ভাঙা সাম্পান
‘যার নয়-এ হয় না, তার নব্বইতেও না। উফফ! বুড়োর কীর্তি দেখলে কার মাথার ঠিক থাকে!’
৩৩ বি, অবিনাশ চন্দ্র সেন লেনের বাড়িতে যেন বিয়ে লেগেছে! সাজো-সাজো রব। পুরো বাড়ি ঘেরা চট দিয়ে। রোদ এখানে চট ভেদ করে যা আসে তা মনোরম। বিয়ের আলো তো মনোরম হওয়াই বাঞ্ছনীয়! হামান দিস্তা, বাটনা বাটা শিলের দুমা দুম আওয়াজ। ভিয়েন বসেছে হয়তো। না, ওসব কিছু নয়!
সান্ত্রাস মিস্ত্রি লেগেছে। আর ওপরের সংলাপ, দোতলার কোণের ঘর থেকে আসছে। রেণুবালা দাস সংলাপদাত্রী। যার উদ্দেশ্যে এ সংলাপ, তিনি বিশ্বম্ভর সমাদ্দার। এ বাড়ির মালিক।
হেগে-মুতে একসা করেছে, আবার তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে তো পারেইনি, উল্টে পা পড়ে সড়াৎ... সারা ঘর আপাতত গুয়ের
গন্ধে নরক। কার না রাগ হয়? রেণুবালা জল দিয়ে পরিষ্কার করছে, আর গজ গজ। ‘গা জ্বালা দেয়, ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচি! আমার ঘাড়ে চাপিয়ে ছেলে বৌ কেটে পড়ল। দিব্যি আছে সব। এর নাম ছেলে! এর থেকে বাঁজা হওয়া ভালো!’ দুমা দুম বাড়ি ভাঙার আওয়াজকে ছাপিয়ে রেণুবালার সংলাপ ক্রমশ চড়ছে।
চট ফাঁক করে বিশু আপাতত আকাশ দেখছে ঘোলা চোখে। সান্ত্রাস ছেলেটা সরে যেতে বলল। বিশুর কানে সে শব্দ
পৌঁছালো না। চোখে তেমন দেখতে পায় না। বেশ কিছুদিন হলো ছানি পড়েছে। সারা অঙ্গে ব্যথা। বিশুর বন্ধু অপূর্ব সামন্ত ফোন করেছিল ছেলে ঋজুকে। ঋজুরেখ, চাকরি সূত্রে বাঙ্গালোরে থাকে। - ‘ছানিটা কাটিয়ে দিলে হয় না?’ ঋজু জানালো – ‘কাকু সব তো ঠিক আছে, মুশকিল হলো বাবার হাঁটুর ব্যথা। গাড়িতে নিয়ে যাওয়া মুশকিল! পা মুড়তে পারে না’। শুনে অপূর্বর মনে হচ্ছিল, ফোনেই না কেঁদে ফেলে ঋজু। ফোন রাখার পর হাসি পেলো, সাথে রাগও। দু’দিন যাওয়া হয়নি। আজ একবার গেলে হয়, বেচারা একা পড়ে থাকে! কিন্তু সকাল থেকে টিপ টিপ
বৃষ্টি।
আজ ভাঙা হচ্ছে ঠাকুরদালান। পায়রার বাসা ছিল অনেক দিনের। গোল হয়ে পায়রাগুলো উড়ছে। বাসা ভাঙলে যেমন হয়! বিশুর কী আনন্দ! যেন শৈশব ফিরে এলো। সকালে ব্রেকফাস্ট করেছে ব্রেড, স্ট্রবেরি জ্যাম, কলা, এগপোচ আর ধোঁয়া ওঠা কফি দিয়ে। আসলে তা নয়। খুব ভুলে যাবার বাতিক হয়েছে বিশুর। খেয়েছে শুকনো মুড়ি। কিন্তু নাতি অর্ক ফোন করলে, তাকে বলল এই সব খেয়েছে। শুনেই অর্ক বায়না ধরল নীপার কাছে – ‘মাম্মি আমাকেও আজ ব্রেড, স্ট্রবেরি জ্যাম, এগপোচ দিতে হবে! কফি ও খায় না, তাই হরলিক্স, বাড়ন্ত বাচ্চার পুষ্টির
জন্য আটাশটি নিত্য প্রয়োজনীয় গুণ সম্পন্ন। নীপা বুঝেছে, হঠাৎ এমন বায়না তো
করে না অর্ক! নিশ্চিত দাদান বলেছে। ফোন করল রেণুমাসীকে। - ‘ভীমরতি! খেলো শুকনো মুড়ি, হেগে ছড়াচ্ছে, আর নাতিকে ভড়কাচ্ছে! আজ ঋজু আসুক! তারপর হচ্ছে! নীপা খুব বিরক্ত। নীপার অফিস বেরুনোর তাড়া। তবু তার মধ্যেই অর্ককে স্কুলবাসে তুলে দিয়েই ফোন লাগালো ঋজুকে।
ভাঙতে গিয়ে খসে পড়েছে পিলার, ইলেক্ট্রিকের তার
ঝুলছে বিপজ্জনক। রেণুবালা গাল পাড়ছে মিস্ত্রিদের। প্রোমোটার ঋজুকে ফোন করেছিল। ঋজু রেণুমাসীকে করল ফোন।- ‘বাবাকে একটু বোঝাও
না রেণুমাসী!’ রেণুর তো মুখ ঝামটা
জানে না! ‘কাকে বোঝাবো গো রিজু? সে শোনার লোক! চেনো না? তুমি বরং এসে নিয়ে যাও। আমারও শান্তি। বলেছে, মরব এখানেই’। টানা বৃষ্টি হচ্ছে তিন দিন ধরে। আজ খসলো ঝুল
বারান্দার ওপরের অংশ। সারা বারান্দা জুড়ে পুরনো ইঁট বালি... এখন রেণুবালাকে সমস্তটা পরিষ্কার করতে হবে। ভালো লাগে? আবার এর মধ্যে রেণুবালার ছোঁয়াছুঁয়ির
বাতিক। গোপালের পুজো করে সে। বিশ্ব দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। সূর্য ডুবছে। অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে কেমন যেন মনে হলো, ভোর। ভোর আর সন্ধ্যের তেমন ফারাক
কিছুই নেই। ফারাক বোঝা যায় কিছু পরে। একটিতে জেগে ওঠা, অন্যতে ডুব মারা আঁধার রাজ্যে। টুথব্রাশ নিয়ে দাঁত মাজতে এলো বেসিনে। কল খোলা, জল পড়ে যাচ্ছে ঝর ঝর করে, মাথায় কী যেন একটা এসেছে। ঠিক কী! বুঝতে পারছে না। বাড়ানো হাতের ওপর জলের ধারাপাত অনুভবে কেমন জানি মনে হলো বৃষ্টি পড়ছে... অনুপমা আর সে ভিজছে। বিয়ের পর পর এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়েছিল অনুপমাই। বিশ্ব অনুপমার দিকে জল ছুঁড়ে দিচ্ছিল বৃষ্টির। অনু সরে যেতে যেতে বলছিল – ‘এই কেউ দেখে ফেলবে...!’ কেবল অনু কেমন যেন অস্পষ্ট! রেণুবালা কখন হাজির! দূর থেকে দেখছে, বেসিনের জলে হাত থাবড়াচ্ছে লোকটা, পাগলের মতো। থেবড়ি খেয়ে বসেও পড়ল। মাথা খারাপ লাগে এসব দেখলে রেণুবালার। কী কুক্ষণে এসেছিল এ বাড়িতে, কে জানে! - ‘দাদা! কি হচ্ছে কী! এত পারা যায়? আমারও তো
বয়স হলো না'কি!’
তুমি চাও বা না চাও জীবন ভারি মজার রসদ হয়ে ওঠে অজান্তেই। অর্থনীতিতে ডক্টরেট বিশ্বম্ভর হেলা ফেলার মানুষ নন। অমর্ত্য সেনের সহপাঠী ড. বিশ্বম্ভর, বহু আন্তর্জাতিক
সেমিনারে একই সাথে পেপার পড়েছেন। কিন্তু সে তো সোনালি অতীত! গমরঙা সেইসব বিকেল
জুড়ে ছিল অন্য আলো। কত লাল, নীল, সবুজ বেলুনের ওড়াউড়ি! কী দাপট! ‘জলসাঘরে’র ছবি বিশ্বাসকে মনে পড়ে? কিন্তু ওই! জলঙ্গীর পাড় ভাঙতে শুরু করলে বাঁধ দেবে কে?
অনু চলে গেল হঠাৎ। যেন সিনেমার গেস্ট আর্টিস্ট! পাড় ভাঙে... চলে গেল বড় মেয়েটাও অকালে, ক্যানসার! নীপা ফোন করেছিল। বাড়ি ভাঙা মোটামুটি শেষ। এবার বিশ্ব যেদিকে থাকে ওদিকটায় হাত দেবে প্রোমোটারের লোক। এরা না সরলে তো আর কাজ করতে পারে না! তাই কাজ বন্ধ। নীপা ফোন করেছে, জানালো রেণু। কিন্তু ওদিকে হুঁশ নেই তার। বন্ধু অপূর্ব এসেছে। বসে আছে চেয়ারে। বিশ্ব আপাতত তার মুখের দিকে চেয়ে... নাম মনে পড়ছে না
কিছুতেই...
সানডে। অর্ক ফোন করেছে। দাদান কথা বলেনি। রেণুবালা জানিয়েছে, উনি ঘুমোচ্ছেন। ঋজুর কেমন অস্বস্তি
লাগলো শুনে, এত বেলা অবধি তো
ঘুমোন না! সত্যি বুড়ো হলে কত ভীমরতিই না ধরে! নীপা পাশ থেকে ঠেস মারলো
– ‘সত্যি বাবার জীবনটাই ভালো, আরামই আরাম’। অপূর্বর কেন জানি না ডান চোখ নাচছে! আজ একবার যেতে হবে বিশ্বর কাছে। বেসিনে জল পড়ে যাচ্ছে। ঘরে সব কটা আলো জ্বলছে। রবিবাসরীয়র পাতা উড়ছে ঘরময়। ভাঙা বাড়িকে পেছনে ফেলে বিশ্ব হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছে। খুব কুয়াশা। ক্লান্ত বর্ষণ কাকডাকা সকালের অনুষঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে অমল, থুড়ি বিশ্ব জানালার রড ধরে। দইওলা কই? পাঁচমুড়ো গ্রাম? দূরে, একটু দূরে অনু দাঁড়িয়ে, আড়ালে। মুখে তারও লাজুক হাসি। মা আর একটু দূরে, বিশ্ব আপাতত হেঁটে চলেছে তাদের দিকেই। ভারী রাশভারী গলায়
বাবা বলে উঠলেন – ‘বিশ্ব মনে
রেখো, উডস আর লাভলি, ডার্ক এন্ড ডিপ, বাট মাইলস টু গো
বিফোর ইউ স্লিপ’। বিশ্ব হাঁটছেই তো, থামলো কই? হুড়মুড়িয়ে ভেঙে
পড়লো বাড়িটার লাস্ট স্ট্রাকচার। হাঁটার সময় কে আর পেছনের দিকে তাকায়! কুয়াশা নেমেছে অবিনাশ চন্দ্র সেন লেনে।
ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।