কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

সুমী সিকানদার

বাসিঘর


ভোরের দিকে ছিপছিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির পানি মাটিতে পড়তেই মাটিভেজা ঘ্রাণ উড়ে নাকে উঠে এলো। সারাঘর মাটিঘ্রাণ। মশারিটা থেমে থেমে নড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। হাওয়ায় না বলে শোরগোলে বলা ভালো। ফ্যানটা চলতে শুরু হলেই প্রথমে কটকট এবং পরে দ্রুত লয়ে কটকট কটকট কটকট অদ্ভুত শব্দ করে ঘুরতে থাকে। ফ্যানটা নষ্টও হয় না, নতুন কেনাও হয় না।
ঘুম ভেঙে চোখ বুজেই আলগোছে চশমাটা সাইড টেবিল থেকে নিলেন মিনহাজ সাহেব। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসেছেন এখন। বসে বসে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করার পর মেঝেতে পা দেন তিনি। তারপর নিয়মিত কাজের তাগিদে বাথরুমে গমন। এই হলো তাঁর প্রতিদিনের প্রথম আধাঘন্টা।
গাছপালা ঘেরা ছোট্ট একতলা বাড়ির বাথরুমটি তাঁদের মূল ঘরের বাইরে। স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি তাঁদের শোবার বড় ঘরটা মেয়েদের ছেড়ে দিয়েছেন। নিজে বাইরের ঘরে ঘুমোন। এখন দুই মেয়েই ঘুমোচ্ছে, এত সকালে তারা ওঠে না। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় তিনি হাঁটতে বের হন। হেঁটে এসে বড় মেয়ে শম্পাকে ডেকে তোলেন। এরকমই চলছে গত কয়েক বছর ধরে।
শম্পার গতকাল কী কারণে ভালো ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে ঘুম গাঢ় হয়েছিল। অন্যদিন আগেই টের পায়, আজ ধড়ফড় করে উঠে পড়েছে, বাবা এখনও ফেরেননি! মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বাসিঘর ঝাড়ু দিয়েই চুলো ধরালো। চায়ের পানি দিল দু’কাপ। আজ বাবার সাথে সেও চা খাবে।
মাঝে মাঝে সে উঠেই এই ঘরঝাড়ু দেওয়ার নিয়মে বড় বিরক্ত হয়। কিন্তু অভ্যেস হয়ে গেছে। মা কী এক জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, সবার আগে রান্নাঘর ঝাড়ু দিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। এটাই বাসিঘর ঝাড়ু।
- কেন, ঘর আবার বাসি হলো কখন মা? রাতে ঘুমোলাম আর সকালে উঠলাম। একই তো ঘর!
মা খুব রেগে গেলেও জোরে বকা দিতেন না। ধৈর্য ধরে বলতেন, বাবা এটা হচ্ছে নিয়ম। এত প্রশ্ন করে সময় নষ্ট কোরো না। এতক্ষণে ঘর ঝাড়ু দেওয়া হয়ে যেত। ঘরের শুভ মঙ্গল চিন্তায় মা আমার দিনরাত একাহাতে খাটতেন। নিজে পড়াশোনা চালাতে পারেননি বলে আফসোস করতেন। কিন্তু মায়ের ইচ্ছেমতো এই ঘরের কাঙ্ক্ষিত মঙ্গল আজও এলো না!

শম্পার এখন আঠাশ প্রায়। পড়াশোনা তেমন নেই, চেহারা মোটামুটি। কিন্তু পাত্রপক্ষ প্রায় প্রত্যেকেই উপহার চায়। যৌতুকের ভদ্র পোশাকী নাম উপহার। এই বয়সে কীভাবে যে উপহারের টাকা যোগাড় করবেন ভেবে কোনো কিনারা করতে পারেন না। চাকরির মেয়াদও আর নেই বিশেষ।

ছোটমেয়ে শাওন তুখোড় ছাত্রী। তার নেশাই পড়াশোনা। তাকেও বিয়ে দিতে হবে। নিদারুণ চিন্তায় তাঁর মুখ ঝুলে যায়। আজ মহুয়া বেঁচে থাকলে ঠিক গুছিয়ে নিতো। আচমকা তাঁকে একা করে চলে যাওয়া এতকালের সঙ্গীনির কথা ভেবে মন খারাপ লাগে মিনহাজ সাহেবের। তিনি আজ আর হাঁটলেন না। লেকের পানির দিকে চেয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকলেন।

চায়ের পানি চাপিয়ে আঁচ কমিয়ে বাবার ঘরে ঢুকল শম্পা। বাবা তখনো ফেরেননি। শম্পা বিছানা থেকে চাদর তুলে তোষক ঝাড়ল। তারপর বিছানার চাদর বিছিয়ে দিল আবার। টেবিলের এলোমেলো কাগজপত্র গুছিয়ে রাখল। তারপর বেরিয়ে যেতে গিয়ে মনে হলো, আলমারিটা কি খোলা? স্টিলের আলমারির সামনে এসে শম্পা কাঁদতে লাগল। আলমারির দরজাটা সত্যিই খোলা। দ্রুত ড্রয়ার খুলতে গিয়ে দেখে সব তছনছ। জরুরি কাগজপত্র সব এলোমেলো, এদিক ওদিক ছড়ানো। শম্পা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।

বসার ঘরে ভিড়। মিনহাজ সাহেবকে ধরে রেখেছেন তাঁর বড়বোন। শাওনের ফোন পেয়ে ছুটে এসেছেন তিনি। মিনহাজ সাহেব মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন। যৌতুকের জন্য যত টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, শম্পার মায়ের ক’গাছা চুড়ি, শ্বশুড়বাড়ি থেকে  পাওয়া আরও কিছু গয়না, সব চলে গেছে। তাঁর মাথা কাজ করে না। আগামী শুক্রবার ছেলের পক্ষ আসার কথা। তাদের সামনে দাঁড়াবার মতো যেটুকু মাটি তিনি অর্জন করেছিলেন, তা আজ ভেসে গেল।

নিজের ঘরে চুপ করে বসে থাকে শম্পা। একটু পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের ব্যাগ থেকে একে একে বের করে সব গয়না, টাকাপয়সা। কাল সকালেই এসব সঞ্চয়ের গর্তে ঢুকিয়ে দেবে। কোনো ভাবেই সে যৌতুক দিয়ে কোনো অচেনা লোভীকে বিয়ে করবে না। মায়ের গয়না তোলা থাকবে শাওনের জন্য। শম্পা কেন বাবার জানপানি করা টাকা যৌতুকে দিতে দেবে! এই বিয়ে বাতিল।


রাতের মিহি লাজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। রঙ ধুপধাপ ফর্সা হচ্ছে। বারান্দায় গাছের ডালে কিচ কিচ কিচিরেরা সাংসারিক আলাপে ব্যস্ত। একটু আগেই একটা চড়ুই ঘুমঠোঁট ঘষে আদর করে দিচ্ছিল অন্য চড়ুইটাকে। আজ সকাল বড় সুন্দর ভাবে শুরু হচ্ছে। শম্পার মনে হলো আজ কিছু ঘটবে। কেন, কে জানে!    

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন