‘কিছু দুঃখ ব্যক্তিগত’র
সাথে কিছুদিন
উৎসর্গ পড়ি – ‘মা নেই। বুকের ভেতর গোর’ আর সাথে সাথে কী এক গভীর নৈঃশব্দ আমাকে আমূল জাপটে ধরে। কে এই নিশিথ নীরব কথক! কার বুকের ভেতর মা নেই, তার এমন দারুণ ছটফটানি! হয়তো সবার ভেতরই এমনই
নিঃসঙ্গতার বাস। কে বলতে পারে এমন করে, কে জানে তার খবর! আহা – মা। না জানি কী এক উৎসব, তার নাম ‘মা’। জন্মে দেখান
তিনি আলো। আলো জ্বেলে জ্বেলে কবে পুড়ে ছাই তার সলতে, কেউ জানি না। যেদিন দীপ নিভে যায়, চারপাশ অন্ধকার, সেদিন বুঝি জানতে পারি সে এক দারুণ দীপ ছিল
জীবনে। উৎসব দিয়ে গেছেন প্রতিদিন
বেঁচে থেকে। জ্বেলে দিয়েছেন প্রত্যূষে নিবিড় কোমল আলো। আর জ্বালাতে জ্বালাতে সন্তানের জীবনের পথ আলোকিত
করতে করতে যখন নিভে গেছে দীপ, তখন ঘোর অন্ধকার সব। বুঝি দারুণ এক উৎসব শেষ। চারপাশে কত
কত যে সব কথার ভীড়, আত্মীয় পরিজন, ধুম্র উদগীরণ, কী প্রখর বর্ষা, জল থৈ থৈ সজল জীবন যাপন! কিন্তু সত্যি কোথায় যেন গোরেরই নিঃস্তব্ধতা। সাদা। বরফেরই মতো রংহীন আর ঠান্ডা সে অনুভব-
‘মা নেই / বুকের ভেতর গোর / বরফের স্তুপ /আমি এক শ্বেত ভল্লুক’।
আমরা জানি, কোনো বইয়ের উৎসর্গ মানে, সাদামাটা শব্দে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কিন্তু এখানে ‘কিছু দুঃখ ব্যক্তিগত’’ মায়ের পায়ের নিচে কৃত আর অর্জিত সম্পদের অঞ্জলি দান। আমি মুগ্ধ এক পাঠক। শুরুতেই নিবন্ধ নিবিষ্ট নিবিড় হয়ে
পড়ি আর ঢুকে পড়ি খালেদ রাহীর ‘কিছু দুঃখ ব্যক্তিগত’র জানালা দিয়ে বহুদূর।
আমি ভীষণ এক ‘চুজি’ পাঠক। শুরুর শব্দ আর বাক্য ভালোবেসে কাছে না টানলে উপযাচকতায় বেশি একটা ঠেকি না। তাই পরাণের গহীন ভিতর পড়ে মুগ্ধতায় লয়ে বিলয়ে বহুকাল
দিনযাপন করি সেই যৌবনের শুরুতে। কিন্তু বেশিদূর জোর করেও এগোতে পারি না প্রিয় সাহিত্যিকেরই ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে। মুগ্ধ বিস্ময়ে যখন ক্লাসে চেয়ে থাকি প্রিয় শিক্ষকের দিকে, হুমায়ুন আজাদের লেকচার শুনি। অবাক বিস্ময়ে মনে রাখি ভাষার দৈন্যতা নিয়ে আমাদেরকে দেওয়া তাঁর দারুণ গালিটি। ঠিক তেমনি
দূর্বিনীত ভালোবাসায় নমস্কার করি আর খুব ভালোবেসে মঞ্চে আবৃত্তি করি তাঁর লেখা-
‘ভালো থেকো ফুল / মিষ্টি বকুল /ভালো থেকো’।
কিন্তু পড়তে পারি না দু’একটি লাইনের বেশি প্রিয় শিক্ষকের অনেক অনেক বই-ই। পাঠের এ দীনতা আমার নিজস্ব। রুচিবোধ
থেকে হয়তো! মা সর্বভূক ‘রিডার’। তাঁকে দেখে দেখে তাঁর সাথে বই কিনতে কিনতে বইয়ের প্রতি নেশা। কিন্তু মায়ের সে সর্বভূক পাঠসত্তা আমার ভেতরে প্রোথিত হয়নি কোনোকালেই। এ আমার পরম না পাওয়া। এই না পাওয়াকে স্বীকার করেই নিদারুণ এক পাঠসত্তা
আমার। হয়তো ‘মিস’ করে যাই অনেক কিছু। ক্ষ্যাপার মতো। আবার পেয়েও যাই কখনো কখনো, বিস্ময় হয়ে জেগে রয় বুকে যা চিরকাল। তেমনি বিষণ্ন অথচ নির্বাক অপরাজিত এক অনুভব পাই কথাগুলো
পড়তে পড়তে
‘কেন যে আশকারা দিয়ে আমার চোখে নেমে এনেছিলে
নীলাকাশ / কেন যে আশকারা দিয়ে আমাকে বানিয়েছিলে ঘুড়ি / যদি উড়ার আগে কেড়ে নেবে সুতো’।
মানুষ পশুর প্রভেদ দেখি তাঁর কবিতায়। পশু জন্মে পশু। দিন দিন সে পশুই হয়। আবার মানুষও জন্মে পশুরই মতো। দিনে দিনে কেউ কেউ মানুষ হয়। আর কেউ কেউ হয় দ্বিপদী জীব। মানুষ নয় কখনো। কিন্তু এ সকল আধ্যাত্মিক মার্গের বাইরে দেখি দারুণ এক স্বচ্ছ সীমারেখা বিভেদের। মানুষ আর পশুতে-
‘আমার ছেলে বয়স আর কত – হামাগুড়ি দেয়... / আচমকা আমার ছেলে দাঁড়িয়ে গেলে / বিড়ালটা ভয় পায় / পশুর কাছে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা এক বিস্ময়’। (কবিতা – ‘বিড়ালের গল্প’)
পশু মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। মানুষ পশুর মতো যখন হামাগুড়ি দেয় তখন যে কোনো পশু তাকে নিজেরই মতো ভাবে। কিন্তু হঠাৎ যখন মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে তখন একই সাথে শুরু হয় পশুর বিস্ময়। জানতে শুরু করে সে বিভেদের সীমারেখা। আর মানুষের পশু শাবকটিও মনুষ্যত্বের প্রথম সিঁড়িটাতে পা ফেলে। বিড়ালের চোখে দেখা মানুষের এমন এই দারুণ ইমেজ কী যেন আরও গভীর কিছু নির্দেশ করে যায় আমার মনে।
জীবনের পায়ে চলার পথে রক্তাক্ত হৃদয়ক্ষত নিয়ত মানুষকে করে দেয় একা। নিঃসঙ্গ। চাওয়া আর না পাওয়ার দারুণ সংঘাতে ক্লিষ্ট হত জীর্ণ অধোবদন করে তোলে ব্যাকুল। নিভৃতে একা বসে সেই চাওয়া পাওয়া আর না পাওয়ার অগুণতি ক্ষোভ হতাশার নিদারুণ ‘ব্লেন্ডিং’ বুঝি একজন মানুষকে করে তোলে কবি। তারই সত্যদ্রষ্ট ছায়া উপচ্ছায়া খুঁজে পাই এখানে, এই পংক্তিগুলোতে-
‘বাতায়ণে গোলাপগন্ধি বাতাস এলে মধ্যবিত্তের খাঁচা ভেঙে কেবলি উড়াল শিখি / উড়াল প্রিয় চিলের ডানায় / উড়তে উড়তে দৈর্ঘ প্রস্থের আকাশ কেবলি অধরা / আহ! এক জীবনে মৃত্যুকে ছুঁয়ে দিচ্ছি; / ছোঁয়া হলো না উচ্চবিত্তের বারান্দা’। (কবিতা – ‘মধ্যবিত্ত’)
এখানে ইমেজের সাথে সুগন্ধ পাই খুঁজে। চেনা চেনা ফুলের সাথে খুঁজে পাই যে কোনো হৃদয়ের আঘ্রাণ আর হতাশা। ভালোবাসা প্রেম স্বপ্ন, যার সাথে বাস্তবের রয়েছে চিরকালীন দ্বন্দ্ব ও এক ঘোর প্রবঞ্চনা। দারুণ শাশ্বত হয়ে ধরা দেয় যা আমার চিরকালের রোমান্টিক ভাবনায়। আরো আরো নানা চিত্রকল্প সমৃদ্ধ করে দিয়ে যায় তাঁর সৃষ্টির চলমান পথরেখা। বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা আসঙ্গলিপ্সার সাথে চিরকালের মিথের মিশেলে এখানে তৈরি হয়েছে আরো একটি অসাধারণ চিত্রকল্প-
‘ভালোবাসা দ্রাক্ষালতা / আর আমি একটা শিয়াল / তোমার শরীরে যৌবন / অথবা আঙুর ফলের মৌসুম / ভালোবাসা দ্রাক্ষালতা নাগালের বাইরে / ফলে আঙুর ফল টক’। (কবিতা – ‘অসম্ভব’)
চির প্রত্যাশিত অমলিন বোধ আর অধরা মানব কিংবা মানবীই প্রধানত মানুষেরে আরাধ্য। আর এইসব প্রথাগত প্রত্যাশিত বোধের মালিন্য কিংবা না পাওয়ার মাঝেই বাস করে একজন লেখকের আত্মা, কবির বিজয়। তাই কবি চিরকাল রোমান্টিক তার স্বপ্নালুতায়, তার বিধ্বংশে তার জটিল দুঃসহবাসে কী যাতনায় কী পরবাসে বিদগ্ধতায় কী বিনাশে কী বিন্যাসে। আমি দেখি এই লাইনগুলোতে তার ক্রমজটিল বিন্যাস আর বিনাশ। চিরকালীন রোমান্টিসিজমের এক অসাধারণ মার্গ। আমাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে এক ক্রম উর্ধ্বতর সত্ত্বায়–
‘ডিম থেকে মুরগীর বাচ্চা ফুটেছে / বাচ্চা তো জানে না / ঘরে বাইরে শিয়ালের আতঙ্ক/ ...আমি এক ডিমখেকো পাখি / আমার স্বপ্নকে আমি খেয়ে ফেলেছি / সতত নরক বাসে’।
কিংবা
‘হৃদয় লাল হতে হতে বটফল / অথচ কোনো পাখি নেই এ ছায়াতলে / ও কুসুম এত লাল কেন?’
অনেকগুলো কবিতায় অসাধারণ সব চিত্রকল্প আমাকে বিমুগ্ধ করে রাখে। মন নামক একটি দেহলীন অনুভবকে গোপনে সবাই প্রাণবান বেগবান করে তুলি। আর প্রতিনিয়ত লাগাম কষে ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টার এক দারুণ চিত্রকল্প দেখতে পাই ‘ভাবনা’ কবিতাটিতে। আমার মনে হয়, এ যেন মনের অবদমিত প্রত্যাশায় ফ্রয়েডিয় স্বপ্নব্যাখ্যার এক মূর্ত প্রবহমানতা-
‘একটা ঘোড়া নেমে গেছে / একটা সুন্দরীর পিছু পিছু / কৈ মাছের মতো কান ঠেলতে ঠেলতে /দূর / অনেক দূর’। (কবিতা – ‘ভাবনা’)
তাঁর কবিতায় পা রয়েছে সৃষ্টির এক বিস্তৃত অংশ জুড়ে। কখনো সে নারীর পা ধরে এঁকেছেন প্রিয় পংক্তি। আর আমার তাতেই দারুণ ভিজ্যুয়ালাইজেশেন। প্রকৃতির নীরব নিথর রূপের মাঝে সুচিন্তিত অসাধারণ এক মানবায়ন দেখতে পাই কোনো কো্নো কবিতার পংক্তিত-
‘তবু পা আমাকে টেনে নেয় রাত্রির আশ্চর্য রোদের তলপেটে.../ শৈশবে নীলুকে চিনতাম; রাত্রি এলে / ভাবতাম পায়ে পায়ে পা ফেলে ডেকে আনবো বংশের প্রদীপ। / আহ্ নীলু তোর পা আমাকে কেবলই ভিখিরি বানিয়ে রাখে ঘুমের শহরে’। (কবিতা – ‘পায়ের জন্য হাহাকার’)
এইভাবে শেষ হয় ‘কিছু দুঃখ ব্যাক্তিগত’ কবিতার বইটি পাঠ। সত্যি বলছি, আমার যে কোনো বইয়ের প্রথম পাঠকে আমি পাঠ বলি না। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পাঠেই আমার চৈতন্যের গভীরে প্রবেশ ঘটে। তাই দ্বিতীয়বার পাঠ করার পর এই দারুণ ভাবনাগুলো, মনে হলো পাঠকের সাথে শেয়ার না করলে আর চলছে না। কবি খালেদ রাহীকে জানাই শুভেচ্ছা। বয়ে চলুক তার হাতে কবিতার স্রোতধারা কালের ব্যাপ্ত পরিসরে। জন্ম নিক আরও আরও অজর অমর অক্ষয় কবিতা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন