![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
ছায়ারা
জড়িপাড় সবুজ মলমলের শাড়ি বিছোনো আছে। ভোরের আড়ামোড়া ভাঙলে ওই জড়ির নরুণ পাড় সোনার। দুপুর হলেই চাঁদি, মানে রূপোর পাত। তখন মলমলের থান কালচে রং ধরে। ছায়া আসে ঘোরাঘুরি করে একের সঙ্গে আরো। ক্রমে এগিয়ে আসে গুমরে ওঠা সবুজ। বেলা পড়ে আসে। পাখিরা একটু গুঞ্জন তুলেই থেমে যায়। যদি খুন হয়ে যায়! মা পাখিরা ভাবে যদি ছিঁড়ে খুঁড়ে একসা হয়ে যায়!
সুনীল শেখর এখানে এসে বসে আছে। বলা ভাল পালিয়ে বসে আছে। শহরের ভেতরে এই নিস্তরঙ্গ এক স্থানে মানুষের অজান্তে। সে খুবই হাঁপিয়ে গেছে। এখন এই মলমলের মত জমিতে সে দু একটা শ্বাস নিতে চায় নির্ভয়ে। এতকাল সে সবাইকে বরাভয় দিয়ে এসেছে। ব্যস্ত নেতা জনপ্রিয় নেতা সেকুলার নেতা সে। সকাল থেকে রাত মানুষকে রক্ষা করা তার কাজ। মানুষ মানে বিপদে পড়া মানুষ। একই যাদের রং। তাদের মতো রং। যিশু খ্রীষ্টের চেয়েও বেশি, শুধু ক্ষমা নয় অপরাধকে অপরাধ নয় করে দেবার পুণ্য কর্ম করেছে সে এতদিন। কিছুদিন আগেও। আসলে পাপ পুণ্য বলে কিছু হয় না এই সিদ্ধান্ত তাকে একদা কতই না শান্তি দিয়েছিল। নিজে হাতে সরিয়ে দিয়েছে কত যুবককে। দরকার ছিল। পৃথিবীর ভার কমানো। পার্টির দ্বায়িত্ব। সবই কর্তব্য। মেয়েরা জবরদস্তি পছন্দ করে এমনটা সেও জানত চাঁপাকে যখন সে ধর্ষণ করে। সেটা প্রথমবার। এমনকি গলায় অতিরিক্ত চাপ লেগে চাঁপার যখন চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, দম নিভে আসছে তখনও কি চাঁপা উপভোগ করেনি সেই পাশবতা? প্রথমবারের পর বাকিগুলো তত অস্বস্তি জাগায় না। সে খুন হোক বা ধর্ষণ। মানুষ নেতিবাচক বড্ড। তাকে এবং তাদের দোষ দেয়। ওরা যায় বা কেন পুরুষের রাজ্যে যাদের কাজ স্বামীসেবা, ঘর দেখা, পুরুষ জন্ম দেওয়া। সেটা অবশ্য পুরনো কনসেপ্ট বলে বাতিল করে তার বউ। কিন্তু অমিতেশের ধর্ষণটা কভার করতে তাকে বেগ পেতে হলো। ক্লান্তি। একধরনের স্নায়ুরোগ হয়ত । রাতদিন কভার করতে করতে হঠাত রাতে এই অতীত ছায়ারা তাকে আক্রমণ করতে শুরু করল। ক্রমে দিনে। ক্রমে ভয়। ডাক্তার বদ্যি কিস্যু করতে পারল না। পার্টির ছেলে পিলেরা সন্তানের মত। তাদের খুন রাহাজানি ধর্ষণ ছেলেমানুষের ভুল। রক্ষা করতেই হয়। এখন আর নিজে হাতে কিছু করে না সুনীল শেখর। কিছুদিন ধরেই ক্লান্তিটা টের পাচ্ছিল। একটা মায়ানদী বারবার... জড়িপাড় সবুজ তার জমি হাতছানি দিচ্ছে। ওখানে ব্যবস্থা করে দিতে হবে না কারো। ওখানে উচ্চ নেতৃত্বের টং থেকে বসে হুকুম নেই। এখন এই শুনশান দুপুরে সুনীল শেখর দেখল চাঁপা ছাড়াও সুরমা কিম্বা পারমিতা, নাম মনে নেই, সবই এক, তাদের অস্থি ভেসে ফুলে উঠেছে নদীর ভেতর। সারিসারি ফড়িঙের কঙ্কাল এগিয়ে আসছে নদী থেকে। কালচে জমাট রক্তের স্রোতে ডুবে যাচ্ছে সুনীল অথবা শেখর। ডাক্তার নানা ওষুধ দিল, প্রেসার মাপল, ঘুমপাড়ানি বড়ি। কিন্তু চোখ বুজলেই সবুজ শাড়ি নারী হয়ে গলা টিপে ধরে। জড়ির পাড় মুখের ভেতর ঢুকে যায় সাপ হয়ে। দেয়ালে মৌমাছি ঢেকে দেয়। কঙ্কালসার সুনীল শেখর এসাইলামের ঘরে বন্দী থাকে।
পর্দা নেমে আসছে নদীর ওপর। এই ঊর্মিমালা নদীর ধারে জন্ম হয়েছিল সবুজ মলমলের ওপর কেটেছিল বালক শেখরের রোদরং। তারপর ফরাসডাঙা ছেড়ে সুতানুটির পুরনো গল্প। চাঁপার মা বুক চাপড়ে বলেছিল, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সুনীল শেখর মরেনি। এভাবেই বেঁচে আছে বন্ধঘরে। সামনে জড়িদার কালচে সবুজ মলমলের শাড়ি। চাকর এসে দুবেলা শানকিতে খাবার দিয়ে যায় মানসিক ভারসাম্যহীন সুনীল শেখরকে। পার্টি অফিসে বিস্মৃত সে। রোদ সরে গেছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন