![]() |
কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৭ |
বন্ধন
অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়ে সবে বসতে যাবে, একটা বাচ্চার গলাফাটা কান্না শুনে চমকে উঠলো অমিতা। আমার একার ঘরে বাচ্চার কান্না! দরজা খুলতে সামনেই কাপড় জড়ানো একটা সদ্যোজাত মানুষের বাচ্চা দেখে অবাক। শীতে নীল হয়ে যাওয়া বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে ঘরে এনে কম্বলে মুড়ে বিছানায় রেখে সেঁক-তাপ দিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতেই সে আবার কেঁদে উঠলো। কোনদিন বাচ্চার মনোবিজ্ঞান না জানা অমিতাও বুঝতে পারলো, এটা বাচ্চাটার ক্ষিধের কান্না। কী করবে এখন সে! বুদ্ধি করে একচামচ মধু এনে একটু একটু করে জিভে দিয়ে ওর কান্না থামায়। সারারাত বুকের ওমে উষ্ণতা দিয়ে বাঁচায় ওকে।
শিশুটিকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে ওর সাথে অপ্রতিরোধ্য এক আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গেছে অমিতার এক রাত্তিরের মধ্যেই। একা মানুষ অমিতা সান্যাল ভাবে একেই কি বলে মাতৃত্ব! মা না হয়েও!
ব্যাঙ্কের চাকরির সুবাদে মাসখানেক হল একটা প্রমোশন পেয়ে ম্যানেজারের পদে কলকাতা থেকে দার্জিলিঙে পোস্টিং অমিতার। এখানে আসার দিনকয়েক পরেই এরকম একটা চমক! নিজেকে দেখে ভাবছে ওর একা জীবন কি ভেতরে ভেতরে এতখানি তৃষ্ণার্ত ছিল!
সারাদিনের কাজের মেয়ে মিনতির কাছে বাচ্চাকে রেখে ল্যাক্টোজেন, দুধের বোতল, রাবারক্লথ, তোয়ালে, ন্যাপি বালিশ, পাশবালিশ, বাচ্চার যাবতীয় দরকারি জিনিষ কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অমিতা। তারপর লম্বা মেডিকেল লিভের আবেদন করে মেইল পাঠিয়ে দেয় অফিসে। এখন অফিসের কথা ভাবতেই পারছে না সে। মিনতিও খুব খুশি বাচ্চা নিয়ে। মিনতি আর অমিতার পরিচর্যায় মেয়ে বেড়ে উঠছে। আর ভেতর ভেতর পূর্ণ হয়ে উঠছে অমিতা ও মিনতি দুজনেই। বাইরের দুনিয়ার সাথে আর যেন সম্পর্ক নেই ওদের! মেয়ের নাম রেখেছে অনিরুদ্ধা।
অফিস জয়েন করেও অমিতার মনটা পড়ে থাকে সারাদিন মিনতির তত্মাবধানে থাকা ছোট্ট অনিরুদ্ধার কাছে। তার মতো এতখানি বাস্তব দূনিয়াদারী দেখা মেয়েও মাতৃত্বের বন্ধনের কাছে হার মেনে বাঁধা পড়ে যায় ভেবে ক্ষণে ক্ষণে আশ্চর্য হয় অমিতা।
এইভাবে যখন সে ভেতর ভেতর ভীষণভাবে মা হয়ে উঠছে, এমনই এক ভোর সকালে বাচ্চাটার অনুতাপদগ্ধ আসল মা এসে অমিতার কাছে কান্নাকাটি করে বাচ্চা ফেরত চায়। অমিতা শাসন করে নিজেকে। কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে পারে না বাচ্চাকে। ভেতর ভেতর দগ্ধ হতে হতে বলে, কী করে বুঝবো তুমি ওর আসল মা? প্রমাণ দিতে না পেরে দাবিদার খালিহাতে ফিরে যায়।
এদিকে মিনতি ভাবে, আমি এই বাচ্চাকে নাওয়াতে-খাওয়াতে-সাজাতে-তেল মালিশ করতে করতে প্রতিদিন যে আরও বেশী করে ওর মা হয়ে উঠছি! এ তো আমারই মেয়ে!
এইভাবে কেউ নিজের জনকে ফেলে যায়,
কেউ কুড়িয়ে নিয়ে আপন করে নেয়। এক মায়ের সন্তান এখন তিন মা পেয়েছে। দুনিয়া বড় আজব কারখানা!
সেদিনই অমিতা অফিস যাওয়ার পর, আরেক
মা মিনতি বাচ্চা অনিকে বুকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন