কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

রঞ্জনা ব্যানার্জী

অমেয়


মাথাটা একদম থেঁৎলে দিয়ে গেছে। ভারী কোন বাহনই হবে। কেউ দেখেনি। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল তুমুল। তখনও গুটিসুটি বসেছিল গেটের পাশে। সিকিউরিটির ছেলেটা দেখেছিলআঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি এসেছে নিতে। ভিড় ঠেলে একনজর দেখেছে রফিক। জগিংএ যায়নি আর, সোজা ওপরে। রীতিমত ঘামছিল,  ‘আচ্ছা সিকিউরিটির ছোঁড়াটা যদি পরে ফ্যাসাদ বাধায়?’

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না রীনু। গতকাল কত শতবার ভেবেছে- অলৌকিক কিছু ঘটুক! সব চিহ্ন মুছে যাক্‌ চিরতরে! অজানা আশঙ্কায় দু’চোখের পাতা এক হয়নি সারারাত।

জানালার কাচ চুয়ে ভোরের আলো তেরছা তাকাচ্ছেএই মৃত্যু ওকে মোটেও দুঃখিত করছে না। রফিকের ঠোঁট নড়ছে অথচ ওর কানে কিছুই যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেও যে ভোরের প্রতীক্ষায় আকুল ছিল এখন তার নরম আলো মগজে ঘাই  মারছে অবিরামচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে রীনুর, একটা ঘোরের চোরাবালিতে ডুবছে ও
সেদিনও ঠিক এমন মিঠে রোদ্দুর ছিল। তবে শেষ বিকেলের মায়াবী কমলা রোদ্দুর। বারান্দার ঝড়কা কেটে আলো-ছায়ার কোলাজ বুনছিল মেঝেতে। রফিক আর রীনু এসেছিল দিন কতক মায়ের কাছে বেড়াতে। ও এসেছিল বাচ্চা দুজনকে নিয়ে; হঠাৎ। সবিতাসবিতা বেগম। রহিমা বুয়ার মেয়ে। সেই কবে দেখেছে ওকে! খড়ি ওঠা সরুসরু হাতপা। সারা মুখ জুড়ে এক জোড়া গরুমার্কা চোখ। কোন চিহ্নই নেই সেসবের; লাবণ্যে ঢলঢল অন্য কেউ যেন! চোখজোড়া সপ্রতিভ। দৈন্য কেবল শাড়ির ধূসরতায় আর সামনে বসা পিঠোপিঠি বাচ্চা দু’জনের হাড় জিরজির শরীরে। ‘বছর বছর বউয়ের পেট বাজান ছাড়া আর কোন কাম করে না’ মা বিরক্ত হয়েছিলও বিকারহীন বলে যাচ্ছিল, ‘নেশা কইরা ঝিম মাইরা বইয়া থাকে। কিছু কইলেই মাইর’! বাচ্চা দু’জনকে মিশনারীদের অনাথ আশ্রমেই দিয়ে দেবে। মা থামিয়েছিল,  ‘মুসলমানের বাচ্চা, এতিমখানায় দে’! ‘না খালাম্মা হেরা কইসে বাচ্চা বিদেশে থাকবোআদরে থাকবো’উঁচু পেটটায় হাত রেখে বলেছিল, ‘খালাস হইলে এইটাও দিয়া দিমু’ বাচ্চা দু’টো মেঝেতে উবু হয়ে একমনে প্লেট থেকে হক-বিস্কুটের ক্রিম চেটে খাচ্ছিল যেন ওদের ভবিষ্যতে ওরা নেই! দুজনেরই সারা মুখ জুড়ে ওদের মায়ের  শৈশবের অভিব্যক্তিহীন সেই চোখ জোড়া খোদাই করা  
      
না চাইলেও সবিতার পেটের দিকেই চোখ যাচ্ছিলো রীনুর। উপরওয়ালার কী লীলা! যে চাইছে না তারই কোল ভরছে। অনেকদিন পর বিষণ্ণতার মেঘ আবার ঘন হয়ে সর জমাচ্ছিল ওর মনেএকফাঁকে উঠে গিয়েছিল নিজের ঘরে। কমলারঙা সেই মিঠে রোদ জানালা গলে ওর চোখের জলে মরে রাত নামিয়েছিল 
অনেক তর্কাতর্কি আর কান্নাকাটির পরেই রফিক হার মেনেছিল  
গণি মিয়াকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছিল শত হলেও স্বামী। নেশা কেটে টনটনে হিসেবী ব্যবসায়ীর মত দরদাম করছিল। অবশেষে পাঁচ লাখে রফা শর্ত একটাই, খোঁজ নেয়া যাবে না
‘সোহম খান আর্য’ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল শরীরে, মেধায়। কেবল চোখ জোড়ায় অতীতের জলছাপ 

গতরাতে সেইসব চুপকথা ফুঁসে উঠেছিল বিকেল থেকেই নাকি গেটের কাছে ঘুরঘুর করছিল সিকিউরিটি ঢুকতে দেয়নি। রীনু ছিল না বাড়িতে। গাড়ি থেকে নামতেই সিকিউরিটির পুঁচকে ছোঁড়াটা ছুটে এসে জানালোপুরনো বুয়াদের কেউ কি? সিকিউরিটির রুমেই ডেকে পাঠিয়েছিল প্রথম ধাক্কায় চিনতে পারেনিকন্ঠার হাড়ের মাঝখানে অতল গহ্বর! হাউমাউ কাঁদছিল, একটাই আকুতি, ‘একটুক দ্যাখবার দ্যান’সেই চোখ জোড়া! রীনু বিস্ময়ে শাদাএক সুরে বলে যাচ্ছিল গণি মিয়া টাকাপয়সা নিয়ে উধাও হয়েছে সেই বছরেই দুই বাচ্চার ঠাঁই শেষমেশ সেই মিশনারী আশ্রমেই হয়তো এখন পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে, অন্য কোন পরিচয়ে রীনু ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে; ‘অসম্ভব’! পা ছাড়ছিল না কিছুতেইসিকিউরিটিই টেনেহিঁচড়ে বার করেছে         
বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই টিউমারটা ধরা পড়েছিলজরায়ু ফেলতেই হলোনিয়তির বিধান মেনে নিয়েছিল ওঅথচ সেই নরম বিকেলে সবিতার শাড়ির আড়ালের আবছা স্ফীতি হঠাৎ করেই ওর বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা ‘নেই নেই’ হুতাশকে আচানক জাগিয়েছিল বাচ্চাটা চাই; যত টাকাই লাগুক। 
  

ধড়মড় করে উঠে বসে রীনু। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে! এতো ঘুমিয়েছে! দশ মিনিটের মধ্যে না বেরুলে এ্যাসেম্বলী ধরতে পারবে না আর্যইস্‌ আজ একাই  ছাড়তে হবে ছেলেটাকে, রীনু  তৈরি হতে গেলেই দেরি! বুয়া উঠেছে, নাকি সেও ঘুমে? ডাইনিঙে তড়িঘড়ি পা দিয়েই থমকায় রীনু। আজ পর্যন্ত না ডাকলে বিছানা ছাড়েনি আর্য, অবাক কান্ড আজ একাই রেডি! মুখের সামনে দিনের কাগজ মেলে  রফিকও তৈরিঘাড় কাত করে রুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে ওর দিকে ফেরে আর্য, ‘গুডমর্নিং মম’! নিমেষে জমে যায় রীনু! আর্যের চোখ নয়, ভ্রূর নিচে টাল  খেয়ে থইথই ভাসছে অতল অন্ধকার!  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন