কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা (পর্ব ৬)




প্রেম আমার জীবনে জুয়া খেলার নেশার মতো জীবনে প্রেমে পড়েছি একাধিকবার বেরিয়ে এসেছি সেখান থেকেও অনেকবার। সব প্রেমিক অসৎ ছিল, এমন নয়। ভালো লাগেনি পথ চলতে আমার সেই ছায়ার সাথে হয়তো! কোনোদিন জানতে পারিনি প্রাক্তনরা আমায় নিয়ে কী ভাবে! জরুরী মনে হয়নি তাদের সিগনেচার সার্টিফিকেট নেবার। সকলের জন্যই সেই নিদির্ষ্ট সময়কালে লুটিয়েছি নিজের অর্থ, মনের সবটা। বেঁচেছি তাদের জীবনের মুহূর্তগুলিতে নিজের ভাঁড়ার শূন্য হয়েছে। আমার কোনো গিফট বা স্মৃতিও নেই, যা আমাকে বা আমি তাকে ধার করি। সব দানেই আমি হারতে হারতে গেছি একেবারে নিঃস্ব হবার আগে সম্বিত ফিরেছে। খেলা শেষ করেছি। আমার কালো রং ও চেহারার প্রতি যে শ্রেণীঘৃণা, তাকে জয় করেছি মাত্র। গেম ওভার।


প্রথম প্রেমের ক্ষী স্মৃতি একদা চোখের কোণা ভরেছে বহুদিন। প্রেমিক এড়িয়ে যেতে থাকলে তার বাড়ি পর্যন্ত ছুটেছি। না, কোনো উত্তর নেই। ছুটেছি কলকাতা, উত্তর মেলেনি। প্রেমিকের গান শোনার শখ। কী করি, কী করি! ওয়াকম্যান দিতে হবে। টাকা হাতে থাকার চল আমাদের সেই সময় ছিল না। এক বন্ধু বলল, ‘উপায় আছে’। আমি জানতে চাই, কী! সে বলল, ‘তোর হাতের এই আংটি বিক্রি করে দে’। সদ্য কলেজে ওঠার পর পড়েছি এটা। বাড়িতে কি বলব? সে বলল, ‘সিম্পল। বলবি হারিয়ে গেছে’! ফস করে জিজ্ঞাসা করলাম, কত টাকা পাব?’ সে বলল, এই ১৫০০ টাকা তৎক্ষণাৎ তার মেসের ঘরে খুলে দিয়ে এলাম হাতের আংটি। পাঠিয়ে দিলাম সেই ওয়াকম্যান ও ঘড়ি। মাঝে কেটে গেছে একটি বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন  আমি ছাত্রী একবার যেতে হয় সেই হষ্টেলে যেখানকার সে আবাসিক সঙ্গে আমাদের  কয়েকজন কমন ফ্রেন্ডস। আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তারপর তার রূমে গিয়ে  অপার বিস্ময়ে দেখি, সে তার নতুন প্রেমিকার সঙ্গে গান শুনছে। বাজছে রফির গান, ‘বড়ি মস্তানি হ্যাঁয় মেরে মেহেবুবা, আনে সে জ্যাইসে আয়ে বাহার...’সাউন্ড বক্সের কডের দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা আমার দেওয়া ওয়াকম্যানে গিয়ে থেমেছে। তার হাতে দেখি আমার দেওয়া ঘড়ি। নিজের খালি আঙুলের দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে ওঠে। ভালোবাসা? নাকি ‘আ ব্রিফ রিলেশনশিপ উইদাউট মাচ ফিলিং’? না,  তার সাথে আমি বেড শেয়ার করিনি। সে আমাকে কখনো স্পর্শও করেনি। তবে ঠোঁট ছুঁয়েছিল একবার, জাস্ট 
একবারই।

পরে তার সাথে বহুবার দেখা হয়েছে কথা হয়েছে একবার কপিল শর্মার শো দেখার মতো গুড় গুড় করে হাসি চাপতে থাকি আমি টনটন করা চোয়াল নিয়ে।  নিজের নির্বাচন ও প্রেমের কন্সেপ্ট নিয়ে। একে কি এক মুহূর্তের জন্যও মিছে মিছে খেলতে খেলতে প্রেমিক বানানো যায়? জুয়ায় দান ফেলা যায়, পাশা খেলা যায় মাত্র শিখন্ডি খাড়া করে নিজের নিশানায় তীর মেরে যাওয়া যায় অবিরাম আমার নিশানা আমি ছিলাম, তফাৎ খালি এইটুকুই।


পুরুষের যে বহুগামীতা আমার নজরে আসে, তা থেকে আমি শিক্ষা নিই। প্রেম নয়,  এবার বিবাহ করে ফেলি, যেমন সান ইন ল বাড়ির প্রয়োজন, তেমনটা। মূল্য এবারে নির্ধারিত হয় আমার মেধা ও সময়। পোষ্ট গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল ইয়ার আমার তখন। কথা হয়, আমার হবু স্বামীকে পাশে বসে পড়িয়ে উৎরাতে হবে তার এম বি  বি এস ডিগ্রী, এটাই তার লাস্ট চান্স। সেটা আমি করে দিই সততার সাথে। বাড়িতে যে বঞ্চনা সয়ে এসেছিলাম কালো চেহারার জন্য, তার আমি মুখতোড় জবাব দিই  পরিবারে প্রথম ডাক্তারেরে স্ত্রী হয়ে। পরে সে মেডিক্যাল পড়া শেষ করে চাকরি পায়। তার আগে সংসার চালানোর জন্য বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে আসতে হতো টাকা বাকিটা তার স্কলারশিপের টাকা। প্রায় না খেয়েই কাটে অনেকদিন তার স্বামী হবার পূর্বশর্ত আমি পূর করি এইভাবে। তারপর তাকে ছুঁড়ে ফেলি জীবন থেকে, মন থেকে। কাগজ থেকে যায়। আমাদের হানিমুন বা বিবাহের যাবতীয় রিচ্যুয়াল অধরা থেকে যায়। আমি তার পরিবারের কাউকেই চিনি না। যদিও সে আমাদের পরিবারে জাঁকিয়ে বসে।

এখন সে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক। কিন্তু বেল পাকলে কাকের কী? আমি তাকে  পেরিয়ে এসেছি। তার কোনো স্মৃতিই আমার কাছে নেই। এমনকি কোনো বিবাহের কোনো ছবিও নেই তবে সে আমার একমাত্র সন্তানের পিতা। বিয়ে নয়, বিষ পান করেছিলাম আমি। ভালোবাসা বা ভালো লাগার কোনো প্রশ্ন বা দায় সেখানে আসেনি।



সবাইকে তাদের লক্ষ্যে পৌছাতে ও শখ পূণের কারিগর হতে গিয়ে আমি সেই  উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের বুড়ো হয়ে থেকে গেছি। আমি মাঝ নদীতে অপেক্ষায়, বাধ্যতায়। পারাপার চলছে, কিন্তু আমি তীরে যেতে পারিনি। কেননা আমি সবার লক্ষ্যে নিজেকে দেখেছি, কিন্তু নিজেরটা করে উঠতে পারিনি আর তাই সময় অধরা থেকে গেল আমার। আমার সময় অন্যের অরবিটে গতি জুগিয়ে গেল।

(ক্রমশ)  
              
 


4 কমেন্টস্: