কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

চন্দন ঘোষ

 

সমকালীন ছোটগল্প


বেশ্যানাথ

 

(১)

 

সন্ধে হয়ে আসছে। জায়গাটাও তেমন চেনা নয় বিশ্বনাথের। বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বনাথের মনে হল  জ্যাকিদার কাছে কাল হেবি ঝাড় খেতে হবে তাকে। চেকটা উদ্ধার করতে না পারার জন্য। অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি না হলে আর জায়গাটা একটু চেনা হলে ঠিক সময়েই পৌঁছতে পারত সে।

কোনো কাজই যে সে কেন ঠিকঠাক করতে পারে না কোনোদিনই তা বুঝে উঠতে পারল না বিশ্বনাথ। তার না আছে কোনো ক্যারিশমা, না আছে মেয়ে পটানোর ক্যালি, না আছে ঝাড়পিটের ধক। সেই ছোটোবেলা থেকেই। এমনকি পাড়ার কাল্টু বিশুরা যখন হ্যাটা করার জন্য তাকে 'বেশ্যানাথ', 'বেশ্যানাথ' বলে টিটকারি দিত তখনও সে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত না। লোকজনের সামনে বাঁচাতে পারত না তার পাংচার হয়ে যাওয়া প্রেস্টিজ। এই ভাবে কেঁচো কেন্নোর মত বাঁচতে বাঁচতে নিজের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে তার। আর এই প্রাইভেট কোম্পানির ঝি-গিরি। গ্র্যাজুয়েট অব্দি ঘষে ঘষে ওঠা বিশ্বনাথ অবশ্য  এর চেয়ে বেশি কী বা আশা  করতে পারত! সিনেমা দেখতে ভালোবাসে ও।  অবশ্য আজকাল মালটিপ্লেক্সগুলোয় টিকিটের যা দাম! তবু মা-কে ভুজুং ভাজুং দিয়ে কিছু টাকা প্রতি মাসে সরিয়ে রাখে সে। আসলে বিশ্বনাথের ভেতরে বেশ কয়েকজন সালমান, অক্ষয় আর নানা পাটেকর বাস করেওই সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরে অব্দিও ওরা বিশ্বনাথে পাশে পাশে হাঁটতে  থাকে। বেশ আরাম হয় ওর। বাইসেপস, বুকের ছাতি সব ফোলা ফোলা লাগে। রগের মধ্যে গরম রক্ত ছুটতে থাকে। নায়িকাকে আড়াল করে সে তখন ঢিসুম ঢিসুম ঝাড়তে থাকে ভিলেনদের দিকে। এসব অবশ্য ওইটুকু সময়ের জন্যই। তারপরে আবার কে যেন ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দেয় ওর শরীরে। আবার স্যাঁতসেতে, নেতিয়ে পড়া একটা ভাব।

রিয়েল লাইফে অবশ্য নায়িকা পাওয়া আর হয়ে উঠল না বিশ্বনাথের। পাবে কী করে? না পারে যোগমায়া গার্লস স্কুলের সামনে লাইন মারতে, না পারে ভালো করে চোখ তুলে ঝাড়ি দিতে, না পারে শাহরুখ খানের মতো পা ফাঁক করে  দাঁড়াতে। মেয়ে তোলা আর হল না তার। এ রকম আতা-ক্যালানের সঙ্গে ফাঁসবে কোন মেয়ে? মেয়ে বলতে সে জানে দুজনকে। মা আর বোন বুলিকে। ওই বাবাটার জন্যেই তো তাদের যত  কেলো। এমন অসময়ে ফুটে যাবার কী দরকার ছিল ভাই! বানের জলের মধ্যে একেবারে বাঁই বাঁই করে ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের  সংসারের ফুটো নৌকোটা!


(২)

হাঁটতে হাঁটতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিশ্বনাথ। এ কোন রাস্তায় ঢুকে পড়েছে সে! এ তো মেন রোডে ফেরার রাস্তা মনে হচ্ছে না! দুপাশে তৈরি-হতে  -থাকা বাড়ির খাঁচাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আর রাস্তার পাশে ডাঁই-করে-রাখা বিল্ডিং মেটিরিয়ালস, কাঠ, বাঁশ, রডের টুকরোয় ভর্তি। অন্ধকার হয়ে গেছে। হাফ জ্যাকেট পরেও শীত শীত করছে তার। স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠেছে।  বড় রাস্তা সামনে না পিছনে? ঠিক বুঝতে পারে না বিশ্বনাথ। সামনের দিকটায় আলো কম। তবে কি সে পিছনদিকেই ফিরবে? এই রকম একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব নিয়ে সবে সে ফিরতে যাবে, হঠাৎ সামনের অন্ধকারের দলাটা থেকে একটা তীব্র চিৎকার  ছিটকে এল। 'বাঁচাও, বাঁচাও'মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকার। কেউ একটা ছুটে আসছে এ দিকেই। হালকা আলো পড়তেই চমকে ওঠে বিশ্বনাথ। একটা কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে। সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত চেহারা। গায়ের ম্যাক্সিটা ছিঁড়ে আছে জায়গায় জায়গায়। ফর্সা চামড়া দেখা যাচ্ছে। একটু কাছে আসতেই দেখা গেল মুখে আর নাকে রক্তের ছোপ আর কালশিটে দাগ। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেছে বিশ্বনাথ। মেয়েটা তার প্রায় পায়ের কাছেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর আর্তনাদ করে উঠল, বাঁচান, বাঁচান আমাকে! ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। জানে মেরে  দেবে আমাকে...! প্রথম ঝটকাটা কাটিয়ে উঠেই বিশ্বনাথ লক্ষ করল দুটো লোক অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। তারা চেঁচিয়ে উঠল, খানকি মাগী, ছেনালি হচ্ছে!  শেরের ডেরা থেকে ভেগে আসা! গলা নামিয়ে দেব, শালী! চল, ওয়াপস চল!  বিশ্বনাথ মাথার দুপাশের রগের মধ্যে রক্তের বাজনা শুনতে পাচ্ছেচেঁচিয়ে ঊঠল, আ বে, কেসটা কী? একটা লোক মুখ বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠল, হঠ বাঁড়া, এ মাল আমাদেরচল, শালা, ফোট। মেরে কিডনী ফাটিয়ে দেব বাঁড়া! বিশ্বনাথের  চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রক্তের মধ্যে নানা পাটেকরের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। খপ করে ফুটপাথে পড়ে থাকা একটা লোহার রড তুলে নেয় সে। দুপা ফাঁক করে সিধে হয়ে দাঁড়ায়। গলা থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র এক হুংকার, কামিনে-এ-এ, খুন পি জাউঙ্গা তেরা...! নিজেই অবাক হয়ে যায় বিশ্বনাথ। এ আওয়াজ তার গলা দিয়ে কখনো শোনেনি সে। লোকদুটো এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না বোধহয়। কেমন একটু ব্যোমকে যায় তারা। কিন্তু হাল ছাড়ে না। হিংস্রের মত এগিয়ে আসে তারা। বিশ্বনাথও থামে না রড ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যায়  ওদের দিকে। আর খুব আশ্চর্য হতে থাকে, এত জোর ওর গায়ে ছিল? ওর গলা  কি অমিতাভের মতো শোনাচ্ছে? কী করে জানি ব্যাপারটা ঘটে যায়। প্রথম লোকটা বাপ রে বলে রাস্তায় কেলিয়ে পড়ে। ওর মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত  বেরোচ্ছে। এত নিখুঁত ভাবে কে রডটা চালালো? সালমান? বুঝতে পারে না  বিশ্বনাথ। দ্বিতীয় লোকটা আর দাঁড়ায় না। মর গিয়া শালা বলে চোঁ চাঁ অন্ধকারের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়।

বিশ্বনাথের রগের দুপাশে এখনও দামামা বাজছে। ওই তো একটু দূরে ওরা তিনজন। নানা, সালমান আর অমিতাভ। থামস আপ দেখাচ্ছে ওকে। সামনে লোকটা কেতরে পড়ে আছে। সালমান ওর বুকের ওপর একটা পা তুলে দিয়েছে। রক্তের ভেতরে দুপদাপ শব্দটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিশ্বনাথ দেখল, সামনের মেয়েটা অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে প্রশংসা ঝরে পড়ছে। আচ্ছা, ওকে কি একটু বুলির মতই দেখতে লাগছে? বিশ্বনাথ বলে, ব্যাপারখানা কী? মেয়েটা বলে, বাবা বেচে দিল আমাকে। মদ খাওয়ার টাকা চাই। ওরা আমাকে খারাপ কাজ করাতে চায়। আপনি আমাকে বাঁচান। ওরা ছাড়বে নাআবার আসবে। শিগগির পালান।

গায়ের জ্যাকেটটা খুলে মেয়েটাকে পরিয়ে দেয় সে। নানা পাটেকর হলেও তো তাই করত, না?

 

(৩)

গলা শুকিয়ে আসছে। বড়ো রাস্তা আর কত দূরে? আলো কী কমে আসছে? বিশ্বনাথ টলতে টলতে এগিয়ে যায়। গলির অন্ধকার কি কমবে না? বিশ্বনাথের  সামনে কাল্টু বিশুরা এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা আবার ওকে খেপায়, বেশ্যানাথ, বেশ্যানাথ! বিশ্বনাথ আর রাগে না। আসলে ভেতর থেকে ওর খুব একটা আনন্দ  হচ্ছে এখন। গলির অন্ধকার ক্রমশ কমে আসছে। ওই তো বড়ো রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে!

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন