কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তৃষ্ণা বসাক

 

সমকালীন ছোটগল্প


নারকেল প্যাটিস

বো ব্যারাকের রাস্তা ধরে বড়ুয়ার কেকের দিকে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল এই রাস্তা আমার পূর্ব জন্মের। এই যে দুধারের বাড়িগুলো, ছোট ছোট ব্যালকনিতে টবে গাছ, রোদ পড়ে আসা বিকেলে ছুটির মেজাজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ানো বৃদ্ধ বৃদ্ধারা, তাঁদের হাতে মোবাইল ফোন না থাকলে বোঝাই যেত না এটা কোন সময়! হয়তো কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন তৃপ্ত মুখে!   এঁদের আর কোন নিজের লোকই এই শহরে নেই, এঁদের নিজেদের বলতে এই একফালি রাস্তা, আর বাজার দোকান ব্যাংকের প্রয়োজনে বৌ বাজার স্ট্রিট, এই তাঁদের কলকাতা। কয়েক পা হাঁটলেই সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন, কিন্তু এঁরা কোনদিন সেই মেট্রোতেও উঠেছেন কিনা সন্দেহ! দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালে ড্রইং রুমের দেওয়ালে পৌরাণিক শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষদের ছবি। এই রাস্তা ধরে বাবা হাঁটত। এই তো চারপাশে লালবাজার, ফিরিঙ্গি কালী মন্দির, রাধাবাজার, এই সব রাস্তায় বাবা হাঁটত তিন দশক কি চার দশক আগে।  এখান দিয়ে হেঁটে ফিরত শিয়ালদা স্টেশনে, ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরত। আর শনিবারের দুপুরগুলোতে বাবার হাতে থাকত ব্রেস্ট কাটলেট কিংবা নারকেল প্যাটিস। নারকেল প্যাটিসই বেশি, হয়তো দামের কারণেই বেশি। সেই গন্ধটা আজো নাকে লেগে আছে।

শনিবার বাবার হাফ ছুটি। ওইদিন তিনটে সাড়ে তিনটের মধ্যে বাবা ফিরত, আর বাবা ফেরা মানেই সঙ্গে থাকত কিছু না কিছু খাবার। বেশিরভাগ দিনেই নারকেল প্যাটিস। ব্রেস্ট কাটলেট, যার মধ্যে থেকে একটা হাড় বেরিয়ে এসে ব্যাপারটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলত। তার গায়ে ঐ যে ঝুরঝুরে বিস্কুটের গুড়ো, কালচে বাদামি রঙ, তার মধ্যে আমি যেন এখন একটা হলুদ আবার দেখতে পাচ্ছি। এত বছর পর থেকে দেখে, কামড় দিলে, মাংসের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ লংকার কুচি, কুচি মানে শুধু রঙের আভাসটুকু, অথচ ঝাল লাগত না তো! এদিকে ডালে আমার জ্বালায় একটা লঙ্কা দেবার উপায় ছিল না। আমি চিৎকার করতাম উহ  ঝাল ঝাল! সেই আমি তারিয়ে তারিয়ে ব্রেস্ট কাটলেট খেতাম। অবশ্য কতটুকুই বা পেতাম খাবার জন্যে!  একটা ব্রেস্ট কাটলেট, বেশ বড় ছিল, বড়দের হাতের মাপের, সেটা তো চারভাগ হত। বাবা মা অবশ্য প্রায় কিছুই খেত না, বিশেষ করে বাবা, সে ফিরে হয় দুধমুড়ি বা শুখনো ছোলামুড়ি খেতেই চাইত বেশি। ক্বচিৎ দুধভাত।  যেদিন চলে যায়, তার আগের দিন দুপুরে ফিরে দুধভাত খেয়েছিল। সেদিন অফিস যায়নি। দিন সাতেক ছুটি নিয়েছিল, বাড়ি রঙ হবে। রঙ কিনতে কলকাতা গেছিল, সকালে টিফিন খেয়ে গেছিল সম্ভবত। এসে বলেছিল দুধভাত দাও। বাবা ছোটবেলায় পেপটিক আলসারের রোগী ছিল। ঠাণ্ডা দুধ ভাত দিয়ে মেখে খাওয়া বহু বছরের অভ্যেস। এক সূর্যে দুবার ভাত খেত না বাবা। পৈতে হবার পর থেকে এই নিয়ম বরাবর মেনে এসেছে। সেই মানুষটা…

যাইহোক, ব্রেস্ট কাটলেট পুরোটা না পেলেও নারকেল প্যাটিস সবার নামে নামেই আসত। আর সেটা খেতে  সবচে ভালবাসতাম। একদম টাটকা তৈরি, নারকেলের গন্ধে ভুরভুর সেই প্যাটিস খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। অথচ বড় হয়ে যাবার পর এই প্যাটিস কোথাও খুঁজে পাইনি। নাকি খুঁজতে চাইনি? আমি তো সবরকম প্যাটিস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম, ঐ যে গুঁড়োগুলো ঠোঁটে লেগে থাকে - লিপস্টিক পরা ঠোঁটে ভারি বিশ্রী দেখায় চিপকে থাকা গুঁড়োগুলো।

আজ বো ব্যারাকে দাঁড়িয়ে আমি কিন্তু দেখছিলাম ঐ গুঁড়োগুলো আমার ঠোঁটে শুধু নয়, সমস্ত অস্তিত্বে লেগে আছে। বড়ুয়ার কেকের দোকানে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটা লাগে। বোর্ডে লেখা আইটেমের প্রথম দিকেই জ্বলজ্বল করছে নারকেল প্যাটিস। প্রথমে কিছু মনে হয় না। অনুভূতি কখনো কখনো অসাড় হয়ে যায়। কিন্তু নারকেলের গন্ধ গিয়ে যখন ঘ্রাণ কোরকে ধাক্কা মারে, সেখান থেকে সোজা স্মৃতির বন্ধ দরজায়। খুলে যায় খুলে যায়। শনিবারের সেই দুপুরগুলো, বাবা…

দেখছি বাবা হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটে একটা বাড়িতে কলিংবেল বাজাল, মিসেস ব্রিগেঞ্জা এসে খুলে দিল, নীল ফ্লোরাল প্রিন্টের ফ্রক পরা মিসেস ব্রিগাঞ্জা!

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন