কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

কৌশিক মিত্র

 

ফোর্ট কোচি

ফোর্ট কোচির রাস্তা


কোচি, কোচিন নাকি এর্ণাকুলাম - এই নাম নিয়েই যত জটিলতা। কেরলের এই কোচি শহরকে আগে কোচিন বলা হতো, যদিও এখন এখানের বিমানবন্দরের নাম কোচিন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আর কোচি শহর এর্ণাকুলাম জেলার অন্তর্ভুক্ত। আবার মূল ভূখণ্ডকে এর্ণাকুলাম বলা হয়। যাইহোক, এবারে আমাদের গন্তব্য ফোর্ট কোচি। মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে কিছু ছোটো ছোটো দ্বীপ নিয়ে এই ফোর্ট কোচি। বলা যেতে পারে, ইউরোপীয়দের স্থাপিত ভারতের মাটিতে প্রথম দূর্গ। তাই ফোর্ট কোচি। এখানে ছিল ফোর্ট  ইম্যানুয়েল - যার ভগ্নাবশেষ এখনও এখানে রয়েছে। তৈরি করেছিল পর্তুগীজরা। ১৫০৩ সালে কোচির রাজা কোঝিকোড়ের রাজাকে যুদ্ধে হারান এই পর্তুগীজদের সমর্থনে। যার ফলশ্রুতিতে এই জমিতে দূর্গ তৈরি করেন পর্তুগীজরা। ১৬০ বছর পর্তুগীজদের দখলে থাকার পর হল্যান্ডের ডাচ সাহেবেরা আসেন। এরা পর্তুগীজদের বেশ কিছু গীর্জা আর অন্যান্য নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে। ১১২ বছর বাদে কোচির দখল নেয় ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ফোর্ট কোচি বিদেশি মুক্ত হয়।

কোচিন বিমানবন্দর কোচি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। তাই ফোর্ট কোচি পৌঁছতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেলো। এখানের সব বাড়িতেই রয়েছে ডাচ সংস্কৃতির নিদর্শন। এখন এই সব বাড়িগুলো সব হোটেলে পরিণত। আমাদের এই রকমই একটা হোটেল বুক করা ছিল। ক্লান্ত শরীরে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। দেওয়ালে রয়েছে ডাচ সাহেব মেমেদের ছবি। উপরে কড়ি বর্গা।

পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ফোর্ট কোচি এক্সপ্লোর করতে। অটো রিকশা এখানে সহজেই পাওয়া যায়। এই ছোট্ট শহর জুড়ে রয়েছে ডাচ পর্তুগীজদের নানান স্মৃতিস্তম্ভ। প্রথমে সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে তৈরি এই গীর্জায় রয়েছে পর্তুগীজ সংস্কৃতির নিদর্শন। ২৫২৪ সালে এই গীর্জার লাগোয়া জমিতেই কবর দেওয়া হয়েছিল ভাস্কো দা গামার দেহ। পরবর্তীকালে তা তুলে নিয়ে যাওয়া হয় লিসবনে। ডাচরা অনেক কিছু ধ্বংস করলেও এই গীর্জা অক্ষত রেখেছিল।

চাইনিজ ফিশিং নেট

পরের গন্তব্য বেসিলিকা ক্যাথিড্রাল ডি সান্তা ক্রুজ। কোচির নয়টি বেসিলিকার অন্যতম এটি। অসাধারণ গোথিক স্থাপত্য। ষোড়শ শতকের পর্তুগীজদের তৈরি এই ক্যাথিড্রাল ডাচেরা ধ্বংস করেনি। ফোর্ট কোচির অন্যতম আকর্ষণ মাতানচেরি প্রাসাদ বা ডাচ প্রাসাদ। নাম যাই হোক না কেন, পর্তুগীজরা এই প্রাসাদ কোচির রাজাদের উপহার দেন। প্রাসাদটি চতুর্ভুজাকার। কেরলের নালুকেটটু স্থাপত্যের নিদর্শন। দেওয়ালে রয়েছে কোচির রাজাদের পটচিত্র। আর রয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের ছবি। এছাড়াও রাজাদের ব্যবহৃত পালকি, হাওদা, ছাতা সবই রয়েছে এই প্রাসাদে। কাছেই রয়েছে ফোর্ট কোচির আর এক আকর্ষণ পরদেশি সিনাগগ। এটি ইহুদিদের উপাসনালয়। এই এলাকাকে বলা হয় জিউ টাউন বা ইহুদিদের শহর। এই ইহুদিরা বেশির ভাগই ইসরায়েল থেকে এসেছিল কোচিতে। এই উপাসনালয় তৈরি হয়েছে ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। এর বাইরের ঘড়িটি সুদৃশ্য। ভিতরে রয়েছে বেলজিয়ামের কাঁচের ঝাড়বাতি। রয়েছে মালায়ালামে অন্তর্লিখিত তাম্রলিপি। যাওয়ার রাস্তার দুধারে রয়েছে পুরাকালের জিনিসের বেশ কিছু দোকান।

কয়েকটি মিউজিয়াম রয়েছে ফোর্ট কোচিতে। ইন্দো-পর্তুগীজ মিউজিয়াম বেশ ভালো। ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতকের কাঠের, রুপোর ও অন্যান্য ধাতুর অনেক সামগ্রী রয়েছে। মূল্যবান ভাস্কর্য, মূর্তি ও পোশাকের সম্ভার রয়েছে এখানে।

ইন্ডিয়ান নেভাল মেরিটাইম মিউজিয়াম এক অন্য ধরনের মিউজিয়াম। আই এন এস দ্রোণাচার্যের মধ্যে এই জাদুঘরটি অবস্থিত। ভারতীয় নৌসেনার জন্মলগ্ন থেকে তার ইতিহাস, বিবর্তন ও বৈশিষ্ট্য এখানে সুন্দর ভাবে বর্ণনা  করা আছে।

চার্চ, সিনগগ, মিউজিয়াম দেখে মধ্যাহ্নভোজ সারতে সারতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফোর্ট কোচির ব্যাকওয়াটার আর আরবসাগর  তো দেখা হয়নি। ভাস্কো দা গামা স্কোয়ার থেকে মহাত্মা গান্ধী বীচ। সমুদ্রতট খুব একটা পরিষ্কার নয়। তবে একের পর এক বড় বড় জাহাজ চলে যাচ্ছে। পণ্যবাহী জাহাজ থেকে নৌসেনার জাহাজ সবই দেখা যায় এখানে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ফোর্ট ইম্যানুয়েল এর ভগ্নাবশেষ। দেখা মিলল পাঁচশো বছরের পুরনো কামান।

পরদেশি সিনাগগ
সন্ধ্যে হতে চললো। পশ্চিমের আরবসাগরে সূর্যদেব অস্তাচলের পথে। ব্যাকওয়াটার জুড়ে এখানের মৎস্যজীবিরা নেমে পড়েছে তাদের জাল নিয়ে। কিছুটা অন্যরকম দেখতে। এর নীচের অংশ মাটিতে আটকানো। এই জালকে বলা হয় চাইনিজ ফিশিং নেট। চীনে নাকি এই ধরনের জাল ব্যবহার হয় মাছ ধরতে। সে আবার এখানে কি করে এল? শোনা যায় চতুর্দশ শতকে চীন থেকে আসা কিছু পর্যটক এখানে এই জালের প্রচলন শুরু করে। সেই থেকেই চলে আসছে। এই চাইনিজ ফিশিং নেটের প্রেক্ষাপটে ডুবন্ত সূর্য এক অপরূপ দৃশ্য। অপর প্রান্তে ভাইপিন দ্বীপ প্রায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। রাতের খাবারে রয়েছে স্থানীয় খাবার, বলা যেতে পারে কেরালা অথেনটিক মিল।

ফোর্ট কোচিতে ভারত, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ব্রিটেন, ইসরায়েল, চীনের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন রয়েছে। আছে চার্চ, মন্দির, সিনাগগ। পরদিন। বিদায় ফোর্ট কোচি। দেখা হবে অন্য কোনো জায়গায় অন্য কোনো দিনে। ট্রেনে কোচির যোগাযোগ বেশ ভালো। এর্ণাকুলাম সাউথ আর নর্থ দুটি স্টেশন রয়েছে। আর আছে কোচিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শহরের মধ্যে রয়েছে মেট্রো আর জলপথে যোগাযোগ।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন