আধুনিকতার রোলার
কোষ্টারে প্রাচীন বাঙালিয়ানা
(পর্ব ২)
বিদ্বান বাঙালীর বিবেকের বলিদান
প্রাচীন বাংলায় বিদ্যাশিক্ষা ছিলো গুরুমুখী। যে সুশৃঙ্খ্ল
ব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে বিদ্যার্থীরা অনেক সময় গুরুমারা বিদ্যাও অর্জন করতে সক্ষম
হতো। অর্থাৎ জ্ঞানে-গুণে ছাপিয়ে যেতো গুরুমশাইকে। শিক্ষক পাঠদানকে জীবনের পরম ব্রত
মনে করতেন, ছাত্ররাও গুরু ভক্তিতে অটলতার প্রমাণ দিতেন।
বশিষ্ঠ, দ্রোণাচার্য, কচ-দেবযানীর সময়কালে বিদ্যার্থীরা গুরুগৃহেই অবস্থান করতেন।
নানা কাজে কর্মে , জীবনধারায়
গুরুকে অনুসরণের সাথে সাথে পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষাও করতেন বিভিন্ন বিষয়ে ব্যুৎপত্তি
লাভের জন্য। অর্থাৎ বইয়ের সাথে সাথে হাতে কলমেও নানা জীবনাচরণ শিখতেন তারা। আচার্য
থেকে শুরু করে গ্রাম্য পন্ডিতমশাই সকলেই নিষ্ঠার সাথে নিজের কর্তব্য পালনে সচেষ্ট
থাকতেন। পন্ডিতমশাইরা কৃষিকাজ বা ঝিমুনির ফাঁকে ফাঁকে প্রবল হুংকার অথবা বেত্রাঘাতের
হুমকি যেটা করেই হোক, নিরলস চেষ্টা
করে যেতেন শিক্ষার্থীদের জীবন চলার পথের শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দিতে।
এসব পাঠশালার তালেবেলেমদের কেউ কেউ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে
পারতেন,
কেউ বা সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে আটকে গিয়ে সাধারণ
জীবন-জীবিকা বেছে নিতেন। কিন্তু ঠিক আজকের
মতোন আকাশ ছোঁয়া উঁচু থেকে আরো উঁচুতে ওঠার অদৃশ্য কনভেয়ার বেল্টে গাদাগাদি চেপে, ক্যারিয়ারের ইঁদুর দৌড়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়াই তাদের
একমাত্র লক্ষ্য ছিলো না। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যরিষ্টার-দারোগা-মুন্সেফের বাইরে
আর কোনো উচ্চতর পদের চিন্তা সেকালের বাঙালী করতেই পারতেন না। তাই কর্পোরেট
কালচারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ ঘরে থেকে থেকে স্বাভাবিক আলো হাওয়ায় নিঃশ্বাস
নিতে ভুলে যেতেন না কয়েক দশক আগেও বাঙালী।
সামাজিক-সাংষ্কৃতিক-রাজনৈতিক অঙ্গনেও শিক্ষিত বাঙালী ঊনবিংশ
শতকের প্রথম দিকেও জোরালো ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হতেন। নিদেনপক্ষে সৎভাবে
জীবনযাপনকেই মোক্ষ হিসাবে জানতেন। ডান হাত-বা হাতের এতো উপায়-পন্থা তাদের অগোচর
ছিলো বিধায়, সৎ উপায়ে কম-বেশী যা আয়
করতে সক্ষম হতেন, তার মধ্যেই
সুখী সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতেন। আজ গ্যালাক্সি ৭ তো কাল আইফোন না হলে
জীবন বৃথা, এসব গোলোকধাঁধার গোলচক্কর মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেনি তখনো
শিক্ষিত বাঙালীর।
কবে, কখন যেন খুব
ধীরে ধীরে বদলে গেছে এই ধীর-স্থির শান্ত জীবনের দৃশ্যপট। এখন একটি শহুরে শিশু
ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাকে নির্দিষ্ট ছকে শিক্ষাদানের আপ্রাণ
প্রয়াস। এমনকি তার খেলনাগুলোও বাছাই করার চেষ্টা করা হয় একাডেমিক শিক্ষার প্রাথমিক
ধাপ হিসাবে। বুদ্ধি বিকাশের লোগো, কম্পিটিউরাজইড
সিডি তাকে যান্ত্রিক পাঠদান করতে থাকে অবিরত। সেই সে স্লেট-চক দিয়ে মা-বাবার কাছে
হাতেখড়ি দেবার মতো সময়ই বা কোথায় আধুনিক প্যারেন্টসএর। স্লেটের বদলে এসে গেছে
প্লাষ্টিকের মুছে ফেলার বোর্ড। কিন্তু সেই সাথে মুছে গেছে যেন আগেকার ভঙ্গুর
গ্রানাইটের কালো স্লেটখানি না ভাঙ্গার চেষ্টায় সযতনে আগলে রাখার যত্নটুকুও। বরং
ঝোঁক বেড়েছে রাইম, এবিসি বা
ওয়ান-টু সিডি অবিকল মুখস্থ শুনিয়ে আশেপাশের সবাইকে তাক লাগিয়ে বাহবা নেবার দূর্বার
নেশা।
শহুরে স্কুলগুলোতে মোটামুটি দুগ্ধপোষ্য শিশুরা আড়াই/তিন বছর
বয়স থেকেই ঘুমচোখে সকালে ছোটে প্লে-গ্রুপে প্রাতিষ্টানিক ডিসিপ্লিনের প্রথম পাঠ
নিতে। এটা যে খুব খারাপ কিছু, তাও নয়। অন্য
বাচ্চাদের দেখে দেখে শিশু শিখে নেয় অনেক আদব-কেতা। আর আধুনিক মনঃস্তত্ব একথাও বলে
যে,
শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের জন্য তার জীবনের প্রথম তিন বছর
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময়টাতেই মস্তিষ্কের গঠন সম্পন্ন হয় শিশুর, পরবর্তী বাকী জীবনে পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এই
মূল ভিতেরই পরিবর্ধন-পরিমার্জন চলে মাত্র। কিন্তু ব্যস্ত চাকুরে পিতা-মাতা বা
সিরিয়াল মগ্ন গৃহিনী / ব্যবসা ভারাক্রান্ত কর্তাবাবুর হাতে কতোটুকু সময় আছে আজকাল, জীবনের এই প্রথম তিন বছরে খুব যত্নে একটি শিশুর শিক্ষার
প্রথম ধাপ বাড়ীতেই গড়ে দিতে? আর তা না
থাকলে,
ওসব প্লে গ্রুপ ফ্যাশনের প্যাশন, কিছু ফার্মের মুরগীর ডিম ফোটা সাদা-সাদা গোবদা চেহারা আর
তাদের মতোই ঝিমানো বোধ-বুদ্ধির, ম্যাচবাক্সের
খাঁচায় বন্দী দু’পেয়ে এক জেনারেশনের ক্যাট ওয়াক ছাড়া, আর কিছুই যোগ করতে পারবে না যুগ বদলের র্যাম্পে।
মাত্র দুই-তিন দশক আগেও অন্ততঃ ৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত
নিশ্চিন্ত খেলাধুলায় শৈশব কাটতো শহুরে বাঙালী পরিবারের শিশুর। গ্রামের শিশুরা
স্কুলে যাওয়া শুরু করতো আরো পরে। তাই বাল্যকাল বলে একটা মধুর স্মৃতি থাকতো প্রায়
প্রত্যেক বাঙালীর জীবনে। এখন প্লে গ্রুপ, নার্সারী, কেজি এরকম কেজি কেজি ওজনদার
পুস্তক গলধঃকরণ শেষে তবেই প্রথম শ্রেণীতে ওঠার ছাড়পত্র মেলে অধিকাংশ বাঙালী শিশুর, আর তার তলে চাপা পড়ে বিবর্ণ হয়ে যায় শৈশবের কোমলমতি সময়, চাপা পড়া
ঘাসের মতোই। নামকরা স্কুলগুলোর ভর্তি যুদ্ধ নিয়ে অভিভাবক-ছাত্রের ওষ্ঠাগত প্রাণ আর
ভর্তি পরীক্ষার কারবালার ময়দানে এজিদের ভূমিকায় কঠিন প্রশ্নপত্র, ফোরাতের জলের মতোই দুস্প্রাপ্য অংকের মোটা টাকার বিনিময়ে ভর্তি নিশ্চয়তা, যুদ্ধরত সৈনিকের ভূমিকায় ঢাল-তলোয়ারের বদলে সকাল-সন্ধ্যা
অভিভাবক-ছাত্র-ছাত্রীর বই-খাতা হাতে কোচিংএ ছোটাছুটি ... এগুলো গা সয়ে গেছে
সকলেরই।
দেশের বাইরে না থাকলে মনে হয় এতোটা টের পেতাম না দেশের
শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান এই মারাত্মক টেনশনের। ২০১৫ সালে আমার একমাত্র মেয়ে
অদ্বিতীয়ার প্লে গ্রুপ কাল থেকে ক্লাশ থ্রিতে পড়ার বাল্যবান্ধবী ও তাদের মায়েদের
সাথে ফি বছর দেশে গেলে গেট টুগেদারের
পার্টিতে,
একেক জন মায়েদের ৪/৫/৬টা এরকম পরিমাণ কোচিংএ মেয়েদের নিয়ে
ছোটাছুটি,
রোদ-জলে কোচিংএর বাইরে বসে থাকার গল্প শুনতে শুনতে প্রাণ
হাঁসফাস করে উঠেছিলো আমার। এমনকি রান্না-খাওয়ার সময়টুকুও বিরল সেইসব মায়েদের। অথচ
নিউজিল্যান্ড শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে এতো যত্নে পাঠদান করে এবং হোমওয়ার্কের প্রতিও
স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তুলে, এতো সিস্টেমেটিক ওয়েতে সবকটি ছাত্র-ছাত্রীকেই গড়ে দেয়া হয় যে, এই ফেব্রুয়ারী মাসে আমার মেয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাশ
শুরু করতে যাচ্ছে, আমার মনে
হচ্ছে হেসে খেলেই আমরা পার হয়ে এলাম ওর স্কুল-কলেজের গন্ডীটুকু। পড়াশোনার চাপ তো
ছিলোই বড় ক্লাশে। কিন্তু ও নিয়ে কোনো টেনশন
আমাদের কারো মাঝে ছিলো বলে তো মনে পড়ছে
না। এটাই সুশৃঙ্খ্ল এবং সৎ সমাজব্যবস্থার সুফল।
বাংলায় কয়েক দশক আগেও কেউ মেট্রিকুলেশন পাশ করলে দশ গ্রামের
লোক ভিড় করে দেখতে আসতো তাকে। এখন সরকারী-বেসরকারী নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায়
ঘরে ঘরে বি এ, অনার্স, এম এ, এমনকি ডক্টরেট
ডিগ্রীধারীও কম না। অথচ সমাজে সুশিক্ষিত মানুষ খুঁজতে গেলেই চালুনীর মিহি ফুটো
দিয়ে অধিকাংশই গলিয়ে যায় জলেরই মতোন। আসলে, “সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত”... এই কনসেপ্টটা মানুষের মন থেকে উঠে যাচ্ছে বলেই, আজ এই পরিণতি সত্যিকারের সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের মতোন
মানুষ গড়ে উঠায়।
শিক্ষালাভ বা শিক্ষাদানের ধারণার সাথে অবশ্যম্ভাবীরূপে
জড়িয়ে গেছে অর্থ উপার্জনের উপায়, সুন্দর
জীবনাচরণ নয়। পেছনে পড়ে গেছে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার বা আইনবিদ হয়ে দেশ-দশের সেবা করার
মানসিকতা। বরং কর্পোরেট অফিসার, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বা আইটি সেক্টরে কাজ করে মোটা মাইনের
স্বপ্ন অনেক বাঙালীর চোখের তারায়। সেবামূলক পেশাগুলোয় নিয়োজিত অনেকেই ‘কসাই’ নামে পরিচিত হচ্ছেন অর্থলিপ্সার কারণে। দেশ-সমাজ ওসব নিয়ে
বলাটা এখন নিজেকে সচেতন প্রমাণ করার বুলি মাত্র।
তবে সুখের বিষয় হলো, বেড়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, পোলট্রি ফার্ম, সবজি-ফল-ফুলের
বাগান বা ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা, এরকম প্রচুর স্বনির্ভর হওয়ার মতো প্রচেষ্টা বাঙালী যুবক সমাজের। ভবিষ্যতে এরাই
হবে সমাজের আসল পথ প্রদর্শক। ‘ব্রেইন ডেইন’
হয়ে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমানো মেধাবীরা নয়।
আধুনিক বাঙালী নয়টা-পাঁচটা অফিস কিউবিকল শেষে বাড়ি ফিরে
কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের সাথে সখ্যতার ফাঁকে-ফোকরে
পরিবার-পরিজন-বন্ধুবান্ধবের জন্যও কিছু সময় বরাদ্দ রাখতে ভোলেন না বটে।
সপ্তাহান্তে একবার রেস্তোরাঁ, মাসান্তে মুভি
থিয়েটার বা গেট টুগেদারের বিপুল খাদ্য সম্ভারের সাথে ফর্মাল আন্তরিকতায় সিক্ত কিছু
রিক্ত সময়, বৎসরান্তে হলিডে ট্যুরে
বিদেশ ভ্রমণে যেতে না পারলে দেশেরই
সাগর-পাহাড়-চা বাগান-ঝর্ণাধারা দাপিয়ে কিছু সেলফি মুহূর্ত উদযাপন, অন্ততঃ একটা ঈদ/পূজোর পরবে নিজ নিজ শহর/গ্রামের দিকে ছোটা… মোটামুটি এই হচ্ছে বর্তমান কালের শিক্ষিত বাঙালীর জীবন
কাটানোর ছক বা স্বপ্ন।
তাই গরম এলেই…
“তাই তাই তাই,
মামা বাড়ি যাই।
মামা দিলো দুধভাত,
পেট ভরে খাই।
মামী এলো লাঠি নিয়ে
পালাই পালাই।”...
দিনগুলো সুদূর অতীত আজ। তাতে লাঠিয়াল সাজার বদলে মামী পদবীর
গৃহিণীকুলের সিরিয়াল দেখার সময়ও কিছুটা নির্বিঘ্ন হয়েছে বলে, বাংলার নারীসমাজ একেবারে যে অখুশী এতে, তা নয়।
গুরুদক্ষিণা ব্যাপারটি বাংলায় প্রচলিত ছিলো সবকালেই। প্রাচীনকালে
যেমন গুরুকে তুষ্ট করতে নিজের হাতের
আঙ্গুল কেটে দেবার মতো উদাহরণও আছে।
অর্থাৎ তখন শিক্ষককে যে মর্যাদায় ভূষিত করতো অভিভাবক-ছাত্রগণ, এ যুগে তা বিরল।
বরং বাবার টাকায় পোষা বয়-বেয়ারা-বুয়া-বাবুর্চি, ড্রাইভার-দারোয়ানের মতোই মাসোহারা মাইনের শিক্ষককেও শিক্ষালাভের গরুর গাড়ির
গাড়োয়ান মনে করতে পিছপা হয় না অনেক স্বচ্ছল ঘরে জন্মানো বঙ্গ সন্তানই। অবশ্য
শিক্ষক সমাজের নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে না পারাও এজন্য কম দায়ী নয়। সব কিছুই
যেন পণ্য আজ, কিনে হও ধন্য। তাই আমাদের কোমল অনুভূতিগুলো যেন চকে লেখা স্লেটের
মতোই হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তবতার প্লাষ্টিক ডাস্টারে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রচুর উচ্চশিক্ষিত মানুষ আশেপাশে দেখা গেলেও, এমনকি ষাটএর দশকেও বাংলায় একজন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, বোধ-বুদ্ধির প্রাঞ্জলতা, সমাজ-সচেনতা, দৃঢ়চেতা
ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন দেখা যেত, তা এখন চোখে
পড়ে খুব কম। তার বদলে দেখা যাচ্ছে স্মার্ট পোশাকধারী, যান্ত্রিক স্বপ্নচারী, আধুনিক আর পুরনো মূল্যবোধের টানাপোড়নে হিমশিম খাওয়া, একদল জীবনপথের পথ হারানো পথিকের। তাই এখন
প্রত্যেক শিক্ষিত বাঙালীর নিজেকেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে, “পথিক, তুমি কি পথ
হারাইয়াছো?”
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন