বর্ণমালার সাতকাহন
(২৬)
জীবনের প্রাথমিক পর্বে নানা প্রত্যাশা জীবিত থাকে। পার্থিব কামনা বেশি থাকে। সবাই যখন ভাল শাড়ি কিনছে গয়না কিনছে ইচ্ছেমত খরচ করতে পারছে ... এমন আমারও বয়স ছিল একসময়। আমাকেও সে সব নানা সাধ আহ্লাদ দমন করতে হয়েছে আর্থিক অনটনে, ভাগ্যের ফেরে। অথচ মেয়েটি ধনী না হলেও সচ্ছলতার ভেতর খেয়ে পরে মানুষ হয়েছিল সকলের আদরে। শুধু আমি নয় এদেশের এমন অনেক মেয়ের এমন ভাগ্যের ফেরে লড়তে হয়েছে জীবন। যখন মাঝামাঝি বয়সে এসে আপন সক্ষমতার জোরে কিছু কিছু সাধ পূর্ণ হতেই পারে। অথবা এমন দিন এলো তখন চাওয়ার স্পৃহাটাই চলে গেছে। আমার মতো অনেক মেয়ের জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়কালটা কেটে গেছে দৈব দুর্বিপাকে। সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারতাম না বহুদিন কারণ আমাদের দেশে পতির পরিচয়ই পত্নীর সবচেয়ে বড় পরিচয়। চাকরি করতে গিয়ে লেখা বন্ধ হলো, শাশুড়ি চলে যেতে গান বন্ধ হলো। কয়েকমাস বড় হতেই মেয়ে বুঝে যেত মা এবার চলে যাবে, সারাদিনের জন্য অমনি পরিত্রাহি কাঁদত। কোল থেকে নামানো যেতো না। চাকরি করতে গিয়ে বুক টনটন করত, জামা ভিজে যেত, বাথরুমে গিয়ে বুকের দুধ গেলে ফেলে দিয়ে আসতে হতো। এভাবেই সহস্র আমার মতো নারীকে জীবন বইতে হয়েছে। পুরুষজাতি এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। তারা নারীকে প্রধানত যৌন পুতুল ভাবতে অভ্যস্ত। নারী পুরুষের থেকে যোগ্যতর এটি আজও ভেতরে ভেতরে পুরুষের অস্বস্তির কারণ।
একটি ছোট্ট ঘটনা মনে আছে। একবার
নিচের তলার ভাড়াটেদের ছোটো মেয়েটি সাত সকালে বিরাট গণ্ডগোল সৃষ্টি করল। আমার স্বামীর
বাল্যবান্ধবী সে। এক বাড়ি একসঙ্গে মানুষ।
বাঁধানো কুয়োতলার একপাড় ঘেঁষে আধ সিঁড়ি উঠে বাথরুম। তবে নিচের তলার ভাড়টেরা কুয়োতলাতেই স্নান করত। মেয়েটির কয়েকমাস হলো বিবাহ হয়েছে। বরটি লয়েডের লজেঞ্নস কোম্পানিতে চাকরি করে। পয়সাওলা ঘর। মেয়েটি হঠাত কুয়োর পাড়ের মাথায় চড়ে কাঁদছে চিৎকার করছে সে ডিভোর্স করবে। নিচে ভিড়। ওপরের জানলায় আমরা। বধূ নির্যাতন? না সে জানাচ্ছে তার বর অপারক। নপুংসক। পাড়াশুদ্ধ লোকের তৎসহ তার মা বাবা ভাই সবার মধ্যে কুয়োর ওপর দাঁড়িয়ে গলা তুলে স্বামীর যৌন অপারকতার এই ঘোষণা বিমুঢ় করেছিল সেদিন সকলকে।
যদিও তার আত্মহত্যা করা হয়নি, বলা বাহুল্য ডিভোর্সও নয়। ওরা নিঃসন্তান। মেয়েটি শেষপর্যন্ত বর নয় শ্বশুরবাড়ির টাকার ওপর বসে জীবন কাটিয়ে দেয়। নারী বেঁচে থাকে লড়াই করে।
কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় মানুষের জীবনে। রবীন্দ্রনাথ সেই সূত্রেই ভাগ করেছেন জীবন সঙ্গীত
প্রকৃতি পর্যায়, প্রেম, পূজা,
আনুষ্ঠানিক, স্বদেশ ও বিচিত্র। এই বিচিত্র পর্যায়ের একটি অভিজ্ঞতা আজও তারার মতো জ্বলজ্বল
করে। একটি রাত। সামান্য একটি সাময়িক কাজ পেয়ে স্বামী গেছে পুরুলিয়া। বিরাট ধ্বংসস্তুপের মতো প্রাসাদোপম বাড়িতে একা আমি আর
তিন মাসের শিশুকন্যা। নিচে সারি সারি ঘর বন্ধ, তালা দেওয়া। লাগোয়া আগাছার জঙ্গল বিস্তীর্ণ
জমি। ক’দিন ধরে অঝোর বারিধারা সন্ধ্যারাতে। দোতলার ঘরগুলি ফাঁকা। শ্বশুর শাশুড়ি পরলোকে।
এবাড়িতে বহু লোকের শেষ নিঃশ্বাস জমা আছে। প্রতিটা ঘরে বালতি হাঁড়ি ডেকচি বসানো কারণ
সিলিং ভেদ করে জল পড়ছে অবিরাম। সেই সুগভীর রাতে ভুতের ভয় নয়, ভয় করত একা কন্যাকে
রেখে দরদালান পেরিয়ে বাথরুম যাব রান্না ঘরে যাবো কীভাবে! পড়ে যেতে পারে। আমি উঠলেই
তার কান্না শুরু হতো। দ্বিতীয় দিন হঠাত এক কৃশাঙ্গী শ্যামরং বউ এলেন কাজ চাইতে। রাতদিনের।
ভাবলাম একা আছি, থাকুক সঙ্গে। সঠিক বয়স হলে যে ম্যাচ্যুরিটি থাকে তা বলা বাহুল্য ছিলো
না। নাহলে এভাবে অচেনা মহিলাকে ঘরে আশ্রয়
দিতাম না। এমন অপরিণামদর্শিতা কয়েকবারই ঘটেছে যে কথা ভেবে নিজের বদনে চপেটাঘাত কষাতে
সাধ হয়। সন্দেহ হলো যখন রাত দশটায় নিজের শোবার ঘরে ছিটকিনি খিল দিতে গেলাম। সে জেদ
করতে লাগল এত বাড়িতে তার ভয় করছে, সে আমার শোবার ঘরেই শোবে। আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। মনে পড়ল তার পরিচয়পত্র চাওয়ায়
সে সকালে বলেছিল পরদিন এনে দেবে পুরনো মালিকের বাড়ি থেকে। আমাদের পরশির বাড়ি অনেকটা
দূর কারণ আমাদের বাড়িটি জায়গা জমি সহ অনেক বড়ো। তারপর থেকে সমস্ত রাত শুরু হলো তার
অত্যাচার। সমানে দরজা ধাক্কা। রাত একটায় কয়েক মুহূর্ত নিরবতার পর সে বলে সদর খুলে
দিতে। সে বিড়ি কিনতে যাবে। এত রাতে বিড়ি? কোন দোকান! তখন মনে হলো কোনো ডাকাত দলের সঙ্গে যুক্ত
নয় তো? ভয় শব্দটি অচেনা ছিল আমার অভিধানে। পুরনো পুকুরের তলায় শ্যাওলা আর গুল্ম
যেমন পা টেনে ধরে, ডুবে যায় সাঁতার জানা মানু্ষ, সেরকম মাঝ দড়িয়া অতিক্রম করলে আসক্তির শ্যাওলা
পা জড়ায়। যত বয়স বাড়ে সূর্য অস্তাচলের দিকে ঢলে। ডাকাবুকো মানুষও রোজ নানারূপ ভয়ের
মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে। মৃত্যুভয়, হারানোর ভয়, বিচ্ছেদ, মায়া নানা গুল্ম অক্টোপাসের মত চেপে ধরে।
সে রাত ভয় পাইনি। ঘুমোতেও পারিনি তার নানা প্রকার কীর্তিতে সমস্ত রাত। শেষে দরজা খুলে তার মুখোমুখি হলাম। আমার রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে সে থমকালো। তারপর তাকে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির বাইরে বার করে দিলাম এক ধাক্কায় এবং মুহূর্তে ভেতর থেকে তালা দিলাম। রাত তখন সাড়ে তিনটে। কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কা তারপর প্রথম পথচারীর পদশব্দ আর পাখি ডাকতে নীরব হলো। এই ঘটনার পরে পুরনো বাড়িতে লোহার গ্রীল বসালাম, জানলায় শুধু গরাদ ছি্ল, বসল গ্রীল। সবটাই নষ্ট অপচয় জীবনের অনেক প্রয়াসের মত। সে বাড়ি ছেড়ে নিজের মতই সামান্য ছোটোখাটো বাসাবদল হলো। যখন বিকেল হতো যখন নতুন মোবাইল ফোনে রিনরিনে গলা বলে উঠত, "মা তুমি ঠিক আছো তো? সাবধানে ফেরো।" মনে হতো অনেক অপ্রাপ্তির বাজারে এ যেন পদ্মার ইলিশ। এ যেন কোটি টাকার লটারি জেতা। তবে মানুষ যখন পায় তখন পাওয়াটা তত খেয়াল করে না, সুখকে সুখ বলে স্বীকার করতে ভয় পায়, পাছে নজর লেগে যায় অশুভের। মানুষ তাই বেশি ব্যাপৃত থাকে না পাওয়াগুলো নিয়ে কষ্ট নিয়ে।
বাঙালির জীবনে মননে সংস্কারে অন্তর ও বারমহলে বিপুল তরঙ্গের মত বিপ্লব ঘটে গেল ২০০০ সালের পর থেকে। সমাজে প্রবেশ করল অন্তর্জাল পরিষেবা। এতদিনের সংগোপনে ক্রমে সার্চলাইট পড়ে হারাতে বসল গোপনতার অধরা মাধুরী। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ফল বোঝা গেল ধীরে। কয়েক বছরের ভেতর এসে পড়ল পেজার জেলিবিন এনড্রয়েড স্মার্টফোন। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের বাধা খুলে গেল চিচিং ফাঁক হয়ে। বন্ধুত্ব জমে উঠল দেশ বিদেশের সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে, রাজনৈতিক মতামত টুইটারে আদানপ্রদান। সেই সময় টুইটারে কথা হয়েছিল অমিতাভ বচ্চন সহ সাংবাদিক নেতা অনেকের সঙ্গেই।
মনে হয় আমরা সেই প্রজন্ম যারা সাক্ষী থাকছি সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের। নকশাল আন্দোলন থেকে ধর্মীয় ডগম্যাটিসম, রবিবারের ফুলকো লুচি কালো জিরে সাদা আলুর তরকারি থেকে অনলাইনের কন্টিনেন্টাল, গলিতে গলিতে বিরিয়ানি। নীল ইনল্যাণ্ড লেটারে প্রেমপত্র থেকে ওয়াটস্যাপ... চাঁদের রহস্য ভেদ করে পরলোক ভ্যানিশ হয়ে গেছে। এখন মহাবিশ্বময় নানা দেশের স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম, একান্নবর্তী পরিবার থেকে বন্ধ বাড়ি থেকে একাকী নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বৃদ্ধার পচা গলা বাসী মৃতদেহ। দেওয়ালে মৃতার আলতা পায়ের ছাপ, কর্তার পায়ের হলুদ ছাপ, লাল রক থেকে টেসলার রোবোট মানুষ এক দীর্ঘ অভিযান।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন