মেয়েখেলা (পর্ব - ১৩)
আমার মা হামেশাই বলতেন, অমাবস্যায় জন্ম যাদের তারা ডাকাত নয় দুশ্চরিত্র হয়। বাবাকে কোনোদিন সে কথার প্রতিবাদ করতে শুনিনি। হয়ত পুত্রসন্তান ডাকাতের মত হলেও প্রকাশ্যে বলা যায় না, কিন্তু কন্যাসন্তানের চরিত্র নিয়ে এমন মোক্ষম তানা বিরল। বাবা প্রতিবাদ করতেন না, তার কারণ হয়ত আমার দুশ্চরিত্র ফ্রেমে সহজে ফিট হয়ে যাওয়া। প্রথমত স্বামীর সাথে না থাকা, দ্বিতীয়ত বিবাহ পরবর্তী একাধিক প্রণয় বা পুরুষের আনাগোনা। সমাজে এমন মেয়েদেরই তো দুশ্চরিত্র বলা হয়। কিন্তু আমি দুপুরের কাঠফাটা রোদের সোনালী ধানের চিকচিক করার মত গর্বিত হতে থাকি। ফেটে পড়ে আস্ফালন আমার। হ্যাঁ, ভালোবেসে পরাস্ত হয়েছি, কিন্তু আমার নিজেকে নতুন করে চেনার আকাঙ্ক্ষাকে সামাজিক শৃঙ্খল জর্জরিত করতে পারেনি। আমি হয়রান হয়েছি, হেরেছি, কিন্তু কোথাও কোনো অনুতাপ নেই। আমি দুশ্চরিত্র মানতে আজ আর আত্মসম্মানে লাগে না। যে সমাজ মেয়েদের হনন মুখ বুজে সয়, স্বামীর চড়, প্রেমিকের গালিকে মেনে নিতে শেখায়, সে সমাজের বিধি বা বিন্যাস রক্ষার কোনো দায় বহনের অপেক্ষা আমার নারীত্ব করে না। আমার মাতৃত্বও করে না। সমুদ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা ঢেউ গুনতি করা পাব্লিকদের আমার নপুংশক ছাড়া কিচ্ছু মনে হয় না। দুশ্চরিত্র শব্দটা তাই আমার কাছে খুব সেলিব্রেসনের।
একদা প্রেমিকের গৃহে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম বাস। তার মাথার উপরে ছাদ গড়তে মেয়ের নামে রাখা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা তুলে দিলাম। তিনি কথা দিলেন তা শোধ করে দেবেন এবং তা দিলেনও পরে। ইতিমধ্যে আমায় আবেগভরে জানালেন, একটি রুম তিনি আমার নামে রেজেষ্ট্রি করে দেবেন। প্রেমের এপার ওপার সব ডুবে ভেসে গেল। ভাবলাম মানুষের উপরে প্রেম সত্য, আমারটার উপরে কিচ্ছুটি নাই। ধীরে ধীরে ঘরটিকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কিনলাম প্রেসার কুকার, বাসন, টিভি, ডিভিডি, ফ্রীজ। চলতে লাগল হাফ সংসারের প্রেম বোঝাই গাড়ি। শুধুই উড়ান, মাঝে মাঝে ভূপতিত হওয়া অভ্যাসের মধ্যে এসে গেল। তারপর একদিন সেই অন্তিম ঘণ্টা। বলহরি, হরিবোল। প্রেমের শবদেহ ফিরে এলো বাবার দেওয়া ঘরে, সঙ্গে প্রেমিককে গিফট করা টিভির বাক্সে আমার নিরীহ দামী শাড়ী ও অন্যান্য জামাকাপড়। ভালোবাসা বৃষ্টির দাগের মত মিটে গেল। হারালাম অগনিত দিনের অনালোকিত সব কিরণ।
কালো মিশমিশে অন্ধকারেও প্রেম পায়। স্বপ্ন দেখে মন। পঙ্খীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে আবার আসবে বুঝি কোনো রাজকুমার। ছদ্মবেশের আড়ালে থাকে প্রেম। আসলে পাওনা গন্ডার কড়ি মেলাতেই ব্যস্ত মগজ আগুন্তুকের। মন নিয়ে নারী আর কোথায় যায়!
কাপুরুষ প্রেমিকের সম্মান সমাজ দেয় কিন্তু সাহসী প্রেমিকার মুখের জন্য পড়ে থাকে চুন কালি। তাকে চুড়েল বানাও, দুশ্চরিত্র বানাও, ডাইনি বানাও, পাগল বানাও সব চলতে পারে কেননা মেয়েরা এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখেনি, শিখবে না। তাদের একটা সাথী চাই, একজন প্রকৃত বিচারক চাই, পুরুষ নয়। এই উপলব্ধির কাঠগোড়ায় যখন আমি, তখন বোধ বিশ্বাস একাকার হল। আমার পুরুষ নির্বাচন ভুল ছিল। মানুষ একা একা পারে না পথ চলতে, আমিও পারিনি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ছিল ব্যতিক্রমী। পুরুষের নিরন্তর অপদার্থতা ও চাহিদার সামনে আমি মূলধন হিসেবে ধরা পড়েছিলাম। আমাকে ক্যাশ করতে করতে এগিয়েছে অনেকেই। নিজেকে ফেরানো আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল, বাধা ছিল মন। পরে ভাঙ্গচূর করে সশব্দে পেরোতে হয়েছে সীমানা। দেওয়ালে দেওয়ালে বিজ্ঞাপিত হয়েছে আমার প্রেম শহরের বুকে। আমি খারাপ যতক্ষণ মেনে না নিতে পেরেছি ততক্ষণ ষ্ট্রাগল। হ্যাঁ, আমি খারাপ। কী হয় মেয়েখারাপ হলে? কিচ্ছু না!
আমি আমার দেখেছি কতগুলি ভালো মেয়েরা তাদের স্বামী বা পরিবারের নির্দেশে এড়িয়ে চলে, শহর জোড়া আঙুল ও চোখের ইশারা সইতে হয়, আর শহরে বড় বড় মুখে শোনা যায় খুব ছোট কথা, শুনেছি মেয়েটি খারাপ! এই খারাপ শব্দটা এক্সপ্লোর করতে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে আমার,
আমরা আসলে এই শব্দটাকে খুব ভয় পাই অনেকটা ক্যান্সারের মত। আজ এই দূরারোগ্য ব্যধি থেকে ফিরে এসেও মানুষ উল্লাসের সাথে বাঁচে। কিন্তু খারাপ মেয়ের লেভেল লেগে গেলে বুঝি আর ওঠে না। আমাকে অনেকে প্রকাশ্যে তসলিমার বোন, স্লাট, রেন্ডি ঐ মেয়েটা বলে। ভাবি, কী আর হয়? এসব শুনে আমার আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, হাসি পায়। কিছু মুখোসের আড়ালে থাকা শয়তানের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছা করে, ‘হোর’ শুধু মেয়েরা কেন হবে, বহু পুরুষও হয়। লেবেলটা মেয়েরা লাগাতে শেখে নি, এই আর কি! আমার মা তো কেঁদে বলে,
মেয়ের জন্য মুখ দেখাতে পারি না! কি জানি এই পৃথিবীতে এত অসৎ,
খারাপ মানুষের ভিড়ে আমি নিকৃষ্টতম কিনা! কোনো মেজারমেণ্ট থাকলে একবার মায়ের সামনে মাথা তুলতে পারতাম। সব কল্পনা বাস্তবকে হারিয়ে আলাদা কিছু তৈরি করে না, তাই সেই সীমানা জুড়েই ইচ্ছার হামাগুড়ি।
যে কারণে আমাদের সমাজ মেয়ের গায়ের ময়লা তোলা থেকে বিরত থেকেছে, তা নিয়ে খুব বেশি কথা বলা যায় না। সিনেমায় পুরুষের সম্পর্কের জীবন, একাধিক মেয়ের উপস্থিতি দেখানো হয়। আখেরে বিখ্যাত গল্পকার, পরিচালকরাও দুটি নারীর সাথে পুরুষের সহাবস্থান বা সমানাচারণ নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন। কিন্তু মেয়েদের বেলায় তা করা খুব কঠিন। দুই নারীকে কখনো একে অপরের সাথে লড়িয়ে দেওয়া বা একে অপরের কাছে আযাচিত শিক্ষা নেওয়া বা দ্বিচারী স্বামীকে ক্ষমা করার মধ্যে দিয়ে গল্প শেষ করে দেওয়া হয়। নারীর ইচ্ছার পরিণতি সমঝোতা মেনে নেওয়াতেই ঝুলে থাকে। সে দুই পুরুষ আনলেই সমস্যা। খারাপ ছাপ্পা ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎবেগে।
পেছনের দিকে তাকালে দেখি তেপান্তরের মাঠ। কোথাও কোনো সবুজ নেই। কোনো ফোটোফ্রেমও নেই যা আঁকড়ে ধরে এক নিঃশ্বাসে কাঁদতে পারি। সামনে ঘন শালবন। বিস্তর প্রলোভন, হাজার হাতছানি। সার সার মাথা উচু গাছের ফাঁকে দুপুর আর ছায়াঘন অপরাহ্নের ভার। ভয় হয় যেন আলোর রেখায় চোখ না রাস্তা ভোলে। কোনো ছায়া চাই না আর যেখানে ভুলক্রমে একদন্ড শ্বাস নিয়ে ফেলি। নিজের লিমিট তো নিজেই বেঁধেছি। অতিক্রম করতে মন সায় দেয় না। আকাশের চোখে চোখ সব অভিমান ওড়াই মনে মনে, বলি, কোথাও দুঃখ,
কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদও নেই।
Valo laglo. Prakritoi kothao dukho,bicched mrittu nei. Kebol jao asa. Ovinandan.
উত্তরমুছুন