কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

১৫ রাজর্ষি কুন্ডু

নিজের কথা
রাজর্ষি কুন্ডু



মা চোখের দৃশ্যগুলোকে এলোপাথাড়ি ভাবে কেটে দাও না; আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? না তো! যা হোক করে জুড়ে নিয়ে শিখে নেব উন্মাদ হবার পাঠক্রমের খতমপ্রণালী। আসলে আমার অতি ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই, যে সব ভাষার আবর্তের মাঝে ঢুকে শব্দগুলো এই পরিসর বানায়, তার চেতনার নির্যাস চারিয়ে দিয়েছি এই সবুজের গোড়ায়-কাদায়-জলে। তবুও এখানে কাম-লালসার অজুহাতে কোনো অজ্ঞাত কালমধুমাসে সন্তানেরাই দেখতে চাইছে মাতৃযোনি, মায়েরে কর্ষণ করে সন্তানেরা করে চলেছে সন্তানের উৎপাদন। এই অকাম, কামুক হয়ে বীতকাম হবার চক্রে সবাই ফিরতে চাইছে মাতৃজঠরে। যদিও, এ আর এমন নতুন কী, তবুও আমায় মিশিয়ে নাও মা, করে তোলো কোনো বীর্যমহলের দায়িত্বে থাকা কৃষকের আত্মমগ্নতার ফলায় প্রতিফলিত কোনো নিরাকার শিশুর ধারণার সম্ভাবনায়, যেখানে অঘ্রাণ শেষে কৃষকের মুখের হাসির অলক্ষ্য হয়ে দৃশ্য হতে চাই কত শত মরে যাওয়া আপাত অস্তিত্বহীন প্রতিনিধিদের ধারণা বুকে রাখা ফসলের দলের মাটিতে মিশে যাওয়ার অপেক্ষায়।

তিনি যে সাঙ্ঘাতিক ভাবুক বা এরকম গোছের কিছু তা নয়, তবে তিনি দেখতেন দৃশ্যগুলোকে, আর দৃশ্যগুলো নির্মাণের ভাষার দৃশ্যের ওপর বসে আছেন ভেবে আমোদ পেতেন। মুখের অঙ্গভঙ্গিতে অবশ্য তা বোঝা যেত না। কোনো কিছু হওয়া-হওয়ি নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনো আসক্তি ছিলো না। মাঝে মাঝে অন্যদের ভাবনায় ঢুকে নিজেকে উয়োর্ষ্ট কেসে রান করা অ্যালগোরিদিম ভাবতেন, আর কোনো কিছু হওয়ার মাঝে যেসব না হওয়াগুলো যুগপৎ হাজির, তাদের অসম্ভাবনার প্রত্যক্ষতাই তাঁকে ফেলে দিত এন সংখ্যক প্রব্লেমের জীবনে। যাদের প্রস্তাবিত অন্ধকার পথগুলোও কখনও কুপির আলোর বৃত্তের গা ঘেঁষে, কিম্বা টর্চের আলোর আল ধরে আরাম-সে পার করে দিতেন, আর চলার মাঝে বিড়ি ধরানোর স্টাইলে যে না হওয়ার সম্ভাবনাগুলো বিপত্তির কারণ, তার দৃশ্য থেকে বিপত্তিগুলো সরিয়ে দৃশ্যের ভাষাগুলো দেখার চেষ্টা করতেন। দেখতেন সুবিশাল ফাঁকা জমি, তাতে আঁকা ননডিটারমিনিস্টিক্যাল আলপথ, যার ওপর দিয়ে সামনের দৃশ্যময়তার সীমা শেষে মিলিয়ে গ্যাছে তাঁর পূর্ব পুরুষের দার্শনিক অস্তিত্ব, তিনি অনুসরণ করে চলেছেন সেই অমোঘ অনুক্রমের কল্পনাকে। নিভে যাওয়া বিড়ি জ্বালানোর মুহূর্তে হাসাহাসি করতেন নিজের অসাবধানতাকে নিয়ে, পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের শেষে সেঁদিয়ে যেতেন নিজের ভবিষ্যতের অজ্ঞাতবাসে। কোনো অতিসচেতন বোঝার চেষ্টার লিনিয়ারিটির অন্তে খাড়া করতেন নিজেকে, চেতনায় সদ্যদৃশ্যমান অতিকায় অধিবৃত্তের কিনারায় অদৃশ্য হবেন বলে।

রোদ তাঁকে স্পর্শ করে না, কিম্বা প্রেম-বিরক্তির অজায়গায় তিনি দিব্যি বৃষ্টিতে ভিজে চলেন, তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটেন একথাও বিশ্বাস হয় না, একপ্রকার চিন্তার ন্যায় রাস্তার বর্ননা, শহর, কাক, কুকুর সময়ের মতোন স্থির তাঁর ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, বিষণ্নতার বাইরের বিপন্নতার অভিজ্ঞান বহনই তাঁর হাঁটাচলার আপাত আপেক্ষিক নিরিখ, বস্তুর সাথে বস্তুর ক্রিয়াচিত্রণের বিপ্রতীপ অবস্থান কিম্বা তাদের সমান্তরালের অন্ত্যমিলের মতো কোনো জ্যামিতিক কৌশল নয়, ইহা আদতেই মেঠোবাস্তব, অস্তিত্বের ক্রমবিকাশি প্রজননই আসলে তাঁর খানিক প্রমাণ। চোখ থেকে দৃশ্যের অকেলাসিত চিনির দানাগুলো এক চা-চামচে তুলে নিয়েছেন আয়ত্তের স্বপ্রযুক্তিতে, মিশিয়ে দিয়েছেন এই তটহীন জলসীমার অপদৃশ্যে।

মাঝে মাঝে তাঁর গোল্ডফ্লেক খেতে ইচ্ছে করতো, তাঁর বাবা গোল্ডফ্লেক খান, এটুকু কোলিনিয়ারিটি বাদ দিলে তিনি নিজেই প্রচন্ড নিখুঁত ভাবে হাসতে থাকেন নিজেতে নিজের বাপ আর বাকি নিজেকে দেখে। আর যাই হোক এসব দেখে যোগফল সংক্রান্ত প্রাচীন জ্যামিতির ওপর তাঁর বিশ্বাস উঠে গ্যাছে, এই তাঁর সাথে বাপের ওভারল্যাপিং, উদ্বৃত্ত তিনি ইত্যাদি লঘু প্যারামিটারের বাইরে বহিঃস্থ যে তিনি গোল্ডফ্লেক জ্বালানোর খন্ড খন্ড মুহূর্তগুলো দেখতে পাচ্ছেন তাদের অবস্থানই যোগফল সম্পর্কিত সব উপপাদ্যের সম্পৃক্ততাকে অপ্রমাণিত করে বলে বিশ্বাস করেন। আত্মোন্বেষণ কিম্বা অন্যান্য জারণের শেষে তৈরি হয়েছে এই একরকম কৃৎকৌশল, আর মৌলসত্ত্বার অঞ্চলে গড়ে উঠেছে পান্থনিবাস-মদের কারখানা, তাদের চারপাশে এলোপাথারি গাছ হয়ে এক ব্যাখ্যাশক্তিহীন পদ্ধতিতে সময় খাচ্ছে কবিতার অংশরা, যেগুলো অংশত ভগ্ন, আপনাজ্ঞতার বিরুদ্ধে সংশ্লেষজাত মৌলবিশেষ, যেমন তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক আছে, বিরক্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক, জানি না, শুনিনি, দেখি না, খিস্তির ন্যায় সহজ অভিঘাতমূলক, এমনই সব জোড়া লাগানো এক্সিয়মের মতোন, সম্পর্কের ভাষা স্থানীয়। এরকম মানে একপ্রকার অগাণিতিক বাক্যের মধ্যের পরিভাষার গণিত খুঁজছেন তিনি, খুব সকালের বৈখরীতে আমাদের নিমশহরের রাস্তার বর্ণনার ওপর দিয়ে আমার সাথে হাঁটছেন, কাক-কাগজওলার-সাইকেল কিম্বা সবুজোত্তর প্রায় ফসলের ঝাঁকার সাথে, সাইমালটেনিয়াসলি। চেনা দোকানের বন্ধ থাকার চেনা দৃশ্য, চেনা লোকেদের শুরু হওয়া ব্যস্ততা ইত্যাদি চেনা স্রোতের মতো ছবিগুলোকে সমগ্রতে ঢুকিয়ে অ থেকে বিয়োগ করে একপ্রকার উত্তরণের কল্পনা যে নিজের অজান্তেই করছি, সেটা তিনি বলেছেন আমায়। দেখছি যে স্মৃতির ক্রমবিস্তার বিষয়ী পরিমিতি বোধগুলো নিজেই নিজের কাছে সুইচ অফ হয়ে বসে আছে! সত্যি বলতে কি এসবে কোনো স্নেহ ভালোবাসা নেই, বরং যে অপরিমিতি বোধের ওপর চলছে হেন প্রকরণের মেলা, তার ধারণার অখন্ডতার কাছেই এবাদত, আমার,শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোন।

কার্য-কারণ-ব্যাখ্যার মনোলগে অজবরদস্ত শব্দের মাঝের ফোকরগুলোয় আটকে আছি, অঘটিত সম্ভাবনার বীজগুলোতে, এদের গাঁথছি মাটির দেওয়ালে-খামারে, তাদের শোভাবর্ধন কৌশল এঁহেশ্বাসের আগের পরিসরে ঘুরে বেড়াচ্ছি কল্পিত মাংসকাঠের চিন্তায় চড়ে, একপ্রকার অপলাপ দূর করবার অবহেলায় দৃশ্যগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, যাই হোক আর কি, নিজের বলা শব্দের মধ্যে অনাবিষ্কৃত জমির সন্ধান পাচ্ছি এরকমে, মাটি বা মনন কি নিষ্ফলা হয়! এক নিশ্চিত ভ্রমের শেষে চলেছি অনাবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে, জলের সন্ধানে। আপাতত এরকম উত্তরণের দৃশ্যে ভ্রমই একমাত্র শুদ্ধ গণিত, এক নিখুঁত জ্যামিতি।

আরে রাজর্ষি নাকি! আত্মমগ্নতাতেই বসিয়ে রেখেছো নাকি নিজেকে, নাকি নিজের বসে থাকাতেই নামিয়ে নিয়ে এসেছ আত্মমগ্নতাকে, গদ্যালাপের যাবতীয় আকার-ঈঙ্গিতগুলোকে ফেলে রেখেছো সময়ের রৌদ্রে! অনুধ্যানের জন্যে প্রাপ্ত শব্দগুলোয় প্রত্যক্ষ করছো তো পার্থক্যের নিয়মিত সন্ততাগুলোকে? ছায়ার অপর আরেক প্রকার ছায়ার মতোন গজিয়ে উঠেছো দেখছি, এই রক্ত-মাংস-রোদে পোড়া রঙ মেখে। মরচে পড়া ইস্পাতের মতো একটা ইগনোরের স্পেসে টানতে চাইছো নিজেকে, আবার বিস্তৃত ভাবছো এই-ঐ নিয়ে, ভাবনার সংশ্লেষ ঘেঁটে বের করছো ইগনোর করার পদ্ধতির সচেতনতাকে, তাই কী? নাকি তালে আছ প্রমাণ করবার অতীতের কিছু অদেহজ চিন্তার আনডিসাইডিবিলিটিকে, সেগুলো থেকে ভবিষ্যত চিন্তার খসড়ার গন্ধ পাচ্ছো নাকি, তার বিষয়নিষ্ঠা থেকে চুষতে চাইছো অভিজ্ঞতার রং-বেরঙিন বিভূতি? চেনা শব্দের চিন্তার ভেতর জমে থাকা সময়ের তৈরি পরিসরে হাঁটতে চাইছো নাকি অচেনা পাহাড়ি রাস্তায়!

না তো, কই? হতেও পারে তবে। এই আর কি, মানে এটাই যে, সেটাই তো ইত্যাদি কনফিউজিংবোধক শব্দের অসম্ভবনাগুলোর ভেতর যে নিশ্চিন্তি ভাব আছে, তার ওপর বসে থাকছি। তাড়া নেই তো কোনো, এই বিড়িফিড়ি জ্বালাচ্ছি, যেগুলোকে মনে হচ্ছে তার বিপরীত উপাদানগুলোর ডিসাইডিবিলিটিগুলোকে জাপটে ধরেছি, এই সব অপ্রমাণের রাস্তার দৃশ্য-গাছ-মানুষ টুকে রাখছি নোটবুকে। আনন্দ-বিষাদ-রাগ নেই এমন এক শূণ্যতার আগের সাধারণ সমীকরণগুলো এক এক করে লিখছি,

রজ্জু = সাপ, (যদি) ভ্রম ডাস নট এক্সিস্ট

রজ্জু! = সাপ, (যদি) ভ্রম ডাস এক্সিস্ট

আপাতত কিছু শব্দ পুনরায় আবিষ্কারের তালে আছি, নিজের প্রতি ব্যবহৃত অক্ষম সর্বণামগুলোকে কল্পনা করছি, ভ্রমোত্তীর্ণ হয়ে ঢুকে পড়ছি আতংকের অন্দরমহলে, চোখে এখন চাপ চাপ অস্তিত্বের অসম্ভবনা, গন্তব্য অন্তের অজ্ঞতাবাসে পাশাপাশি শুয়ে আছে সাপ, রজ্জু, ভ্রম, অন্ধকার। নির্মাণের যাবতীয় শব্দ, বিক্ষুব্ধ শব্দ, প্রতিশব্দের যজমানত্ব জায়েজের কূটমেধামাধুরিখন্ডনে জন্মাচ্ছে মনোতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষিত রূপমুর্শিদ, বিভিন্ন কৌশলে অখন্ড এক আমি হয়ে।

নিজেতে মেলার যাবতীয় প্রক্রিয়া-ক্রিয়ায় চালু আছি একপ্রকার, এক স্ব-উদ্ভাসিত প্রযুক্তি যেন! চলছি তো, মনে তো হচ্ছে তাই, তাই আশেপাশের লোকজন দেখছে দেখছি। হয়েছে কী, নিজের পা-গুলোকে আমার মোটেই পছন্দ নয়, হাতের পুরনো কলাকৈবল্য-কৌশলে দেখছি ধূলো পড়েছে, একপ্রকার নিজের চিন্তার বাইরে বসে আছি, ফলত, এখন আর ঘুমোতে ভালো লাগে না, পড়তে ভালো লাগে না, যৌনতা ভালো লাগে না -- ইত্যাদি ইচ্ছেগুলোকে মনে হচ্ছে গাছ-পাহাড়-আকাশের ল্যাণ্ডস্কেপ মার্কা দৃশ্যের মতো কৃত্রিম আঘ্রাণমালা। পারদ উঠে যাওয়া আয়নার ভেতর দিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে যাওয়া জড়দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখছি ছাদে বৃষ্টিবিরতি, রোদে শুকোচ্ছে যৌনস্নায়ুগুলো। স্তরপর্যবেক্ষণবিদদের মতে, জীবন ভেঙে গ্যাছে চূড়ান্ত সরলতম দুটো পর্যায়ে, তারা শুয়ে আছে পাশাপাশি, অত্যন্ত মায়ায় জড়াজড়ি করে, তাদের ভেতর ওভারল্যাপিত অংশ দাবি করছে, তারাই আদতে জীবন। কেউ অবজেকশান করছে ‘বন্ধ হোক এ মিলমিশ’, ঘোষণা করতে চাইছে ‘এরা একই আদমি’ বলে, এরকম বৃত্তবর্ণনার ইতিহাসের কোনো জায়গা থেকে ছিটকে আসা স্পর্শকোণ বরাবর একপ্রকার বাসি রজনীগন্ধার বাস, ধূপকাঠির ধোঁয়া বা অগুরুর উপস্থিতি অনভ্যস্ত কান্না চিড়ে কিছু ছিমছাম শোকপ্রস্তাব দিচ্ছে বটে, তবে হ্যাঁ, নিজের মৃত্যুর জন্যে আলাদা কোনো শোক নেই।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন