কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তপনকর ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


গর্ত

একাধিক অসংগতি। সপ্রতিভ ও দীর্ঘ, অর্থপূর্ণ অথচ দুর্বোধ্য। পদে পদে ধাক্কা খেয়ে চলা মানুষের মধ্যে আপনারা আমাকে খুঁজে পাবেন। আমার সবকিছুতেই অসংগতি, যা আপনাদের চোখে অদ্ভুত এবং দুঃখজনক। না, সেকথা আপনারা কখনো গোপন করেননি। আবার সোচ্চারও হননি। শুধু বুঝিয়ে দিয়েছেন। আপনাদের শীতল নীরবতা আর উপেক্ষা দিয়ে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তোমার বাপু বেঁচে থেকে কী লাভ! আমার জীবনে স্মরণীয় কিছুই ঘটেনি। হ্যাঁ, আপনাদের অনেক কিছু বা আপনাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বহু স্মরণীয়,  তার মধ্যে বেশকিছু বরণীয়, এসব তো আছেই, কিন্তু আমাকে দেখুন, খাটান দিতে দিতে এতদূর। আমার বাবাও খাটান দিত। কাকা, জ্যাঠা, কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাই, সবাই এইসব পেশায়। অবশ্য যদি এগুলো পেশা বলতে রাজি থাকেন।

বাবার বাবা,মানে আমার ঠাকুরদার খাটান ছিল অন্যের হয়ে জেল খাটা। এক মাড়োয়াড়ির গদিতে তিনি সামান্য বেতনে, অথচ অসুখ বিসুখ, নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারের হাঁ মুখে যা হোক কিছু গুঁজে দেবার অদম্য তাড়নায় ক্যাশ থেকে সা মান্য, অতি সামান্য কয়েকটা টাকা, আরে ওই টাকায় মুড়ি বাতাসার বদলে রাতের খাবারে গরম গরম ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ, গোগ্রাসে সবার মতো বাবাও, বাবার মুখেই শোনা —  খাবারের সে এক অমৃতের স্বাদ — সেই রাতে,যা না কি  মুখে লেগেছিল অনেকদিন।

ঠাকুরদার চাকরি নট,যথাবিধি। সেই সময়ে,হন্যে হয়ে  কিছু একটা খুঁজে বেড়ানোর কালখন্ডে, রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের ষাট পাওয়ারের আলোর নিচের অন্ধকারের সঙ্গে তাঁর  একদিন দেখা হল। টুকটাক, ছুটকো ছাটকা, ছিঁচকে কাজ,গোপনীয়তা বজায় রেখে,কারণ তখনো তিনি ভদ্দরলোক আপনাদের মতই, সেই সময়ে খাটানের অফার। পরিবারের দেখভালের আশ্বাসের বিনিময়ে একজনের হয়ে জেল খাটতে হবে। তখন যাবজ্জীবন চোদ্দ বছর, আট বছরের মাথায় সশ্রম কারাদণ্ডের চাপ সইতে না পেরে পঞ্চাশের  আগেই তাঁর  চিরবিদায়। ম্যাট্রিক পাশ, গানের সমঝদার তা আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের,

ভদ্র সভ্য সেই মানুষটার খাটান দেওয়াকে আমার বাবা পেশায় নিয়ে আসতেই ফ্যামিলির গেট আপ, সেট আপ, সব চেঞ্জ।

বাবা সত্তরের নকশাল, একাত্তরে নব কংগ্রেস। বাহাত্তরে মিসা আইনে জেলে পাঁচবছর। সরকার কংগ্রেসের, বাবাও কংগ্রেস, কিন্তু হাতে রক্ত,তখন রক্ত অনেকের হাতে, তাদের মধ্যে সেই অনেকের সঙ্গে বাবা জেল খেটে বাইরে এসে দেখল জমানা বদলে গেছে। সি পি এম বাবাকে যে নেবে না, সেই বুদ্ধি তাঁর ছিল। বামফ্রন্টের শরিক ফরোয়ার্ড ব্লকে গুটিগুটি পায়ে বাবা, ততদিনে পাইপগান, ভোজালির যুগ শেষ হব হব, বাবা পিস্তলে।বাবার মাথায় বন্দর এলাকার এক মুসলিম মন্ত্রীর হাত।

ওই এলাকায় টাকা উড়ছিল। আগেও উড়ত। বদলে যাওয়া সময়ে তার দখলদারিতে কয়েকজন অনুগত ক্যাডারের সঙ্গে বাবা। টাকা ও সম্পদে আমরা ফুলে ফেঁপে বড়লোক।

ততদিনে বাবা নির্দেশ দেওয়ার পজিশনে।রক্ত মাখার অনেক ক্যাডার সেই নির্দেশ পালনে তৈরি। তারই মধ্যে, সেই নিশ্চিন্ত সুখের সময়ে হিসেবের গোলমালে সেম সাইড। সাত সকালের মর্নিং ওয়াকে বাবার কপালে দানা ভরে দিল দলেরই অপোনেন্ট লবি।

খাটান দেওয়ার পক্ষে আমি তখন নেহাতই নাবাল। ফলে অপেক্ষা, কিন্ত বয়সোচিত খুচখাচ যেটুকু তাতেই জাত চেনাতে পেরেছিলাম।

আমি কিন্তু বাপ ঠাকুরদার গল্প শোনাতে বসিনি। যেটুকু ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড না বললেই নয়, তার বেশি, ফালতু বকবকানি ভাল্লাগে না।

তো যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই।অসংগতি!

এত শক্ত শক্ত কথা কিন্তু আমার নয়। আমি বলে যাচ্ছি আমার মতো করে, আর একজন সেই কথাগুলো দাঁতভাঙা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করছেন। (তিনি লিখে আমাকে বললেন, এভাবেই এইসব লিখতে হয়। আমি যখন বলছিলাম, মাঝে মাঝেই খিস্তি বেরোচ্ছিল, তিনি যত্ন করে তা বাদ দিয়েছেন এবং আমার অনুমতি নিয়ে)।

জীবনে এমন কিছু খোদল আছে, তার মধ্যে ঢুকে পড়লে, আর ফিরে আসা যায় না। ফলে সামনে এগোনোর রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যায়।যতই খারাপ হোক, হারামিগিরি (শব্দটা বদলাননি) করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। সেটাকে গ্রহণ করতেই হয়। এভাবেই আমরা বাঁচি।

প্রথম যে মেয়েটার সঙ্গে শুয়েছিলাম,বেশ শিক্ষিত। ইংরেজি ফাটাচ্ছিল। টাকা নিয়ে চলে যাবার সময় বলেছিল, আমি কিন্তু গ্রাজুয়েট। মাথায় আগুন জ্বলে গেল। স্যারকে বললাম, ব্যবস্থা করে দিন। আমি গ্রাজুয়েট হব।

প্রথমে মাধ্যমিক। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক।শেষে বিএ পাশ। লোকজন সব ফিট হয়ে গেল। সময় লাগলো,কিন্ত হয় গেলো। দু’লাখ টাকা খরচা করে হাজার দুয়েক লোক খাইয়েছিলাম। দেদার রাম, হুইস্কি, কার্পণ্য করিনি।

এর মধ্যে কম মেয়ের সঙ্গে শুইনি,কিন্তু গ্রাজুয়েট মেয়েটার কথা মনে ছিল।ওকে বিছানায় তুলে, সমানে সমানে একটা সংগমের( আমার বলা শব্দটা লিখতে রাজি হল না) জেদ জেগেছিল। গল্পটা শেষ করব ওকে নিয়েই, এখন সেই অসংগতিতে ফিরে যাই।

ছোটবেলাটা হেভি ছিল।বাবার দুনম্বরি টাকায় একটা গাড়ি পর্যন্ত, চোদ্দ বছর বয়সেই আমার গাড়ি চালানো।লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়নি, তাই বাবার এরিয়ায়, সেটাও কম বড়ো ছিল না, পোর্ট এরিয়া মানে বিশাল এরিয়া, ট্রাফিক পুলিশ চিনত৷ অমুকের ছেলে, ধরা যাবে না। হুড়ুদ্দুম মস্তানি,চ্যালা চামুণ্ডার অভাব হল না, দু তিনটে ধাক্কা, একটা তো বড়সড়, কিন্তু আশ মিটিয়ে একটা কিছু করার ইচ্ছেটা তখন থেকেই। তিনবার মাধ্যমিক। শেষবার ফেল করে আর চেষ্টা  করিনি।

অবহেলার শিকার হওয়া  জিনিসটা যে কী, একজন মানুষকে দুমড়ে মুচড়ে কীভাবে শেষ করে দেয়, অবহেলিত মানুষ ছাড়া কেউ বুঝবে না। এর যন্ত্রণা যে ক্ষত তৈরি করে, তার নিরাময় অসম্ভব।

(প্রচুর গালাগাল দিয়ে কথাগুলো বলেছিলাম। সেগুলো এখানে নেই। এত ভালো ভালো কথা জীবনে বলিনি।) তাছাড়া আমাকে অবহেলা তো কেউ করেনি।

সবসময়ই আমি ফুল ফর্মে, বাবার সেমসাইড কেসটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, যে কোন অ্যাকশন, সে তোলাবাজি হোক আর পিটিয়ে ছাতু করে দেওয়া হোক, সাবধান না হলেও চলত,কিন্তু  কাউকে গুলি চালিয়ে শেষ করে দেওয়ার রাস্তায় কখনো ছিলাম না।

স্যারকেও দেখেছি, ওই রাস্তায় না হাঁটতে। তবে তোলার টাকা ভাগের দায়িত্ব ছিল আমার। কোটি কোটি টাকা, কয়েকশো লোকের মধ্যে তার বিলি বন্টন, সব ক্যাশে, তাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য ছ সাত জনের টিম। তাদের বেছে নেবার দায়িত্ব আমার। বুঝতেই পারছেন আমার পজিশন।

আমার পিছনে স্যার, স্যারের পিছনে দল আর দলের আড়ালে আমি। স্যার সেবার এম এল এ থেকে মন্ত্রী। আমাকে বলেছিলেন, সবসময় আড়ালে আবডালে থাকবি, সামনে এলেই পাবলিক ফিগার, তাতে বিপদ বেশি। তোর বাপের কেসটা মাথায় রাখবি। তাছাড়া খিস্তি বাদে তো একটা সেন্টেন্স শেষ করতে পারিস না। পাবলিক এ ব্যাপারে খুব সেন্সিটিভ। তোকে সামনে রাখলে আমার ইমেজের বারোটা। তখন দল কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না।

আমার আর সামনে আসা হল না। এই পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর। ছলচাতুরী, ভন্ডামি আর কপটাচারের হাত থেকে কারুর রেহাই নেই। (আমি বলেছিলাম, দুনিয়াটা ফেরেববাজে গমগম করছে। এটা তো খিস্তি ছিল না। তবু ব্যাটাচ্ছেলে বাদ দিয়ে ওপরের কথাগুলো লিখে দিল।) স্যারের সঙ্গে আমাদের কাউন্সিলরের বখরা নিয়ে গন্ডগোল প্রথম থেকেই। কাউন্সিলর বয়স্ক, প্রথম দিন থেকে দল করছে। স্যার সেই দিক থেকে পিওর নন। দো আঁশলা। ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন (লোকে বলে আমার বাবাকে উনিই গুলি করেছিলেন।) আমার সঙ্গে যোগাযোগ বাবার ছেলে হিসেবে। কাউন্সিলরের দাবি তিনিই স্যারকে দলে জায়গা করে দিয়েছেন। তোলাবাজির বখরা তার আরো বেশি হওয়া উচিত।

স্যার বলেছিলেন একটু করকে দিতে। সেইমত অন্য এরিয়ার দুটো ছেলেকে ফিট করলাম। একটা নাইন এম এম পিস্তল, দানা ছিল না, বুড়ো রোজ মর্নিংওয়াকে - বাইক থামিয়ে পিস্তল ধরে ভয় দেখানো, তারপর স্পিডে স্পট ছাড়ার কথা। যতই হোক, লোকাল কাউন্সিলর তো — আশপাশের লোকেরা পেছনের মালটাকে ঠিক ধরে নিয়েছিল।

কিচাইন বলে কিচাইন। ছেলেটা পুলিশের কাছে আমার নাম বলে দিতেই আড়াল থেকে আমি সামনে। কাগজে, টিভিতে আমার ছবি, স্যার বললেন লড়ে যা। তোর নেতা হবার সময় হয়ে গেছে।

থানায় সারেন্ডার করলাম। এক হাজার ছেলেকে দিয়ে থানা ঘেরাও। তারাই আমাকে বের করে আনল। স্যার বললেন, তুই এখন থেকে যুব নেতা - ওপর থেকে ঠিক করে দিয়েছে। সামনেই কাউন্সিলর ইলেকশন। ওই  বুড়োর জায়গায় তোর নমিনেশন পাকা।

ইলেকশনে আমি জিতে কাউন্সিলর। পদে পদে ধাক্কা খাওয়া মানুষদের মধ্যে আমি আর রইলাম না। শুরুতেই নিজের অসংগতি নিয়ে যে গম্ভীর কথা, এখন সেটা বেড়ে গেল। ক্ষমতা আর টাকা, এত টাকা, নিজেকে ঠিক রাখতে ভগবানই পারবে না, আমি তো সেখানে গান্ডু (এই শব্দটা চেঞ্জ করতে  নির্ঘাত ভুলে গেছে)। ইচ্ছে হলেই হাতে মাথা কাটতে পারি। দেখা করতে আসা মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করাতে পারি। দু তিন লাখ টাকা দিয়ে দুস্থ মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে জনসেবার আড়ালে দশলাখ টাকার কাটমানি, আমার ওয়ার্ডে যত উন্নয়ন (মানে পুরনো বাড়ি ভেঙে প্রমোটরদের স্বর্গ প্রাসাদ নির্মাণের আহ্বান, রাস্তা ভেঙে নতুন রাস্তা) তত আমার বখরা। আগের কাউন্সিলরও এই টাকা পেত, তবু তার চোখ ছিল স্যারের ইনকামের ভাগ বাঁটোয়ারায়। একে বুড়ো, দল চাইছে ইয়াং ব্লাড, তার উপর এত লোভ, হড়কে গেল। তাই তো স্যার পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, হড়বড় করবি না।

সমস্ত কিছুই চলমান। ভালোবাসা, জীবন, ন্যায় অন্যায়, সবই পরিবর্তনশীল। একই চেহারায়, এক জায়গায় তারা চিরকাল থাকে না। (এই কথাগুলো কেন, সে-ই জানে। আমি একথা বলতে যাবই বা কেন।) আরো ফালতু সব কথা। যেভাবে পেরেছে, গুঁজে দিয়েছে। যেমন, মানুষের কল্পনাশক্তি কমে আসছে। মনের সঙ্কীর্ণতা বাড়ছে। ধর্মীয় সহনশীলতা কমছে। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও কল্পনাশক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সময়ের গর্তের অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে। যারা একাধারে উদাসীন ও অনুতাপহীন, তারা স্বচ্ছন্দে দিন কাটায়। (এসবের  সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অথচ সে লিখে দিল।) লেখার মতো অনেক কিছুই ছিল, আছে এবং থাকবেও। হড়বড় করতে বারণ করে স্যার আমার বারোটা বাজিয়ে দিলেন। সব সময় মনে হচ্ছিল, পাঁচটা তো বছর, তার দু'বছর শেষ, সামনে তিনবছর। তারপর ফের ইলেকশন। দল যদি হেরে যায় (যার সম্ভাবনা খুবই কম), তবু বলা তো যায় না, রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ না বুঝলেও, এটা জানতাম, এবং শুনেছি, — রাজনীতি এক সম্ভাবনার খেলা। কথাটা মনে ধরেছিল, তাই যা করার, গুছিয়ে নেওয়ার জন্য এই তিনটে বছর বরাদ্দ আমার জন্য, এই সিদ্ধান্তে আমি, যখন কানের কাছে স্যারের পইপই করে বলা — হড়বড় করবি না — বেজেই চলেছে।

এর মধ্যে দুটো বিয়ে, একটাও টেকেনি।প্রথম বউ গায়ে আগুন দিয়ে ( বিরোধীদের সন্দেহ, আমিই আগুন লাগিয়েছি, ঝাঁট জ্বলে যায় এসব শুনে), পরের বউটা স্রেফ কেটে পড়েছিল। বিছানায় নারীশরীর (আমি বলেছিলাম মেয়েছেলের শরীর) ছাড়া ঘুম আসে না, স্যার জানতেন আমার থেকে কাজ পেতে হলে ওইটা দরকার। এ ব্যাপারে দরাজ ছিলেন তিনি। একটু গোপনীয়তা রক্ষা করে, একটু চুপিসারে — রেড লাইট এরিয়া তো আছেই  — অসুবিধে হয়নি, কিন্তু হল তো! শেষ পর্যন্ত ঝামেলাটা নিজের কোলে, বলা ভালো নিজের পশ্চাদ্দেশে ঢোকালাম।

জীবন এত গুরুত্ব দিয়ে ভাবার মতো কিছু নয়। ধরো যখন তুমি ছোট্টটি ছিলে, তোমাকে হাসানো কতই না সহজ ছিল। একটা ভঙ্গিমা বা একটা যে কোনো আওয়াজ অথবা ছলাকলাই  তোমাকে হাসানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বড়ো হতে না হতেই, জীবনকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করলে আর তোমার স্বাভাবিক আবেগের কাছে  আমসমর্পণ করলে। আত্মত্যাগ, ব্যর্থতা, দুঃখ,কষ্ট  এই শব্দগুলোর সঙ্গে তোমার প্রথম পরিচয় হল। তুমি কুঁড়ি থেকে ফুলে প্রস্ফুটিত হলে। রাগ, হিংসা, বিষাদ নিয়ে  তোমার বয়স বাড়ছিল। এর সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল তোমার আবেগ। এভাবেই হাসি তোমাকে ছেড়ে চলে গেল। সুখ এবং ভালোবাসা জীবনকে বিদায় জানালো। তুচ্ছ ও সামান্য বিষয়ে হাসতে ভুলে গেলে। এখন আর যা হোক কিছু বলে তোমাকে হাসানো সম্ভব হল না।

এরই মধ্যে কবে যে আস্ত শয়তান (এখানেও গান্ডু লিখতে বলেছিলাম) হয়ে গেলে তুমি জানতেই পারলে না। (শালা! এই কথাগুলো আমার  বলে চালালে গরুও হাসবে। মানুষকে এরা গাধা ভাবে না-কি?)।

একদিন সেই মেয়েটা! যে সাপ্লাই দিত, বলেছিল রেট বেশি। হাই প্রোফাইল। সেই গ্রাজুয়েট! দেখেই রোখ চেপে গেল। আমি এখন কে, কী আমার স্ট্যাটাস — এ তো কিছুই জানে না।

ভালো করে বুঝিয়ে ছাড়ব ভেবে শুরুতেই ডবল টাকা ছুড়ে দিলাম, কিন্ত নিল না। গুনে গুনে ওর যা রেট, টাকাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে বাকিটা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, আমি কি ভিখারি?

মাথায় আগুন চড়ে গিয়েছিল। সেই আগুনে সঙ্গে সেক্সের আগুনের গনগনে আঁচে আমার ঝলসে যাওয়ার দশা। প্রচুর আদর করেছিলাম। আর তারই মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার। মেয়েটা কাঠ হয়ে শুয়েছিল, অথচ যখনই আমার ঠোঁট তার গলা স্পর্শ করছিল, সে সাড়া দিচ্ছিল। নিরাবরণ শরীরের সবটুকু ছেড়ে আমার নজর মেয়েটির গলায়। ঠোঁটের বদলে হাত দিয়ে আদর করতে শুরু করলাম। সেই স্পর্শেও সে কাঁপছিল। মুখ থেকে গোঙানির শব্দ। সেটা বাড়ছিল। ছটফট করতে করতে এই গোঙানি, এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়, কিন্তু সঙ্গম না করেও মেয়েটা সুখের সাগরে, আমি দু'হাত দিয়ে ওর গলায় আদর করতেই থাকি।

একসময় মেয়েটা এলিয়ে পড়লে ঘোরের মধ্যে টের পেলাম আমার আঙুলগুলো এমনভাবে ওর গলায় এঁটে বসেছে, আমি সেগুলো আলগা করতে পারছি না। একটা চোখের মণি বেরিয়ে এসেছে, তার ফাঁকে রক্ত।

স্যার দারুণ সামলে দিলেন। সুরতহাল বা ময়নাতদন্তে খুনের গল্প নেই। কেউ কিছু বোঝার আগেই বডি চুল্লিতে ছাই। তার দু'দিন পরে পুলিশ আমাকে এ্যারেস্ট করল। যত রেড লাইট এরিয়া আছে, সেখানকার সব মেয়েরা, শহর ঝেঁটিয়ে মেয়েরা দলে দলে রাস্তায়। স্যার বলেছিলেন, এ্যারেস্ট না করলে তোকে পাবলিক পিটিয়ে মেরে ফেলবে। মাসখানেকের তো ব্যাপার। বেল পেয়ে যাবি।

তারপর তিনবছর কেটে গেল। আমার দল ভোটে জিতে ক্ষমতায়। স্যর ছোট মন্ত্রী থেকে বড়ো মন্ত্রী। বাইরে থাকলে এম এল এ হতে পারতাম।

লোয়ার কোর্টে রায় বেরোল। ফাঁসির আদেশ। এরপর হাইকোর্টে যাব। তারপর সুপ্রিম কোর্ট।

মরা মাগীটার সঙ্গে ওই ঘরে সারারাত। কী বলব মাইরি, কোন আওয়াজ নেই। সব শুনশান। খুটখাট শব্দ ছিল না তা নয়, কিন্তু সে শ্লা কখন যে মিলিয়ে গেল, শুধু আমার শ্বাসের শব্দ। মাথা কাজ করছিল না। হঠাৎ শ্বাসের শব্দটা বুক থেকে গলায়, হাঁপরের টান, হেভি কষ্ট হচ্ছিল। বডিটা গাড়িতে তুলে একটা নির্জন জায়গায় ফেলে আসলে ঝামেলা মিটে যেত। কিন্তু শালা ড্রাইভারকে ফোন করে যে ডাকব, কেমন ম্যাদা মেরে গেলাম। আমার বেলুন ফুটো, সেই ফুটো গলে সব সাহস ঝপাস। স্যার আমার দাদা, আমার বাবা —  তিনি রেখেছেন তাই আমি ছিলাম, তাকে যে ফোন করে বলব - কী বলব মাইরী, হেব্বি ভয় - ভয়ে মুচড়ে তেলাপোকার মতো ফরফর করছিলাম। মাগীটার মুখে চাদর ঢাকা দিয়ে  বিছানা থেকে নেমে চেয়ারে কোনরকমে। নর্দমার পাঁক থেকে চ্যাটালো থকথকে বমি উগড়ানো গন্ধে সেই পাঁকের মধ্যে ডুবে যাবার একটা ফিলিং হচ্ছিল। গন্ধটা কখন মেয়েটার মরা গা থেকে। সেই মরার গন্ধ পাঁকের সঙ্গে মিশে পেট থেকে গলায়, হড়হড় করে বমি। বমির মধ্যে লেপটে মুখ থুবড়ে আমিও।

জ্ঞান ছিল না। আমার শরীরটা মাটিতে লেবড়ে পড়েছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন