কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৭


নিঃপুষ্প কদমগাছ ও একটা সাইনবোর্ড

বন্ধুর বিশাল বাড়ি। সেখানে বেদীতে ঘেরা একটা বিশাল কদমগাছ, তাতে সাইনবোর্ডে লটকানো – ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’!

বন্ধুর বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই গাছের নীচে বেদীটাতেই বসেছিলেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, এতবড়ো কদম গাছ, এতে কোনো ফুল তো দেখছি না?

তিনি বললেন – না! এ গাছে এখনো ফুল ফোটার সময় আসেনি!

তারপর জ্যাঠামশাই নিশ্চুপ!

পাশেই দাঁড়িয়েছিল বন্ধুটি। আমাকে বলতে লাগলো তার অগ্রজদের কাছ থেকে শোনা কাহিনী। এই কদম গাছের জন্ম-ইতিহাস।

১৯৪৬ সালের কথা! চারপাশে কমিউনাল দাঙ্গা চলছে। পাশের গ্রামে একদল মুসলমান হিন্দুদের মারছে। তারই প্রতিক্রিয়া, হিন্দুরা মুসলমানদের মারছে। এরই মধ্যে আবার কিছু মানুষ ধর্মমত নির্বিশেষে আক্রান্ত মানুষজনদের বাঁচাচ্ছে।

এরকমই একটা দিনে তাদের পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল গ্রামেরই এক আক্রান্ত মুসলমান যুবককে। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমে। খবর পেয়ে একদল লোক ঘরে এলো। আশ্রিত সেই মুসলমান যুবকটাকে বাইরে বের করে আনলো। তারপর? তারা ছেলেটাকে খতম করে চলে গেলো! লাশটাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার কেউ ছিলো না। কারণ, এই দাঙ্গায় ইতিমধ্যেই তার পরিবারের বাকিরা নিহত, নিখোঁজ! ছেলেটার লাশটা পড়ে থাকলো বাড়ির বাগানে।

তখন জ্যাঠামশাই একজন তরুণ গবেষক! তারই ইচ্ছেয় বিশাল বাগানটার এককোণে একটা কবর খোঁড়া হলো। সেখানেই গোপনে দাফনানো হলো মুসলমান যুবকটার লাশ!

কিছুদিন বাদে দাঙ্গা থামলো। তারই কয়েক বছর বাদে জ্যাঠামশাই সেই কবরের উপরে লাগালেন একটা কদম ফুলের গাছ।

দেশ তখন স্বাধীন। কদমফুল গাছটা বড় হলো, চারপাশে একটা বেদী তৈরী হলো। নিহত মানুষটার স্মৃতিতে জ্যাঠামশাই বোর্ডে লেখালেন মাত্র দুটো শব্দ – ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’।

পাশেই বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই আমার বন্ধুটির সব কথা শুনছিলেন। এতক্ষণে মুখ খুললেন। তাঁর গলার স্বর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। - এই গাছে কেন ফুল ফোটেনি জানো? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখনও বহুৎ দূর! তবুও আমি ভরসা রাখি, একদিন নানা রঙ-বেরঙের পাখি এই গাছটার চারপাশে উড়বে, এই বাজা কদম গাছটাতেও কুঁড়ি ফুটবে! তখন দেখো, গাছটাতে লটকানো এই ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র বিজ্ঞাপন-বোর্ডটাও নিজে নিজেই উধাও হয়ে যাবে! সেসব দিনে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র কথা মানুষজনকে আর জবরদস্তি মনে করিয়ে দিতে হবে না। দেখবে, সে সময়ে এই কদমগাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে!

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন