একটি গাছ ও এক পৃথিবী
সবুজ
পাতাগুলো এতদিন বাদে বৃষ্টিতে ভিজে কেমন হাসছে, বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে, ডালে ডালে
শিহরণ উঠছে, আনন্দে কেঁপে উঠছে গাছটি। এই যে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এই গাছ, ভেতরে
পুষে রেখেছে আনন্দ, সেও তো ক্ষণিকের। কবে না জানি উৎখাত হতে হবে কোন কাঠুরের
কুঠারের ঘায়ে! গাছ মরে যাবে। আর সেই কাঠুরে তখন বুঝবে না যে সে আসলে নিজেই মরে
গেল। অন্যকেও মেরে ফেলল। বুঝবে কিছুদিন বাদে। যখন এই পৃথিবী থেকে বৃষ্টি মুছে
যাবে, সবুজ মুছে যাবে, শহরের ইট, কাঠ, পাথরের খাঁচায় দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে
মানুষগুলো একে একে। পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে এইভাবে একদিন। চোখ বুজলে আজকাল আমি
এমন স্বপ্ন দেখি। আর কোন স্বপ্ন আমার কাছে আসে না। বিলুপ্তির খুব কাছে এসে পৌঁছে
গেছি আমরা। এই হতাশার মধ্যেও বাঁচার ইচ্ছে জাগে যদি, আবার যদি সবুজের স্বপ্ন দু’ চোখ ভরে দেখে ফেলে কেউ, খুব কি অন্যায় হবে? পারমাণবিক চুল্লীর থেকে একটু দূরে থাকতে পারে না কোন সবুজে ঘেরা
শহর বা গ্রাম? আবেগ এখনও তো কথা বলায়, বলার চেষ্টা করে অন্তত, সেই আবেগটুকু
বাঁচিয়ে রেখে যদি আমরা ওই সবুজের হাত ধরি আবার, খুব কি ভুল হবে? চেষ্টা করে দেখাই
যাক না! আর শুধু আবেগ থাকলেই তো চলে না, কোন কাজকে সুষ্ঠুভাবে সফল করতে গেলে চাই
সঠিক পরিকল্পনা। আবেগ আর নিষ্ঠা এই দুই দিয়ে পৃথিবীকে ভরিয়ে তুলি সবুজে। একজন
মানুষ যদি সারাজীবনে দুটি বৃক্ষকে মাথা তুলে বাঁচাতে পারে, তাহলে কিছুটা অন্তত
সার্থক হবে এই প্রচেষ্টা। আর গাছ বাঁচাও, সবুজ রক্ষা কর – এতো আমরা আজ নতুন ভাবে
ভাবছি না। অনেক অনেক দিন আগে থেকেই এই ভাবনা জেগেছে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের
মনে। সত্যি বলতে কি, জঙ্গলের বাসিন্দারাই গাছের মর্ম বুঝেছে অন্তর দিয়ে। কোন রকম
আন্দোলন ছাড়াই তারা বরাবর গাছ বা পরিবেশ রক্ষা করেছে নিজেদের পরিবারের মত করে।
চিপকো
মুভমেন্ট বা চিপকো আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৩-এ। বন সংরক্ষণে প্রাথমিক ভাবে এই আন্দোলন
শুরু হয়ে পরবর্তীকালে সারা বিশ্ব জুড়ে র্যালি সিস্টেমে এই আন্দোলন কার্যকরী
ভূমিকা নিয়েছে। বিভিন্ন ইকো-গ্রুপ অহিংস আন্দোলনের পথে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ
করে ও গাছ কাটলে কী কী ক্ষতি হতে পারে, এই প্রচার চালিয়ে ডিফরেস্টেসন কমেছে। গাছ
আমাদের ইকোলজিতে কী কী প্রভাব ফেলে, ভূমি সুরক্ষা থেকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো
– এই সাধারণ জ্ঞানগুলো মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া, তারা যাতে নিজেরাই স্বেচ্ছা
প্রণোদিত হয়ে গাছ লাগায় এবং গাছ কাটা রোধে একত্র হয়, এই আন্দোলনের এটাই ছিল
লক্ষ্য। সত্যগ্রহ আন্দোলনের মতই এই আন্দলন ছিল অহিংস এবং নারী, পুরুষ উভয়েরই।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে গৌরা দেবী, সুদেষ্ণা দেবি, বাচনী দেবী এবং চন্ডীপ্রসাদ ভাটের নাম ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৭ সালে চিপকো মুভমেন্ট
পেয়েছিল ‘Right
Livelihood Award’।
ব্যক্তিগতভাবে অনেক অনেক
মানুষ আছেন, যাঁরা গাছকে ভালোবেসেছেন, রক্ষা করে চলেছেন আজও। যাঁদের অনেকের খবরই
আমাদের জানা নেই। এই সেদিন শুনলাম, মধ্যপ্রদেশের এক আদিবাসী মহিলার উদ্যোগে তৈরি
হয়েছে একটি মহিলা দল। যারা নিজেরাই অনেকগুলো দল ও উপদলে ভাগ হয়ে জঙ্গলের মধ্যে গাছ
পাচারে বাধা দিচ্ছেন। অস্ত্র বলতে পাথর আর লাঠি, কুড়ুল। অনেক সময়ে তারা নিজেরাও আহত হয়েছে, তবু দমে নি। আর এই কাজে
অনেকাংশেই সফল হয়েছে তারা। তামিলনাড়ু
স্টেট ট্রান্সপোর্টের কর্মী, বাস কন্ডাকটর, মারিমুথু যোগনাথন গত ৩২ বছর ধরে একাই
চালিয়ে যাচ্ছেন সবুজ বাঁচাও অভিযান। স্রেফ গাছকে ভালোবেসে, যখন যেখানে পেরেছেন গাছ
লাগিয়ে গেছেন। প্রায় ৩৮,০০০ গাছ একাই লাগিয়ে এই ‘সবুজ’ বাস কন্ডাকটরকে সিবিএসসি
সিলেবাসে ‘সবুজ রক্ষাকারী যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। গাছের ওপর নিখাদ
ভালোবাসা না থাকলে এই ভূমিকা কিছুতেই পালন করা যায় না। বন্যপ্রাণী
সংরক্ষণে যুব সম্প্রদায়ের কাছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। পরিবেশ রক্ষার
বিষয়ে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিয়মিত বক্তব্য রাখেন। আর গাছও লাগান
নিয়মিত। কোন সম্মান পাওয়ার জন্য তিনি এই কাজ করেন নি, যা করেছেন গাছকে ভালবেসেই। এই
যে সেদিন যশোর রোডের সব গাছ কাটার নির্দেশ এসেছিল উড়ালপুল তৈরির জন্য, আর একদল
তরুণ সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে আন্দোলন শুরু করেছিল, আর ব্যাপক প্রচারে তারা সফল
হয়েছে অনেকটাই। আদালতের নির্দেশে আপাতত গাছকাটা বন্ধ হয়েছে। কিছু গাছ কাটা হলেও,
আশা করি ভবিষ্যতে যশোর রোডের গাছগুলো ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ছায়া দেবে, সবুজে
ভরিয়ে দেবে ওই পথ।
আর বিশেষজ্ঞ টিমও পিছিয়ে নেই। এদের মধ্যে একটি - গ্লোবাল ট্রি
ক্যাম্পেন হল ফনা ও ফ্লোরা (FFI) এবং বটানিক
গার্ডেন কনভারসেশন ইন্টারন্যাশনাল (BGCI)-এর মিলিত এক আন্দোলন। এটাই একমাত্র
ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম যার সাহায্যে পৃথিবীর লুপ্ত হয়ে যাওয়া গাছেদের সংরক্ষণ
করা হয়ে থাকে। যতদূর জানা গেছে, ৯,৬০০-র’ও বেশি গাছের
প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ১,৮৫০ প্রজাতিকে ক্রিটিকালি এনডেনজারড্ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই
ক্যাম্পেনের মূল লক্ষ্য হল, বন সংরক্ষণই শুধু নয়, বিভিন্ন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া
গাছেদের রক্ষা করা। এর মধ্যে একেকটি গাছকে আলাদা করে বিশেষ ভাবে যত্নও নিতে হয়েছে।
১৯৯৯-এ শুরু করে এই ক্যাম্পেন এখন পৃথিবীর ২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রোগ্রামে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাজে লাগিয়ে, তাদের প্রয়োজন
মত শিক্ষিত করে তুলে এবং কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে নির্দিষ্ট করা গাছেদের বাঁচাতে
চেষ্টা করা হয়। পরে এই গ্রুপ আবার অন্য আরও একটি গ্রুপকে দরকার মত শিখিয়ে পড়িয়ে এই
কাজে লাগায়। এভাবেই চেন সিস্টেমে সমস্ত কাজ হয়ে চলেছে। এরপরে যারা বন সংরক্ষণ
করেন, গাছ লাগানোয় উৎসাহী যেসব দল আছে তাদের মধ্যে বিলুপ্ত প্রজাতির গাছগুলিকে
বন্টন করেন।
১২০টি IUCN/SSC স্পেশালিস্ট গ্রুপ
এবং রেড লিস্ট অথোরিটি নিয়ে গ্লোবাল ট্রি স্পেশালিস্ট গ্রুপ(GTSG)-এর বিস্তৃতি।
২০২০সালে এরা এক গ্লোবাল ট্রি অ্যাসেসমেন্ট করবে, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত গাছের
অবস্থান সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা পাওয়া যাবে। এই গ্রুপে ৮০জন সদস্য আছেন, যাঁদের
মধ্যে বটানিক গার্ডেনস, হার্বারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী
সংস্থার বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন।
ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করা যেতে পারে -
চেয়ারপার্সন – ডঃ সারা ওল্ডফিল্ড, বটানিক
গার্ডেনস কনসারভেসন ইন্টারন্যাশনাল
ভাইস চেয়ারম্যান – ডঃ অ্যাড্রিয়ান নিউটন,
বোরনমাউথ ইউনিভারসিটি
সেক্রেটারি – ম্যালিন রিভারস
একটা সরু দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটেছেন কখনও? সাহস নেই তো?
বা যদিও কেউ হেঁটেও থাকেন ব্যালেন্স করে, সে তো কিছুক্ষণের জন্যই। কতক্ষণ একটা
লাঠি হাতে নিয়ে একবার এদিক, একবার ওদিক টাল খেয়ে খেয়ে হাঁটতে পারবেন আর! ঠিক পড়ে
যাবেন ক্লান্তিতে। ঠিক এই রকম একটা সরু দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছি আমরা সবাই। অথচ বুঝতে
পারছি না কিছুতেই। ভাবছি, আমাদের পায়ের তলার শক্ত জমি আমাদের টলাতে পারবে না
কিছুতেই। আজ পৃথিবীর গভীর সংকট। ক্ষমতার দর্পে আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না সেটা।
আমাদের হাতের লাঠিটা পড়ে গেলে বোধহয় বুঝব, কিন্তু তখন আর পড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর
কিছু করার থাকবে না। হুঁশ ফিরিয়ে আনো হে মন! আর মানুষ হও। গাছকে আঁকড়ে ধর, সবুজে সবুজে
ভরিয়ে দাও তোমার পৃথিবী। বুক ভরে শ্বাস নাও তুমি ও তোমরা। গাছ বাঁচলেই তুমি
বাঁচবে, মাথায় রেখ!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন