কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

পায়েল চ্যাটার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৭


লাল-হলুদ-সবুজ


লাল-সবুজের কাটাকুটি খেলায় হলুদ বরাবরই অপছন্দ দীপকবাবুর। হলুদ রঙের  সিগন্যাল দেখলেই হৃদস্পন্দনের লাব-ডুব আওয়াজটা শুনতে পান। লাল-সবুজ মানে নিশ্চয়তা। হলুদে অনিশ্চয়তা। লাল হলো বলে। সাবধান থাকতে হয়। অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত পেলেই নিউরনগুলো অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে দীপকবাবুর মানসিক শান্তির ব্যাঘাত ঘটাতে চলে আসে। ওঁর সবচেয়ে প্রিয় লাল থেকে সবুজ বা সবুজ থেকে লাল হওয়ার মাঝের সময়ের বিরতি। প্রত্যেক বিরতিতে একটি গান। সঙ্গে স্মৃতির উঁকিঝুঁকি। ড্রাইভার শ্যামলকে মাঝে মাঝে সাবধানবাণী শুনিয়েই আবার গান-স্মৃতির অতলে ডুবে যান দীপকবাবু। এইজন্যে অফিস যাওয়ার রাস্তাটা বড় প্রিয়। সল্টলেকের বাড়ি থেকে ধর্মতলায় অফিস যাওয়ার রাস্তায় বেশ কয়েকটি সিগন্যাল তাঁর সঙ্গী। অফিসটাইমের বিভীষিকাময় ট্রাফিক জ্যাম তাই মন্দ লাগে না। গাড়ির সারি আর বাসের লাইনের ওপারে সকলে‌ নাজেহাল, এদিকে দীপকবাবুর সঙ্গী “কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা”। আহা! মৃন্ময়ীর চোখদুটো শর্মিলার মতোই ছিল। শুধু সেখানে দীপকবাবু ধরা পড়লেন না!

নিজের পছন্দের এরকম হাজারো গান ধরে রেখেছেন গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে। হেডফোন না-পসন্দ দীপকবাবুর। গান চললে গাড়িটা গমগম করবে, তবেই না মজা! তবে চলমান অবস্থায় গান চালিয়ে ড্রাইভারকে বিভ্রান্ত করেন না। তাঁর মনোযোগের সঙ্গে কোনোরকম চালাকি করতে নারাজ। অফিসে সময়মতো হাজিরার ব্যাপারেও অবহেলা করেন না। যথেষ্ট সময় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। সিগন্যালে বন্দি হলেই গান শোনেন। সিগন্যালে সময়টা বেশি লাগলেই খুশি হন। 'শ্যামল আস্তে চালিও', যাতে জ্যামসমেত একটি সিগন্যালে একটি গানই শেষ হয়। তবে তার জন্য অন্য চালকদের কোন অসুবিধার সৃষ্টি করেন না। এক একটা গান একেক রকমের স্মৃতির উস্কানি। কোনো গান জীবনের ওঠাপড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই গান-সিগন্যাল উপভোগ করার জন্য বাড়িতে রামায়ণ-মহাভারতের সাক্ষী হতে হয়। “রোজ এই সাত-সকালে রান্না! ক’টা বছর আর আছে চাকরি?” গিন্নির বাক্যবাণেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে গান- সিগন্যাল-স্মৃতি উপভোগ করছেন।

উল্টোডাঙার সিগন্যাল এলেই 'চৌরঙ্গী', খান্নায় 'ববি', হাতিবাগানে 'ডন', শোভাবাজারে 'সপ্তপদী', চাঁদনীতে 'স্ত্রী'রা সঙ্গ দিতেন। দিন প্রতি গানের তালিকা মস্তিষ্কে ভরা। অফিস থেকে ফেরার সময়ও একই ব্যবস্থা। সল্টলেক থেকে ধর্মতলা। অনেকখানি রাস্তা। আলাদা গান। হুড়মুড়িয়ে ভিড় করা স্মৃতি।

বেশ ভেসে চলছিল গানের ভেলা। কিন্তু 'মুখপোড়া ভাইরাস'। ব্রেক কষে দিল একেবারে! আপাতত সপ্তাহে দুদিন অফিস! কিন্তু কোথায়  সিগন্যাল বিরতি? কোথায় ট্রাফিক জ্যাম? সব বেবাক ফাঁকা। গানের অর্ধেক এগোতে না এগোতেই সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ। হুটোপাটি করা আনন্দের বা চিনচিনে ব্যথার স্মৃতিরা ভিড় করার আগেই ভ্যানিশ। এইতো সেদিন সবেমাত্র “গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’’ শুনে সেই বিনুনি দোলানো সুমিত্রার মুখটা ভেসে আসা শুরু হয়েছিল, আর ঠিক তখনই সিগন্যালটা খুলে গেল। লাল থেকে সবুজ। দেখা যাক,পরের সিগন্যালে যদি স্পষ্ট হয় মুখটা! “বাঁশি বুঝি সেই সুরে” গানটা শুনবে না হয়!

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন