কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

ময়ূরী মিত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


ভুবন রইল জেগে

সে বনে সূর্য ঢোকে না৷ যদি কোনোদিন সূর্য বলে - আজ একটু ঢুকে গাছের পাতাতাটাগুলো সবুজ করে আসি - তো সবার আগে গাছই বাধা দেবে৷ অন্ধকার বনের মধ্যে ততোধিক অন্ধকার এক গুহা৷ গুহায় ঢোকার সুড়ঙ্গপথে পাশাপাশি দুটো লোক হাঁটতে পারে না৷ লম্বা লোককে মাথা হেঁট করে ঢুকতে হয়৷ আলো বাতাস কিছু নেই - এককণা শ্যাওলাও নেই৷ সুড়ঙ্গপথের শেষে গুহার মধ্যেই একটা ছোট জলাশয় - তার মধ্যে কিছু অন্ধমাছ৷ ওখানকার মিথ -তারা নাকি হাজার বছর 'নেই চোখে' বেঁচে আছে৷ আমি অবশ্য অন্ধমাছ দেখার জন্য সেখানে যাইনি৷ ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে আমার আকর্ষণ ওই গুহাপথে ছিল - যে পথে একটা মানুষকে একাই যেতে হয়৷ সঙ্গী থাকলেও সে হাঁটবে পিছনে - সামনের লোক পিছলে যাচ্ছে দেখেও ধরতে পারবে না কেবল আলোর অভাবে৷

গুহার কাছে যখন পৌঁছলাম তখন সেখানে দুটি মাত্র মানুষ৷ বর এবং বউ৷ বরটা খুব সুন্দর দেখতে - বউটা তত ভালো নয়৷ দুজনেরই ষাটের ওপর বয়স৷ এতটা বয়সেও বউকে দেখলাম খুব চড়া লাল লিপস্টিক পরেছেন৷ লিপস্টিকের লাল ঠোঁটের চারপাশে ছড়ায়নি৷ বউটার সামান্য পুরুষালী ঠোঁট ও ঠোঁটের নিখুঁত রেখার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলাম৷ আমার আসলে লিপ্সটিক পরার দেড় মিনিটের মধ্যে সব জেবরে যায় তো - তাই দেখছিলাম৷ বউ হেসে বলল - ম্যাক লিপস্টিক৷ আমাকে বরাবরই ও দামী লিপস্টিক কিনে দেয়৷ লাল আমার বর খুব পছন্দ করে৷ এই তো এখানে আসার আগের দিন ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট দেখিয়ে ফেরার পথে ও এই লিপস্টিকটা কিনে দিল ৷ বলল - এই ট্যুরটায় এই লিপ্সটিকটাই তুমি পরবে৷ বউ যখন এসব কথা আমাকে বলছিল - লম্বা বর ঘাড় নামিয়ে একদৃষ্টে বউয়ের ঠোঁট দেখছিল৷ নাকি লিপস্টিকটা দেখছিল? ধুর! বুঝিও না ছাই৷

অস্বাভাবিক দ্রুততায় সুড়ঙ্গ দিয়ে নামছিল বর৷ মাথায় বারবার স্যাঁতসেঁতে ছাদ, বাদুড় চামচিকের ডানার ঝাপটা লাগছিল৷ বরের সেদিকে খেয়ালই নেই৷ গাইড বললেন - আরে! আমি কি তাড়া দিয়েছি কোনো? পথটা বিপদজনক৷ আমার ল্যাম্পের আলোকে লক্ষ্য রেখে ধীরে আসুন৷ তবু বরের তাড়াহুড়ো কমল না৷ এরবেলা বউকে আমার হেফাজতে রেখে গাইডের আগেই যেতে লাগলেন৷ একটা অদ্ভুত কথাও বললেন - আলো আগে থাকাও যা, পরে থাকাও তাই ৷ আলো আগে দেখলে আগে সাবধান হওয়া যায় - পরে দেখলে একটু পরে৷ ওই পরিমাণ অন্ধকারে যখন পা একটু একটু হড়কে যাচ্ছে তখন বরটার এই ‘ডেসপ্যারেট টক’ অসহ্য লাগছিল আমার৷ পিচ্ছল পথে পাগলা হল নাকি লোকটা!

জলাশয়ে তখন কিলবিল করছে চোখহীন মাছ৷ সংখ্যায় তারা  বেশি - এমন নয়৷ তবে আধারটি ছোট বলে তাদের অনেক দেখাচ্ছে৷ আঁধারে জীবের অন্ধত্ব বোঝা যায় না৷ বরকে দেখলাম - গাইডের ল্যাম্প মাছগুলোর চোখে ফেলার চেষ্টা করছেন৷ চোখ খোলা না বন্ধ, কানা না অন্ধ, এসব দেখার চেষ্টা করছেন৷ বউকে বললাম - আপনার বর জীববিজ্ঞান পড়েননি? এ কী পাগলামো করছেন - ওঁকে বারণ করুন৷ পাখির চোখ মানুষ বারবার দেখে শুনেছি - ইনি মাছের বিচ্ছিরি দৃষ্টিহীনতা আলো ফেলে ফেলে দেখছেন! মাছগুলো দেখতেও জঘন্য৷ বারণ করুন ওঁকে - এবার আমি চেঁচাব৷ আমার খুব খারাপ লাগছে৷

আমার রাগ দেখে বউ  হাসল৷ লাল লিপস্টিক পরলে সবসময় হাসিই বেরোয় হয়ত৷ আমরা উঠতে লাগলাম৷ বরকে দেখলাম তখনো নিচু হয়ে একটা মাছকে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করছেন৷ যা মর গা৷ মাছ মেরে তুই খা গা৷

গুহা থেকে উঠেও গজগজ করে যাচ্ছি ৷ আর মনে করেছি - বর বউ কারোর দিকে তাকাবই না মোটে৷ দেখলাম বর বউ আগুপিছু হেঁটে আমার দিকেই আসছেন৷ আমাকে দেখে ফ্যাকফ্যাক করে হেসে  বললেন - আরে ম্যাডাম! আমি আজ বিরাট জোর পেলাম, জানেন!

আমি বললাম - কী করে? অন্ধকারে ঠোক্কর খেয়ে?

একটুও লজ্জা না পেয়ে বর বলতে লাগল - আরে! ডাক্তার বলেছে আমি আর আটমাস মতো আছি৷ এখন তো এই রোগে রোগীকে সব খুলে বলে দেয় - জানেন তো! তা ডাক্তারের কথা আমি বিশ্বাসই করিনি৷ টিকিট কেটে বউকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ ওরও সংসারের চাপে কোথাও যাওয়া হয়নি কতদিন! এখানে এসে অন্ধ মাছের গুহার কথা শুনে মনে হল - যাই দেখে আসি৷ যা দেখলাম ম্যাডাম - গায়ের লোম ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে৷ হাজার বছর ধরে মাছগুলো যদি চোখ হারিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, জলে নেচে আমাদের আনন্দ দিতে পারে, আমি পারব না আটমাস পেরিয়ে আরো দূরটাকে দেখতে? বলুন ম্যাডাম! তুমিও বল না গো - আমি বাঁচব না? আরে আজকালকার ডাক্তার সব! দুম করে একটা পাতলা প্লেট দেখেই বলে দিল, আপনি মরে যাবেন! আমি যত বলছি, আমি বাঁচব, আমার কিছু হয়নি, ডাক্তার তত বলছে, তাড়াতাড়ি ভর্তি হোন৷ কী যে হ্যারাস করছে না ডাক্তারটা!

চারদিকে থুতু ছিটিয়ে বকে যাচ্ছিল বর৷ আমি দেখছিলাম, বরটা  নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছে প্রকাশের  থেকে ডাক্তারের নকল করছে বেশী৷ ডাক্তার কীভাবে তাকে ‘আট মাস বাঁচবেন’ বলেছে, এটাই ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে যাচ্ছে৷

বউ অবশ্য একটি বাক্য বলল, লাস্ট মাছটা - ওই যে গো আমরা চলে আসার সময় যেটাকে তুমি হাত দিয়ে ধরতে গেলে - ওটা লাল ছিল৷ ফ্যাকাশে হলেও চামড়ায় লাল শেড ছিল গো!

দূরে গাইড তখন চা খাচ্ছে৷ একদল নতুন টুরিস্ট৷ তারা এবার আঁধারে ঢুকবে৷ প্রাচীন জলচরের জীবনে ভাসা দেখবে৷


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন