কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


খিদে

বাড়িটা মাঠের প্রান্তে রাতে একটা ধ্বংসস্তুপের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সরকারী সমী়ক্ষক হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। কিন্তু এমন বিদ্ঘুটে বাড়িতে এর আগে আশ্রয় জোটেনি। জনবসতি বহূদূর। বাড়িটা আগাছায় ভরা। কড়িবরগায় পেঁচা, রাতে পায়রা ঘোঁট বেঁধে থাকে। দোতলার ধুলো ধুসারিত ঘর বারান্দা। একটি ঘর তার জন্য খোলা। টিকারাম রাতের খাবার-জল, লম্ফ জ্বেলে দিয়ে চলে যায়।

কাগজপত্র আর কলকাতা থেকে আনা হুইস্কির গ্লাস। রাত বাড়লে গেট খুলে যায়। একটা ধারি কালো কুকুর ঢোকে, নিঃশব্দে উঠে আসৈ দোতলার ঘরটায়। পুরনো তক্তপোষের মড়মড় আওয়াজ পাই। সন্ধ্যাবেলা দেখেছি বিরাট মাংসপিণ্ড  পড়ে আ়ছে। হয়ত টিকারাম রেখে যায়।

সেদিন পূর্ণিমা। কাজ কর়ছি, পান করছি। ভাবছি বাড়ির কথা।

-‘কেমন আছেন অনিমেষবাবু?’ চমকে তাকাই। কালো কুকুরটা, সাধারণ কুকুরের থেকে কয়েকগুণ বড়ো। সামনে বসা। নেশাটা বেশিই হয়ে গেছে ভাবলাম।

-‘আসলে কুকুর জীবনে আসার পর বিশেষ মানুষের সা়থে কথা বলা হয় না, তাই ভাবলুম...। এবার আর কোনো ভুল নেই। পরিস্কার বাংলাভাষায় কথা বল়ছে। চকচক্ করছে ওর দেহ।  সামলে নিতে সময় লাগে। এই পোড়া বাড়িতে একা বসে কয়েক ঢোক পান করি মনের জোর  বাড়াতে। কাঁপা গলায় বলি-

-‘বলুন! আপনার নামটা জানা হয়নি’।

-‘আমার নাম উমাপদ ভাণ্ডারী। বাড়িটা আমারই। কেয়ারি করা বাগান, ঝকঝক্ করত দরদালান। ব্যবসাদার ছিলাম।

আমি একবার চিন্তা করি উমাপদবাবুকে হুইস্কি অফার করব কিনা!

-‘আপনি খান অনিমেষবাবু, আমি অন্য পানীয় খাই’।

-‘দুটি ছেলে বউ, ভরা সংসার ছিলো মশায়’।

এরপর স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকি উমাপদর কাহিনী।

-‘একবার ব্যবসার কাজে দিল্লী গেলাম। রাতে ফিরে দেখি বাড়ি শুনশান। এখান ওখান রক্ত। কাপড়ের টুকড়ো। টাকাপয়সা গয়নাগাটি কিছু নেই। দেহগুলো পড়ে আছে। ওপরের ঘরে আমার মেয়ের পচা লাশটা খাচ্ছে কালো একটা কুকুর। জানেন, ওদের মাটি চাপা দিলাম। তারপর শুধু একটু খাবার আর মাংস কিনে আনতাম। কুকুরটা রয়ে গেলো। আমি আর সে। শেষে আর মানুষের কাছে যেতে ইচ্ছে করত না। ওর সাথেই কথা বলতাম। ফল, পাতা খেতাম আর ইঁদুর বেড়াল ধরে কুকুরটাকে দিতাম। অনেক বছর কেটে গেলো। ওর সাথে থাকতে থাকতে আমাকেও ওর মতোই যেন দেখতে হয়ে যাচ্ছিলো। ফল, পাতা ছেড়ে আমি়ও কাঁচামাংস খেতে লাগলাম। ঝামেলা নেই। বেশ খেতে, বু়ঝলেন! তা খেলে একটু বেশি মাংসই তো লাগে! একদিন বুড়ো হয়ে মরেই গেল। আমি ওকেই খেলাম কদিন। তারপর খুঁজে বেড়াই মাংস রোজ।

কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চাঁদ। হাওয়ায় লম্ফটা জ্বলছে নিবছে। একটু ভ়য় করছে যেন এবার।

উমাপদ বলছে, ‘আজ আর কাউকে পেলাম না। খিদে পাচ্ছে খুব। যদি কিছু মনে না করেন... বেশি লাগবে না কিন্তু...’ অনিমেষ জ্ঞান হারাল। কিন্তু তার আগে ভারি বোতলটা ভে়ঙে ঢুকিয়ে দেয় উমাপদর পেটে।

সকালে চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসে। আয়নার সামনে চোখ পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।

বড়ো কালো একটা কুকুর এখনো ঢোকে গেট খুলে। টিকারামের দেহটা বেশ কিছুদিন খাওয়া গেছে। সুস্বাদু নরমাংস। অনিমেষ ভালো়ই আছে। তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। এখন অনিমেষ আর পুরনো বাড়িটা নতুন অতিথির অপেক্ষোয়। খিদে পায়।


1 কমেন্টস্: