পাখিরা নামানো নেহা আর কুয়াশা পাতানো রিয়ার একশো সূর্য
তারপর সব হারানো খেলা। ভাষা শব্দ বাক্য।
মাথার ভেতর শুধু কিছু ধ্বনি ধা ধরেছে। স্বরলিপিহারা। স্বর থেকে নেহানো লিপিরাই
একদিন তোমার কথা বলেছিল। রুয়াম রুয়াম ডেকে ডেকে রয়ূম হয়ে ওঠা ঝলক। ছোঁয়া-ছুলাম ভ্রূ থেকে নেহানির্মিত যেসব রাস্তারা হেঁটে যায়; সময়ের দুলকিলতায় রিয়ার মোমচি যেখানে চলনমাত্রায় লীন হতে
চায়, সেখানে সমস্তটাই বেবাক যাত্রা। সেখানে বার্থ কখনো কনফার্মড হয়না। সিটে বসেই
হারিয়ে বসি প্রথম পৃথিবী। তোমার হাত ধরে দ্বিতীয় তৃতীয়। কোথাও রিজার্ভেশান হয়না।
সব কটা পৃথিবী ঘোরে বেঘোরে। প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে উঁকি দেয় মিলেনিয়াম সূর্য।
তার চলন বলন সবটাই সমান্তরালের সঙ্গে সমঝোতায়। অথচ তোমার দেখনভঙ্গি নাগরিক
জ্যামিতির জ্যা খুলে নগ্নরেখায়। রেখাদের গায়ে রোমান্টিক রোদ। অতিবেগনি
ক্যাম্পফায়ারের তাপ মেখে কল্পলোকের গল্পকথা কাহিনিসুলভ করে তুলি। নিটোলে পা রাখলেই
বস্তুকণায় মুখ রাখা রিয়া নিউক্লিয়াস ফাটিয়ে আলাদা করে ফেলে ম্যাটার ও
আন্টিম্যাটার। কেন্দ্রমুখী প্রোটন আর বিয়োগান্ত ইলেকট্রনের দৃষ্টিরেখায় তোমার মুখ
আর জলজাভিরাম ভার্সাবলী। আমি স্বনির্বাচিত আকাশ বুনি। বুটিকে বসানো জীবন্ত ভাষা তখন রোদাবিল ট্রেকিং-এ।
স্বপন রায় মূলত কবি। কিন্তু কথাটা ফিরিয়ে নিতে হয় তাঁর গদ্য সংকলন ‘একশো সূর্যে’ হাতে পেলে। কবি কখনও কখনও লেখকও বটে। ‘একশো সূর্যে’ – মিলেনিয়াম সানরাইজের আবাহন। সূর্যোদয়ের একটু আগে সিকিমের সর্বোচ্চ হিল ষ্টেশন, রাবাংলায় শূন্য দশকের কিছু তরুণ আর হিমলমানব প্রণব দের সঙ্গে অলোক, রঞ্জন, প্রণব পাল আর স্বপনের জলছাপ পড়ে গেল। সঙ্গে রইল আমাদের প্রিয় বারীনদা। শুধু পায়ের জেগে ওঠা নয়। কবিতা যোগ করে পায়ের চলাচল মাথার পেন্টহাউসে। কিন্তু শতাব্দীর প্রথম সূর্যোদয় দেখতে এত পাহাড় ভাঙা কেন? উত্তরে কবি, “দেখা অনুভূতি আর বিস্ময় আলাদা হবেই। তাই এই জার্নি, এই ট্রেকিং”। কবিতার ট্রেকিং কোথায় নিয়ে যায়? হয়তো রঞ্জনের সেভেন বেলোর বাড়িতে যেখানে দৃশ্যকে বাজিয়ে তোলা হচ্ছে কিংবা প্রণব পালের মাজিক ক্যানভাসে যেখানে রোদ্দুরকে একটু দাঁড়াতে বলে তাকে আরো উজ্জ্বল করা হচ্ছে।
সিকিমের পাহাড়চেরা
রাস্তায় কবিতার এই জার্নি দ্বিতীয় পৃথিবীর। এরই সমান্তরালে প্রথম পৃথিবীর গল্প, থানায় একটি রাত; তিন্নি, তুঁহু, সন্তুর, ওসি ও সুজন
জীবনপ্রণালী খুঁড়ে চলেছে, যেখানে ওসিও কবিতা লেখে। দুই পৃথিবী ভ্রমণশেষে
তৃতীয় পৃথিবীতে ফেরা ও ফিরে দেখা -
এই গদ্যের সমান্তরাল
প্রথম পৃথিবীর শব্দ বাক্য ব্যাখ্যা অর্থ প্রতিপত্তি রেষারেষি যৌনতা প্রেম রাজনীতি
দর্শন ভিশন নিয়ে সন্তুর,
তিন্নি, তুহুঁ, ওসি বা সুজনের রসায়ন গড়ে
উঠেছিল। হয়তো কোনো ক্রশিং’-এ দেখা হয়ে
যাবে। চেনার প্রশ্ন নেই,
প্রয়োজনও
নেই। দ্বিতীয় পৃথিবীর পাসওয়ার্ড হল চেতনা। যার আছে তার রেশন কার্ড বা শেষনকার্ডের
প্রয়োজন নেই। [একশো সূর্যে ]
তো এই দুই পৃথিবীর
সমান্তরাল চলন প্যারালাল ইউনিভার্সের গতিতত্ত্ব মেনে নিলেও মৌলকণার প্রকৃতি
হারমানাহার। স্বপন পারেন,
দুটো
পৃথিবীকে একই কলমের নিচে কুলকুল করে বইয়ে দিতে। আসলে দুরূহতাও যখন আনন্দমগ্ন, গ্রীবার বাঁকানো অবকাশ
উঠে আসে উদ্দাম চারুকলায়। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে রেণু রেণু তুমুলে। আমি কোয়ান্টাম
কোহেরেন্স ভাবি। ভাবনারা লাগামছাড়া হলে কত সহজেই পেরিয়ে যায় আলোপার দীর্ঘতা।
রুয়ামের সঙ্গে - এই তো কিছুক্ষণ; এক পা দু পা। গন্তব্য
কোথায়? নেই। যাওয়া বা আসায়
কীসের সন্ধান? দিকচিহ্নহীন
শব্দালো মেখে এই উড়ান;
এই
জলকান্তার। আসলে কান্ত থেকে অন্তহীনতায় যেতে যেতে যখন প্রান্তরের সীমা ছুঁয়ে ফেলি, খুঁজে দেখি কিছু জলজ ওয়েসিস।
পাখি আছে? নেই। অনাগত
পাখালির ডানায় পাখয়াজি স্বপন;
ধ্রুপদের
ধা থেকে সূর্য নামাচ্ছে।
তো যোগে ও বিয়োগে দেখি
ময়ূর রয়ূম হয়ে নাচছে। নাচ মানে কী? অনুষ্টুপ অঙ্গদোলনের আনন্দলোক নাকি আনন্দাঙ্গের অনুষ্টুপ
চলন? নাকি এসব
কূটনৈতিক বিসংবাদে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র হর্ষোৎফুল্ল অঙ্গের রয়ূম হয়ে ওঠা? রয়ূম যদি বিশেষণ তবে
রুয়াম কি রয়ূমজাত বিশেষ্য?
ধরাছোঁয়ার
মধ্যে ভূগোলের বর্তুলাকারে সারান্ডা আর তিরিলপোসি তিরিলপোসি ডেকে বৃষ্টির জাঙ্গলিক
ইশারা। এরই মধ্যে ময়ূর। না ঠিক ময়ূর না। ময়ূরকে দৃশ্যে রেখে দৃশ্যভাবনা। দৃশ্যের
কেন্দ্র থেকে উৎসারিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে দৃশ্যাবলীর ভাবনা। আর ভাবনাকে দেদার করলেই
বৃষ্টিল ছুটে ময়ূর। তো বৃষ্টি আর বিশেষ্য রইল না। তালেগোলে ছুটকে রঙদুরস্ত করল।
বেআব্রু হল ময়ূর। তো ধোপ সইলে ভাবনাকে এভাবেই দুর্বিনীত। যার ভাবনা নেই সে বিনীত
হোক ক্ষতি নেই। কিন্তু ‘ধা’ বা ‘স্থা’–এর খোঁজ কেন? স্বপনের দুরন্ত
স্ব-লাফগুলোয় কেন্দ্র থেকে ছিটকে যাওয়ার এই সাধ; যেখানে সাঁকো পেরোলেই একমুঠো উষ্ণতা। পরিচিত
স্বাদকোরক পেরোনোর স্বপ্নগুলো যখন অস্থির করে তোলে, তখন দেখি পণ মাপার সুডৌল কুনকে উল্টেপাল্টে
একচেটিয়া দীপ্তাংশুর সংসারে একশো সূর্যে পরিক্রমা।
রোদান্তারা রা রা - কোথায়? এক রোদাক্রান্ত
ক্লাসরুমে, যেখানে শুরু
হচ্ছে মহাবিশ্বের চেয়েও বড় ভালোবাসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তবে শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় এনার্জির
ঘাটতি ছিল। ফলে প্রেম ইউনিফর্মিটির স্বীকারে গেল না। তা সে যাই হোক, তখন “স্কার্টে অজর
তাপজ্বরের সেলাই”। স্কার্টের মালিকানা বিষয় নয়, বিচার্যও নয়। তো সেই স্কার্ট তো স্মৃতি।
কিন্তু স্মৃতির প্রতিটি বুনোটে স্বপন যখন হাত রাখেন আমরা বিস্ময়াবিষ্ট হই। এই
বিস্ময়বোধ ও বোধের অন্তরালবর্তী দরজাকে হাটখোলা করে, যেখানে “অগনবর্জিত স্কার্টে অলেখা
কম্পার্টমেন্টের রহস্য ছায়া ফেলছে, বিভঙ্গ দিচ্ছে রোদের”। রোদ্দুরপ্রেমিক লেখকের
কনশাসনেস ভাবি, কসমিক জিনোমের
কথা মনে পড়ে। ওপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটা বাক্যে পূর্ণ মাত্রায় রোপিত হয়েছে স্বপনীয়
সত্তা। কখনো একটি বাক্য,
কখনোও
বা একটি মাত্র শব্দই যথেষ্ট হয়ে ওঠে সাবএটোমিক ঘূর্ণির মধ্যে ফেলে দিতে। বেহিসেবি
স্বাপ্নিকের দাগ রয়ে যায় চেতনমোহনায়।
তো এখন প্রশ্ন হল কোন
দেখাকে ভাববো বাস্তব?
যা
ঘটে গেল নাকি যা ঘটতে পারে। বাস্তব অবাস্তবের দ্বন্দ্বে কবিজগৎ -
সচেতন কল্পমূর্তির
পৃথিবী যার মধ্যে আছে সুখ দুঃখ,
রঙ
ধারনা, বাল্যকালের স্মৃতি, মৃত্যুভয়, ভালোবাসা, বোঝাপড়া, অসংখ্য ঘটনার স্মৃতি, জ্ঞান অজ্ঞানতা, প্রতিহিংসা, গন্ধ, ধ্বনি, এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়গত
ও বুদ্ধিগত সম্পর্কের সংকলন এবং সেই সঙ্গে বর্হিপৃথিবীর মানসিক প্রতিরূপ ও ক্রিয়া
বিক্রিয়া। এই প্রাথমিক পৃথিবী-ধারনা ছাড়া আমরা মানুষ হতে পারি না। অথচ এটি অপ্রত্যক্ষ, একেই আমি বাস্তব বলি। দ্বিতীয়
পৃথিবী প্রত্যক্ষ হলেও আমাদের জীবনের সঙ্গে ততটা জড়িত নয়। এটি হল আশেপাশের
প্রাকৃতিক ও তথাকথিত বাস্তবিক পৃথিবী। সূর্য চন্দ্র গাছপাতা জল চেয়ার টিভি গাড়ি
চাকরি সংসার মানুষ এবং নিউরনের কাজকর্ম অণু পরমাণু ইলেকট্রন বিদ্যুৎ ঝড় প্রজাপতি
পাখির গান স্পেসটাইম –
যেগুলো
আমি না থাকলেও থাকে, আমারই জন্য
বিশেষ নয়। একে আমি বলি অবাস্তব।
[কবিতার ভবিষ্যৎ – বারীন ঘোষাল]
এ তো গেল বারীনীয়
তত্ত্ব। কিন্তু স্বপন তো তত্ত্ব বলেন না, গল্প বলেন। গল্পের জন্য গড়ে তোলা নেহা, রুয়ামের সঙ্গে হাঁটতে
হাঁটতে খুলতে থাকে বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যবর্তী কপাটগুলো। কপাটের ওইপাশে কেউ কি
অপেক্ষায়? নেহা কে? আঁচলের নিভৃতে নেহা নামে
এক নিরপেক্ষ দ্বন্দ্ব;
গানবেলার
বাহিকা; রুয়ামের
হৃদয়ঘটিত কফি! চেতনার খুব কাছে কবিতা সম্পর্কিত আলো ও অনালো; ক্যাম্পফায়ার প্রণীত
ভালোবাসায় রঙ ও বেরঙ। নেহা কোথায়?
“রাইট
অন দ্য টপ অফ লাইফ”। তো এই জীবনপ্রবাহের ধারাপাত উল্টে দেখি কবির বাস্তব কী, কোনখানে তার বাস–
এরপর ফর্সা ফোলানো
জ্যোৎস্না এসে পড়ে। বুকের কোন দাগে হয়তো গন্ধ রয়ে গেছে, এল্পাইন। অতি বেগুনি ক্যাম্পফায়ার। একটা
আলাদা জীবন, চলে নীল শাড়ি
নিঙাড়ি নিঙাড়ি, এই রূপ হল
বাস্তব আর নিষ্ক্রান্ত কল্পনার আহরণ ভালোবাসা। তো ভালোবাসায় ভুলে যাওয়া কিন্তু
দরজা বন্ধ করা নয়। হাজার হাজার খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডুবতে থাকা চেতনার হঠাৎ
বিস্ফোরণ যা সয়ে যাবে প্রকৃতির সহ্যে, এই কবিতাও আমার নিছক কল্পনা নয়, আমার বাস্তবও নয়। কবিকে আলাদা হতে হয় আপামর
থেকে, সমষ্টির গুণ
থেকে, আলাদা হওয়ার মানসিক
স্তরেই কবির বাস্তব জন্ম নেয় তার কল্পিত গুণ নিয়ে, তার গুণজড়িত অভিজ্ঞতা নিয়ে। ফলে কবির বাস্তব
খুবই জনপ্রিয় সমাজ সচেতনতার বাস্তব হতে পারে না। [রুয়ামের সঙ্গে]
নতুন কবিতার দাবিদাওয়া, শব্দের ডিফর্মেশান, শব্দ ভেঙে প্রতিশব্দ জোড়শব্দ কল্পশব্দ
নতুন শব্দ,
ক্রিয়াপদ ও ব্যাকরণের ভার নামিয়ে আকাশ হওয়া - এভাবেই আমরা একটু একটু করে স্পর্শ পেতে থাকি কবি স্বপন রায়ের কবিতাভাবনা। স্বপনের
বৈশিষ্ট্য হল নিটোল দেখলেই ভেঙে ফেলা। পরমাণু যেমন দুই বিপরীত মেরুর চার্জ নিয়েও
সুষম থেকে যায়; স্বপন কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিক
শৃঙ্খলায় নিজেকে রাখতে নারাজ। তাঁকে সঙ্গত দেয় রিয়া। রিয়া কে? না, রিয়া
বস্তু। অবিনাশি কিন্তু পরিবর্তনশীল। নিউক্লিয়সের ভেতর সমস্ত বস্তু সমস্ত জগতকে
একীভূত করে দেখে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কবি। কবি প্রলোভিত হয়। ম্যাটারের সঙ্গে আন্টিম্যাটারকেও কেন্দ্রিভূত করতে চায়, কবির চাহিদার তো কোনো লিমিট নেই। ফলত একটা প্রচণ্ড
বিস্ফোরণের সম্মুখিন হয়ে পড়ে।
বিস্ফোরণজাত রশ্মিটাতে কবির লোভ, কেন্দ্রাতিগ
চলনের ওই অনুভাবিত রশ্মিটি নিয়ে কবি তার দ্বিতীয় জগতে পালাতে চায়। রিয়া এই
বিস্ফোরণটা আটকায়। কারণ রিয়া ওমনিপ্রেজেন্ট।
‘কবিতালিপিক’ অধ্যায়ে বাংলা কবিতার ‘স্বঘোষিত ভিলেন’কে নিয়ে ‘কবিতার ট্রেকিং’। বাক্যটিতে দুটো
শব্দবন্ধকে একটু আলাদা করতে চেয়েছি। তবে কি ‘স্বঘোষিত ভিলেন’কে চেনাতে বসলাম? না। বাংলা নতুন কবিতার এই স্বর্ণযুগে আজ আর নতুন করে তাঁকে
চিনিয়ে দিতে হয় না। জীবনানন্দীয় পরাবাস্তবের কেন্দ্রমুখী চলনকে যিনি একদিন পেরিয়ে
আসতে চেয়ে ছিলেন; জীবনানন্দের
নকলনবিশী নয়, বরং
কেন্দ্রোৎসারিত চেতনার সফর অনুরাগী হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন যে মানুষটি; তাঁকে এড়িয়ে যাবার উপায়
আজ আর নেই। প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্যের তাগিদে কেউ কেউ তাঁকে স্বীকার না করার
ভান করলেও সেটা সত্য নয়,
ভান
মাত্রই। শিব থেকে গাজন বা ভান নিয়ে ভানানো ছেড়ে এবারে আসি কবিতার ট্রেকিং-এ।
বন্ধঘর কবিতা ওয়ার্কশপকে একধরণের পূর্ণতা দিতে চাওয়ার নাম কবিতা ট্রেকিং; অর্থাৎ কবিতাকে নিয়ে
বাইরে বেরোনো; হাঁটাযোগে
বিষাদবিয়োগ।
পাহাড়মিতির অতীন্দ্রিয়
ফার্মেসি থেকে গর্ভিত আকাশ যখন স্বনির্বাচিত দ্বিধা বুনছে; প্রখর মে’র ভাবনাসুতোয় বোনা রাত, চড়াই ভাঙছে সোমবারিয়ার
নৈসর্গিক ন্যুব্জতায়;
তখন
বারীনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়া। গুণেগেঁথে চলা দৈনন্দিন পায়ে কৈশোরিক ট্রেকিং গেঁথে
নেওয়া আর তুলকালাম থেকে একগ্রাম কুহু তুলে তুলে কোয়েল গাইছেন লেখক স্বপন রায়।
কিন্তু বারীনকে নিয়ে বেরোনোর উদ্দেশ্য কী? – আসুন লেখকের ভাষাতেই শুনি,
উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে যে,
কেমন মানুষ তেপান্তরের মাঠে,
পাহাড়চূড়োয়, কুয়াশাথমে বারীন ঘোষাল? কেমন কবি যখন একাকী
সূদূর এসে তাকে দ্বিধাময়াল পুল পেরোতে বলে? বারীনের দেখায় যে ঘাসের ঘাসেরা যে বারীনের
বারীন কীভাবে তাদের বা তার রসায়ন হল? [কবিতালিপিক]
এই অধ্যায়ে স্বপন রায়
কবি বারীন ঘোষালের কবিতা এবং কবিতাভাবনাগুলো নিজের সহজাত অনুপম গদ্যে আলোচনা
করেছেন। বারীনের কবিতাকে আবার একবার নতুন করে অনূদিত হতে দেখি স্বপনের চোখের আলোয়, অনুভবের বহুমাত্রিকতায়।
দ্রামদিরিনের সবুজাজিমে,
সোমবারিয়ার
হাঁটাপথে, ভার্সের
পাকদণ্ডী বেয়ে বারীন নামের মৌলকণাটিকে আবিষ্কারের আনন্দে মেতে উঠতে দেখি লেখককে।
সঙ্গে কবিদের তুমুল আড্ডা। আর ছোট ছোট আঁচড়ে কবিতমগ্ন মানুষটিকে চিনিয়ে দেওয়া।
আজকের বিখ্যাত কবি স্বপন রায়ের সেই শুরুরদিনগুলো, যখন তিনি ধূপশহর লিখেছেন আর তারই
প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন বারীন ঘোষাল। সেদিন বিস্মিত হয়েছিলেন স্বপন
রায়। কিন্তু আজ আর এটা কোনো বিস্ময় নয়। কারণ সেই তরুণটি যেই হোক, যত অচেনা অখ্যাতই হোক, তার লিপিত কবিতায় নতুনের
স্পর্শ পেলে বারীনের হাত পৌঁছে যাবেই তরুণটির কাঁধে। হয়তো বা তার দরজায় নক করে
বলবেন, “তোকে দেখতে
এলাম... কীভাবে থাকিস তুই... তোর বন্ধুরা কেমন... তোর লেখার টেবিলে রোদ্দুর পড়ে তো?” - এমনই ছোট ছোট টানে
এই সংবেদিত মানুষটির অনবদ্য ছবি এঁকেছেন স্বপন রায়।
“হাঁটতে হাঁটতে কবিতা”– কেন? কবিতার জন্য
হাঁটা কেন? নিরিবিলি এই
পরিশ্রম মনকে তুরামতারা করে;
নির্জন
এই চলার প্রতিভাকে কবি বললেন চল্মি। চলতে চলতে যে দূরত্বটুকু পার হওয়া যায়, তাকে কোনো এককের
বেড়াজালে বাঁধা যায় না। প্রতিদিনের প্রাত্যহিকতা থেকে সে কবিকে ধারামুক্তির স্বাদ
এনে দেয়। চেনা রাস্তার দৈনন্দিন বাঁকগুলো যেখানে শব্দের মানেকে মানিয়ে নিতে চায়; মনোহারী কবিতা যেখানে ধারাবিচ্ছিন্নতার
রিস্ক নিতে পারে না; সেখান থেকে
কবিকে উৎক্ষিপ্ত করে;
অনুভাবিত
উচ্চারণকে প্রতিষ্ঠিত করার শক্তি যোগায়। শশী শৌভিক আর অনুপস্থিত রাজশ্রীকে নিয়ে ত্রিকোণমিতির
গল্পের মোড়কে লেখক দেখিয়েছেন কবিতা ট্রেকিং কীভাবে নতুন কবিতা নিয়ে অবিশ্বাস
সন্দেহগুলো মুছে দেয়;
ধারামুক্তির
নব আনন্দে উজ্জীবিত করে।
তবু লিখে ফেলা যাক আমার
অবঙ্গজ বাল্যকাল এবং কৈশোরের আদিগন্তকে। দেখা যাক কতটা রোমহর্ষক ছিল অরম্য হর্ষের
স্থিতিস্থাপকতায় নামানো আমার লকগেট, কতটা জলোচ্ছাস ছিল বাঁধ ভাঙার অসংযমে, রোমে না গিয়ে রোমান
হওয়ার তুমুলে
[অবঙ্গজের গান]
তো এই ‘অবঙ্গজের গান’ স্বপন নামক খেরোখাতাটির
প্রথম অধ্যায়। নামি ও দামি ছেলেবেলা ডানা মেলল শিল্পশহরের ভাবদৃশ্যে। কবি ফিরে
তাকালেন ইতিহাসে, যখন হাফপ্যান্ট
খচিত হাঁটুতে ডম ডম ডিগা ডিগা/ মৌসম ভিগা ভিগা গড়িয়ে গড়িয়ে নক্ষত্রলোকের ওইপারে, যুগলবন্দী ধরেছে
রোদ্দুরমাখা স্কার্টের সঙ্গে। বিষ্ণু দের এথেনা আর আফ্রোদিতের ছায়ায় হাফ প্যান্ট
হাঁটতে হাঁটতে দাস ক্যাপিটাল...বিপ্লব...রিয়া... বয়ঃসন্ধির সাতটা পালক কখন যেন
রামধনু হয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে। তবু বয়ঃসন্ধির প্রকরণ, নিটোল ছন্দের কারসাজি ভেঙে কবি পাড়ি দিয়েছেন
নতুনের পথে; সম্ভাবনার
দিগন্তে।
গ্যাংটক থেকে পেলিং
যাওয়ার পথে “স্বর্গের ফোকাস” – “আরোহণের রাস্তা জুড়ে
মাঝেমাঝেই মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল রোদসারিতে হারিয়ে যাওয়া ঠান্ডা ফোকাস”। অলোক, রঞ্জন আর স্বপনের জলকে
চলার অনুষঙ্গগুলো ঝরাতে ঝরাতে সাঙ্কোচোলিং, রাবডানৎসের কুয়াশামুখর ট্রেকিং। অভ্যস্ত
জীবনের নিয়মাবলীর ছায়ায় বসে থাকতে থাকতে যখন মগজের ছায়ার বদলে আমরা পেতে থাকি
ছায়ার মগজ তখনই এই বেরিয়ে পড়া। কবিতার শব্দ, দৃশ্য, ধ্বনি, চেতনা আর রিয়ার বেণীতে জড়ানো বিভ্রমগুলো
নাড়াচাড়া করতে করতে পথ চলা। তো এই যাত্রাপথের হেডিংগুলো প্রথমে লিখে ফেলা যাক-
১ জলের ফিজিক্স হল গাছ
২
ঈশারা নামল নিসামাপায়
৩
রাস্তার রঙ পায়ের পেশীপর্যন্ত
৪
আস্তে চলি, সাঙ্কোচোলিং
৫
শব্দ শেষ, কথা থেকে গেল
তবু
৬
ধরো শিন্বোনে রোদ, শিউরে ওঠাকে ধরো
তো প্রথমেই গাছকে ছ-রহিত
করে দিই। কুয়াশার গা;
বেয়ে
তিস্তা; গা গড়ানো গর্জে মহাকালীয়
কবিতার মিথ্যে জল যখন ছলাৎ করে উঠল, ঝিমরঙ ভাবনার বাঁকানো গ্রীবায় ফিজিক্স খুঁজি। কালের পাটে
পাটে যেসব অকাল পরিক্রমারা পথ চলে, তার মায়ামার্জিনে কখন যে কুয়াশার আলতো ছোঁয়া। নিসামাপায়
নামা ঈশারা, চিন্তা আর
ভাবনার গুটিপোকা ভেঙে দিয়ে বের করে আনলো রঙিন প্রজাপতিমুখ চেতনা। আমি তফাৎ খুঁজি।
লেখক বললেন, র-মেটিরিয়াল এবং
ফিনিশড প্রোডাক্টের যতখানি পার্থক্য। কবিতাতত্ত্ব যখন পাখিরায় নামছে, আমি ডানা ছেড়ে রঙে। চেনা
রঙে মন ভরে না। হয়তো প্রণব পালের “ম্যাজিকান্ত নীল”; যা “বয়ে যাছে সাদা পাতা্র
ঢালাও জ্যোৎস্নায়। ...ধুধুস্নায় এক পলক উল্লাসে গ্লোবেন্টাম” লাগা পায়ের চলনে; কিংবা আলপনার ব্লো-আপে
বারীনজ তিনসারেগা বোটানিকা। রং রং খেলা কখন যেন ঝমঝম হয়ে এল। ভেজা নামাবলীর পায়ে
পায়ে রাস্তার রং; রাত নামাচ্ছে
গ্যাংটক। আর আঙুলের ফাঁকে জড়িয়ে যাচ্ছে কবি-আড্ডার সাতলহরী ঘ্রাণ।
তো বৃষ্টির চ্ছলচ্ছল
ঢাকনা খুলে লেখক একটা ভাবনা সূত্র দিলেন – কুয়াশা। রঞ্জন অলোক স্বপন সকলেই কুয়াশা নিয়ে; আমি ভাবতে থাকি। অন্য এক
পৃথিবীর খোঁজে আমার এই গোপন মানচিত্র। নিতান্ত শাহরিক ঢালে আমার পাহাড়িয়া ট্রেক।
বাঁকনির্জন রাস্তার পরতে পরতে দেখি বিম্বিত ভোর; বিভ্রমে কুয়াশা। ভালোবাসার কোলডাঙায় সেই ভোর
গড়িয়ে পাখি। দলছুট পাখিটার শিষচুপ ঠোঁটে ঘুমন্ত কুয়াশারা। আমি কুয়াশামুখর হতে
থাকি। আস্তে আস্তে মাত্রাহারা। আসলে কোনো মাত্রারই আমি হরিণ দেখিনি কোনোদিন। হ
থেকে রিণ হতে দেখেছিলাম। সমস্ত মাপক যন্ত্রগুলো কখন যেন একে একে বিদায় সম্ভাষণে।
ঠোঁট ভেঙে পেয়ালা ভেঙে ভেঙে দিওয়ানার অঙ্কগুলো থই পায় না যখন, হাত রাখি স্বপনসমীকরণে ->শিন্বোনে রোদ = শিহরণ
আমি শব্দাতীত হতে থাকি।
অতি ব্যবহৃত একটা ফিনিক্স কখন যে গা থেকে ঝরিয়ে ফ্যালে পরিচিত ডানাগুলো। গর্ভিত
আলোরা দিগন্ত বেয়ে নেমে এলে কোল পেতে রাখি। শব্দের জনারণ্য স্মৃতি আরণ্যক হতে
থাকে। নিদাঘী আকাশ ভেঙে আঙুলে জড়িয়ে নিই দু এক পশলা। মুখর স্তব্ধতাও মূক হয়ে আসে। ভুবনগ্রামের
ওস্তাদ তখন পাড়া মাতায় আমাদেরই গহীনে নাকি মহাবিশ্বের গুহান্তরালে, কে জানে! অনির্দিষ্ট
কম্পাঙ্ক রহস্যের বেভুল ডাক তোলে। সিঁড়িভাঙা অঙ্কগুলো ওঠে আর নামে; উল্টেপাল্টে। কুয়াশা তখন
ভোর বেয়ে ক্রমশ ভোরাই।
যে কবির একশো সূর্যে–এর শিন্বোনে ওঠা রোদে আমার এই রোদ্দুরভ্রমণ তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
স্বপন রায়:
জন্ম: জামশেদপুর, ১৯৫৬। স্কুলজীবন: ইস্পাতনগরী রাউরকেলা। কলেজজীবন: খড়গ্পুর, বি.কম। ১৯৯৭ পর্যন্ত বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারপর রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হলেও জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রের স্বপ্ন কবি এখনও দেখেন। লেখার শুরু প্রাইমারি স্কুল থেকেই। কবিতার কাছে আসা হাইস্কুলে। নাটক, পথ-নাটক লেখা আর অভিনয়ে সক্রিয় বহুদিন। কবিতা লিখতে লিখতে নিজের ৩০/৩২ বছর বয়সে কবির মনে হয় “কবিতা লিখছি, কিন্তু এর ভাষা তো ধার করা। আমি কোথায়?” খড়গ্পুরে একা থাকার সময়ে আবার গীতাঞ্জলি পড়তে আরম্ভ করেন। দিনরাত্রি এক করে কবিতার স্রোত। একেকটি গানের শিরোনামে একেকটি কবিতা, যা ‘ধূপ-শহর’ নামে ‘কবিতা ক্যাম্পাসের’ দীর্ঘ কবিতার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। অতিচেতনার পুরোধা কবি বারীন ঘোষাল জানান এই কবিতাই অতিচেতনার কবিতা। কবির খড়গ্পুরের বাড়ি আর জামশেদপুরে বারীনদার ফ্ল্যাটে নিয়মিত কবিতার ওয়ার্কশপ, যা পরে কবিতার ট্রেকিং-এ রূপ নেয়। পত্রিকা সংপৃক্তি: দ্রিদিম, কবিতা ক্যাম্পাস, নতুন কবিতা। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: আমি আসছি (সংস্কৃতি খবর, ১৯৮৪), চে (সংস্কৃতি খবর, ১৯৯০), লেনিন নগরী (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯২), কুয়াশা কেবিন (নতুন কবিতা, ১৯৯৫), ডুরে কমনরুম (কবিতা ক্যাম্পাস, ১৯৯৭), মেঘান্তারা (নতুন কবিতা, ২০০৩), হ থেকে রিণ (নতুন কবিতা, ২০০৯), স্বপনে বানানো একা (সঙ্কলন, কৌরব, ২০১০), দেশরাগ (নতুন কবিতা, ২০১১), সিনেমা সিনেমা (নতুন কবিতা, ২০১৫)। প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ: স্বর্গের ফোকাস (কবিতা ক্যাম্পাস), রুয়ামের সঙ্গে (কবিতা ক্যাম্পাস), একশো সূর্যে (নতুন কবিতা, ২০০৯), কুঁচবাহার (ঐহিক, ২০১৭), মাধবী সিরাপ (নতুন কবিতা, ২০২০)।
একটি অনবদ্য গদ্য!
উত্তরমুছুনস্বপন, বারীনদা-এদের যেমন রুণা মেলে ধরেন নতুনতর আঙ্গিক, রুণা নিজেকেও,নিজের কলমকেও চেনাতে চেনাতে চলতে থাকে। আর আমরা ঋদ্ধ হই।