কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রোখশানা রফিক

পর্দাপ্রথা,  কিছু সংশয় ও প্রবাস






(৭)  

ব্যক্তিগতভাবে আমি ইন্টেরিয়র ডিজাইনে দু'টি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী লাভ করলেও, ফ্যাশন ডিজাইনের বেসিক কাছাকাছি হওয়ায় সে সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা রাখি। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যতটুকু খেয়াল করেছি, বহুজাতিক বিমান সংস্থাগুলো তাদের  বিমান বালাদের জন্য যতদূর সম্ভব স্মার্ট, আঁটসাঁট এবং যৌন বেদন সম্পন্ন অথচ  পরিশীলিত, এরকম ড্রেস কোড ব্যবহার করে। এর উদ্দেশ্য দু'টি,  প্রথমতঃ বিমানের দুই সারির সিটের মাঝখানের সরু আইলে দ্রুততার সাথে চলাফেরা ও কাজের সময় যেন পোশাক টকে গিয়ে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। দ্বিতীয়তঃ অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা   করে বাছাই করা বিমান বালাদের স্লিম কর্ষণীয় শরীরের নয়ন মোহিনী প্রদর্শন।  

এরই ধারাবাহিতায় Emirates নামক বহুজাতিক বিমান সংস্থাটি তাদের এয়ার হোস্টেসদের জন্য মাথায় টুপি / হ্যাটের নিচের বাপাশ থেকে ডানপাশ পর্যন্ত গলায়  পেঁচানোর লাল স্কার্ফ, বুক পকেট সহ খাকী / বাদামী শার্ট, একই রঙের শর্ট স্কার্ট,  হাইহিল, চড়া রঙের লাল লিপস্টিক... মোটামুটি এরকম একটা ড্রেস কোড চালু করে। এয়ারপোর্টে ট্রলি স্যুটকেস হাতে তাঁরা যখন অপ্সরার মতো হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে চারপাশ আলো করে হেটে যান, কার না ভালো লাগে? আমি যে কোনো সুন্দরের  পূজারী বলে, আমারও যথেষ্ট ভালো লাগে তাঁদের পদচারণা। (রংধনু ভাববেন না যেন প্লিজ) মি ব্যক্তিগতভাবে কখনো এমিরেটস-এ ভ্রমণ না করলেও অনেক বিমান বন্দরেই তাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। বিশ্বমানের বলে তাদের সেবা সুপরিচিত।

বাংলাদেশে থাকার সময় একজন এমিরেটস-এর বিমানবালাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন। তিনি আশকোনা-উত্তরা এলাকায় মধ্যপ্রাচ্য ফেরত নির্যাতিতা গৃহকর্মীদের আইনগত ও চিকিৎসাসেবা প্রদান, প্রাথমিক ও হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিনামূল্যে দেয়ার একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, যা এমিরেটস-এর সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের র্থিক সহায়তায় পরিচালিত হতো। পার্টনারশিপ নিয়ে  প্রতিষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোক্তা বিমানবালার সঙ্গে দ্বন্দ্বে বিজয়ী হয়ে তিনি পরে কি একটা ন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে, মারিয়া নাম ছিল মেয়েটির। তাঁর পরিচালিত আশকোনায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির নাম মনে পড়ছে না। 

যেজন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম, তা হলো, যতবার তাঁকে দেখেছি, তিনি বাঙালি সালোয়ার-কামিজ ওড়না বিহীন পরতেন, অনেক ডায়েটিং-এর ফলে ফ্যাকাসে রক্তহীন  চেহারার স্লিম লম্বা একজন সাধারণ চেহারার নারীই মনে হয়েছে তাঁকে আমার। হতে  পারে উন্নত মেকআপ টেকনিকের কারণে কাজের পোশাকে তাঁদের এত কর্ষণীয় লাগে!

আমার লেখায় এই প্রসঙ্গ টেনে নার কারণ হলো, এমিরেটস-এর এই স্কার্ফ-এর আদলে মধ্যপ্রাচ্যের ধুনিকা তরুণীদের আমি মাথায় ওড়না / স্কার্ফ পেঁচিয়ে মনকাড়া মেকআপের সাথে হিজাব পরা খেয়াল করি প্রথম। অধিকাংশ মেয়েকেই মোহনীয় লেগেছে আমার চোখে ওই পোশাকে। পরে এই ট্রেন্ডই অন্যান্য দেশের মেয়েরা ফলো করতে শুরু করেন।

কিন্তু, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটি আসলে মূলগত ভাবে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ইসলামকে বাজারজাত পণ্যে রূপান্তরিত করার বিজনেস পলিসি ছিলযার  পিছনে এখন আমরা চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্ধ অনুকরণে মেতেছি পুণ্যলাভের আশায়।

কেবলমাত্র বাংলাদেশের কিছু অসাধু পীর-ফকিররাই ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেন না,  ভ্রাতা এবং ভগিনীগণ! ন্তর্জাতিক ব্যবসাঙ্গনেও ধর্ম একটি পণ্যতার অনুকরণে পুণ্যলাভ কখানি হবে, তা অবশ্য আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কুলায় না।






(৮)

আমি যেহেতু মার এই লেখাটিকে গবেষণামূলক প্রবন্ধ হিসাবে কোটেশন ভারাক্রান্ত করতে চাইছি না, তাই পর্দাপ্রথা সম্পর্কে ইসলামিক প্রেক্ষাপট বা দৃষ্টিভঙ্গীও সহজ ভাবেই উপস্থাপন করতে আগ্রহী হলাম। 

কোরান এবং হাদিসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, সর্বপ্রথম নেকাব / পর্দা / হিজাব / ড়াল যাই বলি না কেন, তা রসুলুল্লাহ (সাঃ)এর স্ত্রীগণের জন্য   নির্ধারিত করা হয়েছিলজানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর মনোনীত যে কোনো একজন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এরকম এক যুদ্ধফেরত কাফেলায়  মুহাম্মদ (সাঃ)এর স্ত্রী হযরত য়েশা (রাঃ) ভুলক্রমে রাতের বেলা পেছনে পড়ে যান কাফেলা বেশ দূরে চলে যাওয়ায় সঙ্গে যেতে না পারায়, তখনো রওয়ানা হননি  এরকম একজন যুবক সাহাবীর পাহারায় তিনি সেখানে রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে হযরত য়েশা (রাঃ) এবং সেই সাহাবীর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে  কিনা, এনিয়ে প্রচুর আলোচনা শুরু হলে নবীজি মানসিকভাবে চাপের সম্মুখীন হন। এরপরই তাঁর স্ত্রীগণের উপর পর্দার আবশ্যিকতার আয়াত সমূহ নাজিল হয়। যাতে  সম্মানিতা হিসাবে তাঁদের আলাদা করে চেনা যায়। তারপর থেকে হযরত আয়েশা  (রাঃ) ফজরের নামাজ জামাতে দায় করতে আসার সময় তাঁর সঙ্গীনিগকেও পর্দা করে আসতে অনুরোধ করেন।... এই হলো ইসলামিক ইতিহাসে পর্দাপ্রথা চালু হওয়ার সংক্ষেপিত ঘটনা।

রো জানা যায়, একবার হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর ভাতিজা আবু ফজল (রাঃ) ও জনৈক সাহাবীকে নিয়ে কোথাও রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে, একজন সুন্দরী  অবিবাহিতা তরুণী তার পিতার কাছ থেকে কোনো এক দরকারী সংবাদ হুজুর পাক  (সাঃ) কে দিতে এলে, মেয়েটির অসাধারণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আবু ফজল (রাঃ) বারবার মেয়েটির প্রতি দৃষ্টিপাত করছিলেন। আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বারবার নিজ হাতে বু ফজলের কাঁধ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়েটিকে পর্দার বরণে জনসম্মুখে সতে নির্দেশ দেননি।

উপরোক্ত ঘটনাসমূহ নিয়ে সারা বিশ্বের মুসলিম আলেম সমাজের মধ্যে মুসলিম নারীদের পর্দার বশ্যকতা এবং কাদের উপর তা প্রযোজ্য, এনিয়ে বিস্তর গবেষণা ও মতপার্থক্য বিদ্যমান। হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের ক্ষেত্রে কেন মহিলাদের হিজাব বা বোরকা পরিধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়নি, এই ব্যাপারটিও পর্দাপ্রথার পক্ষে /  বিপক্ষে যুক্তিতর্কের লোচনাকে বেগবান করেছে। আবার, বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত  ইসলামিক পর্দার বিভিন্ন ধর, যেমনঃ হিজাব, বোরকা, নেকাব, চাদর, শায়লা এরকম  আরো কয়েকটি প্রকারভেদের মধ্যে কোনটি অধিক ইসলামসম্মত, তা নিয়েও মতভেদ আছে।

পাশ্চাত্য দেশগুলোর বিভিন্ন স্কুলে অনেক সময় আমরা লক্ষ্য করে থাকি, ছাত্রীদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করার একটা চল বর্তমানে হয়েছে। মুসলিম দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ক্ষুব্ধ হন এই সিদ্ধান্তে। প্রচুর প্রতিবাদমুখর ন্দোলনও হয়ে থাকে এনিয়ে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম গুরুত্ব সহকারে এই খবরগুলো প্রচার করলেও ফলোআপ কম হয়। মানে, শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, তা খুব কমই  জানা যায়।

শিক্ষকতা পেশায় সংশ্লিষ্ট একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমি ওই সকল স্কুল কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ উদঘাটন করতে সচেষ্ট হয়েছি। কেবলমাত্র আমি  যে মুসলিম, সেই দৃষ্টিকো থেকে নয়। ভেবে দেখেছি, যে কোনো স্কুলে ড্রেস কোড মেনে চলা হয় মূলতঃ ছাত্র / ছাত্রীদের পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থানের ব্যবধান ঘুচিয়ে, একটি সম মানসিকতার একাত্মতাবোধ বা ইউনিটি তৈরি করার লক্ষ্যে। সেখান থেকেই ইউনিফর্ম শব্দের উদ্ভব। এর উদ্দেশ্য যাতে কেউ আত্মম্ভরিতা বা হীনমন্যতায় না ভুগে, পারস্পরিক সৌহার্দ মূলক একটা পরিবেশ শিক্ষাঙ্গনে বজায়  থাকে।

এক্ষেত্রে, সম্ভবতঃ, সেই সকল স্কুল কর্তৃপক্ষ এই দৃষ্টিকো থেকে স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ  করেন, যাতে কিছু সংখ্যক ছাত্রীর ধর্মীয় পরিচয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু ধর্মীয় পরিচয়, তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সেপারেট আইডেন্টিটি বা মাইনরিটি, এরকম কোনো বাধার প্রাচীর হয়ে না দাঁড়ায়।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই ব্যাপারটি স্কুল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিকো থেকে?

(ক্রমশঃ)


1 কমেন্টস্: