![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
হারানো চশমার খোঁজে
অনিমেষবাবু একসময় স্কুলে চাকরি করতেন। বাংলার শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের মুখে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো গভীর শ্রদ্ধা ও একটু ভয়ের সঙ্গে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে যে মানুষটি প্রতিদিন সকালে কাঁধে ঝোলাব্যাগ আর হাতে লাঠি নিয়ে স্কুলের পথে হাঁটতেন, যাঁর কণ্ঠে ‘বিদ্যাসাগরের ভাষা’ বলে পরিচিত তীক্ষ্ণ শব্দের প্রবাহ ছিল, সে মানুষটি আজ অবসরপ্রাপ্ত। সেই শব্দ নেই, সেই গন্তব্যপথও নেই। তবুও ভোরবেলার ঘুমটা ঠিক পাঁচটায় ভেঙে যায়, যেন স্কুলের ঘণ্টা এখনও বাজছে দূরে কোথাও। সেই মুহূর্তে, প্রতিদিনের মতোই, চোখ চলে যায় বুকশেলফের উপর রাখা সেই পুরনো চশমার খোঁজে, যার ভেতর দিয়ে তিনি একসময় পাঠ্যবইয়ের অক্ষরের গভীরতা দেখেছেন, শিক্ষার্থীদের চোখে অনিশ্চয়তা পড়ে ফেলেছেন, এবং দুপুরের ক্লান্ত আলোয় চিঠি লিখেছেন নিজের স্ত্রীকে। এখন সে চশমা যেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী, জীবনের অভ্যাস, স্মৃতির ভার আর বর্তমানের একাকীত্বকে একসূত্রে বেঁধে রাখা এক নীরব বাহক। স্ত্রী নেই বহুদিন, মরণ তো হঠাৎ করেই এসে নিয়ে যায় প্রিয়তমকে। আর ছেলেমেয়েরা? তারা এখন নিজস্ব পৃথিবীর অধিবাসী — বিদেশে, ভীষণ ব্যস্ত। বছরে একবার ফোনে শুভেচ্ছাবার্তা আসে — শব্দগুলো ঠিক থাকে, কিন্তু শব্দের আড়ালে থাকে না আর সেই আবেগ। এই একাকীত্বের মধ্যে হঠাৎ একদিন সকালে, চায়ের কাপে ভেসে থাকা দুধের রেখা দেখে যেন মনের মধ্যে এক ঢেউ উঠে এল — ‘চলো দীঘা যাই। একা’। দীঘা — যেখানে একসময় স্ত্রীর হাত ধরে প্রথম বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ছেলে সদ্য হাঁটতে শিখেছে। সেই ছবিগুলো আজও তাঁর মানিব্যাগে পুরনো হয়ে থাকা রঙছোপে ধরা আছে। এই সফর হবে না নিছক ভ্রমণ। এটা হবে নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর প্রয়াস, পুরনো স্মৃতির ছায়ায় বসে বর্তমানের রোদটাকে ভালোবাসার চেষ্টা। পেনশনের টাকায় শরীর আর মন দুইকে একটু ভালো রাখার প্রয়াস — শরীরকে সামুদ্রিক বাতাস, আর মনকে পুরনো জীবনের ঢেউয়ে প্লাবিত করা। ট্রেন ছাড়ে সকাল সাড়ে ছ’টায়। অন্ধকার ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, জানলার বাইরে দূরের গাছেরা যেন ঘুমচোখে তাকিয়ে আছে। অনিমেষবাবু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো পকেট হাতড়ান, ব্যাগের চেন খুলে দেখে নেন টিকিট, ওষুধ, মানিব্যাগ, মোবাইল সব ঠিকঠাক। তবে চশমাটা পকেটে না রেখে বরং চোখেই পরলেন। নাকের উপর বসিয়ে একটু ঠিকঠাক করে নিলেন, যেন চোখের সঙ্গে মনটাকেও শান দেওয়া যায়। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে হালকা রোমাঞ্চ লাগে। বয়স যতই হোক, ট্রেনযাত্রা যেন অন্তরের কোথাও এক চিরন্তন গতি জাগিয়ে তোলে। জানালার পাশে বসে তিনি নদী, মাঠ, গরুর পাল, জলকাদা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে চলে যাওয়া সেই চিরচেনা বাংলার মুখখানি দেখতে থাকেন। মাঝে একবার ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে খান, পাশে বসা এক কিশোরকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় নিজের নাতির কথা। দীঘায় পৌঁছে, ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই যেন আচমকা বাস্তবের ঠোক্কর। চোখে হঠাৎ ঝাপসা। তিনি দাঁড়িয়েই পড়েন, হাত চলে যায় নাকের উপর, তারপর পকেটে, তারপর ব্যাগে। নেই! চশমা নেই। কপালে ভাঁজ পড়ে, “আমি কি ট্রেনেই রেখে এলাম? নাকি নামার সময় পড়ে গেল কোথাও?” একবার মনে হলো, হয়তো ঠিকমতো পরেননি, হুড়োহুড়িতে খসে পড়ে গেছে। আবার ভাবলেন — “তবে কি সিটে ফেলে এসেছি? কিন্তু তো মনে পড়ছে, ছিল তো চোখেই!”এই ছিল না-ছিল-এর ধোঁয়াশায় দাঁড়িয়ে যেন হঠাৎ তাঁর চারপাশের সব দৃশ্য মেঘে ঢেকে গেল। দীঘার উজ্জ্বল রোদে চোখ কুঁচকে আসে, আর মনটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে — চশমা শুধু দেখার যন্ত্র নয়, এই বয়সে সেটা যেন জীবনের মহাকাশ। জীবনের অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে - সময়, সম্পর্ক, স্বজন… তবু সবকিছুর মধ্যেই নিজেকে ধরে রাখার একটা উপায় ছিল এই চশমার ফ্রেম। সে-ই যদি না থাকে! অদ্ভুতভাবে, তাঁর দীঘা ভ্রমণ শুরু হলো চশমা হারানোর মধ্য দিয়ে — দৃশ্যের নয়, যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অনিশ্চিত অভিযানে পা রাখলেন অনিমেষবাবু। হোটেলে পৌঁছেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা উদ্বিগ্ন। প্রথমেই ব্যাগটা বিছানায় রেখে খুললেন। একে একে জামা, তোয়ালে, চটি, ওষুধের পাতা, ছাতার বাঁট সব বের করে বিছানায় বিছিয়ে দিলেন। তারপর ব্যাগটা উলটে ঝাঁকিয়ে দিলেন — নেই। বুকের ভেতর যেন ধীরে-ধীরে দুশ্চিন্তার হাওয়া ছড়াতে লাগল। পকেটগুলো আরেকবার হাতড়ালেন — প্যান্টের সামনের পকেট, পেছনের পকেট, শার্টের বোতামের কাছে থাকা ছোট পকেট — সেখানে কেবল একটা ভাঁজ করা রসিদ আর একটুকরো মিন্ট ক্যান্ডি। চশমার কোনো চিহ্ন নেই। একটা অস্থিরতা যেন চেপে ধরল বুকে। মনে পড়ল, কত কিছুই তো ওই চশমার উপর নির্ভর করে — সকালের কাগজ পড়া, সাইন করা, মোবাইলের স্ক্রিন দেখা, পথঘাট চিনে নেওয়া… এমনকি খাবারের রেসিপিও তো এখন মোবাইল দেখে নিতে হয়। এই বয়সে চোখ আর মন দুটোই কমজোর, কিন্তু চশমাটা থাকলে অন্তত দৃষ্টিটুকু স্পষ্ট থাকে। হঠাৎ করে যেন নিজেকে খুব একা, অক্ষম মনে হলো। এই অচেনা শহরে, নিজের মতো করে সময় কাটাতে এসেও একটিবারের জন্য নিজের অগোচরে একটা অতি প্রয়োজনীয় জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন। এমনটা আগে হতো না। বয়স হচ্ছে — এই উপলব্ধিটা কেমন যেন কাঁটার মতো বিঁধে গেল। তবুও, এক দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দীঘার দিগন্তরেখা—নীল জলরাশি আর হালকা সোনালি রোদ মিশে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি হয়েছে। নিজেকে ধীরে-ধীরে বোঝাতে লাগলেন— “হারিয়ে গেলে গেছে, সেটা ধরে বসে থাকলে চলবে না। এখন অন্তত চোখকে একটু জলের দিকে ফেরাও। সবকিছু তো চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়েও দেখা যায়। তার অনুশীলনটাই দরকার আজ।” এ কথাটা মনে পড়তেই যেন অস্থিরতা একটু হালকা হলো। তাঁর মধ্যে কোথাও এক ঝলক রোদ উঠতে শুরু করল, যার আলোতে চশমাহীন চোখও বুঝতে পারল, এই ভ্রমণটা হয়তো নতুন দৃষ্টিতে দেখারই সুযোগ। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ধীরে-ধীরে হাঁটছিলেন অনিমেষবাবু। বালিতে তাঁর জুতোবিহীন পায়ের চিহ্ন পড়ছে, আবার পরক্ষণেই তা মুছে দিচ্ছে ঢেউ। মাথার পাকা চুলগুলো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, সূর্যের হালকা আলোয় সেগুলো যেন সোনালি বর্ণে দীপ্ত। চোখ কিছুটা ঝাপসা — চশমার অভাব বুঝিয়ে দিচ্ছে বারবার। তবু তিনি থামলেন না। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি যতই অস্পষ্ট হোক, শ্রবণেন্দ্রিয় যেন আগের চেয়েও প্রখর। ঢেউয়ের গর্জন যেন প্রকৃতির কোনো সংকেত বয়ে আনছে, একেবারে অন্তরের গভীরে গিয়ে ধরা দিচ্ছে তার ছন্দ। কোথাও শিশুর হেসে ওঠা, কোথাও বাদামওয়ালার হেঁকে ওঠা — "বাদাম! ভাজা বাদাম!" এইসব শব্দ যেন বহুদিন বাদে কানে আসা কোনো প্রাণের সঙ্গীত। এক কোণে এক কিশোর তার ছোট বোনকে হাত ধরে টেনে বসাল বালিতে। কিশোরটির কণ্ঠে উৎসাহ — “এইখানে বসে থাকলে পুরো সূর্যাস্ত দেখা যাবে।” অনিমেষবাবু একটু থেমে গেলেন। সেই কিশোরদুটিকে দেখে মনে হলো নিজের ছেলেমেয়েদের অনেক ছোটোবেলার কথা। সেও তো এমনভাবেই তাদের নিয়ে সমুদ্রে এসেছিলেন একসময়। তখন স্ত্রী ছিলেন পাশে — চোখে রোদচশমা, হাতে ছোটদের স্ন্যাক্স ভর্তি থলে, ঠোঁটে একরাশ মৃদু হাসি। তারপর তিনি নিজেই একটু হেসে ফেললেন — একটা নীরব, হালকা হাসি।
‘বসা’ শব্দটা যেন আজকাল শুধু তাঁর
সঙ্গেই মানানসই। এখন আর ছুটে বেড়ানোর বয়স নেই, এখন তাঁর কাজ শুধু বসে থাকা, দেখা,
আর মনে রাখা। কিন্তু আজকের সেই বসে থাকা শুধু শরীরের বিশ্রাম নয়, এ যেন এক আত্মবিশ্রাম
— একটা জীবনের পাশে বসে থাকা। তাঁর মনে হলো, জীবনটা অনেকটা এই সমুদ্রের মতোই — বারবার
আসে, ছুঁয়ে যায়, আবার সরে যায়। কিন্তু কিছু স্মৃতি ঠিক আঙুলের ফাঁকে লেগে থাকে,
যেমন এই ঢেউয়ের জল। চোখের অস্পষ্টতায় ভেসে ওঠা সূর্যের আলোর রেখাগুলো আজ যেন নতুন
করে উপলব্ধি করিয়ে দিল — দেখা শুধু চোখের কাজ নয়, তা মন দিয়েও হয়। সেই মনটাই আজ
অনেক স্পষ্ট, সংবেদনশীল। চশমার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন অনিমেষবাবু হোটেলের রিসেপশনে।
বুকের মধ্যে একটা চাপা অস্থিরতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই শহরে কোথায় কাছাকাছি চোখের
দোকান আছে?”
রিসেপশনিস্ট, এক সদ্য যুবক, কম্পিউটার
স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “সমুদ্র বাজারের দিকে একটা অপটিক্স আছে, ‘দৃষ্টি
অপটিক্যাল’। হেঁটে গেলে দশ-পনেরো মিনিট।” ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অনিমেষবাবু।
হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলেন, এই অচেনা শহরও ঠিক কতটা চেনা হয়ে যেতে পারে যদি মনের জানালাটা
একটু খোলা রাখা যায়। রাস্তার ধারে শামুক, ঝিনুক বিক্রি করা মেয়েটার কণ্ঠে একটা পরিচিত
ছন্দ; বাদামভাজা আর ডাবের গন্ধে যেন পুরনো কলেজ স্ট্রিটের দুপুরগুলো মনে পড়ে যায়। হঠাৎ
এক জায়গায় থেমে গেলেন — এক ফুচকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে তরুণ-তরুণীদের
ভিড়। লোভ সামলাতে পারলেন না। দাঁড়িয়ে বললেন, “ভাই, ছ’টা দাও, ঝাল একটু কম কোরো।” ফুচকার
জল মুখে পড়তেই চোখ জ্বলে উঠল। “উঃ মা, এ তো ঝালের আগুন!” চোখের কোণে জল এসে গেল। কিন্তু
তবুও মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাসি একা ফুচকার জন্য নয়, এমন এক মুহূর্তের জন্য যা বহুদিন
পর হঠাৎ জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে আনল। পাশেই দাঁড়ানো এক কলেজপড়ুয়া দম্পতি হেসে বলল,
“কাকু, ঝালটা একটু বেশি ছিল, না?” অনিমেষ হেসে বললেন, “চোখে জল এলেও মনটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এমন কাঁদা তো চাই-ই মাঝে মাঝে।” তাদের হাসির রোল যেন বাতাসে মিশে
একটা গরম, স্নিগ্ধ দুপুর গড়ে তুলল। সেই মুহূর্তে মনে হলো, বয়স কেবল শরীরের হিসেব।
প্রাণের কোনো বয়স হয় না। এবং জীবনের আসল চশমা হয়তো এইসব মুহূর্ত দিয়েই তৈরি হয় — ঝাল
ফুচকার জলে ধুয়ে ফেলা অতীত আর বর্তমানের মাঝামাঝি কোথাও। অপটিক্সের ভিতরে ঢুকতেই ঠাণ্ডা
এসির বাতাস গায়ে এসে লাগল, বাইরের গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে আসা শরীরটা একটু স্বস্তি পেল।
দেয়ালে সারি সারি ফ্রেম সাজানো — আধুনিক, রঙিন, দামি ও সস্তার মিশ্রণ। এককোণে দাঁড়িয়ে
থাকা দোকানদার ভদ্রলোকটি মাথা তুললেন। “হ্যাঁ বলুন, কী দরকার?” অনিমেষবাবু একটু ইতস্তত
করে বললেন, “একটা চশমা দরকার। আমার চশমাটা
ট্রেনে বা স্টেশনে হারিয়ে গেছে।” দোকানদার প্রশ্ন করলেন, “আপনার পাওয়ার জানা আছে?”
“প্রেসক্রিপশন বাড়িতে আছে, তবে মনে আছে মোটামুটি। চোখে মাইনাস দুই, সিলিন্ডার একটু
আছে... বয়স অনুযায়ী রিডিংও দরকার।” ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, “চোখ মেপে দেখি একবার। তাহলে
তৈরি করে দিতে পারব।” চোখ মাপার চশমায় মুখ
গুঁজে বসলেন অনিমেষবাবু। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে পরা সেই চশমার দোকানের কথা
মনে পড়ে গেল — একটা কাঠের বাক্স, তার মধ্যে নানা পাওয়ারের কাঁচ আর পিতলের ফ্রেম। এখন
কেমন ঝকঝকে, যন্ত্রের ভিতর দিয়েই চোখের ম্যাপ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে
একটা হালকা সস্তা ফ্রেমে কাঁচ বসানো হলো। কালো রঙের, পাতলা রিম — দেখতে সাধারণ, কিন্তু
চোখে তুলে নেওয়াটাই যেন এক আশ্চর্য মুহূর্ত হয়ে দাঁড়াল। চশমাটা চোখে পরতেই প্রথমে যেন
একটু ঝাপসা, তারপর ধীরে-ধীরে সব কিছু স্পষ্ট। বাইরের আলো যেন চোখের ভেতর ঢুকে গেল —
দোকানের কাচের জানালা দিয়ে রোদের রেখা, পাশের গাছের পাতার স্পষ্ট রেখা, আর রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যাওয়া মানুষজনের মুখ — সব যেন হঠাৎ করে ফিরে এলো। দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন ধীরে-ধীরে।
হাঁটতে হাঁটতে আবার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। এবার আর কেবল আলো নয়, দৃশ্য স্পষ্ ট— একটা
পাখি উড়ছে দূরে, তার ডানায় রোদ ঝলমল করছে। ঢেউয়ের ফেনা রুপোলি আলোয় চকচক করছে, দূরে
একটা বাচ্চা বালিতে দুর্গ বানাচ্ছে — সব স্পষ্ট, জীবন্ত। অনিমেষবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন
রাস্তার একপাশে। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন — একটা চাপা, অথচ গভীর হাসি নিয়ে,
যেন নিজের সাথেই কথা বলেন—
“দেখো দেখি! এই তো, আমি ফিরে এসেছি।”
সে ‘ফিরে আসা’ কেবল দৃষ্টির নয়,
এক অন্তর্দৃষ্টির। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস, হারিয়ে যাওয়া আত্মপরিচয় যেন আবার
ফিরে এলো এক টুকরো কাঁচের ভিতর দিয়ে। পরদিন সকালে ভোরের দীঘা যেন অন্য রকম। হাওয়ায়
একরকম শিশির-মাখা সতেজতা, আর বালির ওপর দিয়ে হাঁটার সময় পায়ের নিচে জমে থাকা ঠাণ্ডা
যেন হৃদয়ের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। অনিমেষবাবু হাঁটতে বেরোলেন, হাতে তাঁর নতুন চশমা, চোখে
সেই পুরনো অভ্যাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হঠাৎ, সমুদ্রের কাছাকাছি এক ফাঁকা রাস্তায় এক বৃদ্ধ
রিকশাচালক ধীরে-ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। কাঁধে ফাটা গামছা, মুখে সারাদিনের জমে থাকা ক্লান্তি, চোখে একধরনের শান্ত দীপ্তি।
“চশমাটা কি আপনার?” — রিকশাচালক প্রশ্ন করলেন। অনিমেষবাবু থমকে দাঁড়ালেন। “চশমা?”—বলেই
তাঁর বুকের মধ্যে যেন কেমন একটা বেদনার সুর বেজে উঠল। বৃদ্ধ তার ছেঁড়া পাঞ্জাবির পকেট
থেকে ধীরে-ধীরে বার করলেন একটি ধাতুর ফ্রেমের চশমা। একবারে পরিচিত! হ্যাঁ, এ তো তাঁর
সেই পুরনো চশমা, যেটি বহুদিনের সঙ্গী, জীবনের অনেক অধ্যায়ের নীরব সাক্ষী। বৃদ্ধ বললেন,
“কাল ট্রেন থেকে নামার সময় আপনার চশমাটা পড়ে গিয়েছিল। আমি আপনার পাশে বসে ছিলাম,
পরে নিচে পড়ে থাকতে দেখলাম। কুড়িয়ে নিয়ে ভাবছিলাম যদি কোনোদিন দেখা হয়... ছবিতে আপনাকে
চিনলাম, তাই আজ সকাল থেকেই রাস্তায় খুঁজছিলাম।” অনিমেষবাবুর চোখে জল এসে গেল। কথাগুলো
যেন শুধু সংলাপ নয়, একেবারে হৃদয়ের কোথাও গিয়ে বিঁধে গেল। একটি অচেনা শহর, এক অজানা
মানুষ, অথচ এতটুকু যত্ন, এতখানি মনুষ্যত্ব! তিনি ধীরে-ধীরে চশমাটা হাতে নিলেন — কোথাও
ভাঙেনি, সামান্য একটু আঁচড় লেগেছে, কিন্তু সেই পুরনো উষ্ণতা যেন এখনো লেগে আছে কাঁচে।
কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নাম কী?” বৃদ্ধ মাথা নামিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “সুকুমার।
নাম বড় কথা নয় বাবু, কাজটাই মুখ্য। সবকিছু হারালেও মানুষত্বটা এখনও বেঁচে আছে — এই
তো আমাদের বাঁচার স্বার্থকতা।” অনিমেষবাবু কিছু বললেন না। শুধু চশমাটা চোখে পরলেন আবার,
এবার তাঁর চোখ শুধু স্পষ্ট দেখল না — তাঁর হৃদয়ের মধ্যে এক নতুন আলো জ্বলে উঠল। সেদিন
তিনি বুঝলেন, একটি হারানো চশমা খুঁজতে এসে তিনি ফিরে পেয়েছেন বহু হারানো বিশ্বাস —
মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি, এবং নিজের প্রতি। চশমা ফেরত পেলেন ঠিকই। সযত্নে ভাঁজ
করা রুমালে জড়িয়ে ব্যাগের এককোণে রাখলেন সেটি — যেন পুরনো কোনো চিঠির মতো, যার স্মৃতি
অমূল্য, কিন্তু ব্যবহার করাটা আর আবশ্যিক নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন কিছু স্মৃতি
শুধু হৃদয়ে জমা রাখে, ব্যবহার করে না, তেমনি পুরনো চশমাটিও রয়ে গেল এক শ্রদ্ধার নিদর্শন
হয়ে। অথচ এবার আর সেটা নাকে তুলে রাখলেন না। নতুন চশমাটাই পরে থাকলেন — হালকা ফ্রেম,
নতুন কাঁচ, আর একরকম অচেনা স্বচ্ছতা। মনে হলো, এই নতুন চোখেই যেন জীবনের রঙ একটু বেশি
স্পষ্ট, একটু বেশি তাজা। কেমন যেন মনে হচ্ছিল, চোখের এই সামান্য পরিবর্তনের আড়ালে তাঁর
অন্তরের ভেতরেও যেন এক অদৃশ্য পালাবদল ঘটে গেছে। এই উপলব্ধিটাই যেন এই দীঘা ভ্রমণের
আসল প্রাপ্তি। পুরনো চশমার মধ্যে ছিল অভ্যস্ততা, নিয়মমাফিক দৃষ্টি, রুটিনবাঁধা জীবনের
নির্বিকার চেনা দৃশ্য। দিন গড়িয়ে দিন, বছর গড়িয়ে অবসর — সবই যেন একটা কাঁচের গণ্ডির
মধ্যে আটকে থাকা সূর্যাস্ত। কিন্তু এই নতুন কাঁচ, এই সামান্য চশমা, যেন এক অপূর্ব দৃশ্যের কাছে টেনে নিল — স্থায়ী
দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিল। একটা পাখির ডানার ক্ষণিক কম্পন জীবনের মধ্যে যে আলোড়ন তৈরি
করে, সূর্যাস্তের মধ্যে লাল-কমলার মিশেলে যে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে, এক শিশুর
হাসির মধ্যে যে আশ্চর্য সুর লুকিয়ে থাকে — সবকিছু যেন তিনি নতুন করে অনুভব করলেন। তিনি
বুঝলেন, চোখে দেখা আর হৃদয়ে বোঝার মধ্যে এক সমুদ্রপ্রমাণ ব্যবধান আছে। আর মানুষ যত
দিন কেবল দেখে, তত দিন হয়তো জীবন তাকে স্পর্শ করে না। কিন্তু যেদিন সে বোঝে, সেদিন
থেকে শুরু হয় তার প্রকৃত জীবন। এই উপলব্ধি নিয়েই তিনি ফিরলেন, চোখে নতুন চশমা, মনে
নতুন দৃষ্টি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন