সক্রেটিসের মৃত্যুর পর
প্লেটো যে সকল সংলাপ প্রতিষ্ঠা করেন তার মধ্যে প্রোতাগোরাস–এর মূল বিষয় হল সদ্গুণ। খ্রি. পূ. ৪৩৩ সাল নাগাদ এটি রচিত হয়। অ্যাথেন্স
নগরীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন প্রোতাগোরাস, যিনি সেই সময়ের এক অনবদ্য সফিস্ট বা বাগ্মী। যাঁর শিক্ষাদানের
প্রতি আকুল সেই সময়ের যুবক। তিনি এসেছেন অ্যাথেন্সের সবচেয়ে অভিজাত কেলিয়াসের
বাসস্থানে। তাঁকে দেখার তীব্র আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে যুবাগোষ্ঠী। এই খবর
চারিদিকে প্রচারিত হওয়া মাত্রই সক্রেটিসের বন্ধু ও শিষ্য হিপোক্রিতিজ সেখানে
উপস্থিত হয়ে সক্রেটিসকে জানান প্রোতাগোরাসের কাছে যাওয়ার প্রতি তাঁর আকুলতার কথা,
তাঁর দীক্ষিত হওয়ার আগ্রহের কথা। কিন্তু
সক্রেটিস এ বিষয়ে বিচলিত হন। তীব্র ভাবে তিনি হিপোক্রিতিজকে বিবেচনায় আসতে বলেন, একজন সফিস্ট
কীভাবে অন্য ব্যক্তিকে সফিস্টে পরিণত করতে পারেন! কারণ বিষয়টি কোনো আমদানিকৃত
জিনিসের মতো নয় যে নিজের আত্মা ও মনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বস্তুকে কারো হাতে তুলে
দেওয়া যায়! যেখানে আমরা আর সকল জিনিস যেমন খাদ্য, বস্ত্র, ডাক্তার সব বিষয়ে এগোনোর আগে বারবার
আলোচনা করি ও ভাবি, সেখানে মননের ক্ষেত্রে তো আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। এই পর্বের পরেই
সক্রেটিস ও হিপোক্রিতিজ প্রোতাগোরাসের মুখোমুখি হন। সেখানে প্রোতাগোরাসকে সদগুণ যে
শিক্ষাদানের বিষয় নয়, সেই তর্কে তিনি অবতীর্ণ করেন। ক্রমাগত বার্তায় প্রমাণিত হয় তাঁরা কিছুতেই একই
দর্শনের ধার ধারছেন না । আসলে প্লেটো বোধহয় প্রোতাগোরাসকে প্রশ্নবাণের মাধ্যমে সক্রেটিসের
মতেরই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। কারণ যখন প্রোতাগোরাসের দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু হয়
তখনই দেখা যায় সক্রেটিস তাঁর পছন্দের পথে
এগোতে সকলকে প্রাণিত করেন। তবে প্লেটোর প্রত্যেকটি সংলাপে যেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
তা হল প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে বিষয়ের গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার প্রবণতা। এ থেকে সত্যের
উৎকৃষ্ট ধারণায় এগিয়ে যাওয়া সত্যি যুক্তিযুক্ত।
এই পদ্ধতির মাধ্যমেই তিনি প্রোতাগোরাসের দর্শনকে আক্রমণ করেন। এবং শেষপর্যন্ত
প্রোতাগোরাসও তাঁর দর্শনের কাছে এসে মত পরিবর্তন করেন। যেহেতু এই সংলাপটি প্রধানত
সদ্গুণ সম্পর্কিত তাই সক্রেটিস জানতে চান সদগুণ একাকী একটি একক, নাকি এটি
মুখমন্ডলের বিভিন্ন অংশ তথা চোখ, কান, নাক-এর মত এক
স্থানের ভিন্ন অংশ, নাকি একতাল স্বর্ণের বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট অংশ?
প্রোতাগোরাস মুখমন্ডলের
অংশটিকে উদাহরণে তুলে নেন। এবার সক্রেটিস তাঁকে ছেয়ে ফেলেন যুক্তির কাঁটায়।
সক্রেটিস বলেন, সব সদ্গুণ কি একই জিনিস, তারা সকলেই কি সদ্গুণ বলে পরিচিত হবে? প্রোতাগোরাস উত্তরে বলেন, “আমার মত হছে এর সবকিছু
সদ্গুণের অংশ, আর এদের মধ্যে চারটি আছে যারা একে অপরের সদৃশ, কিন্তু সাহস বাকি চারটি হতে প্রভূত আলাদা। আমি যা বলছি তা
হল, দেখা যায় অনেক মানুষ আছে যারা অন্যায়কার্যে পটু, পাপী, অসংযত এবং অজ্ঞ; কিন্তু একইসঙ্গে অত্যন্ত
সাহসী”। সক্রেটিস বলেন, যারা অজ্ঞতার সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী, তারা সাহসী নয় বরং উন্মাদ এবং উল্টোপক্ষে যারা জ্ঞানী তারাই
সবচেয়ে আত্মপ্রত্যয়ী; এবং ফলে সবচেয়ে সাহসী, অতএব তাদের জ্ঞানই সাহস। প্রোতাগোরাস পুনরায় উল্টোদিকে চলে যান। তাঁর মতে, ক্ষমতার মতোই আত্মপ্রত্যয় দক্ষতা থেকে জন্ম নিতে পারে, অথবা সমভাবে উন্মাদনা বা আবেগ থেকে; কিন্তু সাহস হচ্ছে প্রকৃতির ব্যাপার এবং আত্মার প্রকৃতির ব্যাপার। এভাবেই
ক্রমান্বয়ে সদ্গুণ যা কিনা প্রোতাগোরাসের
মতো সফিস্টের কাছে আবশ্যিক ও শিক্ষাদানযোগ্য বিষয়, অপরদিকে দার্শনিকশ্রেষ্ঠ
সক্রেটিস কখনোই মানেন নি এটি
শিক্ষাদানযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের বিপরীত অংশেও অবস্থানের প্রভাব দেখা যায়। কারণ ন্যায়নীতি, সংযম, সাহস সবকিছু যদি জ্ঞান হয়
তবে সদ্গুণ অবশ্যই শিক্ষাদানযোগ্য। আর এটি যদি প্রোতাগোরাসের
আংশিক যুক্তি মেনে এটাকে জ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু বলা হয়, তবে তা শিক্ষাদানযোগ্য নয়।
এই কারণেই এটি প্লেটোর সিদ্ধান্তমূলক সংলাপ না বলে বিতর্কমূলক সংলাপ বলাই ভালো।
প্লেটো পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সংলাপের আলোচনায় এটি আরো সুস্পষ্ট হবে আশা করা যায়...
[অংশটি গৃহীত হয়েছে ‘প্লেটো
/ প্রোতাগোরাস’ নামক বই থেকে। এই সংলাপটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া।
বইটির পরিবেশক ও প্রকাশক –পাঠক সমাবেশ (কলকাতা)
ভারতী বুক স্টল, ৬বি, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা –
৭০০০০৯]
ভাল লাগলো বেশ৷
উত্তরমুছুনবেশ ভাল লাগলো৷
উত্তরমুছুন