কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

০৬ রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাগৈতিহাসিক প্রতীক্ষা



আমি নৈঃশব্দ্যের নিরাময় নিয়ে খানিকটা তোলপাড়। সময়ের তরঙ্গ মুছে অন্তরঙ্গ হতে চাইছি একলার সঙ্গে। চাইতে গিয়ে দেখি অলিরহিত জীবন থেকেও কীভাবে ফোঁটা ফোঁটা মৌ। নিঝুম দুপুরের গায়ে গুঞ্জন নামাচ্ছে। কিছুটা জলজ। কিছুটা গহন। পর্যাপ্ত আলো পেলেই জলমর্মর উঠবে বুকের ভেতর। নিঃশব্দে জেগে উঠবে শব্দনির্ঝর। নতজানু খেরোখাতা অপেক্ষায় থাকে।

আমি নৈঃশব্দ্যের মৌন চরিত্র নিয়ে ক্রমাগত যাতায়াত করি বিশেষ্য থেকে বিশেষণে। কখনো বা বিশেষণ থেকে বিশেষ্যে। মূক থেকে মুখরের দূরত্ব মাপি আলোকবর্ষ স্কেলে। নিভে যাওয়া নক্ষত্রমণ্ডল থেকে কে যেন ডেকে ওঠে। মনে পড়ে বিহানবেলা। পরীপা। মায়াকানন। মনে পড়ে উচ্ছল প্রহরের পিঠে আলতো আঙুল রাখা। হাওয়ায় এঁকে রাখা হরিণচোখ। কাজলায়িত বিভ্রম। এখন তাদের সবার গায়ে সেঁটে রাখি অলীক বিশেষণ। ফলত খেরোখাতার অপেক্ষা শেষ হয় না।

আমি এক নিভৃত দরজা দেখেছি অতীতের চিলেকোঠা থেকে বর্তমানের কার্নিশ পর্যন্ত। পিছনের পাল্লা খুললেই এক একটা বসন্তকে অঢেল হতে হতে পেরিয়ে যেতে দেখি দাঁড়ি কমা। ছেঁড়াপালে তার ঘূর্ণির ঘোর। চুমুর রহস্য লিখছে নিদারুণ কালবেলা। আমি দাহ সম্পর্কিত সংস্কারগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। দহনের নিমিত্ত জড়ো করে তুলি আকাঙ্ক্ষার মাত্রাগুলো। সংগ্রহে রাখি আসন্ন বার্তার জলীয় সংবাদ। নিদাঘী আকাশ তখনো জল পোড়ায়। আমি কার্নিশে ফিরে এসে হৃদয়কে বিনিময় করে নিই অলখ শব্দবন্ধে। বীক্ষণে রাখি প্রতিটা ক্ষণ। প্রত্যয়ী মুহূর্তগুলো জড়ো হয়ে আসে বুকের কাছে। খেরোখাতা অপেক্ষায় থাকে।

আমি মেঘেদের নিঃশব্দ গর্ভসঞ্চার দেখে কিছুটা আবেগে কিছুটা মোহে গ্রস্ত হই। জমাট জয়ন্তী শুনি পরতে পরতে। জলজ ভাস্কর্যের নিবিষ্ট ধ্যান। যেন কোনো নিঃসঙ্গ সত্যকে আরবার বলবার এই-ই পথ। এই-ই পাথেয়। ঊষর মৃত্তিকাগড়ানো কান্নায় দেখি নত হয়ে আসে তার গর্ভিত চলন। তারপর শুধু বৃষ্টি। রিম ও ঝিম মিশিয়ে দেদার হতে থাকে তুমুল হতে থাকে। মরিয়া হয়ে ওঠা পায়ের তলার মাটি নরম হতে হতে নহবতে বসে। আমি যেমন খুশি রূপ থেকে রূপকে যেতে থাকি। পিছনে দুলতে থাকে অরূপের অনালোকিত রূপ। এমন অনায়াস এমন অনাহত যেন দৈনন্দিনের হাটে ওই রূপটুকুই মূলধন। রূপের হাটে ধন মানে না জন। তাই ফাঁদ। ধরাধরি। লুকোচুরি। রাতরহস্য নিজেকে সমর্পণ করে নির্জন প্রলাপে। আবছায়া ঘোমটায় পাখিডাক। আড়াল ডেকে ডেকে মাতলানো ঠোঁট নিমেষ হারায় নিভাঁজ ভালোবাসায়। খেরোখাতার মার্জিনে আলতো মায়া অপেক্ষায় থাকে।

আমি ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে কিছুটা বিব্রত। মদির রাতভাষা ন্যুব্জ হয়ে এলে ক্লান্তচরণ সদর খোঁজে। আর আমি ভাবি তার আরণ্যক জন্মকথা। কীভাবে বিপন্ন হয় জনারণ্যে। কীভাবে হস্তান্তরিত হয়ে যায় জেহাদি অঙ্গনে। আমার শীতার্ত আঙুলে যেটুকু রোদকাহিনী আজও তোমার কথা বলে, তাদের বিছিয়ে রাখি নেহাইতে। উল্টে পাল্টে সেঁকতে থাকি ফাংগাসমুক্ত রাখতে। খানিকটা দায়মুক্তও। এভাবেই বেলার দাবি মেটাতে গিয়ে দেখি কখন অবেলা একান্তে ডেকে নিয়েছে অকালের ঝরাপাতা। নিহত হরিতে অসহ্য অবসাদ। দু’এক ফোঁটা গ্লানিও। হিমকুড়োনো বেলায় এইভাবেই শীতযাপন। লেনদেনে বেঁধে রাখা মণিবন্ধে এভাবেই শীতল রক্তস্রোত। খেরোখাতা তখনো অপেক্ষায় থাকে উষ্ণ ঝর্ণার তীব্র প্রপাতের।

আমি কাল ও অকালের মাঝে খানিকটা স্পেস দাবি করি। মহাকালের দামামা বাজে মৃত্যুতোরণে -- কালের কাছে তোমার কোনো ন্যায্য স্বত্ব নেই; গর্ভে তোমার বীজরোপণের মন্ত্র নেই; কেবলই অর্থের হাটে অনর্থের বিকিকিনি। তাই সময়কে পিছনে ফেলে বেরিয়ে পড়ি। ইরাটিক ইরেজারে মুছতে মুছতে চলি অতীতের চলন, বর্তমানের বলন আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আগমনীগুলো। অনন্তের হাটে বাসা বাঁধে এক অচিন পাখি। ভাঙা স্বপ্নে রং দেয় ডানা বসায়। রঙের ভেতর আমি লাল সবুজ বাদ দিই। আঙুলে লেগে যায় গাঢ় কালকূট রং। তীব্র হলাহলে ক্রমশ নীল হয়ে আসে সমস্ত শরীর। হৃদি উপচে কয়েক ফোঁটা গরল গড়িয়ে পড়ে নরম মাটিতে। রোপিত হয় বিষবৃক্ষ। সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি থেমে যায়। মৃদু বাঁশরি বাজে গহনে কোথাও। আমি হাতড়ে বেড়াই দিগনির্ণয়ের প্রথাসকল। ধূসর খেরোখাতা তখনো রঙের অপেক্ষায়।



আমি দিক বা বিদিক নিয়ে এখনও কিছুটা স্বেচ্ছাচারে। তোমার ওই তির্যক ভঙ্গি ক্ষয়া চাহনি আর চলনের চোরাবাঁকগুলো আজ বড় রহস্যহীন লাগে। অথচ দিকের প্রতিকূলেই সূর্যসম্ভব অপেক্ষায় ছিল। বিদিকের অনিশ্চিত বাঁকে অপেক্ষায় ছিল এক অ-সুখ বিস্ফোরণ। আমি কূলের এপারে দাঁড়িয়ে দেখেছি প্রতিশ্রুতি রঙের বোঁটায় কীভাবে সাদারাও নীল হয়ে ওঠে। প্রতিকূলের ওপারে রচিত হতে থাকে এক নাটকীয় ক্যানভাস। দ্রোহের আগে অভিমানী মুখ। বিদ্রোহের পরে বিপদসংকেত। লাল ও সবুজের উদ্দাম যৌথতা। আমি নিঃশব্দে পেরিয়ে যাই মিথ্যে আঙুলের মিথ। খেরোখাতা রয়ে যায় সত্যের অপেক্ষায়।

আমি কোনো গোপন রাতনকশায় তোমার করতল রেখা উচ্চারণ করিনি। বিদ্রোহী বিষবৃক্ষের মলাটে এমন শূন্য প্রচ্ছদ এঁকেছি, এমন শূন্যমাফিক রং, যেন গতকালের রং দাও রং দাও বলে সমস্ত উচ্চারণ আজ অলীক হতে পারে। যেন স্বপ্নের রং থেকে রঙের স্বপ্ন পর্যন্ত জেগে থাকে এক দুরূহ দ্বন্দ্ব। আমাদের নির্মিত কথামালাবৃত্তে দ্বন্দ্ব গড়াতে থাকে। গড়াতে গড়াতে পাঁজরের একোণে ওকোণে লয় ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে অন্ধবিন্দুতে জেগে ওঠে নিস্পৃহ বৃক্ষুর সারি। সম্ভাব্য বৃত্তের স্পর্শকরেখাগুলি যত্নে মুছে রাখি। ঘরে ফেরার বৃত্ত তাই স্পর্শকাতর তন্দ্রা ছেড়ে মুহূর্তে পরিযায়ী। খেরোখাতা তখনো দিগন্ত থেকে ঘরফেরা অপেক্ষায়।

আমি ছড়ানো ডানায় এঁকে রাখি এক সর্বংসহা মোহ। আলতো পায়ের নিচে মুগ্ধ বালুচর। ভেজা চোখের আগে উদাসীন ঢেউ। আর ব্যথানীল ঠোঁটে সাজিয়ে তুলি সাগরীয় চুয়া চন্দন। গহিনে কোথাও চোরাস্রোত। নিঃশব্দে ভেঙে ভেঙে যায় তার বাদী ও বিবাদী সব ঢেউ। গোপন বালুচরে রেখে যায় তার তরঙ্গচিহ্ন। সে চিহ্নে বাজে না কোনো রাই। বাজে না তার অলক্তরাগ। ভালোবাসার আয়নারহস্য আমি চিনি। তাই ঘসে ঘসে মুছে রাখি পারদপ্রলেপ। আরোপিত মুখে তখনো কিছুটা কামিনীসুলভ দাগ। মুখর হয়ে ওঠার আগেই আমি অ-দৃশ্যে ফিরতে থাকি। দৃশ্যে শুধু জেগে থাকে কৌণিক ঠোঁটের ব্যর্থ প্রয়াস। আঙুলে লেগে থাকে ফেলে আসা মনখারাপের হলুদ রেশ। ফলত খেরোখাতার অপেক্ষা ধূসর হতে হতে ক্রমশ প্রাগৈতিহাসিক হয়ে ওঠে।






2 কমেন্টস্:

  1. গদ্যভাষার ঋজুতা নেই । এটি কিন্তু সুররিয়াল গদ্যকবিতা হয়েছে রুণা। ভাল লিখেছিস।

    উত্তরমুছুন
  2. ভালোবাসার আয়নারহস্য !
    প্রতীক্ষা রইলো
    খেরোখাতার
    নতুন পাতার !!

    উত্তরমুছুন