ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি... সমাজের বাইরের অভিনেত্রী বিনোদ ও
বিনোদিনীরা
প্রতি
থিয়েটারের দর্শক
সমাজ কী? কে বানায়? কারা সমাজ? সমাজের বাইরের কারা? সমাজের বাইরে থাকলে তাঁদের দিয়ে সমাজের কোনও কাজ কি করানো যায়? যদি যায় তাহলে তাঁদের কাজকে কী বলা হবে, সমাজের কাজ নাকি বাইরের? এই প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নটীদের সমাজ? বা, সেই সীমায় আবদ্ধ ছিল না নটী তথা অভিনেত্রীদের সমাজ তাহলে কেন? সেটাই বিস্ময়! আর সেটাই আলোচনারও।
বারো বছরের বিনোদিনী, মলিন ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির সামাজিক অবস্থান নিয়ে কক্ষনও প্রশ্নই উঠত না, যদি না মেয়েটি বিনোদিনী নামের এক অভিনেত্রী হয়ে উঠত। হ্যাঁ, বিনোদিনীর সেই সমাজে কারা ছিলেন, কাদের সঙ্গে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তাঁদের কোনও ছবি কোথাও পাওয়া যায়নি। কারণ! অনেক। সেদিন এক ছোট্ট মেয়ে বিনোদিনী গঙ্গামণি বাঈয়ের সূত্রে ভর্তি হয় গ্রেট ন্যাশনালে। মাইনে দশটাকা। ১৮৭৩ সালে দশটাকা মাইনে আজকের হিসেবে কত হতে পারে? অর্থাৎ, এও অনুমান করা যায় তখন নটীদের চাহিদা কিছু কম ছিল না। গঙ্গাবাঈ-এর নামও উঠে আসছে, সেই কারণও বিনোদিনীর হয়ে ওঠা। কেন, থিয়েটারে এসেছিলেন এই মেয়েটা, সেই কথা সবারই জানা।
বিনোদিনীর পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার
কথা এখন সকলেরই জানা। 'আমার কথা' বইতে বারবার লিখেছেন, তিনি দারিদ্রের আন-কাট কথা সব লিখেছেন। লেখার মধ্যে
দিয়েই যে ছবি ফুটে ওঠে, সেটাই আমাদের বিনোদিনীকে দেখার ছবি, যা আমরা, লিখিত আকারে
তো পাই।
নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষমহাশয়
অভিনেত্রীদের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, পূর্বোক্ত অভিনেত্রীদের প্রত্যেকের চেয়ে
অনেক বেশি প্রতিভাময়ী ছিলেন বিনোদিনী। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, অভিনয় কেমন করে করতে
হয়, তা শিখতে হলে বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আর নেই।
'শ্রেষ্ঠ উদাহরণ' শব্দটাকে ধরলে
প্রশ্ন ওঠে, কখনও সময়ের নিরিখে আবারও নতুন করে দেখা দেয় শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ 'হয়ে ওঠা'
থেকে শুরু করে, সেই ধারা অব্যাহত রাখার কাজ। শ্রেষ্ঠ শব্দের অর্থ দিয়েই বিনোদিনীর
কথা লেখা যায়। কারণ, এইসব কা জের কোনও প্রমাণ নেই, শুধু কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কথা
ছাড়া। সেই বয়ানই ছবি, সেটাই তাঁর অভিনয়ের দলিলও বটে। আমাদের কাছে ছবি একটা বড় প্রমাণ।
সেকালে ছবি তোলার চল আমাদের মুঠোফোনে সাঁটানো ক্যামেরার মতো ছিল না।
তাই, লেখাই ভরসা। সেই বিনোদিনীর
শ্রেষ্ঠ শব্দের অর্থ এখানেই রাখা হল। এবারে সমাজের দিকে ফেরা যাক। কেননা, সমাজের জন্য
থিয়েটার। থিয়েটারের তিনি অভিনেত্রী বিনোদ।
বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ১৮৭৪, ১২
ডিসেম্বর তারিখে। তাঁর লেখা আত্মজীবনী নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। সবচেয়ে পঠিত সম্পাদনী
হল নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর। এক আলোচনায় নির্মাল্য আচার্য লিখেছেন
যে, গিরিশচন্দ্র তাঁর পূর্বোল্লিখিত ভূমিকায় বিনোদিনীর 'চৈতন্যলীলা', 'বুদ্ধদেব', 'দক্ষযজ্ঞ', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'বিবাহ বিভ্রাট'
'সধবার একাদশী', 'কপালকুণ্ডলা', 'হীরার ফুল', 'মৃণালিনী'তে দর্শকের মনকাড়া অভিনয় করেছেন।
এসব আমাদের জানা। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুর্গেশনন্দিনী', 'বিষবৃক্ষ'
উপন্যাসে যথাক্রমে 'আয়েষা' ও 'তিলোত্তমা', 'কুন্দনন্দিনী' চরিত্রের অভিনয়েও মুগ্ধ হয়েছিলেন।
মনে রয়েছে বঙ্কিমের উক্তিও... 'মৃণালিনী' নাটকে মনোরমার চরিত্র দেখে। বলেছিলেন যে, "আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই। আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল।"
সাল ১৮৭৭। অর্থাৎ, থিয়েটারে যোগ
দেওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই প্রশংসা পেয়েছিলেন। তবে, এখানেও কথাই, না এইসব অভিনয়ের
কোনও ছবি নেই।
বিনোদিনী তখন বেঙ্গল থিয়েটারে।
তখন তাঁর বয়স চোদ্দ-পনেরো বছর হবে। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বঙ্কিমচন্দ্রের এহেন প্রশংসা-বাক্য
কি সমাজের বাইরের, নাকি সমাজের? শুনেছি অভিনয়ের জোরেই বিনোদিনী এসেছিলেন বেঙ্গল থিয়েটার
থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়-এর থিয়েটারে। এবং কত শংসাপত্র যে পাওয়ার ছিল বা ছবিতে
ছবিতে ছাপিয়ে যাওয়ার ছিল বিনোদিনীর! কারণ, যে অভিনেত্রী একসঙ্গে 'মেঘনাদ বধ' নাটকে সাতটি চরিত্র রূপায়ন করতে পারেন, তিনিই আগামীর বিনোদিনী।
হ্যাঁ, তিনি চিত্রাঙ্গদা, প্রমীলা, বারুণী, রতি, মায়া, মহামায়া এবং সীতাও। তাঁর জন্যে
কত না উপাধি! ‘ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ', 'প্রাইমা ডোনা অব দি বেঙ্গলি স্টেজ' বলে
অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছিল তাঁকে। আর বিনোদিনী যিনি এরপর স্টার থিয়েটারের ঘটনা, বির্তকে
জড়িয়ে গেলেন! যা বিনোদিনীর কথায় "থিয়েটার ভালবাসিতাম, তাই কার্য করিতাম, কিন্তু
ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম।"
নটী বিনোদিনী। মাত্র বারোবছর অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে তিনি স্টার বা নটী বিনোদিনী বা এখনও পর্যন্ত তর্কে-বিতর্কের সবচেয়ে বেশি টিআরপি তোলা অভিনেত্রী। কিন্তু, কত সহজে যে তিনি তাঁর কৃতিত্ব, সবচেয়ে ভালবাসার স্থান ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র এই সামাজিক ছলনার কারণে!
এখন প্রশ্ন ওঠে, যাঁদের সমাজের
বাইরের বলা হচ্ছে, তাঁদের আবার কোন সমাজ? সমাজ মানে নটীদের হল অভিনয়ের সমাজ, যেখানে
তাঁরা কাজ করেন। শুধু কি কাজ? সেখানে তাবৎ উৎসাহী, ভাবনায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে
ওঠাবসার সুযোগ। অর্থাৎ, তাঁদের অভিভাবকত্বে নিজেদের গড়তে পারার সুযোগ। এবং সেখানে নট,
অভিনেতার সঙ্গে নটীদের যোগ দেওয়া। কিন্তু এর কোনওটাই নতুন নয়। আমাদের দেশে সেই কবে
থেকেই মেয়ে পুরুষে অ্যাক্ট করে। এর কোনওটাই 'মন্দ মেয়ে'-দের মঞ্চায়ন বলে নির্ণয় করা
যায়? একদিকে সমাজের ঘরে থাকা চৌহদ্দিতে মেয়েরা, ভদ্র ঘরের মেয়েরা। অন্যদিকে, বিনোদিনীদের
কোথায় ঘর ও অবস্থান? সমাজের বাইরে থেকে যাঁদের সমাজের কাজে লাগে, তাঁরাই তো নটী। এসব
তথ্য তো বই থেকে পাই, চোখে দেখা নয়। কিন্তু চোখে পড়ে যায় আরেকটা বিষয়, যেখানে সমাজের
ছবি দেখা যাচ্ছে এক প্রত্যক্ষদর্শীর।
উল্লেখের বিষয় যে, তখন থিয়েটার
নিয়ে অনেক লেখা বের হত। তারই কিছু প্রতিবেদন দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা করার। আর সেজন্য
২০২৫ থেকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে ১৫২ বছর আগে। সেইসময় 'সাধারণী' নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হত। তাতে
উল্লিখিত তারিখ তথা ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৬ বঙ্গাব্দ-তে ছাপা প্রতিবেদনের অংশবিশেষ পড়ে চোখে
সর্ষেফুল।
উক্তি বা প্রতিবেদন – “কী কুক্ষণে
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গের রঙ্গভূমিতে বারাঙ্গনা প্রবিষ্ট করিয়া গিয়াছেন অধঃপতিত বঙ্গসমাজে
অতি সন্তপর্ণে ইজ্জত রাখিতে হয়... এই বিড়ম্বনায় গিরিশ, কেদার, অর্ধেন্দু, শত, নগেন্দ্র,
যোগেন্দ্র মাটী হইয়া গেলেন।"
এখানে বিশেষ করে লক্ষ্য করার যে,
কয়েকটি বিশিষ্ট নামী ব্যক্তি মাটি হয়ে গেলেন, লেখা রয়েছে। অর্থাৎ, এইভাবে কি ধরে
নেব যে, মুষ্টিমেয় অনাম্নীদের ক্ষমতা এত বেশি? নিষ্ফলা তর্ক ছেড়ে ইতিহাসের পাতায়
দেখা যায় কেউই যে মাটি হননি, মাটিতে মিশেও যাননি, তার পরিচয় বিলক্ষণ মেলে ইতিহাসের
পাতায়।
এসব নাট্যালয়ের ইতিহাস পড়তে বসে
মনে হচ্ছিল, নাট্যরঙ্গ বুঝি নাট্যেই শেষ হয় না, তার প্রবাহ নিরন্তর সমাজে। সেকালের
নাট্য-ব্যক্তিত্বরা কেউই মাটি হননি বলেই আজও বিনোদিনীর কথা লেখা হচ্ছে। সিনেমা তৈরি
হচ্ছে। আলোচনা সভা হচ্ছে। আর এইসব কাজ হচ্ছে কোথায়? সমাজে। কোন সমাজে? সমাজ অনেকটা
হাওয়ার মতো। যেখানে সবই রয়েছে, অনুভব করা গেলেও, চোখে দেখা যায় না। হ্যাঁ, কিছু বিস্তারিত
তথ্য রয়েছে, যা একরকম ছবি, বা সামাজিক ছবি। আমাদের কাছে এক সমাজ রয়েছে। উদার উন্মুক্ত
সেই সমাজের অন্তরাত্মা হলেন দর্শক। থিয়েটারের দর্শক। সমাজের দর্শক। আর লেখার ক্ষেত্রে
সেটা হয়ে যাবে পাঠক। সেই সমাজ কোনও ছোট জায়গায় নয়। সীমাবদ্ধ নয়। বিস্তার অপার সেই পাঠকের
মতামত জানানোর স্থান বা স্পেস যতদূর পর্যন্ত যায়, ততদূরই আমাদের সমাজ।
ইতি
@একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন