![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
সময়ের বিদ্রোহ
শিউপুর শহরটা পুরনো। সেই প্রাচীনত্ব বোঝাতে এখানকার বাসিন্দারা যে সব ঐতিহাসিক জায়গা বা জিনিসকে প্রমাণ হিসেবে তুলে আনে, শহরের ঘন্টামিনার তার মধ্যে সবচেয়ে নামী অবশেষ। লোকের মুখে মিনারটাই ঘন্টাঘর।
শিউপুরের ঠিক মাঝমধ্যিখানে ঘন্টাঘরটা।
শহরের বুকে একটুকরো পর্তুগালের গল্প। এর ‘হেরিটেজ ভ্যালু’ নিয়ে শুধু এই শহরে নয়, গোটা
রাজ্যেই চর্চা চলে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এই মিনার দেখতে আসে। শহরের ভারী অহংকার
এটা নিয়ে।
বহু যুগ ধরেই ঘন্টাঘর ঘিরে একটা
বাজার বসে। প্রথমদিকে ব্যাপারটা ছোটোখাটো থাকলেও বর্তমানে তার বিরাট আয়োজন। Alpine
to Elephant কী না পাওয়া যায়! সবাই একে ঘন্টাঘর মার্কেট বলে। হাতের কাজের মনভোলানো জিনিসপত্রের জন্য এরও চারদিকে খুব নামডাক।
সেজন্য গর্বে ফেটে যায় শহর।
চারতলা মিনারের ওপর আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট একটা আটচালা সিমেন্টের খোপে ঘন্টাঘরের ঘড়ি ঝোলানো রয়েছে। একশো বাইশ বছরের পুরনো ঘড়ি। কিন্তু এখনও এমন নির্ভুল সময় দেয় যে শিউপুর তাতে শ্লাঘা বোধ করে। বেশ ছাতি ফুলিয়ে প্রতিটি পর্যটককে কথাটা শোনায় তারা।
‘ঐতিহ্যাগত’ তকমা শুধু ঘন্টাঘরের
নয়, তাকে আঁকড়ে স্থাপিত বিবর্তিত এবং বিবর্ধিত বাজারটিও সেই একই সম্মান। আসলে অর্থনীতি
জানে, ‘হেরিটেজ’কে চড়া দামে কীভাবে বিক্রি করতে হয়। পর্যটক প্রথমে ঘন্টামিনার দেখে,
তারপর এর চারপাশে অনেক দূর ছড়িয়ে থাকা বাজারের শিরা-উপশিরায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরে
বেড়ায়। শেষমেশ কিছু না কিছু কিনেই ফেলে। তাই বৃদ্ধ ঘন্টাঘর নিয়ে বাজারের অনন্ত অহমিকা!
ঘন্টামিনারের ঘড়িটা প্রতি ঘন্টায় বাজে। ঘড়ির ঠিক নিচে একটু মঞ্চ করা আছে, তার ওপর দেড়ফুট লম্বা একটা পুতুল। ঘন্টা বাজলেই পুতুলটা ঘুরে ঘুরে নাচে। একটা বাজলে একবার… পাঁচটা বাজলে পাঁচবার পাক খেয়ে নেচে নেচে ঘোরে। চমৎকার সব পোশাকে সাজানো হয় ওকে। রোজ বদলে যায় সেসব জামাকাপড়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী বেশভূষায় নিত্য নব হয়ে নাচে পুতুল। এসব সাজসজ্জাতেও শিউপুরের হেরিটেজ ভ্যালু চড়চড়িয়ে বাড়ে বলে বিশ্বাস এখানকার অধিবাসীদের। পুতুলটা নিয়েও তাই তাদের যথেষ্ট দম্ভ।
প্রতি ঘন্টায় ঘড়ি বাজে। এক বাজলে…
একবার। চার বাজলে… চারবার। দশ বাজলে… দশবার। পুতুলটাও নিজের টাকুর ভরে কোমর দুলিয়ে
ঘোরে… ততবার। ঘন্টার প্রত্যেক শব্দে তাল মিলিয়ে। পর্যটকরাও সেই মুহূর্তের প্রতীক্ষায়
মিনার ঘেঁষে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন ঘন্টা বাজবে… সঙ্গে পুতুল নাচবে… আর তারা
গোল হয়ে ঘিরে হাততালি দেবে।
ঘন্টার আওয়াজ কানে গেলে বাজার
হাসে। ধাতব নাদ নয়, এই শব্দ তার কাছে মধুর সিম্ফনির মতো। সে স্বপ্ন দেখে, ভিড়… ঘন্টাধ্বনি
মানেই গ্রাহকের ভিড়। আর আজ তো রবিবার।
রবিবার এখানে এমন দমচাপা গাদাগাদি হয় লোকের, যে মার্কেটের গলিঘুঁজিতে পর্যন্ত তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এদিন বাজারের পূর্ণ যৌবন… রঙিন সময়। আজও এখানে পায়ে পায়ে পর্যটক। অগুণতি গ্রাহক।
সন্ধ্যে সাতটা প্রায় বাজতে এল।
ঘন্টামিনারের গোল চত্বরের জনসমাবেশে একটা ধাক্কাধাক্কির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সাতটা
বাজল। ঘন্টা বাজতে শুরু করে। পুতুলটাও সঙ্গে সঙ্গে নাচছে। তর্কাতর্কি ঠেলাগুঁতো সমস্ত
ছেড়ে লোকেরা সেই দৃশ্য দেখতে থাকে। এক। দুই। তিন। …ছয়। সাত। ঘন্টা বাজছে। পুতুলও
ঘুরে ঘুরে নাচে। দর্শক হাসছে… হাততালি দিয়ে… খিলখিলিয়ে।
সাতটা ঘণ্টা বাজিয়ে ঘড়ির থেমে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হল না। ঘন্টা বাজতেই থাকে। ধীরে ধীরে তার গতি আরও দ্রুত হয়। এখন এত জোরে বাজছে যে চারদিকে শুধু ঘন্টারই আর্তনাদ। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ঘণ্টারবে পূর্ণ। মানুষের পারস্পরিক বলা-কওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে… এত তীব্র সেই শব্দ।
পুতুলটাও লাগাতার নেচে যাচ্ছে।
ঘন্টার ঝঙ্কার যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষিপ্র হচ্ছে পুতুলের বেগ। আর বাড়ছে
জনতা। নতুন তামাশা দেখা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। নিজের দুঃসহ নিনাদে সবাইকে জড়ো
করেছে ঘন্টা। জমায়েত এখন অসংযত হয়ে উঠছে।
ঘন্টাঘরে ঘন্টা বেজেই চলছে। জনসমাগম
বাড়ছে। অকুস্থলে ছুটতে ছুটতে পুলিশ আসে। মার্কেটের ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্টকেও
উপস্থিত হতে দেখা যায়। ঘণ্টামিনারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীরাও এসে গেছে। ঘড়িবাবু
মিনারের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে যায়। ঘড়ি খোলার চেষ্টা করে। দু-চারবার এটা-ওটা
ধরে চাপ দেয়। তবুও বাজনা বন্ধ হয় না। শেষপর্যন্ত সে সর্বশক্তিতে ঘড়ির ঘন্টাটা আঁকড়ে
তাকে নিরস্ত করতে চায়। কিন্তু পেন্ডুলাম তার
মুঠো থেকে ছিটকে যায়… গিয়ে ঘড়িবাবুর মাথায় এমন জোরে গুঁতো দেয় যে মিনারের সিঁড়ি
দিয়ে গড়িয়ে পড়া থেকে সে কোনোরকমে রক্ষা পায়!
ঘন্টার বাদ্যি এখন বদলে গেছে… ভয়ংকর গর্জনে। সেই স্বনে কেঁপে উঠছে শিউপুরের আকাশ। কর্মচারীরা সবাই মিনারের ওপরে এসে দল পাকিয়ে পেন্ডুলামকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃথা আশা! ঘন্টা বেজে যায়। এই মুহূর্তে গতির চরম শিখরে পুতুল। নিচে জনপ্লাবন। আর পুলিশও এসেছে প্রচুর। এমন অ-পূর্ব কৌতুকে বাজার ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। জনসমষ্টি ক্ষণে ক্ষণে আরও … আরও বেলাগাম। আচমকা নাচুনি পুতুলের কোনো কলকব্জা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সেই অগ্নিকণা গ্রাস করে তার ঘাগরা। জ্বলন্ত ঘাগরায় নৃত্যরত পুতুলমেয়ে। আগুনের একটা গোলা মিনারের ওপর নাচ করছে, মনে হচ্ছে। ভয়ানক দৃশ্য!
মিনারে-চড়া শ্রমিকদের সবাই এখন
নিচে নামার প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে চাইছে। টাল সামলাতে না পেরে মিনারের কার্নিস ভেঙে
একজন সোজা নিচে গিয়ে পড়ে। মাথা ফেটে চৌচির।
এবার ঘন্টাঘরকে ঘিরে শুরু হয় হুড়োহুড়ি।
লোকজন পালাতে পালাতে বাজারের অলিগলিতে ঢুকে পড়ে। ঢুকে যায় দোকানপাটেও। লুটপাট আরম্ভ
হল। দোকানগুলো ফটাফট ঝাঁপ ফেলতে থাকে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে গোটা বাজার বন্ধ। তার রন্ধ্রে
রন্ধ্রে এখন খ্যাপা কুকুরের মতো জনস্রোত। লাথি ঘুসি ডাণ্ডা— যেনতেন প্রকারেণ দোকানের
দরজা তারা ভাঙবেই। এর পেছনেই তো লুকিয়ে বসে রয়েছে বাজার— ভিতুর ডিম একটা!
যাবতীয় হই-হট্টগোল ছাপিয়ে বাজারের
বন্ধ দরজাগুলো ভেদ করে শোনা যায় ঘন্টার কানফাটানো শব্দ।
ওদিকে জ্বলন্ত পুতুল এখনও মিনারের
ওপর পাক খাচ্ছে। দোকানের বন্ধ দরজার আবডালে লুকিয়ে থাকা বাজার নিজের অধীনস্থ ঘ্যামা
সরকারি অফিসার, পুলিশ আর ঘড়িবাবুকে ডাক দেয়। ওরা সবাই এখন একজোট। বাইরেটায় তখন ছুটন্ত
পা, ভয়ার্ত গলা আর ঘন্টার গগনবিদারী শব্দ ছাড়া কিছু নেই। দাঙ্গা বাঁধার অবস্থা।
ভয়ে দুশ্চিন্তায় বাজারের মুখ শুকিয়ে
গেলেও পরিস্থিতি যে সামলে নিতে পারবে এই বিশ্বাস তার আছে। — এসব কী হচ্ছে, স্যার? একনম্বর অফিসারকে অভিযোগের
স্বরে জিজ্ঞাসা করে বাজার।
অফিসার সোজাসুজি ঘড়িবাবুর দিকে
তাকান।
— হ্যাঁ হে, ব্যাপারটা কী? এই ঘড়ির
নজরদারি করে কে?
— আমি স্যার।
এবার কনস্টেবল মুখ খোলে, তাহলে
এটা কী হচ্ছে?
— আমি কী করব স্যার? ঘড়িবাবুর দিশেহারা
উত্তর।
— কী করবে মানে? একনম্বর অফিসার
মনের ঝাল ঝাড়েন, আরে ঘন্টাটা বন্ধ করো। তুমি না করলে আর কে পারবে?
বাজার আদুরে গলায় তার কাছে মিনতি
করে, — এই ঘন্টাকে এক্ষুনি থামাও ভাই। খরচাপাতি যা লাগবে না হয় দিচ্ছি।
ঘড়িবাবু হাত তুলে দেয়। — না দাদা,
এখন একে চুপ করানো যাবে না। আমি চেষ্টার কোনো ফাঁক রাখিনি। কিন্তু এর আসল যে চাকা,
সেটা খোলা অসম্ভব।
-অন্যভাবে নিশ্চয়ই কিছু করা যাবে।
স্থানীয় থানার বড়সাহেব বলেন, সামান্য একটা মেশিন
ছাড়া এ আর কী? একদম না পারলে জোরে দু’ঘা
হাতুড়ি মেরে শালিকে সিধে করে ফ্যালো।
— না স্যার। ঘড়ি আমাদের হাত থেকে
বেরিয়ে গেছে। কোনো উপায়েই…।
— বাহ! বাহ! কি কথাই না শোনালে।
দাঁড়াও… কালই তোমাদের ঠিকাদারের ঠিকা বাতিলের ব্যবস্থা করছি। তাহলেই মজা টের পাবে।
অফিসারের মধ্যে ক্ষমতার গরম চাগাড় দেয়। বাজার,
প্রায় কেঁদে-ককিয়ে বলে, যেভাবেই হোক একটা পথ বের করো ভাই। মার্কেটের সেন্টিমেন্টটা তো বুঝতে হবে… ঘড়ি
বেগড়বাই করলে বাজার … না … না… পুরো শিউপুর ঝাড়েমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
— সত্যি বলছি… এখানে আর কিচ্ছু
করার নেই, ঘড়িবাবুর সেই একই বুলি।
— তুমি বোধহয় তেমন খুঁটিয়ে দ্যাখোনি।
কনস্টেবল নিজের দাপট দেখাতে চেষ্টা করে, আবার গিয়ে দ্যাখো।
— আপনি শুধুমুদু আমায় ধমকাচ্ছেন।
বাধ্য হয়ে মৃদু প্রতিবাদ জানায় ঘড়িবাবু, বলছি তো, ঘড়ি হাত থেকে ফসকে গেছে।
বড়সাহেব একটু থমকান, — সে আবার
কী?
— মানে… বলতে চাচ্ছি যে, আসলে সময়
বিদ্রোহ করেছে।
হতভম্ব বাজারের প্রশ্ন, — কে? কী
করেছে?
— সময় বিদ্রোহ করেছে। ঘড়িবাবুর
একটাই বচন।
আর ভাবতে পারে না বাজার। সময়ের
বিদ্রোহ? এ-ও হয়?
— সময় যদি বিদ্রোহ করবে বলে ভাবে
তাহলে কারোর কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই। কথায় কথায় এত বড়ো দার্শনিক সত্য অনায়াসে উচ্চারণ
করে ঘড়িবাবু।
পুলিশের দলটির মনোযোগ এখন দরজা
পেটানোর শব্দের দিকে। ভিড়, যেকোনো সময় দরজা গুঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়বে।
আগে থেকে এরকম বিশৃঙ্খলার এতটুকু
আভাস পায়নি বাজার। সময় কখনও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে? নিজেকে সে বরাবরই সময়ের
ঊর্ধ্বে রেখেছে। তাই বহুবিচিত্র স্কিমের মধ্যে এধরনের পরিস্থিতির জন্য কোনো ব্যবস্থাও
নেওয়া হয়নি। ইস! কী সাংঘাতিক ভুল।
না… না… ভুল নয়। এটা বিদ্রোহেরই
সময়। এই সত্যটা বাজার বুঝতে বা মানতে না পারলেও একদিন এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
আর সেই একদিনটা …আজই।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন