ধারাবাহিক উপন্যাস
হে
নেপথ্যচারিণী
(৮)
আলব্ধভূমিকত্ব
বাইরে তীব্র তাপদাহ। এ কোন পৃথিবী তৈরি করেছি আমরা কে জানে। মনের ভিতরেও কী সেই দাহ কম? অত্রি সুচন্দ্রার সুন্দর দাম্পত্যর ভিতর চলাচলকারী সেই রহস্যময়ী নেপথ্যচারিণী। মনসুর গাজির ভুডু পুতুল 'রেশমি'। আর মনোরঞ্জন শিকদারের সেই শকুন্তলাদেবীকে ঘিরে মনকেমন করে তোলা গান, "কোই চুপকে সে"। মনের ভিতর দোলাচলে নতুন সংযোজন। শহরজুড়ে তথাগত অধিকারী ও সংবাদমাধ্যমকে বিচলিত করে তোলা 'ত্রিনেত্র' খুনের সমারোহ। এতো দাবদাহর ভিতরেও বসেছিলাম কলামন্দিরের শীততাপ প্রেক্ষাগৃহে। কলেজের কাজ সকালেই সেরে নিয়েছি। মঞ্চে বসে আছে আশুদা। তার মানুষের চেতনা নিয়ে অন্বেষণ ও গবেষণা উদ্যোক্তাদের সমীহ আদায় করেছে। আশুদাকে 'ইন্টারন্যাশনাল স্লিপ ফোরাম' আজ সম্মান জানাবে, সম্বর্ধনা দেবে। এমন একটি বিরল মুহূর্তের সাক্ষী না থেকে পারা যায় কি? ফলত আমি সব কাজ সেরে ফেলে কলামন্দিরে বসে। স্ক্রীনে স্লাইড দেখাচ্ছিলেন ডাঃ সবিতা আগরওয়াল। দেড়মাস হলো বাঙ্গালোর থেকে এই রাজ্যে এসেছেন। তার আবিষ্কৃত এক আশ্চর্য ওষুধের কথা বলছিলেন তার বক্তৃতায়। কলামন্দিরের এই মুহূর্তগুলো আমাকে সেই পৃথ্বীর ভরতনাট্যমের অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমাকে। ডাঃ সবিতা আগরওয়াল মধ্যবয়স্কা। বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বয়স। ছিপছিপে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ইংরাজি উচ্চারণ বেশ স্পষ্ট। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ভঙ্গিতেও বেশ আত্মবিশ্বাসী চলন। দৃপ্ত স্বরে ইংরাজিতে বোঝাচ্ছিলেন কেন ঘুম দরকার মানুষের। ঘুমের স্বাস্থ্য, তার যথাযথ লালন। ঘুমের বিক্রিয়করণে আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তির অনুদান ও কুপ্রভাবের কথাও তিনি বললেন। ডাঃ সবিতা আগরওয়ালার ওষুধটির নাম 'অস্মিতা'। এই ওষুধের যৌগটি এমন, যে ঘুম এলেও, এই ওষুধে কোনও নির্ভরশীলতা তৈরি হবে না। এর আগে যেসব ওষুধ বাজারে নিদ্রাবাহক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে, তাদের নেশা ধরাবার প্রবণতার কথা সম্পর্কে আমরা সবাই ভালোমতোই ওয়াকিবহাল। এখানেই সবিতা আগরওয়ালার আবিষ্কার 'অস্মিতা' অনন্য। সবিতা স্লাইডের রঙচঙে ডায়াগ্রাম দেখিয়ে বলছিলেন কীভাবে 'মেলাটোনিন' হরমোন তৈরি করে মানুষের পিনিয়াল গ্রন্থী। মানুষ ঠিকঠিক সময় ঘুমিয়ে পড়েন এই মেলাটোনিনের ওপর নির্ভর করেই। শরীরের ভেতর জেগে থাকার সময়, ঘুমের সময় নির্দিষ্ট করে দেয় সে। 'অস্মিতা' এই মেলাটোনিনের পূর্বসুরী যৌগ হাইড্রক্সি-ইন্দোল-ও-মিথাইল-ট্রান্সফারেজ। এই যৌগ স্থিতিশীলভাবে প্রকৃতিতে পাওয়া কঠিন। ঠিক এখানেই সবিতাদেবীর আবিষ্কারের জিনিয়াস। সবিতা এমন একটি উপায়ে তার গবেষণাগারে এই যৌগটি তৈরি করছেন যেখানে সহজে এই যৌগ প্রাকৃতিক অবক্ষয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না।
আশুদাকে সম্বর্ধনা জানাবার পর নিয়মমাফিক কিছু আচার বিচারের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা হলে সাইড উইংসে চলে এলাম। আশুদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ডাঃ সবিতা আগরওয়ালকে বলল, "মিট মাই মেলাটোনিন। ডঃ অর্কপ্রভ সান্যাল।" হাতজোড় করে শুভেচ্ছাবিনিময় সেরে নিয়ে আমরা চলে এলাম গ্রিনরুমের দিকে। লক্ষ্য করলাম ডাঃ সবিতা আগরওয়ালের সঙ্গে একজন বেঁটেখাটো অ্যাসিসট্যান্ট গোছের লোক ঘুরছে। লোকটি সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে, চোখে পুরু চশমা, মাথার ডানদিকে একটা গাঢ় কাটা দাগ। লোকটা সামান্য তোতলাতে তোতলাতে কয়েকটা ফাইল দেখাচ্ছিল ম্যাডামকে। খেয়াল করে দেখলাম, ম্যাডাম চমৎকার বাংলায় কথা বলছেন ওর সঙ্গে। সেই বাংলা উচ্চারণে এতোটুকু দক্ষিণী টান নেই। আমাদের কৌতূহল অনুভব করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্যাডাম বললেন, "ওর নাম শুভঙ্কর। শুভঙ্কর শাসমল। অস্মিতার যাবতীয় ডিস্ট্রিবিউশন মার্কেটিং উনিং সামহালছেন।" শুভঙ্কর তার পুরু কাঁচের আড়াল থেকে সামান্য হাসল। আর ঠিক তখনই মহিলা ড্রেসিংরুমের ভিতর থেকে এক অস্বাভাবিক মহিলা আর্তনাদ ভেসে এল। হতচকিত হয়ে আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম সেই দিকে। ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরের এক কোণে একটি বছর একুশের মেয়ে, হয়তো ঝাড়াই পোছাই করতে এসেছিল, দু কান চেপে কাঁদছে। আর ঘরের মাঝখানে হুইলচেয়ারে বসে একটি বছর পনেরোর ছেলে লালা ঝরা মুখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে হাসছে। আমার এতো বছরের দীর্ঘ মেডিকেল জীবনে এমন ভয়ানক হাসি আমি আগে দেখিনি। শুভঙ্কর শাসমল দৌড়ে মেয়েটির কাছে যেতেই মেয়েটি আঙুল দেখিয়ে ছেলেটিকে দেখালো। চিৎকার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে প্রেক্ষাগৃহের কোঅর্ডিনেটর মিস্টার বানশাল চলে এসেছিলেন। তাকে দেখিয়ে হতাশ ম্যাডাম সবিতা আগরওয়াল বললেন, "আপকো বলে থে নজর রাখনে কে লিয়ে।"
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ছেলেটির অবশ্য সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই।
সে আগের মতোই হেসে চলেছে। লক্ষ্য করলাম শুভঙ্করের মতোই তার কপালেও আঁক করে একটা শুকিয়ে
যাওয়া কাটা দাগ। কে এই ছেলেটি?
বানসাল মেয়েটির কাছে গিয়ে কীসব শুনল। তারপর সবিতা আগরওয়ালকে বলল,
"এক্সট্রিমলি সরি ম্যাডাম। হলি গুড নাথিং হ্যাপেন্ড। ছেলেটি হুইলচেয়ার নিয়ে তেড়ে
গিয়েছিল দেখে ভয় পেয়ে গেছে। ডোন্ট উই ওয়ারি। আই উইল ম্যানেজ।"
বানসালের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে সবিতাম্যাডাম ইশারা করলেন শুভঙ্করকে।
শুভঙ্কর কলের পুতুলের মতো ছেলেটিকে হুইলচেয়ার সমেত ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। ওদের
বেরিয়ে যেতে দেখে ডাঃ আগরওয়াল আশুদাকে বললেন।
-সরি ফর অল দিস। আমার ছেলে। শুভাত্রেয়। একটু আলাগ। ইউ নো। ব্রেন ইনজুরি।
আজ আর কথা হলো না। বাট প্লিজ আসুন একদিন আমার বাড়ি। আমি কাছেই থাকি। ত্রিভোলি কোর্ট।
চলে আসুন দুজনেই। অনেক কথা হবে। এই আমার কার্ড।
'থ্যাঙ্ক ইউ' বলে আশুদা কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। ওরা বেরিয়ে যেতে
বিনসাল আশুদাকে বলল,"উফ। হরিবল। ওয়াট আ মেস।"
বানসালকে আশুদা পৃথ্বীর অনুষ্ঠানের দিন থেকেই চেনে। সহজ হয়ে বলল,"কী
হলো বলুন দেখি?"
-দ্যাট চাইল। ছেলে নয়। ডেমন। ঘুমের ওষুধ দেওয়া থাকে সবসময়।
-আপনি চিনতেন?
-শুনেছি। আমার এক বন্ধু কুলকার্নি বলছিল। ছেলের কারণেই তো ম্যাডাম
বাঙ্গালোর ছেড়ে চলে এল। আফটার দ্য কার অ্যাক্সিডেন্ট, হি বিকেম এ ডেমন।"
-একবার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা যাবে?
-বলিয়ে। বলুন।
মেয়েটি তখনও ঘরের কোণে থরথর করে কাঁপছে। আশুদা পরম স্নেহে তার কাঁধে
হাত রাখল। তারপর বলল।
-কিচ্ছু হবে না তোর। আমি বলছি। এবার বল তো। কী হয়েছিল?
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মেয়েটি যা বিবরণ দিল, তা খানিকটা এইমতো। সাফাইকাজ
সারতে মেয়েটি মেয়েদের ড্রেসিং রুমে ঢুকেছিল। ঘরে কেউ ছিল না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল
ঠিক করতে গিয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে দেখে হুইলচেয়ার করে ওই ছেলেটি ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে।
শুধু তাই নয়, তার দিকে তাকিয়েই এক অদ্ভুত হিংস্র চোখে ছেলেটি হাসছিল। এমন চাহনি, যেন
এক্ষুণি তার হাড়মজ্জা গিলে খাবে। মেয়েটি ওই চাহনি দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাই চিৎকার করে ফেলেছিল।
আশুদা 'ঠিক আছে' বলে বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে বসে গম্ভীর হয়ে তার নতুন স্মার্টফোনে
কীসব খুটখুট করে চলল। আমিই গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম।
-শুভঙ্কর শাসমল আর শুভাত্রেয়, দুজনেরই মাথার উপর দাগ। অদ্ভুত লাগল
না?
-অদ্ভুত কেন? ম্যাডাম তো বলল। 'সিন্স দ্য কার অ্যাক্সিডেন্ট'। গাড়ি
দুর্ঘটনা। হেড ইঞ্জুরি। হয়তো একসঙ্গেই দুজনে একই গাড়িতে ছিল।
-হতে পারে। কিন্তু একটা খটকা লাগছে জানো?
-কী খটকা বল দেখি?
-শুভঙ্কর শাসমলের কাটটা বাঁদিকের টেম্পোরাম হাড়ের উপর। আর শুভাত্রেয়রটা
ডানদিকে কানের পিছনে। ভাবছিলাম গাড়িটা কেমনভাবে পাল্টি খেল বা ধাক্কা খেল যে দুজনের
এইরকম আঘাত হলো। অবশ্য যদি না দুজন গাড়ি চলাকালীন মুখোমুখি বসে থাকে।
-সাবাশ অরিন্দম!
আশুদার চোখেমুখে প্রশংসার চাহনি দেখে বুঝলাম আমি পরীক্ষায় পাশ করে
গেছি। আশুদা আমার সেই উপভোগ করা দেখে বলল, "অতঃপর অরিন্দম। তোমাকে দেখে এতোদিনে
বোঝা যাচ্ছে তুমি একজন ফরেন্সিক গবেষক। আমারও তেমন খটকা লেগেছে। মুখোমুখি বসবার মতো
ল্যাম্বর্গিনি গাড়ি এদেশে বিরল। অবশ্য দুর্ঘটনাটা বিদেশেও ঘটে থাকতে পারে। ওখানে এমন
সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট জলভাত। সিনেমায় দেখিসনি?"
গাড়ি গোলপার্কের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশুদা তখনও তার মোবাইলে খুটখুট
করে চলেছে। গাড়ি চালু হতেই খানিকটা অস্থিরভাবেই বললাম, "কী এতো খুটখুট করছ মোবাইলে,
বলো দেখি?"
আশুদা খুটখুট থামিয়ে ফোন পকেটস্থ করে বলল।
-ডাঃ সবিতা আগরওয়ালের আবিষ্কারটা অসামান্য, বুঝলি অর্ক। বাঙ্গালোরে
প্রথম এ নিয়ে গবেষণা করেন সবিতা। তারপর হঠাৎ
চলে এলেন বাংলায়। কেন কে জানে? ছেলের জন্যই হয়তো।
-তারপর?
-অসামান্য অসাধ্যসাধন করেছে সবিতা। সত্যিই এই পরিস্থিতিতে একজন মা
তার ছেলের দুর্ঘটনা পাশে রেখেই কেমন বের করে ফেলল এমন একটি যৌগ, যাকে খুঁজতে সারা পৃথিবীর
বৈজ্ঞানিকরা হিমসিম খাচ্ছিল। আরও আশ্চর্যের বিষয় আছে।
-যেমন?
-যেমন ডাঃ সবিতা আগরওয়াল গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন নিউরোসার্জেন হিসেবে।
সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক
প্রতিষ্ঠা পাবার একটা হাতছানি থাকে। সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি চলে এলেন গবেষণাজগতের
অনিশ্চয়তায়। এই ত্যাগ কী কম?
এই আত্মত্যাগের সাক্ষী আমি নিজে। ডাঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজেই তো
কম মেধাবী চিকিৎসক ছিলেন না। খানিকটা তার পুত্র ঋক, আর তারপর মানুষের মনের ব্যবচ্ছেদের
নেশায় একদিন সেও তো সব প্রলোভন ছেড়ে চলে এসেছিল। গাড়ি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকাতে
ঢোকাতে বললাম।
-আশুদা। কোথাও ওনার স্বামীর উল্লেখ দেখলাম না।
লক্ষ্য করেছ?
আশুদা লিফ্টে উঠতে উঠতে বলল।
-মোবাইলে খুটখুট করে দেখলাম বুঝলি। সবিতার স্বামী কার্ডিওলজিস্ট ছিল।
একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত। তবে এই দুর্ঘটনা আর ওই শুভাত্রেয়র দুর্ঘটনা এক ঘটনা
কিনা জানবার উপায় আপাতত নেই। কারণ গুগুলের কৃত্রিম মেধা তার জবাব দিতে পারছে না।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে দেখলাম বসার ঘর থেকে আশুদার তৈরি আলোর
গোলক থেকে এক অদ্ভুত বিভা বের হয়ে আসছে। আশুদা ডিমার আর সেন্ট্রাল ইলুমিনেটর ব্যবহার
করে এই অদ্ভুত চমক তৈরি করতে পেরেছে। ডাঃ সবিতা আগরওয়ালের বয়স আমার চেয়ে খুব বেশি হবে
না। বছর দুই বড় মেরেকেটে। তবু কাজে, মেধায়, ও সাধনার বলে তাকে যেন অনেক প্রাজ্ঞ লাগল আজ। একদিন
তো নিমন্ত্রণ করেছে আমাদের তার বাড়ি ত্রিভোলি কোর্টে। গেলেই তো হয়। মনের ভিতর যেন এক
অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। তবে আপাতত রাতে খাদ্য-অন্বেষণ মূল বিষয়। আশুদা এই বিষয়ে
খুব পারদর্শী বলা যাবে না। খাবার আনিয়ে নেব ভাবছি, এমন সময় আশুদার ফোনটা বেজে উঠল।
ফোন কানে দিয়ে 'হুঁহাঁ' করার পরেই আশুদা চঞ্চল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "চল। বেরোতে হবে।"
-কোথায়?
-লেক টেম্পল রোড। তথাগত অধিকারীর ফোন। আবার খুন।
-ত্রিনেত্র!! আবার?
-হতে পারে। চল এখনই।
রাতের খাদ্যাভ্যাসচিন্তা মুহূর্তে ভুলে গেলাম। লেক টেম্পল রোড আমাদের
বাড়ির কাছেই। ঘটনার লোকেশনটা তথাগত পাঠিয়েছে ফোনে। ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। লোকেশন দেখে
জায়গার কাছাকাছি পৌছে পুলিশ জিপের পিছনে গাড়ি রেখে নেমে পড়লাম। ইতিমধ্যেই লোক জমায়েত
হয়েছে বেশ। তার ভিতরেই পুলিশ কর্ডন করে লাশটাকে আলাদা করে রেখেছে। ভীড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই
দেখলাম তথাগত অধিকারী নোট নিচ্ছে। আমাদের দেখে ম্লান হেসে বলল, আসুন। আশুদা কথা বলল
না একটুও। গম্ভীর হয়ে লাশটিকে দেখতে লাগল। উপুর হয়ে পড়ে আছেন এক বছর পঁয়ত্রিশের মণিপুরী
মহিলা। পরণে হাল্কা সাদা টি শার্ট আর স্পোর্টস শর্টস। ঘাড় কাত করে স্থির চোখে উল্টো
ফুটের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুই চোখের মাঝখানে, ভুরুর ফাঁকে একটি গর্ত। খানিকটা বুলেট
ইনজ্যুরির মতো। কিন্তু শরীরে বুলেট ঢুকলে সাধারণত তার চারপাশে যে সামান্য বারুদের গুঁড়ো
আর পোড়া দাগ থাকে, এক্ষেত্রে সেটা নেই। ফলত ধরে নেওয়া যায় কোনও অত্যন্ত ধারালো অস্ত্র
দিয়ে আঘাতটা করা হয়েছে। মহিলাটির হাতের চামড়ার ব্যাগ অগোছালো লুটিয়ে পড়ে আছে ফুটপাতের
উপর। সেখানে একটি লিপস্টিক আর পাঁচশো টাকার কয়েকটি নোট উঁকি দিচ্ছে। আশুদা সব দেখে
তথাগতকে বলল।
-এখানে তো রাস্তার পোলে সিসিটিভি থাকার কথা। সেগুলো চেক করেছ?
তথাগত মাথা নেড়ে বলে, "গতকাল ঝড়ের পর একটি ক্যামেরা খারাপ। তবে
বাকি দুটো ফরেন্সিককে দেওয়া হয়েছে।"
-কখন জানা গেল ঘটনাটা?
-আধঘন্টা আগে। সচরাচর রাস্তার এই অঞ্চলটায় একটা নোঙরার ভ্যাট থাকায়
লোকে এড়িয়ে চলে।
-কে দেখল?
-অন ডিউটি ট্রাফিক সিভিক গার্ভ সুদর্শন চৌধুরী। ওই তো ওখানে।
সুদর্শন অল্পবয়সী। সবে কাজে যোগ দিয়েছে হয়তো। এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার
জীবনে এই প্রথম। তাই স্বভাবতই তার চোখেমুখে তীব্র ভয়ের ছাপ। আশুদা তার কাছে গিয়ে বলল,
"এসে কী দেখলে?"
-বডিটা পড়ে আছে স্যার।
-আর? আশপাশ?
-আর কেউ নেই। এই অঞ্চলটায় সব বুড়োবুড়িরা থাকা। পুরনো বাড়ি। নটা বাজলেই
জানলা দরজা বন্ধ। তার ওপর আবার গতকাল ঝড়ের পর দুটো লাইট জ্বলছে না। ভাবলাম একটা সিগারেট
খাই লুকিয়ে। ডিউটির সময় আমার সিনিয়র স্যার একদম স্মোকিং পছন্দ করে না। তা জায়গা বেছে
এখানে এসে এই দৃশ্য দেখলাম।
-কোনও সন্দেহভাজন লোককে আশপাশে ঘুরতে দেখেছ?
তথাগত পাশ থেকে বলল। "একজন লাশের খানিকটা দূরে বসে ছিল। বেশভুষা
দেখে আমার সাধারণ ভ্যাগাবণ্ড মনে হলো না। ওকে আটক করেছি।"
-ভেরি গুড। সে এখন কোথায়?
-থানায় চালান করে দিয়েছি। মিডিয়া আসার আগেই। ওরা এলে আরও তিলকে তাল
করবে।
আশুদা সম্মতি জানিয়ে বলল,"শোনো। মিডিয়াকে আমাদের কথা বলার দরকার
নেই। কিপ ইট কভার্ড। যদি কিছু মনে না করো, আমি লাশের দুটো ছবি তুলে নিয়ে একবার তোমাদের
থানায় যাচ্ছি। যাকে আটক করেছ, তাকে একবার আমার দেখা দরকার। তুমি মিডিয়া সামলাও।
-ওকে।
তথাগতর মুখচোখ দিখে বোঝা যাচ্ছিল, আশুদা যে কেসটা নিয়েছে, এতে সে ভিতর
থেকে নিশ্চিন্ত। তবে আমরা আপাতত থানার দিকে চললাম। সন্দেহভাজন যখন ধরা পড়েছে, তখন সেই
তো এই ত্রিনেত্র খুনখারাপির মূল পাণ্ডা। যাক। তাহলে অন্তত একটা রহস্যর সমাধান হবে।
রাতের থানা সাধারণত অনেকটা পোড়ো কেল্লার মতো হয়ে যায়। তার চারপাশে নিঃস্তব্ধতা থাকে। তবে আজ হয়তো এই টাটকা খুনির জেরে দেখলাম থানার ভিতরটা বেশ গমগম করছে। ওসি স্টিফেন ঘোষ আমাদের দেখেই 'চলুন' বলে হাজতের দিকে নিয়ে চলল। বোধহয় তথাগত ইতিমধ্যেই ওকে আমাদের কথা বলে রেখেছে। মনের ভিতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এতোদিন মৃতদেহ দেখে দেখে আজকাল একটা কথা বুঝতে পারি যে মৃত্যুর ঠিক আগে মানুষটা কতোটা আন্দাজ করতে পেরেছিল যে তার উপর এমন বিপদ নেমে আসবে। লেক টেম্পল রোডের লাশটির চোখেমুখে ভয় ছিল না, তাৎক্ষণিক বিস্ময় ছিল। অর্থাৎ পুরো বিষয়টা এতো দ্রুত ঘটেছে যে সে রিঅ্যাক্ট করার সময় পায়নি। এতো দক্ষ খুনি এলান পো বা আগাথা ক্রিস্টির ক্লাসিক উপন্যাসে পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে তাকে দেখার সুযোগ পাওয়া কী কম রোমাঞ্চের। ভাবতে ভাবতেই আমরা পৌছে গেলাম হাজতের সামনে। আর সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য আমি বা আশুদা, দুজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হাজতের এক কোণে হাঁটুর ওপর মুখ রেখে একটি চেনা লোক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে চলেছে, "বিশ্বাস করুন। আমি খুনটা করিনি।" লোকটি আর কেউ নয়। আমার কলেজের ময়নাতদন্ত বিভাগের জুনিয়র অফিসার, ডাঃ অত্রি পালচৌধুরী!
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন