কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

দ্য ক্লাউড

 


(পঞ্চদশ পর্ব)         

অপরিণামদর্শীতা তো অনেকেই দেখায়। যেমন এই শুন্যলোকের সংসারে আনন্দ, নিমচাঁদ, মনিরত্না ভরদ্বাজ,  এমনকি হাল আমলের বাবলু - এরা তো সবাই-ই অপরিণামদর্শীতার ফলাফল।

উৎপল চিত্রকরের আজ কেমন যেন, কুছ পরোয়া নেহি - ভাব।

নিম্নচাপের পর নিম্নচাপ। আর যে কতো নিম্নচাপ আকাশকে কুচকুচে কালো মাখিয়ে রাখবে - এ প্রশ্ন উৎপলের।

কবরস্থানে মৃতদের স্মরণ করে উৎপল চিত্রকর এখন ধবধবে সাদা শানবাঁধানো বড় আকৃতির একটা কবরের পাশের কামিনী গাছের ছায়ায় বসে পড়লো।

ক্যানভাস আজ কেবলই কালো। কালো মানে মেঘের ঘনঘটা। অনেকগুলো ফটিক পাখি চিল চিৎকার দিতে দিতে গোল গোল করে আল্পনা চিহ্নের মতো উড়ছে। ওদের মুখে ছোটোবেলায় মায়ের মুখে শোনা গল্পের সেই বিখ্যাত শব্দ ‘ফটিকজল' বসিয়ে দিলো উৎপল।

এখন ফটিক পাখির দল জল জল করে আকাশে উড়ছে। এরপর উৎপল বাতাসের চারটি স্তর এঁকে বলয়াকৃতির সেইসব স্তরকে একটার থেকে অনেকটা ওপরে পরবর্তী স্তরকে বসিয়ে ভাবতে লাগলো-

আচ্ছা, আনন্দ এখন কোন স্তরে আছে?

ইতিমধ্যেই গীর্জার ঘন্টা সময় নিয়ে বেজে বেজে জানালো, এখন দুপুর বারোটা বাজে। এই যে বারোটা, এটা খুব সিগনিফিকেন্ট সাউন্ড।

উৎপলের সৃষ্টি - 'আনন্দ'র বারোটা বেজে যাওয়ার খবর একটু একটু করে সেইসময়কার  মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। চলতি পথের যেখানে সেখানে বালি, স্টোনচিপস্ আর মাতব্বরি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও মানুষ নিরুপায়।

আনন্দ বলতে তখন, মানুষকে কষ্ট দেবার নাম আনন্দ। ব্যাথা দেবার নাম আনন্দ। আর মানুষকে প্রতারিত করার নাম আনন্দ।

উৎপল বেশ ভেবেচিন্তেই আনন্দকে  আনন্দ - এই নামে ভূষিত করেছে।

এইতো, ক'দিন আগেই ১৫ই আগস্টে দেশের স্বাধীনতা দিবসে এ অঞ্চলে নতুন গড়ে ওঠা একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পতাকা উত্তলনের সময় বিজ্ঞাপনের টিনের সেডটা সরাতেই আনন্দ বায়ুমন্ডলে অবস্থিত তার টিনের বাসা থেকে হুস করে বেড়িয়ে গোত্তা খেতে লাগলো পতাকা দন্ডের মাথার ওপরে।

ঠিক কাক যেমন পড়ে থাকা খাবার দেখলে ডানা মেলে কা কা করে, ঠিক তেমন ভাবেই আনন্দ তার সাংকেতিক প্রকাশে অন্যান্য আনন্দদের ডাকতে আরম্ভ করলো।

উৎপলের সেদিনের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী দেখেছেন যারা, তারা অনেকেই বিদগ্ধজন। এই যেমন প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক মিস্টার শেখর রায়চৌধুরী উল্টেপাল্টে, সোজা-বাঁকা করে ছবিটি দেখে বললেন, তিনি মনে করেন, সেদিনের আনন্দ আর আজকের আনন্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক ঘটে গেছে। আর বটেই তো! বিজ্ঞাপনের টিনের বাক্সে আঁকা হাসি হাসি মুখের আনন্দ দীর্ঘদিন ধরে বাক্সটার মধ্যে থাকতে থাকতে তাঁর ভাবের পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর তাতেই এই ছবির আনন্দের ভাষায় কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই যেমন, ওর দু'হাত এখন ঊর্ধমুখী। যেন ক্ষণিক জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার আনন্দ, আর মৃত্যুর পরে অনাবিল শান্তি পাওয়া আনন্দ - এই দুইয়ের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক ঘটে গেছে।

এই কথাগুলো মিস্টার শেখর রায়চৌধুরী বলছিলেন আর উপযুক্ত দাম দিয়ে ছবিটা সেদিন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

উৎপল, ওজোনস্তরের মধ্যে আনন্দকে একটা ধারণার মধ্যে আনতে চাইছে। ধীরে ধীরে রুল পন্সিলের  কালো রেখায় পরিস্ফুট হচ্ছে আনন্দ-স্বরূপ।

কিছুক্ষণ ওজোনস্তরে ঘুরে ঘুরে আনন্দ এখন ফিরে আসলো নিমচাঁদ, মনিরত্না আর বাবলু যেখানে থাকে, সেই ডেরায়।

বাতাসের মাইক্রোফোনে ওরা সবাই চোখ বন্ধ করে ওঁ ধ্বনি বলছে। উৎপল ওদের সকলের কুলকুণ্ডলিনীতে জাগরণের মন্ত্র ভরে দিলো।

এই পর্বের পরে ওরা সকলে মিলে সন্ধ্যার আহার গ্রহণ করতে বসলো।

বাবলুর পরলোকে আসার আজ জন্মদিন। মনিরত্নার হাতে বৃষ্টির দুধের পায়েস আর শান্তির বাতাসের লুচি ও নীরবতার আলুর দম, বাবলু চেটেপুটে খাচ্ছে। ঠিক এইসময়ে মনিরত্না ভরদ্বাজ খাবার পরিবেশন করতে করতে তার মনে জমে থাকা মেয়ে মানুষের সখের সংসারের ইচ্ছের ভেতরে ডুবে গেলো।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন