিবীর শক্তিধরদের ক্ষমতা
প্রদর্শনের যুদ্ধ থামল। কিন্তু ওই ছ-টি বছর ঝাঁঝরা করেছে ঔপনিবেশিক ও শোষিত দেশগুলোকে।
দিন কাটছিল।
বিয়ের আটবছর পর কমলার গর্ভসংবাদের চিঠি এল তারাসুন্দরীর কাছে।
মুরারী লিখেছে,
“কমলাকে লইয়া কলকাতা আসিতেছি। ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নিকটে বাড়িভাড়া
করিয়াছি। আপনারা আসিয়া কয়মাস থাকিলে আপনার কন্যার সুবিধা হইত। ডাক্তার বলিয়াছেন, বেশ
কিছু জটিলতা আছে। কমপ্লিট রেস্ট আবশ্যক।”
ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলেন ধীরেন্দ্রনাথ। স্কুলে তিনমাসের ছুটির
আবেদন করলেন। কিন্তু তাঁরা একসঙ্গে গেলে সংসার সামলায় কে? অমলা, নিরঞ্জন, স্কুলে যায়।
মনোরঞ্জন গ্র্যাজুয়েট হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। মধুসূদন সদ্য চাকরি পেয়ে কলকাতায় গেছে। চকিতে
সমতরঙ্গ খেলে গেল স্বামী-স্ত্রীর চিন্তায়। তারাসুন্দরী বললেন,
“আমার মন লয় রমু পারব। বিয়া দিলে শ্বশুরঘর করত না? কুমু সংসার
করতাছে না? নিরুরে আমগ লগে লই। হে ছুটো, ফিরা আইয়া ইশকুল যাইব’নে।”
সায় দেওয়া ধীরেন্দ্রনাথের ছাড়া উপায় ছিল না। রমলা নিঃশব্দ। কমলার
চেয়ে আড়াইবছরের ছোটো। বিয়ের আগে দিদির ছায়া ছিল। হয়ত সে কমলার চেয়েও সুন্দর, কিন্তু
খুঁতো। বাঁ-হাতটি কনুইয়ের নীচে বেশী বাড়েনি, জন্মগত ত্রুটি। সেখানে কয়েকটি আঙুলের মতো
আঁকশি। মেয়ে মা-কে ভরসা দিয়েছিল,
“চিন্তা কইর না মা, যাও। চিঠি দিবা।”
জুলাইয়ের শেষে প্রসব হওয়ার কথা। জুনমাসে কলকাতা গেলেন দু-জনে।
সমস্ত ওলট-পালট হয়ে গেল। আর ফেরা হল না।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন