কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৭


আম

 

আমটার গায়ে একটা দাগ ছিল। মা বলল, জন্মদাগ। যে আমের গায়ে জন্মদাগ,  তা ছেলেদের খেতে নেই। তা মাতৃভক্ষ্য। বীথি ঠোঁট বাঁকাল। আমি অপ্রস্তুত। বীথিদের বাপের বাড়ি বামপন্থী। দেওয়াল জোড়া কমরেড অমুক, কমরেড তমুক। মায়ের ফালতু আচারবিচারগুলো ওর সামনে ঢেকেঢুকে রাখি৷

সকালে অম্বুবাচীতে মা আম-দুধ খেতে চেয়েছিল। বীথিকে ইম্প্রেস করতে আমি তড়িঘড়ি বলি, “আহ্ মা! যত্ত বাজে সংস্কার”।

মাকে নার্ভাস দেখায়। বলে, “থাক তবে, খাব না”।

বীথি বলে, “নিশ্চয় খাবেন। খাবেন না কেন?” কথা ট্যারাব্যাঁকা হলেও, জানি, বীথি সহজেই আর্দ্র হয়। হাঁফ ছেড়ে বাজারে যাই।

রাতে মা অতগুলো আমের মধ্যে খুঁজে পেতে ঠিক খুঁতোটাকে বের করেছে। স্বভাব। কাটা বেগুনের পোকায় খাওয়া প্রান্তটি কায়দা করে কেটে রেখে দিত, পুড়িয়ে খাবে বলে। আমাদের পাতে পড়ত চাকা চাকা সুচারু বেগুনভাজা। আজকাল মায়ের রান্নার পাট চুকেছে৷ বীথি যখন রান্না করে, মা ঘুরঘুর করে আশেপাশে। কিছু নির্দেশ দিতে যায় রন্ধন বা পরিবেশন সংক্রান্ত। সাহস পায় না। বরং চকচকে চোখে ঘ্রাণ নেয়। “আজ লটে মাছ রাঁধলে? বেশ বেশ”।

আমটির গায়ে আড়াআড়ি চলে গেছে এক ইঞ্চি কালো দাগ। পচে উঠেছে, নাকি স্রেফ পাতার দাগ? মা অবিচল বলে চলেছে ‘জন্মদাগ, জন্মদাগ’। বীথি গজগজ করে। মা বালিকার জেদে জন্মদাগওয়ালা আমটিকে দখল করেছে।  বীথির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে।

“ভুলভাল কথা যত! দাগওয়ালা বা পোকাধরা জিনিষ যাতে সংসারে মা-এর  ভাগেই জোটে, স্বামী-সন্তান যাতে ভালোটা  পায়, তাই এসব লোকঠকানো  ব্যবস্থা”। বীথি সপাট উত্তরে হামেশাই মা’কে স্তব্ধ করে দেয়। মা কুঁকড়ে যায়।

“আমি, আসলে শুনেছিলাম... তাই... আসলে অম্বুবাচীও বটে… অবশ্য পুরো আমটা বুড়ো পেটে সহ্য হবে না... তাও ঠিক!”

বীথি পিঠে হাত রাখে মায়ের।

“সব সহ্য হবে, মা। খেতে ইচ্ছে করলে, খেতে হয়। সুগার-টুগারও নেই, খাবেন  না কেন? কিন্তু শুধু অম্বুবাচীতে কেন? আর খুঁতোটাই বা আপনাকে খেতে হবে কেন, শুনি?”

সলাজ মা আমার, ধরা-পড়ে-যাওয়া বালিকা যেন। বলে, “মেয়েমানুষের নোলা  ভালো নয়। বিধবার তো নয়ই। কিন্তু বুড়ি হতেই কেমন যেন নোলা বেড়ে গেছে, বৌমা…”

মায়ের খাওয়া দেখেছি কি কোনোদিন? সবার শেষে সেই যে মানদাদিকে সঙ্গে করে খেতে বসত, দেখেছি কি? কী খেত মা? কী ভালোবাসে? মা কি আম ভালোবাসে? আমার বাম কানের জুড়ুল, জন্মদাগ। মা, তোমার জন্মদাগ আছে? ডাকনাম?

ছুরি দিয়ে মুখ কেটে জলে ভিজিয়ে রেখেছি টুকটুকে আম। মা  জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে একখানি গোটা জলমগ্ন আমের দিকে। ভাগ্যিস বার্ধক্যে মানুষ শৈশব ফিরে পায়। সত্যি কি ফিরে পাওয়া যায়?

তোমার কোনো শৈশব ছিল, মা? দাদুদের ওই বিরাট আমগাছ... বিকেলরোদে তুমি কি পাকা আমের চিকণ গায়ে ড্রাকুলার দক্ষতায় দাঁত ফুটিয়ে টেনে নিতে সোয়াদ? হাত বেয়ে গড়াত হলুদ রস? ফেরো মা, একটিবার, চোখ বোজার আগে। অসমাপ্ত শৈশবে। ডাকনামে ফেরো। ফেরো জন্মদাগে।

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. মনে পড়ে গেল - রবিবার দিন জলখাবারে লুচি তরকারি বানাচ্ছে মা আর কাকিমা। বিরাট সংসারের জন্য প্রচুর আয়োজন। সবার খাওয়ার শেষে মা কাকিমার জন্য দুটো করে চ্যাপ্টা লুচি (যেগুলো ফোলে নি আর কি) কেবল পড়ে থাকতো। কাকিমা তরকারী কাটার সময়ে আলু পটলের খোসাগুলো রেখে দিত। সেগুলোর একটা তরকারি বানিয়ে নিত নিজেদের জন্য। এরকম আরো অনেক গল্প মা কাকিমার জন্য আছে।

    উত্তরমুছুন