কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

গোলাপ


Some people grumble that roses have thorns : but I am grateful that thorns have roses. (Alphones Karr)

রাত দশটা। ব্যারেজের বর্ধমানের দিকের সেচখাল পাঁচটা গেট খোলা। পাহাড়ী নদীর মতো জলের স্রোত, ফেনা। সাদা মেঘের মতো ভেসে যেতে গিয়ে ঝরে পড়েছে জল হয়ে। অভিষেক বটগাছের নিচে বসেগাছের ডালগুলো মাটির সমান্তরালে নেমে এসেছে খালের দিকে  
টোল প্লাজা পেরিয়ে দক্ষিণভারতের ট্রাকগুলো একের পর এক বয়ে যাচ্ছেপেছনের রাস্তার সেই আলোর দিকে অভিষেক তাকায় না

আজ বুধবার। ১৯শে ফেব্রুয়ারী। ফাল্গুনমাস পড়ে গেছে। তবে বেশ শীত। কাশ্মীরে একটা নতুন ঝঞ্ঝা তৈরি হয়েছে। অতলান্তিক ভূমধ্যসাগরে জলীয়বাষ্পর আধিক্যের জন্য একের পর এক পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ইরাণ–আফগানিস্তান–পাকিস্তান হয়ে কাশ্মীরে আছড়ে পড়ছেকাশ্মীর হিমাচল উত্তরাখন্ডে বৃষ্টি আর তুষারপাত চলছে একটানা। কনকনে ঠান্ডাফলে ব্যারেজ এলাকায় এখন তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছিঅভিষেক তার বাইকের ডিকি থেকে মাফলারটা বের করে বেঁধে নেয় মাথায়
খালের কলকল শব্দ, প্রচন্ড স্রোত, ভয়ংকর এই অশান্তি কিছুদূর যাবার পর শান্ত, ঠিক যেখানে তামলা খাল পার হয়েছেঅভিষেক অপেক্ষা করতে করতে নিজের মোবাইলটা বের করে। কললিস্ট খুঁটিয়ে দেখেমস্তিষ্ক জুড়ে একটা ঝড় জন্ম নেয় আর তখনই সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সচকিত করে প্রবাহিত হলো সেই অতি পরিচিত শব্দ, ‘বলো হরি ... হরিবোল!’ নাকে এসে ঝাপটা মারল সস্তা ধূপের কড়া গন্ধ । হিমহিম ভেজা ঠান্ডায় ধূপের গন্ধের ভেতরেই অভিষেক ভাবে, অতটা সরল নয় তার মোবাইলের এই কললিস্ট

ছমছমে নির্জনতায় সে একা খুব মন দিয়ে কল লিস্টের নামগুলো দেখতে থাকেঅশোক বাবুল রিংকুদি সুপ্রিয়া সকলেরই বিশ্বাস ছোটবেলা থেকেই অভিষেক একটু পাগলাটে
আবার সুমনদা বলে, ওটা একটা সেয়ানা বজ্জাত। অভিষেকের বাবার শরীর ভালো না, কোথায় বাবার কাছে কাছে থাকবে, তা না, বরং বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মিশে মিশে সকাল বিকাল নিজের বাপকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছেমা’র সঙ্গে সম্পর্কটা তবু খানিক সড়গড়, তবে সেটাও খুব বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না না, আজ অভিষেক একটুও কাঁদেনি। কান্না পাচ্ছেই নাবাবা নামধারী লোকটা আজ দুপুরে মারা গেলভুগছিল বেশ ক’বছর ধরেই তবু শেষকালটায় আত্মীয়স্বজনেরা এমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল! ঘনঘন দেখতে আসা, ফোন করা, কালীবাড়ির প্রসাদী ফুল ছোঁয়ানো...  জ্যেঠু বলেছিল অভিষেককে, আর তো খুব বেশিদিন নেই, একটু কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারো না?’
জবাব দিতে পারেনি অভিষেক বুক ধুকপুক করছিল। বলতে পারত, উনি তো আমার বাবা নন!  
কিন্তু জ্যেঠুর বিকট রাগের মুখে কোনোক্রমে বলেছিল, পরে যাব 
পরে যাবে? ... পরে?
ঠিক তক্ষুণি অভিষেকের পেছনেই নিঃশব্দে মা এসে দাঁড়িয়েছিলমাকে দেখেই কেমন নিভে গেল জ্যেঠুমনে মনে অভিষেক জানে, তার বাবা নামধারী লোকটা কোনোদিনই এ সংসারের কেউ ছিল নাতাদের বাড়ির ড্রইংরুমের গোল্ডফিশের ছোট্ট অ্যাকোরিয়ামটা পর্যন্ত মায়ের। বাবার কিচ্ছু না। বাবা শুধু বসে বসে খায়মা ইচ্ছে করলেই আবার একটা বিয়ে করতে পারত। হয়তো করবেও একদিন করছে না  বোধহয় অভিষেক এখনো কলেজ অব্দি পৌঁছতে পারেনি বলেই! নইলে বাবার জন্য মায়ের কোনো অনুভূতিই নেই

বাবা? অভিষেক নিঃশব্দে হাসেমালতীপিসির কাছে কবেই জেনে ফেলেছে অভিষেক,  তার আসল বাবা জ্যেঠু
জ্যেঠুই বাবা? ভাবতে একরকম হিংস্র বন্য আনন্দ বুকের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জ্যেঠু লোকটাকেও দু’চক্ষে দেখতে পারে না অভিষেক। অঢেল টাকা, অথচ এক প্যাকেট সিগারেটে একমাস কাবার করে দেবে। মায়ের জন্য অবশ্য দামী দামী শাড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র রাতদিন কিনে এনে দিচ্ছে। তবু লোকটাকে সময় সময় বেদম বিরক্তিকর মনে হয়জ্যেঠুই যদি সত্যি বাবা হয়, তো একদিন অভিষেক ঠিক  প্রতিশোধ নিয়ে নেবে জলে ভর্তি খালপাড়ের ইউক্যালিপ্টাস জঙ্গলের ওইদিকে বার্নিংঘাটঅভিষেক জানে, তার বাবা নামধারী লোকটা এতক্ষণে ওখানেই পুড়ছে। পকেটের বাকি মোবাইল দুটো সুইচ অফ্। ইচ্ছে করেই রেখেছে এমন। বন্ধ মোবাইলগুলোর একটায় তন্ময়দার ফোন নাম্বারটা রাখা আছে। ছোটবেলায় মনে হতো অভিষেকের, তন্ময়দা তার বাবা হলে দারুণ হয় ব্যাপারটা! কী হুল্লোড়বাজ আর সাহসী! তন্ময়দার কাছে মার নামে চুকলি কাটা যেত ইচ্ছেমতোন। এই রকম চুকলি কেটে মার কাছে আগে কতবার মারও খেয়েছে অভিষেক কিন্তু একটা সময়ের পর  মা আর তন্ময়দা কেউ কাউকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না। টাকা পয়সা সংক্রান্ত কীসব ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল যেন!

তিন নম্বর মোবাইলের কললিস্ট আবার খুঁটিয়ে দেখলনাঃ কোনো মিসড কল নেই কিংবা কাঙ্ক্ষিত কলটা এখনও অভিষেকের কাছে এসে পৌঁছতেই পারেনি। কান থেকে মাফলারটা টেনে নামা মনে হয়, কল লিস্টের প্রতিটা নামের পেছনেই চাঁদ লুকিয়ে আছে। শুধু মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষা

এ মোবাইলটা মায়েরঅনেক আগে ব্যবহার করত মা, কখনও সখনও দেখেছে অভিষেক এবং এটাই সেই মোবাইল যেটা দিয়ে কথা বলার সময় মাকে দারুণ উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত হাসিখুশি দেখাতএকটু কি তখন নিষিদ্ধ আনন্দের অস্বস্তি লেগে থাকত না মা’র মুখে?
অশান্ত খালপাড়ের ঘনঘোর নির্জনতায় মেঘের আস্তরণ সরিয়ে আকাশে ঘিয়ে রঙা চাঁদটা উঁকি মারল এসময়
অভিষেক বলল, গোলাপ


1 কমেন্টস্: