কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


লাঠিয়াল

 

--আরে দাদা, মারছেন কেন? 

--আপনাকে মারলাম কই? আজব লোক তো মশাই! 

হাওড়া স্টেশন চত্ত্বরে বাসডিপোতে ট্রাফিক পুলিশের বাস পেটানোর দৃশ্য অতি পরিচিত। সেই পরিচিত তথা নিয়মিত দৃশ্যের চিত্রাঙ্কনের সময়েই ঘটে গেল বাসযাত্রী এবং পুলিশের মধ্যেকার এই সংলাপ। নিশিকান্ত বসেছিল জানলার ধারে। পুলিশের ডান্ডাটা তার ঠিক বাইরের দিক বরাবরই পড়েছিল সজোরে। পিলে চমকে গেছিল সরকারী কর্মচারী নিশিকান্ত হালদারের। তখনই এই প্রহারের অভিযোগ। আহা বাস বলে কি মানুষ নয়? বাসের ভেতর কি মানুষ নেই নাকি? যত্তসব সাউন্ড পলিউশন! 

--আমার কানে যে তালা লেগে গেলো, তার বেলায়? 

-- যাহ বাবা! 

-- বাবা মানে কী? এই শব্দে আমার হার্ট অ্যাটাক হলে আপনি দেখতেন? 

-- দাদা, আজ দশ বছর হল বাস পিটছি। এই শব্দে কারুর কিছু হয় না। হলে  আপনি মহান অথবা শয়তান। 

নিশিকান্ত আর কথা বাড়ালো না। দিনের শুরুতে বচসা করে কী লাভ! অফিসে গিয়ে মেলা কাজ। তার মধ্যে শালা হাজারটা বিলো দ্য টেবল কেস। সামান্য সৎ থাকাটাই একটা পলিটিকাল স্টেটমেন্ট হয়ে উঠেছে এই বাজারে। যে দলই আসুক না কেন, যুগ যুগান্তর ধরে একই গল্প। ঘুষের টাকা সে নেয় না। সবাই জানে। তাও সবাই দিয়ে যায়। সে না নিলে কী হবে? জুনিয়ার, সিনিয়ারদের মধ্যে টাকা ভাগ হয়ে যায়   রীতিমত। টাকা নেবে না বললে কেউ কেউ আবার আইফোন দিয়ে যায়। কী জ্বালা! নিশিকান্তকে তখন সেসব জিনিস অন্য কাউকে চালান করে দিতে হয়। হাসিমুখে সেসব নিতে নিতে জুনিয়ার ছোঁড়ারা বলে, "নিশিদা, আপনি বড় ভালোমানুষ। আপনার কিছু হবে না মাইরি!" 

এহেন নিশিকান্ত পুলিশটাকে বলতে গিয়েও থেমে যায়: "হ্যাঁ, হবেই তো। দশ বছর ধরে বাস পেটাচ্ছেন আর পাঁচ বছর ধরে বউ।" না বলে নিশিকান্ত ভাবে, ভালোই করেছে বলেনি। এটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যেত। ইংরেজিতে যাকে বলে, বিলো দ্য বেল্ট। হয়তো পুলিশটা চড়াও হত। হয়তো ক্যালাতো। হয়তো ধরেই নিয়ে যেত। না না, অফিসে মেলা কাজ। সকাল সকাল ক্যাঁচাল করে কাজ নেই। এইসব  ভাবতে ভাবতে নিশিকান্ত নিজের উপস্থিত বুদ্ধিকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারে না। 

সংলাপের অপরপ্রান্তে ধবধবে সাদা জামা পরা মুচমুচে কালো ট্রাফিক পুলিশটির নাম রমাপদ। সকাল সকাল সবে ডিউটিতে এসেছে। এখন তো সারাদিনের পেটাপিটি বাকি। এর মধ্যেই প্রতিবাদ! দশ বছরের কেরিয়ারে এই প্রথম এই কেস, বাস পিটলে যাত্রী চেঁচাচ্ছে। কী সব দিনকাল এলো! যত দোষে পুলিশই শালা নন্দ ঘোষ!  দল আসে দল যায়, পুলিশ শালা রয়ে যায় পাবলিকের খিস্তি খেতে। নেতানেত্রীদের খিস্তিগুলোও গুনে গুনে খায় কারণ পাবলিক তো আর যখন তখন তাদের পায় না, পায় পুলিশদের। আর পুলিশও শালা দলদাস। দল, সরকার, রাষ্ট্র -- সব একাকার ওদের কাছে। যা বলে তাই করে, করতে হয়। চাক আর নাই চাক। রমাপদ নিজে অবশ্য টুকরিতে ফুলের নিচে টাকা নেওয়া পার্টি নয়। অবশ্য ওকে দেয় কে?  ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে কেই বা পোঁছে? না তার ক্ষমতা আছে, না ঘুষের বাজারে বিশেষ দাম। যখন তখন গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাওয়াল দেওয়ার স্বভাব, যা তার বন্ধু কলিগরা মাস্টার করে এনেছে, তাও তার নেই। অথচ সে রাষ্ট্রের হয়ে গরীব ক্যালায়নি, মায় দুএকটা ছাত্রও নয়। সুযোগও যে পেয়েছে এমন নয়। তাও শালা পুলিশ বলে খিস্তি  খেতে হয়। 

মাঝে মাঝে রমার মনে হয়, দে শালা রামক্যালানি কেলিয়ে, যদিও রামএর নামে ক্যালানোর আলাদা একটা বাহিনী আজকাল তৈরি হয়ে গেছে দেশে। রমা মাঝে মধ্যেই ভাবে, খিস্তি যখন খেতেই হচ্ছে, কেলিয়েই খাক। রমাপদর শর্ট ফর্ম রমা হলেও রমা রলা তো আর নয়! ছোটবেলা থেকে ঐ রমা নামের জন্য প্রভূত খিস্তি  পেটে পড়েছে, মেয়ে-মেয়ে বলে। তারপর মহিলা নাম্নী পুরুষ রমা, ট্রাফিক পুলিশ হয়ে অবিশ্যি নিজের হৃত পুং গৌরব ফিরে পেয়েছে। তাও ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে লোকজন যখন হ্যাটা মারে, তার হাত পা নাড়ার শ্যাডো অ্যাকটিং করে, কিম্বা চলতি বাস থেকে জ্যামের জন্য গাল পেড়ে যায়, সেইসব রাতগুলোয় মাল গিলে বাড়িতে হাল্কা হুজ্জুত করে রমা। বৌ মালা তখন খচে ফায়ার। ফলে গালমন্দ আরো বাড়ে। মাঝরাতে রমাও খিস্তিতে ভরিয়ে দেয় বৌকে। তবে না, গায়ে হাত তোলেনি কোনোদিন। কেন জানে না, ওর মনে হয়, মনের সব রাগ ও এই বাস  পিটিয়েই মিটমাট করে নিতে পারে। সে বৌয়ের খোঁটা আর পাবলিকের হ্যাটা -- যাইহোক না কেন!  

এই শালা পাগল মালটা, যে আজ চেঁচিয়ে উঠলো বাস পেটাতেই, সে কি চোখে  চোখে রমাকে বৌ পেটানো পুলিশ বলে গেল না? শেষে লোকটা কী একটা বলতে গিয়েও বললো না। গিলে ফেললো গলার কাছে শব্দ। তবু রমা যেন হালকা রেশ পেল সেই শব্দের। সেই বাক্যের। যেন লোকটা বলতে চাইছে, "দশ বছর ধরে বাস  পেটাচ্ছেন আর পাঁচ বছর ধরে বউ।" কিন্তু যে খুন হয়নি তার জন্য যেমন সাজা হয় না, তেমনি যে কথা মুখ দিয়ে বেরোয়নি তার জন্য ঝগড়া করাও বৃথা। তাও আবার সকাল সকাল। দিনভর মুড খিঁচড়ে থাকবে। হয়তো মেরে ভেঙেই দেবে একটা বাসের হেডলাইট, সাইডবডি। কাটাও বস, কাটাও। 

সেদিন রাতে খাটে শুয়ে শুয়ে নিশিকান্তর কানে তখনো বাজছিলো সকালের ঐ বাস পেটানোর আওয়াজটা। মালার ততক্ষণে একঘুম হয়ে গেছে। পাশে মেয়ে মণিও ঘুমিয়ে কাদা। শব্দটা শুনে যে ওর পিলে চমকে গেছিল তার কি আর কোনো কারণ নেই নাকি? বিয়ের পর তখন বছর তিনেক হয়েছে। একদিন সন্ধ্যেরাতের ঝগড়ার পর... বাকিটা জানে মালার শরীর। সারা শরীর জুড়ে ভয়। আর তারই মধ্যে রাতের নীরবতা ভেঙে লাঠির শব্দ। তখনো মণি হয়নি। 

ভোররাতে একটা বীভৎস স্বপ্ন দেখে কুলকুল করে ঘাম দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো  নিশিকান্ত। দুদিকে দুবার মালা আর মণির দিকে তাকালো। তারপর লজ্জ্বায় মাথা নিচু করলো। নিশিকান্ত স্বপ্নে দেখেছিল, সকালের ঐ ট্রাফিক পুলিশটা, যাকে আমাদের পাঠক মাইবাপ, রমাপদ বলে চেনে, সে একটা মোটাসোটা ডান্ডা নিয়ে ফাঁকা একটা বাসে উঠছে। কেউ নেই, শুধু পেছনের দিকে সিটে লুকিয়ে বসে আছে কে ওটা... মণি! হ্যাঁ, নিশিকান্তর একমাত্র মেয়ে মণি! যে কিনা আগামী মার্চে পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পড়বে। মণির সারা শরীরে ভয় খেলা করছে। রমাপদর লাঠিটা শূন্যে দুলে উঠলো। রাতের নীরবতা ভেঙে পিলে চমকানো লাঠির শব্দ...                

 

 


1 কমেন্টস্: