কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

মধুবন চক্রবর্তী

 

শাক্ত পদাবলীতে শ্যামাসংগীত : দুই যুগপুরুষ




রেডিওতে ছোটবেলায় খুব দরদী কন্ঠে দুই সংগীত শিল্পীর গাওয়া ভক্তিগীতি মুগ্ধ করত আমাকে। অনুরোধের আসরে ভক্তিগীতি হলেই বাবা বলে উঠতেন, মন দিয়ে শোন গাইছেন বিখ্যাত গায়ক পান্নালাল ভট্টাচার্য। আরও একজনের নাম বাবার মুখে শুনতাম ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। শ্যামাসংগীত যেন প্রাণ পেত এই দুই শিল্পীর কন্ঠে। মনোমুগ্ধকর গায়নশৈলী বা গায়কীতে এই দুই সংগীতশিল্পী শ্রোতাদের মোহিত করে দিতেন। তাঁদের কন্ঠ থেকে নিঃসৃত  শ্যামাসঙ্গীত শ্রোতাদের আবেগে আপ্লুত করত। অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গানের কথা।মনে পড়ছে। সেটি হল-

“সকলি তোমারি ইচ্ছা

ইছাময়ী তারা তুমি

তোমার কর্ম তুমি কর মা

লোকে বলে করি আমি"

পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এই জনপ্রিয় গানটি আজও সমানভাবে সমাদৃত আট থেকে আশির কাছে। গান শিখতে গিয়ে পরে বুঝেছি দুজনের গায়নশৈলী একেবারে ভিন্ন হলেও, গানের অন্তর আত্মায় ভক্তিরস ছিল ভরপুর। শ্যামাসংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে এই দুজন যেরকম শ্রোতার হৃদয়ের মনিকোঠায় নিবিড় জায়গা করে নিয়েছিলেন, ঠিক সেরকম শাক্তপদাবলীতে শ্যামাসংগীত নামক বিশেষ গানের ধারাকে সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর ভক্তি আন্দোলনের সময় থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দুই যুগপুরুষ। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর লীলাকীর্তন বিষয়ক শ্যামাসঙ্গীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। কালীর লীলাকীর্তন ছিল তার সেরা আবিষ্কার। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা হল কীর্তন। এবং বাংলার লোকসংগীতের আর একটি বিশেষ অঙ্গ হল বাউল। এর সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরের মিশ্রনে রামপ্রসাদ তৈরি করলেন

এক নতুন সুর যা রামপ্রসাদী সুর নামে খ্যাত হল। ছেলেবেলায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কন্ঠে-

"মন রে কৃষিকাজ জানো না

এমন মানব জমিন রইলো পতিত

আবাদ করলে ফলত সোনা"  

লোকসংগীতের আঙ্গিকে এই সুর আমাদের গানের ক্লাসের অনেক বন্ধুকেই মোহিত করেছিল। আসলে সহজ ভাষায় মনের আকুতির এত সুন্দর প্রকাশ, অন্য গানে দুর্লভ যেন। যদিও গানটি গাওয়ার সময় সূক্ষ্ম অলংকার প্রয়োগ করেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। 'সাধক রামপ্রসাদ' 'ছায়াছবিতে সর্বাধিক ২৩টি গানের রেকর্ড আছে তাঁর। 'সাধক বামাক্ষ্যাপা', 'সাধক কমলাকান্ত্‌’, ‘দেবাতীর্থ কামরূপ-কামাখ্যা’ এইসব ছবিতে তাঁর গাওয়া শ্যামাসংগীত বা ভক্তি সংগীত আপামর বাঙালীকে ভক্তিরসে প্লাবিত করেছিল। বাংলাসংগীতের ইতিহাসে  ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং পান্নালাল ভট্টাচার্যের কন্ঠের লালিত্যে "শ্যামাসংগীত"  মানুষের হৃদয়ে ভক্তিরস কে এক উত্তুঙ্গ শৃঙ্গে নিয়ে যায়।

এই শ্যামাসংগীতকে ধীরে ধীরে বহুল প্রচারিত ও প্রসারিত করেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা রামপ্রসাদ সেন।

শাক্তপদাবলীর দুটি ধারা শ্যামাসংগীত এবং উমাসংগীত এই বিশেষ দুই কাব্যধারাকে সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই কাব্যসাহিত্য। সেই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতি রাজনৈতিক জীবন ছিল গভীর দুর্বিপাকে। একদিকে বর্গীয় হাঙ্গামা, শাসকদের অত্যাচারে বাঙালির ধর্মপ্রাণ থেকে মনুষ্যত্ব সবকিছুই নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছিল। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতকের শুরুতে সমগ্র গৌড়বঙ্গ জুড়ে দেখা দিয়েছিল এক অমানিশার অন্ধকার। সেই সংকটাপন্ন মুহূর্তে সাধক কবি রামপ্রসাদ এসেছিলেন তার অনুভূতি লব্ধ সুর ও ধ্বনি নিয়ে। জন্ম নিয়েছিল রামপ্রসাদের সুর শ্যামাসঙ্গীতের আধারে।

বাংলায় তখন বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ার। তার পরবর্তী সময়ে সম্রাট শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে কালীমন্দির নির্মাণের উপরে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ফলে কালীপুজোর সেভাবে চল ছিল না। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বঙ্গদেশে আবার কালীমূর্তি ও কালী মন্দির স্থাপনের জোয়ার আসে। তথ্য থেকে জানা যায় বঙ্গদেশে প্রাচীন কালীমন্দির গুলির শতকরা চুরাশি ভাগ স্থাপিত হয়েছিল, ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে। শোনা যায় মুর্শিদাবাদের মহারাজ নন্দকুমার কালীভক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি শ্যামাসংগীত জনপ্রিয় হয়েছিল তৎকালীন সময়ে।

যদিও শ্যামাসংগীত রচনায় জোয়ার এনেছিলেন দুই কালীসাধক রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যেমন শান্তির পথ দেখিয়েছিলেন ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার প্রসারে, রামপ্রসাদ সেনের আগমনী বিজয়ার গান, কৃষ্ণসংগীত, কালীকীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত সেরকম জোয়ার এনেছিল ভক্তি সাধনায়। তাঁর গানের বাণীতে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, সেই অস্থির সময়ের এক বাস্তব চালচিত্র। শক্তিসাধনার মধ্যে যে নিরস শাস্ত্রাকার এবং তান্ত্রিকতা রয়েছে, তার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সহজ আবেদন পূর্ণ সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি দান করেছিলেন তিনি। জন্ম দিয়েছিলেন শ্যামাসংগীত নামে বাংলা সংগীতের এক বিশেষ ধারার, যেখানে মা ও সন্তানের মধ্যে রয়েছে এক অভূতপূর্ব প্রেম। রয়েছে বাৎসল্য ও ভক্তির শাশ্বত সম্পর্ক। আর তারই সাঙ্গীতিক রূপ ধরা পড়েছে শ্যামাসংগীতে।



রামপ্রসাদের রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য (অষ্টাদশ শতাব্দীর ষষ্ঠ অথবা সপ্তম দশকে) কালীকীর্তন, কৃষ্ণকীর্তন নামক সম্পূর্ণ খন্ড কাব্য শlক্তগীতি। কালীকীর্তন গ্রন্থে গীতিকবিতা ও আখ্যানমূলক কবিতার মাধ্যমে উমার জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থে গান ও কবিতার মাধ্যমে কৃষ্ণের জীবন কথা বর্ণিত হয়েছে। বিদ্যাসুন্দর গ্রন্থে রাজকুমারী বিদ্যা ও রাজকুমার সুন্দরের বহুল প্রচলিত প্রেম ও পরিণয় কাহিনী অবলম্বনে কাহিনী বর্ণিত। অবশ্য শাক্তগীতি রামপ্রসাদের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ও প্রসিদ্ধতম রচনা। এখানে মা ও সন্তানের সম্পর্কের এক নিবিড় প্রেমের সহজ রূপ দেখানো হয়েছে। এই সবগুলোর মধ্যেই গীতিকবিতা ও আখ্যানমূলক কবিতা ভীষণভাবে জায়গা করেছে।

শোনা যায় শ্রী শ্রী পরমহংসদেবের প্রিয়কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। তাঁর গাওয়া গানগুলি শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করতেন কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের লেখা, লীলাসঙ্গীত শুনে। এমনকি ভগিনী নিবেদিতা রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের তুলনা করেছেন। উইলিয়াম ব্লেক একজন নিষ্ঠাবান চিত্রশিল্পী, মুদ্রাকর, যাকে রোমান্টিক যুগের অগ্রদূত বলা হয়। যদিও জীবদ্দশায় যতটা স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল, ততটা পাননি তিনি। অথচ চিত্রশিল্পের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর কবিতা সবচেয়ে কম পঠিত হয়েছে। আর রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গে এই জায়গাতেই তাঁর সাদৃশ্য। রামপ্রসাদ সেন নিজে যতটা উচ্চস্তরের গীতিকবি ছিলেন, ঠিক ততটা স্বীকৃতি এই বাংলা সংগীত জগত তাকে কি দিতে পেরেছেন? উইলিয়াম ব্লেকের আঁকা ছবিগুলো এতটাই মানুষকে আনন্দ দিয়েছে যা হৃদয়ে লালন করার মত। সেইসব চিত্তাকর্ষক ছবিগুলি সাধারণ মানুষকে কল্পনার জগতে নিয়ে যেত। কখনোও বাস্তব চিত্র ফুটে উঠত রূঢ় ভাবে। সেইসময়ের একজন তৎকালীন শিল্পসমালোচক বলেছিলেন, "ব্রিটেন যত শিল্পী সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সবার সেরা তিনি এবং যে কারোর চেয়ে অনেক এগিয়ে”।

রামপ্রসাদ সেন সেরকমই একজন দক্ষ গীতিকবি ছিলেন, যাঁর রচনায় ফুটে উঠত সমাজের রূঢ় বাস্তব চিত্র এবং  ভাবাবেগ। রামপ্রসাদ সেন যখন চাকরি করতে কলকাতায় আসেন, সেখানে এক জমিদারির কাছারিতে মজুরির চাকুরী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মনের ভাব উদয় হলে নির্জনে একা বসে গান গাইতেন। জমিদারির হিসেবের খাতায় তা লিখে রাখতেন কখনও সখনও। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জমিদার রামপ্রসাদের এই ভক্তিভাব ও অসাধারণ কবি প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর জন্য তাকে চাকুরী থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এরপর নিজের গ্রামে এসে সাধনা ও সংগীত রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন রামপ্রসাদ। নিজেই সুর করে নিজেই গাইতেন। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদের কবিতা ও সংগীতে খ্যাতির কথা শুনে, নিজের রাজ্যসভায় যোগদানের জন্য তাকে আহবান জানিয়েছিলেন।  ভরতচন্দ্র তখন কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু প্রচার বিমুখ রামপ্রসাদ রাজসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও কৃষ্ণচন্দ্র ভরণপোষণের জন্য একশত বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন তাকে এবং "কবিরঞ্জন" উপাধিতে ভূষিত করেন। নির্জনের পূজারী রামপ্রসাদ কখনোই প্রচার চাইতেন না। আর এখানেই উইলিয়াম গ্লেকের সাথে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।



কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন রামপ্রসাদের উত্তরসূরী। খুব ছেলেবেলা থেকেই তিনি ভক্তিগীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই তাঁর কিছু গান আবার রামপ্রসাদের সুরে আধারিত ছিল। কমলাকান্ত রচিত অধিকাংশ গানই হল রাগাশ্রয়ী। এবং যথাযথ তালবদ্ধ। কিন্তু রামপ্রসাদের আগমনী গানে ভাবাবেগ যেন অনেক বেশী। কমলাকান্তের আগমনী সংগীতে আবেগ থাকলেও, তা আধ্যাত্মিকতা এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারকে ছাপিয়ে যায়নি কখনোও। কমলাকান্তের আগমনী সংগীতেই সর্বপ্রথম উমা শ্যামার দার্শনিক, আত্মিক, আধ্যাত্বিক সমন্বয় প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- "আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে"। এই গানে তিনি গিরিরাণীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আবার আগমনী গানের যে মূল সুর কন্যার জন্য বাঙালী মায়ের যে আবেদন, সেই রূপ প্রজ্বলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। মাতৃভাবে রচিত সঙ্গীতগুলিতে ব্যক্ত হয়েছে শ্যামামায়ের প্রতি তার আত্মনির্ভরতা। এবং ভালোবাসার অভিব্যক্তি।

কমলাকান্তের পদগুলিতে শব্দের ব্যবহার ভাষাব্যবহার যেন বৈষ্ণব পদাবলীকেই  অনুসরণ করেছিল। কমলাকান্তের

শ্যামাসংগীত সংসারের তীব্র সংকটে এবং আশাভঙ্গের বেদনায় মাতৃ চরণকেই মুক্তির তীর্থরূপে স্বীকার করে নিয়েছিল মায়ের চরণতলে। তাঁর রচিত গানগুলি যেন আত্মসমর্পণের গভীর ভঙ্গী। রামপ্রসাদের পরে শ্যামাসংগীত রচনায় নিজস্বতা আনলেন এই কালীসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। কালীপদে নিজেকে সঁপে দিয়ে তিনি রচনা করলেন, একের পর এক

শ্যামামায়ের গান। যেখানে দার্শনিক চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটেছে ভক্তিরসের সঙ্গে। যেমন-

"আমার একুল ওকুল দুকুল গেল পাথার মধ্যে সাঁতার বিষম হলো”

কিংবা

"মজল আমার মন ভ্রমরা

কালীপদ নীলকমলে

যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল

কমাদী কুসুম সকলে"...

ভক্তিরসে অধারিত এই গীতধারা ভক্তিবাদী বাঙালীর কাছে এক, অবিচ্ছিন্ন জায়গা করে দিল। কীর্তনের পাশাপাশি, শ্যামা সংগীত জনপ্রিয় গীতিকাব্য হয়ে উঠল বাংলা পুরাতন গানের ইতিহাসে। আপামর বাঙালীর হৃদয় স্পর্শ করল শ্যামা মায়ের গান। ভক্তিরসে আচ্ছন্ন হল আসমুদ্র হিমাচল।  বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে গীতিকবিতার জন্মলগ্নে শাক্ত পদাবলী হয়ে উঠেছিল সাহিত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শাক্তপদাবলী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদের মতোই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে রাজনৈতিক দূর্বিপাকে যখন জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত, অপমানে নিষ্পেষিত হতাশা এবং নৈরাশ্যের অন্তর্জালে হাঁসফাঁস করছে সমাজ জীবন, সেই সময় বাঙালির হৃদয়ে আলোড়ন তুলল মাতৃ হৃদয়ের গান। আধ্যাত্মিক ধারায় প্রবাহিত কমলাকান্তের শ্যামাসংগীত মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিল। মাতৃ মূর্তির মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুললেন দেশ কালের এক বিপর্যস্ত চেহারা। তাঁর রচিত শ্যামাসঙ্গীতের পদগুলি অশান্ত মনকে দিয়েছিল শান্তির নীড়।

কোন গীতিকবি কাব্য প্রতিভায় কতটা এগিয়ে সেই বিতর্কে না গিয়ে, এটুকু বলাই যায় উভয়ই ছিলেন বাংলার আধ্যাত্বিক চেতনা জাগরণের, ভক্তি আন্দোলনের যুগ পুরুষ।  তিনি শ্যামা মাকে কল্পনা করতেন কখনো গৃহাঙ্গনে, কখনও বসবাসকারী মা হিসেবে, কখনো বা জগজননী হিসেবে। যিনি সমস্ত বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেন। তাঁর আগমনী গানেও বাঙালির গৃহঙ্গনের চিত্র ফুটে উঠেছিল। সময়টা ছিল কৌলিন্য প্রথার। এই প্রথার যুপকাষ্ঠে বাঙালী মা-বাবা তাদের কন্যাকে বলি দিতে বাধ্য হতেন। ফলে উদ্রান্ত দৃষ্টিতে মা-বাবা অপেক্ষা করতেন বছরশেষে কবে আসবে তাদের কন্যা। অপেক্ষার আগুনে পুড়ে ছাই হতেন। এই যন্ত্রণার আগুনে শান্তির জল দান করেছিলেন। কমলাকান্তই প্রথম কবি যিনি বাংলার ঘরে ঘরে বাবা-মার এই গার্হস্থ্য উৎসবে করুণা বিহবল রসটিকে আগমনী ও বিজয়া গানের মধ্যে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

শ্যামাসংগীত রচনার ক্ষেত্রে দুই যুগপুরুষ রামপ্রসাদ সেন, ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য উভয়েই শক্তিপূজা বা মাতৃপূজার এক বিশেষ দিক স্থাপন করেছিলেন উমাসংগীত ও শ্যামাসংগীতর মধ্যে দিয়ে। কমলাকান্তের গানে ভক্তিরসের নিবিড়তা, আধ্যাত্মিকতার গভীরতা, মনের ভাবকে ছন্দের সৌন্দর্যে সুন্দরভাবে অলংকরণের মধ্যে দিয়ে শ্রুতিমধুর শব্দ প্রয়োগে এক শিল্পসম্মত রূপ বৈভব। যা আমাদের সিক্ত করে। প্রেমময় অনুভূতির জন্ম দেয়। তার শ্যামাসঙ্গীতের অন্তরেই জড়িয়ে আছে রাগাশ্রীত ভাববৈচিত্র্য। সেই ভাবরূপের সঙ্গে তৈরি হয় ক্লাসিক মেলবন্ধন। একদিকে ভক্তিভাব অন্যদিকে কবিতা ও পাশাপাশি উচ্চমার্গের শিল্প কমলাকান্তের পদগুলিকে এক উচ্চস্তরে নিয়ে গেছে।

"শুকনো তরু মন জোড়েনা ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে তরু পবন বলে সদাই দোলে, প্রাণ কাঁপে মা থাকতে গাছে"

এখানে কবি নিজেকে গাছের সঙ্গে তুলনা করে স্বার্থক উপমার সাহায্য নিয়েছিলেন।

অধ্যাপক জান্হবী চক্রবর্তী একদা রামপ্রসাদ সেন এবং কমলাকান্তের শ্যামাসংগীত বিষয়ে বলেছিলেন, "রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত সুরে সমর্পিত হইবার অপেক্ষায় রাখে, কানে না শুনিলে তাহার অর্ধেক মাধুর্য নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু কমলাকান্তের পদাবলী গীতিকবিতার মতো আস্বাদ্য। কেবলমাত্র আবৃত্তি করিয়াও তাহার মাধুর্য আস্বাদন করা সম্ভব"।

আবার রামপ্রসাদ সেন ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম এবং দেবিকালীর লীলাকীর্তন শ্যামাসঙ্গীতের এই ধারাটিকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনিই প্রথম কবি যিনি গভীর ভক্তি সহকারে দেবী কালীর লীলাকীর্তন রচনা করেছিলেন। এবং তাঁর গানে প্রথম শ্যামা মাকে স্নেহময়ী মাতা হিসেবে, এমনকি ছোট্ট মেয়ে রূপেও দেখা যায়।  এই কালীভক্তি প্রথাটিকে ধীরে ধীরে উজ্জীবিত করতে থাকেন তিনি।

শ্যামা সঙ্গীতের ধারা প্রবাহমান কাল ধরে বয়ে চলেছে এই বাংলায়।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো পদাবলী সাহিত্য। এই পদাবলী সাহিত্য মূলত দুই ভাগে বিভক্ত

প্রথমত বৈষ্ণব পদাবলী, দ্বিতীয়ত শাক্তপদাবলী। বিষয়গত দিক থেকে দুই পদাবলীর ভেতরে পার্থক্য আছে। ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "বৈষ্ণব পদাবলী ভাববৃন্দাবনে অনুষ্ঠিত অপ্রাকৃত রাধাকৃষ্ণের সূক্ষ্ম গীতিকা। আর শক্ত পদাবলী হল বাংলার মায়ের অন্তরের বেদনার গান"...

শাক্ত পদাবলীর একটি বিশেষ ধারা হচ্ছে শ্যামাসংগীত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শক্তি সাধনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত পদর্শিত হয়েছিল তাকেই শাক্তপদাবলী বলা হয়। ডক্টর অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতে, শক্তি অর্থাৎ উমা, পার্বতী, দুর্গা, কালিকাকে কেন্দ্র করে রচিত যে গান তাকে বলা হয় শক্ত গান"। আগে এই শাক্ত গানকে মালসী বলা হত। মালবশ্রী রাগে রচিত ছিল বলে এই গানকে মালসী গান বলা হত।

শাক্তপদাবলীকে বারোটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয় সেগুলি হল যথাক্রমে-

বাল্যলীলা

আগমনী বিজয়া

জগতজননী রূপ

মা কি ও কেমন

ভক্তের আকুতি

মনোদীক্ষা

মাতৃপূজা

সাধনশক্তি

নামমহিমা

চরণতীর্থ

ইচ্ছাময়ী মা

লীলাময়ী

ব্রহ্মময়ী মা

শাক্ত পদকর্তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের গানগুলির মধ্যে অবশ্যই মাতৃপূজা সাধন শক্তি বা সাধারণ বিষয়ক গানগুলোই শ্যামাসংগীত-এর রূপ ধারণ করেছে। শাক্ত পদকর্তাদের মধ্যে প্রথমসারির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন।

কমলাকান্ত অবশ্য শুধু কবি ছিলেন না তিনি একজন সিদ্ধ পুরুষ ও বটে। তাই শাক্ত পদাবলীর তাত্ত্বিক পদগুলিতেও তার কবিত্ব শক্তির পরিচয় ঘটে।

সাধনার ক্ষেত্রে রামপ্রসাদের সঙ্গে কমলাকান্তের প্রধান পার্থক্য ছিল রামপ্রসাদ জগৎজননীকে এতটাই আপন করে পেয়েছিলেন যে, মায়ের প্রতি ছেলের অভিমান অভিযোগ খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়েছে তাঁর গানের মধ্যে। রামপ্রসাদের গানের মধ্যে সেই বাৎসল্য রস খুঁজে পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কমলাকান্তের গান যেন বাৎসল্যর রস থেকে কিঞ্চিত দূরে, যেখানে অভিমানের সুর তার রচনায় দুর্লভ। শুধুমাত্র মাতৃ চরণের আশ্রয়টুকুই তার কামনার বস্তু অর্থাৎ দার্শনিক কমলাকান্তের গানে যেন আত্মসমর্পণের ভঙ্গি বা আকুতি।

যুগ যুগান্ত ধরে এই দুই যুগপুরুষের রচনা বই নিয়ে বাংলার সংগীতের ইতিহাস। ১৯৩০ ও ৪০ দশক থেকে বহু শিল্পী শ্যামাসংগীত গেয়েছেন। কে মল্লিক থেকে ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমলা ঝরিয়া, রাধারানী দেবী এবং পরবর্তীকালে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, হীরালাল সরখেল, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী শ্যামাসংগীতের এই ধারাকে বহন করেছেন।

 


1 কমেন্টস্: