প্রতিবেশী সাহিত্য
শ্রীলঙ্কার কবি চেরন রুদ্রমূর্থির কবিতা
(ভাষান্তর ও ভূমিকা: গৌরাঙ্গ মোহান্ত)
কবি
পরিচিতিঃ চেরন রুদ্রমূর্থি
তামিল ক্যানাডীয় অধ্যাপক, কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক যিনি কবিতার জগতে শুধুমাত্র চেরন
নামে নিজেকে প্রকাশ করেন। তামিল ভাষার এ অগ্রগণ্য কবি শ্রীলঙ্কার জাফনা অন্তর্ভুক্ত
সমুদ্র-তীরবর্তী আলাভেড্ডি গ্রামে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারিক
ঐতিহ্য আধুনিক তামিল সাহিত্যের রূপ ও রসে অভিষিক্ত। চেরনের পিতা 'মহাকবি' খ্যাত তি.
রুদ্রমূর্থি (১৯২৭-৭১) আধুনিক তামিল সাহিত্যের একজন পথিকৃৎ। গত শতকের সাতের দশকে চেরন
কবিতার পটচিত্র আঁকতে শুরু করেন; শ্রীলঙ্কার জাতিগত সংঘাত যখন গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতায়
পর্যবসিত তখন ১৯৭৭ সালে তাঁর প্রথম কবিতা 'The Sea' প্রকাশিত হয়। জীবনের অধিকাংশ সময়
ধরে তিনি শ্রীলঙ্কার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁর
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্য কবিতায় পল্লবিত হয়ে ওঠে। সহিংসতা, সামাজিক সংকটের পাশাপাশি
প্রেম, নিসর্গ-চেতনা, নির্বাসন ও ডায়াস্পোরিক অভিজ্ঞতা চেরনের কবিতায় অনন্য ব্যঞ্জনায়
স্ফুরিত হয়। সহিংসতার একটি দুর্বিষহ দৃশ্য চেরনকে প্রতিনিয়ত আচ্ছন্ন রাখে। সিংহলী পুলিশ
১ জুন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে জাফনার একটি বাজার এলাকাসহ একটি গণগ্রন্থাগারে অগ্নিসংযোগ
করে; কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসহ তামিল ভাষায় রচিত ৯৫০০০ সংখ্যক গ্রন্থ ভস্মীভূত হয়।
ভয়াবহ এ দহনদৃশ্য ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে লিখিত 'দ্বিতীয় সূর্যোদয়' (A Second Sunrise) এবং
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত 'মহাপ্রলয়' (Apocalypse) কবিতায় চিত্রিত হয়। 'মহাপ্রলয়' কবিতায়
চেরন তরুণ কবি শিবরমাণীর আত্মাহূতিকেও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন। তরুণী তাঁর সমস্ত
বই জ্বালিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে চরম প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। চেরনের
কবিতায় অগ্নির রূপকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ২০১০-এ রচিত 'অরণ্য-উজ্জ্বীবন'
(Forest-healing) কবিতায় অরণ্যের অগ্নিমান রূপ দৃশ্যমান হয়। শবদাহের তৃতীয় দিনে শাস্ত্রাচার
রূপে অরণ্য-উজ্জীবন বা 'কাদত্রু' পালিত হয়; অরণ্যের ভেতর অবস্থিত শ্মশানভূমিতে মৃতের
স্বজন উপস্থিত হয়ে অরণ্যের উজ্জীবনের জন্য দুগ্ধ সিঞ্চন করেন ও অন্যান্য খাদ্য নিবেদন
করেন। ১৯৯৪-এ প্রণীত 'শিশুরা' (Children) শ্লেষাত্মক হলেও এ কবিতায় অরণ্য থাকে অগ্নির
অধিকারে এবং পাখির দল উড়ে যায় আগুনের ভেতর।
চেরন ইতিহাসের নির্ভীক সাক্ষী হিসেবে কবিতায় তাঁর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেন। শ্রীলঙ্কায় তিনি বিপজ্জনক সাংবাদিক-জীবন অতিবাহিত করেন। আটের দশকে জাফনার ইংরেজি সাপ্তাহিক 'Saturday Review'-এর জন্য ঝুঁকি নিয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতার খবর প্রকাশিত হলে এ পত্রিকাটির দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসে।চেরন ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে 'Changing Formations: Tamil Nationalism and National Liberation in Sri Lanka and the Diaspora' শীর্ষক বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা পরিচালনার জন্য টরন্টোয় পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি উয়িন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান ও অপরাধতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপনার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন। তিনি তামিল ভাষায় ১৫টিরও বেশি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন এবং তাঁর রচনা ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। চেরন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ONV Kurup Foundation in Dubai থেকে আন্তর্জাতিক কবিতা পুরস্কার লাভ করেন। উল্লেখ্য যে চেরন তামিল ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম হয়ে থাকবার জন্য কেবলমাত্র তামিল ভাষায় কবিতাচর্চা করেন। Isabel Alonso-Breto কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকারে তিনি প্রকাশ করেন, 'Once I decided that Toronto is going to be the place I'm going to live in, even there is a large Tamil community here with whom I can speak in the language, I feel that to continue writing my poems in Tamil is the best way for me to keep organically linked to my heritage which was largely defined by the Tamil Language. I can write all kinds of texts in English but will write poetry only in Tamil in order to keep a more intimate connection to that language.'
চেরন সংস্কারবাদী কবি (radical poet) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। Aparna Halpé কর্তৃক গৃহীত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি কবিতার শক্তি সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন: 'Poetry can be a radical resistance to any kind of erasure, and epistemic violence... ' তাঁর কাব্যাবলি বিশেষ করে ১৯৮৩ -২০১৯ কালপরিসরে প্রকাশিত
Second
Sunrise (1983), Yaman: The Lord of Death (1984), We Live Amidst Death (edited
volume, 1985), Mirage (1986), At the Time of Burning (1988), The Procession of
Skeletons (1990), The River You Step in Now (2000), Return to the Sea (2005),
Healing the Forest (2010), Anjar: Trauma and Beyond (2019), এবং Thinai
Mayakkam: Overlapping Landscapes (2019) কবির সংস্কারবাদী চেতনার স্বাক্ষর বহন করে।
Forest-healing', 'Children', 'A Second Sunrise', 'Apocalypse' কবিতাচতুষ্টয় Lakshmi Holmström অনূদিত 'In a Time of Burning'(2013) এবং 'Death of a Day' কবিতাটি Chelva Kanaganayakam অনূদিত 'You Cannot Turn Away' (2011) কাব্য থেকে সংগৃহীত।
অরণ্য-উজ্জীবন
বহ্নিমান অরণ্যের সজীবতার জন্য
আমরা বেরিয়ে পড়ি
দৃষ্টিসীমার ভেতর কোনো পাখি নেই।
ওপরে শূন্য আকাশ
চড়ুইয়ের উড়ান-পথ
কেউ জানে না কীভাবে
দূর দিগন্তে প্রসার্যমাণ
ভস্মাবৃত ভূমিশূন্য দেশে
বিক্ষিপ্ত অস্থি সংগ্রহ করা যায়
তথাপি
আমরা এখন কী আর করতে পারি
যখন বহিরাগত মানুষজন
সঞ্জীবনী দুগ্ধ ঢালবার সময়
আমাদের প্রবহমান অশ্রুকে উপহাস
করে
উৎসবে মেতে ওঠে ও নাচে?
হৃদয়ের আগুন নেভানোর
এখন কিছুই নেই
কোনো সাক্ষী নেই
বিদ্যমান অশুষ্ক
রক্তফোঁটার
আমাদের জন্য নেই সমুদ্র কিংবা বাতাস
ভস্ম নিশ্চিহ্ন করবার
সমাপ্তি ঘোষণা করবার
এবং আমাদের চোখ ঢাকবার।
কখন হবে
অরণ্য-উজ্জীবন?
শিশুরা
শিশুদের কে সৃষ্টি করেছে,
জিজ্ঞাসা করলাম।
জানালা দিয়ে ঝিরঝির বাতাস
এসে বললো,
আমি নই
আমি শুধু তাদের কণ্ঠে দিই
সঙ্গীতের শক্ত স্নায়ু।
আলো বললো,
আমি তাদের চোখে দিই
গাঢ় রং।
রক্তকরবী বললো,
আমি হাসি নিয়ে
তাদের কোমল পা ছুঁই।
সমুদ্র বললো,
আমি ভালোবাসার সুতো দিয়ে
গেঁথে তুলি তাদের হৃদয়ের দেওয়াল।
অরণ্য বললো,
আমি তাদের হাসিতে
যুক্ত করি মোহিনীশক্তি।
তা যদি সত্যি হয়
কে তাদের হাতে তুলে দেয় বন্দুক
তাদের পায়ে সামরিক বুট
তাদের কোমরে গ্রেনেড
এবং তাদের চোখে ঘৃণা,
আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
বাতাস ও সমুদ্র ঠান্ডায় জমে গেছে;
আলো নিষ্প্রভ,
চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে
কাচের টুকরোর মতো।
বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানির ভেতর
পুষ্প ও অরণ্য ছিলো অগ্নিশিখার
অধিকারে
একটি বিশাল ঝাঁকে পাখিরা
উড়ে গিয়েছিলো আগুনের ভেতর।
শিশুরা,
আমাদের শিশুরা।
দ্বিতীয় সূর্যোদয়
কোনো বাতাস ছিলো না সেদিন;
এমনকি সমুদ্র ছিলো মৃত,
ছিলো না তরঙ্গের উত্থান।
আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম,
বালুর ভেতর পা নিমজ্জমান,
আমি অন্য সূর্যোদয় দেখি।
এবার দক্ষিণে।
কী ঘটেছিলো?
আমার শহর ভস্মীভূত হয়েছিলো,
আমার জনগোষ্ঠী হয়েছিলো পরিচয়হীন;
আমাদের জন্মভূমিতে,
বাতাসের ওপর যেখানে বাতাস বইতে
থাকে,
জেগে থাকে বহিরাগতের মোহর।
কার জন্যে অপেক্ষা করছো,
তোমার পেছনে হাত বাঁধা?
মেঘের ওপর
আগুন লিখেছে এর আখ্যান।
কে এখনও অপেক্ষমাণ?
রাজপথ থেকে এখনও
জেগে ওঠে অঙ্গার,
ওঠো, এগিয়ে যাও।
একটি দিনের মৃত্যু
রোজ
রাতের বেলা
যখন সকলে ঘুমিয়ে থাকে
কুকুর বন্ধ করে ঘেউ ঘেউ,
শুধু তারকারা একাকী থাকে
আকাশের সাথে
আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
জনাকীর্ণ রাজপথে
দৌড়াতে অক্ষম,
অজ্ঞাত বসার কৌশল,
হাঁপ-ধরা ও দুর্বল;
অর্ধেক রাতে
এমন স্বপ্ন,
আমি জেগে উঠি।
কখনো সাগর ও নদী হলুদ হয়ে ওঠে
এবং দৃশ্যমান হয়
নভেম্বরের ফুল;
আমি ভ্রমণের স্বপ্ন দেখি।
সকালে জেগে উঠি
আমার হাত থাকে এক জায়গায়
পা অন্যখানে,
এমনকি আমার মুখমণ্ডল
ইতস্তত ছড়ানো থাকে অন্য কোথাও।
আমি সেগুলো সংগ্রহ ও সংযুক্ত করি,
ঋজু হয়ে দাঁড়াই
এবং আমার দিন
তোমার কাছে বিক্রি করি।
মহাপ্রলয়
আমাদের নিজেদের সময়ে আমরা
মহাপ্রলয় দেখেছি। ধরিত্রী
কেঁপে উঠেছে মৃতের নৃত্যে;
শরীর সহসা বিদীর্ণ হয়েছিলো বন্য
ঝঞ্ঝায়;
সবকিছুর ভেতরে ও বাইরে আগুন লেগেছিলো
বলে
আতঙ্কে আর্তনাদ করেছিলো অন্ধকার।
সর্বশেষ বন্যা শিশু ও মানুষদের
টেনে এনেছিলো
এবং তাদের নিক্ষেপ করেছিলো অগ্নিশিখায়।
আমরা অসময়ে মৃত্যুবরণ করেছি।
আমাদের মুমুর্ষু চোখ দিয়ে চারপাশের
মানুষজনের অসহায়ত্বের প্রতি তীর্যকভাবে
কটাক্ষ করে, অনন্যদর্শী হয়ে, ধিকিধিকি
জ্বলতে জ্বলতে
আমরা ধূম্র-মেঘের ভেতর উঠে গিয়েছি।
নিজের কর্মাবলিকে ভস্মীভূত করার
জন্য
কাফকাকে সুযোগ প্রদান করা হয়নি।
কিন্তু শিবরমাণী তার কর্মাবলিকে
জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
কবিতা মধ্য-বাতাসে ধ্বংস হয়।
অন্যেরা এখন যা লিখছেন
অস্তিত্ব রক্ষায় অস্বীকৃতি জানায়।
আমরা সবাই ছেড়ে গিয়েছি;
আমাদের ইতিবৃত্ত বলবার একজনও নেই।
এখন শুধু থেকে যাচ্ছে পরিত্যক্ত
একটি দেশ; ক্ষতবিক্ষত ।
আমরা যতক্ষণ না ফিরে আসি
এখানে হয়তো আর কোনো পাখিও উড়বে
না।
খুব ভালো অনুবাদ। পড়ে অনেক শান্তি
উত্তরমুছুনআপনার ইতিবাচক মূল্যায়নের জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাই প্রিয় কবি। আনন্দে থাকুন।
উত্তরমুছুনগৌরাঙ্গ মোহান্ত
সমসাময়িক কবিতা। আর অনুবাদ হল দ্বিতীয় কবির কবিতা। ভালো লেগেছে
উত্তরমুছুন