সমকালীন ছোটগল্প |
ফাইনাল টাচ
অনুরাগের হাতটা স্পন্দনের গলার কাছে এসে ভ্যান গগের শিল্প হয়ে উঠছিল। আবেশে চোখ বুজে আসতে আসতে পরের টাচটার একটা ‘স্টোরি’ ওর মাথায় ছাপ ফেলতেই ওর শিরায় শিরায় একটা রক্তিম আনন্দ স্টেপ বাই স্টেপ আরোরা বোরিয়ালিসের ড্যান্সিং স্টারের মত নেচে উঠলো। ঠিক ফাইনাল টাচটা, স্পন্দনের কন্ঠনালির কাছাকাছি মোস্ট স্পেশ্যাল হয়ে ওঠবার ব্রহ্মমুহূর্তেই ডোরবেলটা ঝমঝম করে গেয়ে উঠল, “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ুরের মত নাচেরে…”
এইসব ঝমঝমে নাচ-গান-বাজনা খুব পছন্দ অনুরাগের। ‘হেসে নাও দু’দিন বৈ তো নয়’— এইরকম দিজেন্দ্রগীতিকারের কথায় বড় বিশ্বাসী অনুরাগ। কার কখন যে সন্ধ্যে হয়, কেউ জানে না! এই যেমন, এইমাত্র সন্ধ্যে হয়ে আসছিল স্পন্দনের! একেবারে না হলেও খানিকটা সন্ধ্যে তো এনে দিতোই স্পন্দনের জীবনে অনুরাগ!
সেই বালক বয়সে ব্লেডের একটানে সোফার গদি, স্কুলবাসের সিট, ডাইনিং টেবিলের সুন্দর ছাপা ফুলকারি টেবিলক্লথ ফাঁসিয়ে দিয়ে কী আনন্দ যে পেয়েছে অনুরাগ! বুক ধ্বকধ্বক করার একটা আলাদা আনন্দ আছে। সবাই তা বুঝতে পারে না। আর তা যদি হয় কোনও নিষিদ্ধ আনন্দ, তাহ’লে তো কথাই নেই! তারপর যত বড় হয়েছে, মানে বয়স বেড়েছে, এই ফাঁসানোর কায়দাগুলোকে গভীর অধ্যাবসায়ে ক্রমে ক্রমে শিল্প করে তুলেছে অনুরাগ। দিনে দিনে ব্লেড ছুরি নাইফ ড্যাগার… বড্ড ভালোবাসার ধন হয়ে উঠেছে ওর। একটু করে বড় হয়ে উঠছে আর এসবের নতুনতর ভাষা আপনার থেকেই সংযোজিত হচ্ছে অনুরাগের হৃদয়ের শব্দকোষে। প্রতিদিন নতুন করে পাচ্ছে তার পরশ। হাতের কারুকলায় সেগুলোকে শিল্প করে তোলার ট্রেনিং নিজেই নিজেকে দিচ্ছে! শুধুই বাসের সিট নয়, একসাথে পড়াশোনা খেলাধুলো করতে করতে সামনের বাড়ির মুনিয়ার টোপা টোপা পায়ের পাতায় টুক করে ব্লেড চালিয়ে মূহুর্তে ব্লেডটা নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ফেলে মুনিয়ার ক্ষত দেখে আশ্চর্য হওয়ার ভান করে কি অসীম আনন্দ পেতো যে অনুরাগ! অথচ, বড় হতে হতে সেই মেয়েটারই অনুরাগী হয়ে উঠেছিল! এইসব চেরা-ফাঁড়ায় রক্তের অণু অণু ক্ষরণ কী যে তৃপ্তির ধারাপাত আনতো অনুরাগের মনে!
হাইস্কুলে উঠে স্পন্দনকে নতুন বন্ধু পেয়েছিল অনুরাগ। তখন সবসময় দুজনে একসঙ্গে। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলো বড্ড টানে অনুরাগকে। একবার একটা বিভৎস-রসের কেমিক্যালের সাথে প্রেমরস সমানুপাতিক হারে মিশিয়ে একটা বিচিত্ররসের রেজাল্ট পায় অনুরাগ। তখন বকযন্ত্রের বুদবুদগুলো অনেক বিচিত্র কাহিনী শুনিয়েছে ওকে। আরও আগ্রহী করে তুলেছে অনুরাগকে এইসব কাহিনী। সেখান থেকে আরও নতুন নতুন কায়দার চির-ফাঁড়ের সুলুকসন্ধান যত্নে জোগাড় করেছে ও। বায়োলজির প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে ব্যাঙ টিকটিকি আরশোলা চিরে তাদের ব্রেন মেমব্রেন লিভার স্টম্যাক লাংস চিরে চিরে কতকিছু নতুনের সন্ধান পেয়েছে! নরম মাংসতে তীক্ষ্ণধার ছুরি চালাতে যা আরাম! সেই নিমগ্ন চির-ফাঁড়ের সময় একদিন স্পন্দন মুখ তুলে অনুরাগকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে অনুরাগেরর হিংস্র মুখ আর তৃপ্ত চোখদুটোকে দেখে কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল! স্পন্দন যেদিন অনুরাগদের বাড়িতে ফিজিক্সের নোটস নিতে গিয়েছিল সেদিন মুনিয়াকে দেখেছিল ওদের বাড়িতে। তারপর যতবার গেছে স্পন্দন, মুনিয়ার দিকে তাকালেই অনুরাগের মুখটা যেন কেমন অন্যরকম লাগতো স্পন্দনের! ঠিক সেদিন ল্যাবে যেমন লেগেছিলো। অনুরাগ কি ভেবেছিল মুনিয়ার জন্যই স্পন্দন আসে ওদের বাড়ি! ও কি আন্দাজ করছিল যে স্পন্দন আর মুনিয়া বাইরে কোথাও দেখা করে! কিংবা স্পন্দন আর মুনিয়া কাছাকাছি হবার চেষ্টা করছে! মুনিয়া ওর কাছথেকে দূরে সরে যাচ্ছে! স্পন্দন মুনিয়াকে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে! এইসব হিজিবিজি চিন্তা ওকে একটু একটু হিংস্র করে তুলছিলো!
আজ অনুরাগের ছুরির সামনে বসে, স্পন্দন ভাবছে, সেই থেকেই কি অনুরাগ এই গেমপ্ল্যান তৈরি করছিল মনে মনে! আজ স্পন্দনের ফোনে যখন জানতে পেরেছে ওর মা-বাবা দুজনেই ওদের নার্সিংহোমে একটা সিরিয়াস ও.টি. নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকবে, দুপুরে ঘরে ফিরতে পারবে না, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে, তখন স্পন্দনকে একাঘরে পাওয়ার এমন সুযোগটা অনুরাগ ছাড়তে চায়নি! ওকে ভয় দেখিয়ে থ্রেট করতে এসেছে! হাতের ফিজিক্স নোটখাতাটা আনা একটা ভানমাত্র! কেননা স্পন্দন অনুরাগের চোখে সেই দৃষ্টিটা আজ এইমাত্র দেখতে পেয়েছে! ভাবতে ভাবতে স্পন্দন কেমন একটা ড্রাউজিনেস অনুভব করলো। ডোরবেলের শব্দ শুনতে শুনতে কেমন ঝুঁকে আসছিল স্পন্দনের মাথাটা। কোকের গ্লাসে কি লুকিয়ে অনুরাগ কিছু মিশিয়ে…
ডোরবেলের গান শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে হাসলো অনুরাগ। এই ডোরবেলটা নিশ্চয় স্পন্দনের মা’র পছন্দে কেনা! স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে আনা! আচ্ছা, যারা মানুষের কাঁচা চামড়া ভেদ করে ছুরি চালায় তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত, পছন্দ করতে পারে! না কি এটা ভদ্রমহিলার একটা ভান! না কি নিজের একটা ডাবল্ আইডেনটিটি রাখার চেষ্টা! ঠিক তারই মতো! নিঃশব্দেভাবে অনুরাগ। ততক্ষণে ডোরবেল আবার বেজে ওঠে।
ঝিমিয়ে পড়া স্পন্দনের দিকে দেখে নিয়ে হাসে অনুরাগ। যে-ই আসুক, দরজা খোলা হবে না। এখন স্পন্দনের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে হবে। মুনিয়া যে একমাত্র আমার, এ’কথাটা ওকে জানিয়ে দিতে হবে। এসব কথা যখন অনুরাগের মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে, ঝনঝন করে উঠলো অনুরাগের মোবাইল ফোন। ওপাশ থেকে কেউ জানাচ্ছে অনুরাগের বাবার মৃত্যু-খবর! কোন কাজটা আগে করবে অনুরাগ বুঝতে পারে না। এ্যাকসিডেণ্টে মৃত বাবার বডি আনতে দরজা খুলে বেরোবে? স্পন্দনের স্পন্দন ডিলিট করে দেবার জন্য যে নিপুণ স্ট্যাবিং’টা আরো শিল্পায়িত করে তুলতে চাচ্ছিলো অনুরাগ, সেটার কী হবে তাহলে! মাথার মধ্যে সমস্ত কিছু জট পাকিয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে স্পন্দন যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে…! হাসিটার ধার কি ওর ছুরিটার থেকেও বেশী! সেই ধারে কুচি কুচি হয়ে যাবে অনুরাগের শিল্পনমুনা!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন