কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

পি. শাশ্বতী

 

ব্রহ্মময়ী না কালী কি হিন্দু ঘরের মেয়ে, নাকি তিনি শবরকন্যা 



 

ব্রাহ্মণ্যবাদ অনুসারে হিন্দুধর্মের তেত্রিশ কোটি দেবতা। কিন্তু এই কোটি বলতে সাদা মনে আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি ব্যাপারটা আসলে কী? হিন্দু শাস্ত্রের জন্মকালে গোটা হিন্দু জাতির জনসংখ্যা এক কোটিও ছিল কিনা সন্দেহ। সেখানে তেত্রিশ কোটি দেবতার বর্ণনা কি একটা অবাস্তব ধারণা নয় কি? তাহলে হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা এমন একটি সংখ্যার কথা কেন বলেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতে ‘কোটি’ শব্দের দুটি অর্থ। একটি কোটি বলতে ‘প্রকার’কে বোঝানো হয, অপরটি সংখ্যা অর্থে বোঝানো হয়। সনাতনধর্ম  মতে দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে যখনই পৃথিবীতে ও অমৃতলোকে অনিষ্টকর কোনো পাশবিক শক্তির উত্থান হয়েছে, তখনই বিশ্বপ্রসবিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী নানা রূপ পরিগ্রহ করে তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে নানারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। ভগবতী কালীদেবী রূপের উৎপত্তিও অনাদির আদি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার থেকে। প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালী। দেবী ভগবতী মহামায়ার কালী রূপ তমোময়ী, উগ্রা, প্রচণ্ডা, ভীষণা হলেও তিনি স্বরূপত ত্রিগুণাতীতা, প্রশান্তা, স্নিগ্ধা, মাতৃরূপা। একই সঙ্গে দুই বিপরীত ভাবের অসামান্য সমন্বয় তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি সাক্ষাৎ বিপরীত রতাতুরা। তিনি মহাকাশের মতো। দূর থেকে মহাকাশের রং এক এক সময় যেমন এক এক রকম ভাবে উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু গভীরে তার থাকে একটিই রং - অসীম শূন্যতা এবং অন্তহীন এক মহাকাশ। মহাকাশ যেমন বর্ণহীন স্বরূপ সত্য, তেমনই সত্য বর্ণময় স্বরূপও। মহাজগতের যা কিছু পরমধ্রুব ও শুভ তার মধ্যে এই বৈপরীত্য বড় অনায়াসে থাকে। ভগবতী কালী দেবীও তেমনই এক বিরাট শক্তিতত্ত্ব। প্রচলিত বৈপরীত্যই তাঁর কাছে তাই অতি স্বাভাবিক।

শ্রীমৎ-দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী কালীর বিবরণ অনুসরণ করে অখণ্ড বঙ্গদেশে দেবী কালী বর্তমানে বহুল প্রচলিত মাতৃময়ী রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। এর প্রসারে সহায়তা করেছে বঙ্গবলয়ে দীর্ঘকাল প্রচলিত বিষ্ণুক্রান্তা তন্ত্রসাধনা। উগ্ৰা মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিত দেবী কালী মহাশক্তির উৎস। সিংহহৃদয়ের মাতৃভক্ত এই মহাদেবীর উপাসক। পৌরাণিক ও তান্ত্রিক পথের আরাধ্য দেবী কালীই পরবর্তী সময়ে বাংলার মাতৃসঙ্গীতে কখনও অভয়া বরদা, কখনও মাতা, কখনও কন্যা হয়ে ফুটে উঠেছেন।

মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত মাতৃসাধক তন্ত্র-আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালীকে বঙ্গের সাধারণ মানুষের উপযোগী রূপকল্পে সাজিয়ে তুলেছিলেন, এমন একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনিই প্রথম দেবী কালিকার মূর্তি গড়ে পুজো করেন। যদিও প্রাচীন সময় থেকেই বঙ্গদেশ ছিল শক্তিসাধনার পীঠস্থান। বঙ্গে অজস্র প্রাচীন মাতৃকাদেবীর মূর্তি রয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেইসব শক্তিমূর্তির সঙ্গে কৃষ্ণানন্দ সৃষ্ট দেবীর মূর্তির মিল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। হলেন স্নিগ্ধা দক্ষিণাকালিকা রূপের আদি রূপকার। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গের একজন প্রসিদ্ধ তন্ত্র-আচার্য। কিংবদন্তি অনুসারে, সাধনায় সিদ্ধ হওয়ার পর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ভগবতীর কাছে দৈবী আদেশ পেয়েছিলেন। সেই আদেশেই ভগবতী কালীর দক্ষিণাকালী রূপ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। দৈব নির্ধারিত পদ্ধতিতে আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই পেরেছিলেন পৌরাণিক ভ্রকুটি ভীষণা ভীমা প্রায় উন্মত্তা রণরঙ্গিনী মহাদেবীকে বঙ্গনারীর মতোই স্নেহময়ী বঙ্গমাতা করে তুলতে। শ্মশানের আরাধ্যা দেবী ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছিলেন লোকালয়ে। সিদ্ধিলাভের পরে মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ততোধিক কঠোর তান্ত্রিক সাধনায় তাঁর কাঙ্ক্ষিত আরাধ্যা ভগবতী কালী দেবীই হয়ে উঠেছিলেন প্রকারান্তরে তাঁর নিজের মা, একেবারে ঘরের গর্ভধারিণী মায়ের মতো মা।

অখণ্ড বঙ্গময় সতীপীঠের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বঙ্গদেশ শক্তির উপাসনালয়। সপ্তম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পূর্বভারতের অসম-বঙ্গদেশে তন্ত্রের প্রভাবকে নষ্ট করে দিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্ত প্রসারের জন্য জ্যোতির্মঠ স্থাপন করতে চাননি। বঙ্গ-অসমে পরিব্রজ্যাকালে তিনি এই অঞ্চলে তন্ত্র সাধনমার্গের মধ্যে এক অতীন্দ্রিয় শুভশক্তি অনুভব করেছিলেন। ফলে বঙ্গদেশের মাতৃসাধক ও তাঁদের সাধনার বিষয়ে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন আদি শঙ্করাচার্য।

তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাস করা হয় - যা আছে মানুষের দেহ ভাণ্ডে, তা আছে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। পুরাণ-তন্ত্র- শাস্ত্রাদির সেই মহতী ভগবতী অখণ্ড অনন্ত চেতনা স্বরূপে সমগ্র বিশ্ব চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। সমস্ত কিছুই তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে, আবার সবকিছুই তাঁর মধ্যে লয়ও হয়ে যাচ্ছে, আবার তিনিই সৃষ্টি থেকে বিনাশ পর্যন্ত সবকিছুকে সযত্নে নিরলসভাবে লালন করে চলেছেন। সমগ্র মহাজগতের এই প্রকাশ ও বিনাশ তাঁর অনন্ত লীলার মাত্র এক ছটা। সাধক আচার্যদেব কৃষ্ণানন্দের মাতৃচেতনার এই মহান ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা, শিষ্য ও ভাবশিষ্যরা। এঁদের মধ্যে অন্যতম মাতৃসাধক ও মাতৃপদ রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত মাতৃসাধক ও শাক্তপদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যেরও সাক্ষাৎ মাতৃদর্শন হয়েছিল। এঁরা দুজনেই প্রথাগত তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কৃষ্ণানন্দের মাতৃচেতনার পথেই দেবী কালিকা যেন গর্ভধারিণীর মতোই ছিলেন রামপ্রসাদের চিৎ-আকাশে।

সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে সাধকদের বাহ্যত দুটি ভিন্ন পথ দেখা যায়। প্রথমটি, সাধকেরা সিদ্ধি অর্জন করে নিত্য সমাধিস্থ হয়ে লোক-জীবনোত্তীর্ণ এক আধ্যাত্মিক পথ গ্ৰহণ করেন। দ্বিতীয়টি, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেও সাধকরা লোককল্যাণের জন্য সাধারণের উপযোগী আদর্শ তৈরি করে দিতে থাকেন, যা অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও দৈনন্দিন জীবনের কাজের মধ্যে থেকেও সাধনায় ব্রতী হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের সাধন লোককল্যাণে ব্যয় করেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের পর রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে অব্যক্ত অখণ্ডমণ্ডলাকার চেতনাতীত মহাদেবী কালী শ্মশানচারী রূপ মুছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বাংলার স্নেহময়ী মা-তে, তিনি আসন পাততে শুরু করেছিলেন লোকালয়ের মাঝে, এমনকি ভদ্রাসনেও। এই পর্বে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (রায়) শাক্তধর্মের প্রসারের কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণনগরে শাক্তরসের সূচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বঙ্গময় ছোট-বড় অজস্র শক্তিপীঠের সংস্কার শুরু হয়েছিল। এই পর্বেই গোটা বঙ্গে একাধিক রাজার তত্ত্বাবধানে একাধিক শাক্তমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রামপ্রসাদের দরদী ও আকুলকণ্ঠে শ্যামা, শ্যাম, শিব, রাম এক রূপে দেখা দিয়েছিলেন। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য গানে গানে বলেছিলেন পরমাত্মার পরম সত্তা আসলে এক, শুধু তাঁর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সেই পরমতত্ত্বকে কেউ জগদীশ্বর বলে চেনেন, কেউ আবার জগদীশ্বরী বলে চেনেন। শাক্ত পদরত্নে ঘোষিত হতে শুরু করেছিল, মাতৃসাধনায় তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির পাশাপাশি শুধুমাত্র মাতৃনাম জপেও সিদ্ধি মেলে। সেখানে মা মন্ত্রের অধীন হন না, তিনি সন্তানের প্রতি বাৎসল্যে অধীন।  কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী জন্মসূত্রে অহিন্দু হয়েও ভগবতী মায়ের পরম শরণ পেয়েছিলেন কত অনায়াসে! তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাতৃসাধক। কলকাতার বর্তমান বৌবাজার অঞ্চলে এন্টনি ফিরিঙ্গী সাহেবের উপাস্য দেবী কালী আজও কৃপা বিলিয়ে চলেছেন।

অন্যদিকে রামকৃষ্ণ দেখালেন শুধু অখণ্ড ভালোবাসা দিয়েও উপাস্য মাকে পাওয়া যায়, নিত্য তাঁর সাহচর্য লাভ করা যায়। ভগবতীকে জীবন্ত দেখা যায়, অন্যকেও দেখিয়ে দেওয়া যায় যে, তিনি কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। তাঁর ক্ষেত্রে দেখা গেল, শুধু আর্তি মাখানো ভালোবাসা দিয়েই সাধনাতীত আদ্যাশক্তি ভবতারিণী ভগবতীকে একেবারে খুব কাছে পাওয়া যায়, তাঁর সঙ্গে একত্রে বসা যায়, কথা বলা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ এখানেই থেমে থাকলেন না, আরও একধাপ এগিয়ে তিনি শেখালেন সর্বজীবে তাঁকে অনুভবও করা যায়। তখন গৃহস্থ বাড়ির সতীলক্ষ্মী নারীও ভগবতী, পতিতাপল্লির বেশ্যাও ভগবতী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, সমস্ত স্ত্রী সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী। আর শ্রীরামকৃষ্ণ তা জীবনে প্রয়োগ করে দেখালেন। শুধুমাত্র তীব্র সহজসাধনায় আবেগমথিত হয়ে ভগবতীর দর্শনের পর রামকৃষ্ণ পরমহংস করেছিলেন তন্ত্রের সাধন। তাঁর তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির সাধনার পথ প্রদর্শক ছিলেন এক নারী— ভৈরবী যোগেশ্বরী ব্রাহ্মণী। শ্রীরামকৃষ্ণজীবনের এক চরম সত্য ছিল অপার ও একনিষ্ঠ সাধ্যসাধন! অখণ্ড বঙ্গদেশে মাতৃসাধনার ধারায় এমন আর দ্বিতীয় হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাতৃচিন্তার এই ধারায় যুক্ত করেছিলেন স্বদেশচেতনা। পুরাণ ও তন্ত্রোক্ত অখণ্ড শক্তিময়ী কালী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন দেশজননী রূপে। বাস্তবিকই সৃষ্টি-পালন-সংহারের ত্রিতত্ত্ব যেভাবে কালীর সঙ্গে যুক্ত, সেভাবেই দেশমাতৃকার সঙ্গেও জুড়ে যেতে শুরু করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর এদেশের একমাত্র উপাস্য হবেন দেশজননী। দেশে বইবে শক্তির উপাসনার মলয় বাতাস। সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চাইবে, মৃত্যুরূপা মাতা কালী করালিনী তাঁর কাছে প্রকাশিত হবেন। এইবার ভগবতী হবেন বীরজননী।’

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মা রূপে প্রকাশিত হলেন কালী ও অন্য শক্তিদেবীরা। স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাও ভগবতী কালী ও দেশজননীকে এক করে দেখিয়েছেন। এই ভাবনা প্রসারিত হলে বীরমাতার বীর সন্তানদের হাতেই দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি আসতে শুরু করেছিল। ইংরেজ শাসনের আসন টলতে শুরু করেছিল এই সময় থেকেই। এর আগে দেশমাতা রূপে শক্তির উপাসনা দক্ষিণ ভারতের মারাঠাদের হৃদয়সম্রাট তথা মহারাষ্ট্রের নবজাগরণের পথিকৃৎ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজও করেছিলেন।

বঙ্গদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শাক্তচেতনা পরিপক্ক আসন তৈরি করে নিতে পেরেছিল। কাজেই ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মমতের মতাদর্শের মধ্যে থেকেই এই ধারায় প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি দেশমাতৃকার বন্দনায় ‘ডান হাতে খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ’ রূপের বর্ণনা করেছিলেন পরম কৌশলে। দেশমাতার মধ্যে এ যে কালীরই আবেশ। পরবর্তী সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতায় বসবাসকালে শক্তির উপাসনা শুরু করেছিলেন উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব শুরুর দিকে নেতাজিও ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত। নেতাজির আগ্ৰহে দুর্গাষ্টমী তিথি বীরাষ্টমীতে পরিণত হলো। বৈচিত্র্যময়ী দেবীর লীলাবৈচিত্র্যে এরপর আরও সমৃদ্ধি দিতে এলেন কবি নজরুলও। জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও তিনি নিজে ছিলেন মাতৃসাধক। অসীম বিরাটকে তিনি আদরের মেয়ে রূপে দেখলেন, আবার পূর্বসূরি কবিদের মতো নিজে শিশু হয়ে দেবীর কোলে মাথা রাখলেন। মুর্শিদাবাদের লালগোলার রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি রাজবাড়ি কালীমন্দির ও লালগলার অদূরে এক জাগ্রত কালীমন্দিরে গিয়ে রীতিমতো সাধনায় মগ্ন থেকেছেন দীর্ঘ দিন। নজরুল ইসলামও কালী দেবীকে দেশমাতা রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। নজরুলের শাক্ত গানগুলিতে বহু রাগ রাগিনীর ব্যবহার রয়েছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে মাতৃচর্চার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল এই সময় থেকে। এই ধরনের শাক্ত পদাবলি যখন বাংলার শক্তিসাধনাকে সমৃদ্ধি দিতে শুরু করেছিল সেই সময়ে আর একজন শাক্ত পদকর্তা ও মাতৃসাধক নজরুলের সমান্তরালে বাংলার কালীচেতনায় এনেছিলেন মাধুর্যের উচ্ছ্বাস, তিনি আন্দুল কালীকীর্তন সমিতির প্রাণপুরুষ প্রেমিক মহারাজ।

মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজও রামপ্রসাদের মতো সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। সাধকোচিত গভীর মাতৃভাবপূর্ণ বাণী ও সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে ছিল বাংলার দিকে দিকে। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য যদি বাংলা মাতৃসঙ্গীতের মাধ্যমে বাঙালির কালীচেতনা ও কালীচর্চার প্রসারের প্রথম যশস্বী জুটি হন তবে মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজ ও নজরুল ইসলাম পরবর্তী সময়ে সেই ধারাকে সফল ভাবে বাঙালি চিত্তচেতনায় প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। আর বিংশ শতাব্দীতে এসে স্বামী কৃষ্ণানন্দও সেই ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন।

এবার আসা যাক দেবী কালিকার আর এক রূপের এক প্রচলিত কথকতায়। অতীত থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রামায়ণের বিভিন্ন সংস্করণ চালু রয়েছে। এগুলোর সাথে মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণের মিলের থেকে অমিল বেশি লক্ষ্ণীয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে এসব রামায়ণ কাহিনি ভীষণ জনপ্রিয়। ঠিক যেমন কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলায় জনপ্রিয় তেমন। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, এর মধ্যে কিছু আঞ্চলিক রামায়ণে রামচন্দ্রকে রাবণ বধের কৃতিত্ব না দিয়ে সীতাকে দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়। সেটাও আবার বাল্মীকির একমাথার রাবণ বা কৃত্তিবাসের দশমাথার রাবণ নয়, একেবারে সহস্রশীর রাবণ! অতীতে শূরবীর সিংহ ফতেহপুর জেলার একটি গ্রামে ‘জানকী বিজয়’ নামের একটি ছোট হিন্দি পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন; তাতে সীতাদ্বারা শ্বেত দ্বীপের অধিপতি সহস্রশীর্ষ রাবণের বধের কাহিনি পাওয়া যায়।

তবে এর থেকেও আশ্চর্যজনক বিষয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রামায়ণ-গীতে। এগুলোও বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চালু রয়েছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশের ব্রজ-অঞ্চলে (মথুরা-বৃন্দাবন এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে) যেসব লৌকিক রামায়ণ-গীত বর্তমানকালেও প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি মজার কাহিনি দেখতে পাওয়া যায়। সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে আসবার পরে, সীতা রামচন্দ্রকে জানিয়েছিলেন যে, রামচন্দ্র তো ‘রমনিয়া’কে হত্যা করেছেন, তিনি রাবণকে বধ করতে পারেননি। কারণ, রাবণ লঙ্কায় থাকেন না, তিনি ‘পলঙ্কা’য় থাকেন, তাঁর সহস্র শির এবং দ্বিসহস্র বাহু। একথা শুনে ভরত রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘তুমি এখন অযোধ্যার সিংহাসনে বসো, আমি গিয়ে সেই রাবণকে বধ করে আসছি।’

তারপরে ভরত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে লঙ্কার দিকে রওনা দিয়েছিলেন; কিন্তু ‘নাকাসুর’ তাঁদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে এনে আটকে রেখেছিলেন। তখন সীতা নিজেই অগ্রবর্তী হয়ে পলঙ্কায় গিয়ে রাবণকে গিলে খেয়ে ফেলেছিলেন, এবং সেখান থেকে তিনি আর অযোধ্যায় ফিরে আসেননি, সোজা কলকাতায় এসে ‘কালী মাই’ হয়ে গিয়েছিলেন। এরপরে নারদ কলকাতায় এসে তাঁকে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু সীতা কিছুতেই রাজি হননি, তিনি কালী মাই হয়ে কলকাতাতেই থেকে গিয়েছিলেন। এর সপক্ষে একটি প্রচলিত প্রাচীন গীত এই রকম—

“কিশ্ন অগারী পরি রহে পেস এক না খাই

সবরে জোধা চলি দএ সর্বুলীনে বান উঠাই

পহুঁচী গয়ে কলকাত্তা মে, তৌ মাতা মংদির পহুঁচী জাই।

মংদির পহুঁচী জাই পাস নারা তব জাগৌ

নারহু চরণ পর্যৌ ভৈরাই বাত অপনী ঠহরায়ৌ

মাতা তৌ ন্যোঁ কহৈ সুনিলৈ জননী বাত

হমতে তূ তৌ কহা কহঁতি ঐ চলৌ হমারে সাথ।

সব চলিবে কী নাঁই অবঊ মতি আস লগায়ৌ

সবু দলু তুম ভগি জাউ পাস মতি মেরে আয়ৌ

বার বার তুমতে কহুঁ বচন কহুঁ সমঝাই

কলকত্তা কী কালী বনি গঈ সবরে ঘার কূ জাই।”

জনকনন্দিনী রামজায়া সীতা কলকাতার কালীঘাটে এসে কালীমাই হয়ে গিয়েছিলেন, এমন কাহিনি কিন্তু রীতিমত দুর্লভ। এ যেন একেবারে উলোটপুরাণ! কারণ, পৌরাণিক মতে— কালীর সঙ্গে দুর্গা বা পার্বতীর একটা সমীকরণ করা চলে, কিন্তু সীতার সঙ্গে কোনো ভাবেই সেটা করা চলে না; বরং চরিত্র অনুযায়ী সীতা লক্ষ্মীর সঙ্গে সম্পর্কিতা। আর লক্ষ্মী অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত বিষ্ণুর সঙ্গে। এবার আমরা জানি, রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতার। অন্যদিকে কালী-দুর্গা-পার্বতী শিবের সঙ্গে যুক্ত। তাই এই কাহিনিকে বৈষ্ণব ও শৈবদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একটা প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। আরও লক্ষ করবার বিষয় হল যে, এতে রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেননি, উল্টে সীতা রামকে পরিত্যাগ করেছিলেন। 

বর্তমানে তন্ত্রের দেবদেবীদের মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় যিনি সর্বাপেক্ষা জীবন্ত ও ভয়ঙ্কর হয়েও নিতান্ত আপনজন বলে গণ্য হন, তিনি হলেন দেবী কালিকা। কলকাতার কালীঘাটের কালী ভারতবিখ্যাত দেবী। রক্ষাকর্ত্রীরূপে তাঁর মাহাত্ম্য অতুলনীয়। সারা ভারতবর্ষে এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে গিয়ে কালীদর্শন করে তাঁর কাছে নিজের নিজের প্রার্থনা জানান না। সিদ্ধপুরুষ শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের ইষ্টদেবী দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীও বহুবিশ্রুত।

ইতিহাস কালী সমতকে বৌদ্ধদের যে ধারণার কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে কিন্তু আমদের প্রচলিত বিশ্বাস ও পুরঙ্কথা গৌণ হয়ে পড়ছে। সেখানে বলা হচ্ছে দেবী কালিকার প্রথম পরিকল্পনা নাকি বৌদ্ধদের ছিল, এবং সেটি নাকি ভারতবর্ষের আদিবাসীদের মধ্যে থেকে শুরু হয়েছিল। যদিও এবিষয়টি নিয়ে আজও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈধ রয়েছে। তবে একথা স্পষ্ট, মা কালী কোনো হিন্দুর ঘরে জন্মাননি, সেই তথ্য স্পষ্ট। কারণ, দেবী কালিকা মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত চণ্ডীরই রোষ-সংস্করণ, অর্থাৎ— তিনি চণ্ডীদেবীর ক্রোধজাত নবরূপা। কিন্তু চণ্ডীদেবী নিজেই তো বিন্ধ্যবাসিনী শবরী, অর্থাৎ— ভারতবর্ষের আদিবাসী শবর জাতির ইষ্টদেবী। মহাযানী বৌদ্ধেরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, শবরীকে তাঁরা শবরদের গৃহেই পেয়েছিলেন। বৌদ্ধদের দাবি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। কারণ অশ্বঘোষ লিখিত ঐতিহাসিক প্রামাণিক পুঁথি ‘বুদ্ধচরিত’ থেকে  অশ্বঘোষের কাল ছিল খৃষ্টীয় প্রথম শতক, অর্থাৎ— বুদ্ধদেবের তিরোধানের পাঁচ বা ছ’শো বছর পরে। এই পুঁথিটি চীনা ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল। সেই অনুবাদে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা থেকে একথাই মনে হয় যে, ভগবান বুদ্ধেরও কালী-দর্শন ঘটেছিল, তবে এখানে তাঁর কার্যকলাপ ছিল একটু অন্য রকমের। বুদ্ধের কালীদর্শনের যে চিত্রটি পাওয়া যায়, সেটি হল— বোধিদ্রুমের নিচে ভগবান বুদ্ধ ধ্যানে নির্বাণ বা বুদ্ধত্বলাভের জন্য বসেছিলেন। তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার জন্য এসেছিলেন ‘মার’, অর্থাৎ— যে দেবতা এসব কাজে পটু ছিলেন (‘মার’-এর আভিধানিক অর্থ কামদেবও বটে)। তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একজন নারীকে; তাঁর নাম হল ‘মা-কিয়া-কালী’ (হয়তো মেঘকালী বা মহাকালী); মহাকালীর হাতে ছিল ‘খর্পর’, অর্থাৎ— মাথার খুলি। তিনি এসে বোধিসত্ত্বের ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়েছিলেন; তারপরে নানা ছলাকলা দিয়ে তাঁকে কামমোহিত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই চেষ্টা নিষ্ফল হতেই মার তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের ত্রিশূলাদি দিয়ে বোধিসত্ত্বকে আক্রমণ করবার অনুমতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ— মহাকালীর কার্যকলাপ এখানে স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভা প্রমুখের পর্যায়ের ছিল।

যাই হোক, এই কাহিননি থেকে বিদ্বজ্জনেরা অনুমান করেন যে, ত্রিশূলধারী শিব ও খর্পরধারিণী শিবশক্তি বা কালী অশ্বঘোষের কালেও সুপরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধতন্ত্রই হয়তো কালীকে তাঁর স্থায়ী আসন দিয়েছে। বৌদ্ধদের হাতে পড়ে, মহাকালী বা কালীই প্রথমে তারা রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন; আর পরে শাক্তদের দলে ভিড়ে তারা হয়েছিলেন ‘ব্রহ্মময়ী’।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন