কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

শিবাংশু দে

প্রাণপণ গাছের শিকড়




 “...সে-ধ্বনির স্পর্শ নিয়ে জেগে ওঠে সর্বস্ব তোমার
সে-ধ্বনির স্পর্শ নিয়ে ফুটে ওঠে নিজে-বোনা ফুল
তুমি কি আমাকে পাও? বারান্দার টবে টবে ঘেরা
খুদে বাগানে বসে ভরে ওঠে আহত সময়
হাসনাহানুর গন্ধ সমস্ত শরীরে শুষে নিলে
চোখের মৃত্যুও তার শেষ মৃত্যুঅভিঘাত নয়
শুধু সেই শ্বাসটুকু তখনও সম্পূর্ণ জেগে থাকে
আমার শূন্যতা দিয়ে ঘিরেছি তোমার শূন্যতাকে

(আশ্বাস: শঙ্খ ঘোষ)

বরাইবুরুর শালবন শেষ হয়ে আবার শালবন বসেছে সামাজিক বনসৃজন  শীতের শেষে সেখানে পাতায় কত রং! একটু গরম পড়লেই শিমূলের খোসা  ফেটে তুলোবীজ উড়তে থাকে চারদিকে হাওয়ার থেকে মাথায়, গায়ে, আস্তিন ছুঁয়ে ঘুড়ির টানে আবার আকাশে উড়ে চলে যায় ফলে পাক ধরে বীজের কথা ভেবে বীজকে কিন্তু ফল ধরে রাখতে পারে না ছেড়ে না দিলে সে তার মাটি খুঁজে পাবে না তার রোদ, জল সব নিজের মতো সে তো একটা অন্য প্রাণ 

আজ সকালে একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলুম যাঁর সাক্ষাৎকার, তিনি বেশ বিতর্কিত একজন মানুষ সৃজনশীল মানুষ তো বটেই তবে 'অ্যান্টি-মহাপুরুষ' গোছের মানুষ বলা যায় মানে তাঁর সংলাপগুলি যতটা বিতর্ক আহ্বান করে, ততটা আপ্তবাক্যের মর্যাদা পায় না আমিও তাঁকে শ্রেষ্ঠ মননশীল ব্যক্তিদের মধ্যে রাখি না কেন রাখি না, সেটা ভিন্ন প্রকরণ তাঁর নাম মহেশ ভাট মনে হয়, পাঠকেরা সবাই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেছেন,  “...We parents are so anxious for our children. We think that they  cannot do it ( any achievement) without us. But at times our paranoia cripple them and makes them doubt themselves. এই  প্রবণতাটি পুরাকালেও ছিলো কিন্তু সাম্প্রতিক প্রজন্মকালে অস্বাভাবিক অনুপাত ধারণ করেছে

যেমন, আমার অনেক বন্ধু বলেন, আমরা তো আমাদের ছেলেমেয়ের বন্ধু ক্ষতি নেই কিন্তু এই বন্ধুত্বকি সন্তানদের নিজেদের উপর নির্ভরশীল করে রেখে দেওয়ার অবচেতন অধিকার প্রবণতা?  'বন্ধুত্বে' সংজ্ঞা নিয়ে মানুষ অনেক চিন্তা করেছে সেই আলোচনার বিশদ বিবর্তন থেকে এইসব বাবা-মা'কে বিযুক্ত বোধ  হয় হয়তো তাঁদের ধারণাটা সবসময় স্পষ্টও নয় হয়তো 'বন্ধুত্ব' মানে তাঁরা ধরে নেন, সন্তানেরা তাঁদের  সঙ্গে অনেক 'মনের কথা' বলে তারা বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায়শ প্রসন্নতা, বিপন্নতা বিনিময় করে তাই কি 'বন্ধুত্বে' অভিজ্ঞান? চিরাচরিত ভারতীয় দর্শনে 'মহাগুরু' পদে থাকা জনকজননীও সখ্যের সীমানার মধ্যেই থাকেন মহাভারতের শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বন্ধুত্ব কাকে বলে? অনেক কথাই বলেছিলেন ভীষ্ম তার সবটাই সামন্ততন্ত্রী, তথাকথিত পুরুষবাদী ডিসকোর্স নয় মননশীল বিশ্লেষণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সেই সংলাপ 'বাবা-মা' সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা 'বন্ধুত্বে'  বিপ্রতীপে নয় কিন্তু প্রজন্মের যে দূরত্ব আসলে অথরিটি স্ট্রাকচার, তা কি এভাবে ঘুচিয়ে দেওয়া যায়সন্তানের 'সমস্যা' স্বরূপ কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে অনেক সময়ই সর্বতোভাবে স্পষ্ট থাকে না "নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে, চলে আসে নতুন সময়/  পুরানো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়, নতুনেরা আসিতেছে বলে" এই পরিবর্তনটিকে সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে মানসিকভাবে সন্তানদের নিজেদের উপর নির্ভরশীল করে রেখে অনেক বাবা-মা বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করেন কিন্তু যে 'দূরত্ব'টি  সন্তান প্রত্যাশা করে জীবনে নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত খুঁজে পেতে, নিজস্ব প্রত্যয়ের ভূমি রচনা করতে, সেখানে এই দূরত্বটি প্রয়োজন যেভাবে মহাকাব্যে বলা হয়েছে, মাতা মানুষের দাঁড়াবার ভূমি আর পিতা আকাশের আশ্রয় সে তো চিরকালীন সামাজিক অবস্থান কেউ হয়তো বা মনে করেন বাবা-মা সন্তানের থেকে সঙ্গত 'দূরত্ব' রেখে চললে সম্পর্কের হৃদয়ভূমি বিকশিত হয় না কিন্তু 'বন্ধু' নামক সম্পর্কটিই তো নির্মিত হয়েছে রক্তসম্পর্ক পেরিয়ে আত্মজনের নির্ভরতা পেতে যে বিনিময় মানুষ বন্ধুদের সঙ্গে করে, তা কি অবিকল বাবা-মা' সঙ্গেও করা যায়? তা কি বন্ধুত্ব? না 'বন্ধুত্বে' ছলনা?

মনে হয় আমরা একটা বুনিয়াদি প্রবণতাকে (সমস্যা নয়) অতিসরলীকরণ  করছি যেন 'বাবা-মা' হিসেবে যেনতেন প্রকারেন সন্তানদের 'বন্ধু' হতে পারলেই এই প্রজন্মগত দূরত্বটিকে অস্বীকার করা যাবে আগেই বলেছি, আমাদের দেশে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে স্তব করতে গিয়ে তাঁকে মাতা পিতার সঙ্গে বন্ধু সখার সম্বোধনও করা হয় অতএব নৈকট্যের প্রশ্নে সম্পর্কগুলির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই তবে যে কোন সম্পর্ককেই সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে উপলব্ধি করতে চাইলে একটা ন্যূনতম দূরত্ব থেকে দেখতে হয় মানুষের জীবনে 'বন্ধু' বন্ধুর ভূমিকায় থাকে রক্তসম্পর্কহীন একাধিক মানুষ হৃদয়ের যে তন্ত্রীর সংবেদনায় পরস্পরের নিকটতম আত্মীয় হয়ে ওঠে, যা বহুসময়েই রক্তসম্পর্কের প্রাবল্যকেও অনেকগুণ ছাপিয়ে যায় সেই বন্ধুত্বের  মাহাত্ম্যকে কে অস্বীকার করে? কিন্তু বাবা-মা মানুষের  কাছে রোদ-জল-অক্সিজেন-ক্লোরোফিলের মতো নৈসর্গিক আশ্রয় শুধু মানবিক, জৈবিক বা সামাজিক সম্পর্কে নয়, প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা মানুষের নিকটতম অস্তিত্ব এটা গ্রহণ করা  ক্লেশকর যে বাবা-মা'কে সন্তানের সঙ্গে নৈকট্য প্রমাণ করতে অন্য সব ভূমিকা বিসর্জন দিয়ে বন্ধু বা সখার রূপই শুধু নিতে হবে তাদের জীবনে নিজের কোন চিহ্ন স্থাপন করতে চাইলে স্বীকৃত ভালোবাসার পথটি শ্রদ্ধাসম্পর্কের সূত্রেই আসে বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও শ্রদ্ধাই প্রধান উপাদান, তবে ভালোবাসার রূপটি ভিন্নতর মাত্রাটি একেবারে আলাদা সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালোবাসা জানানোর কি কোনও নিজস্ব ভাষা নেই? বাবা-মা কি শুদ্ধ 'বাবা-মা' হয়েই থাকতে পারেন না তাতে কি গরিমার হানি হয়? সে ভাষা কি শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেই আছে? এই জটিলতম সময়ের কূট গণিত কি এত সরল  পাটিগণিতের নিয়মে মিলিয়ে দেওয়া যায়?  

একটা প্রশ্ন অস্বস্তিকর হলেও প্রাসঙ্গিক আজকের চূড়ান্ত ভোগবাদী সংস্কৃতির বশবর্তী বাবা-মায়েরা কি সন্তানকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই গণনা করছেন? সন্তানদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে তাঁদের অতীব স্পর্শকাতর এবং উৎকণ্ঠ অবস্থান তো তাইই বলে যতদিন যাচ্ছে, পোস্ট পার্টাম সিনড্রোমের বোলবালা সমাজজীবনে জাঁকিয়ে বসছে সন্তানদের নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, জেদ, আনন্দ, বিষাদ সব কিছুর সঙ্গেই যদি বাবা-মা নিজেদের আইডেন্টিফাই করতে চা', তবে তা নেহাৎ বিড়ম্বনা নিজের প্রজন্মের ভাষাকে ভুলে গিয়ে অন্য প্রজন্মের ভাষা শেখার আকুল প্রয়াস তো সফল হয় না নানা কারণেই শিকড় ওপড়ানোর জন্য এই প্রাণপণ স্ববিরোধী অবস্থানটি বাবা-মা বা সন্তান, কারো জন্যই মঙ্গলকর হয়ে ওঠে না শেষ পর্যন্ত

সন্তান তো আশীর্বাদমাত্র এই শরীর থেকে জন্ম নিয়েছে হয়তো কিন্তু সে তো নিসর্গের অংশ কিছুদিন সঙ্গে থাকে আবার শিমূল বীজের মতো নিজের  আকাশে উড়তে চলে যায় হাজার হাত বাড়িয়ে তাকে ধরাছোঁয়া যাবে না তার কক্ষপথ আলাদা চলার পথে হয়তো কখনও দুটো সমান্তরাল চলতে থাকা রেলকামরা থেকে পরস্পর উঁকি দিয়ে রুমাল নেড়ে চলে যাওয়া, যতক্ষণ না  ট্র্যাকের রেখা দু’দিকে সরে যাচ্ছে আঁকড়ে থাকা, বলা ভালো আঁকড়ানোর চেষ্টা, নিরাশা ছাড়া আর তো কিছুই দেবে না
তবু বিহঙ্গ হে, পাখা বন্ধ করতে শেখো না, কেন?

সকালে সঙ্গিনী একটা ফেবু বার্তা দেখালেন তাঁর এক বন্ধুর পাঠানো, একজন মা তিনিও "Our children are ultimately our showpieces, are'nt they" দুজনে হেসে উঠি আমাদের দীর্ঘ পথ চলা থেকে যে সব সার সত্য অনেক মূল্যে আহরণ করেছি, সে সব অলীক জগতের দৈববাণী হয়ে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসে আমার ছেলে আই আই টি, আই আই এম প্রত্যুত্তরে হয়তো ভেসে এলো আমার মেয়ে এম আই টি এখন স্ট্যানফোর্ডে তারপর? তার আর পর নেই না, আছে আমাদের ট্রেন তো নিজের ট্র্যাকেই, নিজের মতো চলে যাবে তবে সন্তানস্নিগ্ধ শব্দগুলি, ব্যঞ্জনাগুলি 'আমাদের' জীবনে কেমন তাৎপর্য নিয়ে ফিরে আসবে কোনোদিন? কন্যা বা পুত্রবধূ সন্তানসম্ভবা হলে 'মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধুহীন, সাহচর্যহীন দূর অচেনা বিদেশে 'মাসের কারাদন্ড সন্তানের সাফল্য, তার ব্যস্ততার পরিমাপে সপ্তাহান্তে গাড়ি নিয়ে কোথাও গাছপালা, হ্রদ, পাহাড়, পার্ক দেখতে যাওয়া সন্তানের শিকড় বদলে গেছে, বসে গেছে, স্থায়িত্বের স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে হয়তো কিন্তু? ওঁহা ম্যাঁয় অজনবি হুঁ তবে সন্তানের প্রয়োজনে যদি বাপ-মা এগিয়ে না যায়, তবে কে যাবে? পরবর্তী প্রজন্মের অংকুরকে ছুঁয়ে দেখার সাধও তো থাকে কোথাও, মনের কোণে, অলক্ষ্যে স্নেহ অতীব বিষম বস্তু কিন্তু সমে পৌঁছে থামার শিক্ষাটিই তো শেষ সিদ্ধি

কয়েকদিনের জন্য দেশে এলে, "দেখো, তোমার মা যেভাবে সানি'কে হ্যান্ডল করছেন, আমার রিজার্ভেশন আছে কত আননোন ইনফেকশন চারদিকে ঐটুকু বাচ্চা ... উইল ডেফিনিটলি ফল সিক" ঠিকই তো, নতুন শো'পিস মিং রাজত্বের নীল পটারি দেখো, মগর দূর সে...

সব গল্পই কি একরকম? হয়তো না ব্যতিক্রম নিয়মকে প্রতিষ্ঠা দেয় বাপ-মা অসুস্থ হলে, নিরাময় না হলে, সন্তান কাঁদে তো! নিজের মতো কাঁদে কোনোটা   দেখা যায়, কোনোটা যায় না তারা সতত 'নিজের মতো' সেটাই তো স্বাভাবিক, স্বাগত বিবর্তন কিন্তু বারবার দেখি বাপ-মা আর 'নিজের মতো' হয়ে উঠতে  পারেন না হয়তো হতে চান না জীবনের যে পর্যায়ে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়, সব জেনেও তাঁরা অনেকেই সে চেষ্টা করে যান সন্তানকে জানতে দিতে চান না, বাপ-মা' নিসর্গের অংশ যেমন রোদ, বৃষ্টি, ক্লোরোফিল, ভিটামিন ডি পূর্বগামিনী ছায়া, একদিন পশ্চিমগামিনী হবেই তবু বাপ-মা' জন্য শো'পিসের 'সম্মান', 'নিরাপত্তা', 'স্বাচ্ছন্দ্য' যে কোনও মূল্যে বজায় রাখতেই হবে তারাই তো আমাদের 'সার্থকতার প্রতীক', সাফল্যের সাঁঝবাতি ভালোবাসা মানে কি শুধু আলখাল্লা-পরা স্মৃতির মেঘ?

"...মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো
রুপোলি মাছ, পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো"

(একবার তুমিঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন