![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
বাপচন্দ্রের শাস্ত্রবচন ও দীনদয়াল
সেদিনের পর থেকে তাকে আর দেখিনি। বাজারে না, ফুটপাথে না, কচি পাঁঠার দোকানেও দেখা হয়নি আর। কিন্তু ভাবা হয়েছিলো আবার দেখা হবে এবং তার বুক-পাছার মাপ থেকে মুখের হাঁ, পায়ের পাতা, কবজি ও সুষম বন্টনের দেঁতো হাসি জেরক্স করে নেব। সুযোগ তো পাওয়াই যাচ্ছে না এমনকি মাকড়া প্রায় ঘুমের মধ্যে, হাগুঘরে, গোপনে মেয়েছেলে দেখার আড়ালটুকুর মধ্যেও ঢুকে বসে আছে। পারা যায়? এভাবে প্রাইভেসি ফাঁক করে দেয়া ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিয়ে চরম সঙ্কটে যখন কেশব ছেঁড়ার অবস্থা, হঠাৎই একদিন দীনদয়াল এলেন। উরিঃ ত্তারা! প্রায় ডাইভ মেরে তলপেটে গোঁত্তা খাবো ভাবতে ভাবতেই তিনি কাপড়টাপড় খুলে প্রায় অর্ধনগ্ন খোঁজ নিলেন ল্যাট্রিনটা কোথায় এবং এতই বেগ যে কথাটা বলে দাঁড়াতেও পারছেন না, এদিক-ওদিক প্রায় ছোটাছুটি শুরু করলেন। অবস্থার বাস্তবতা টের পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে তাকে দেখানো হলো গন্ধমন্দির, তিনিও নিমেষে ছুটে ঢুকে পড়েই ধড়াম। দরোজা সেঁটে দিলেন। বাকিটা কল্পচক্ষে। সে চর্চা আপাতত না করাই সমীচিন। যখন বেরিয়ে এলেন, প্রথমেই এমন এক ঝারি দিলেন, সেই থেকে আর এমন কোনও রাত পাচ্ছি না নির্বিবাদ দু-এক পেগ রাম নির্জনে চুষে দিতে পারি। তো বিষয় দাঁড়ালো গিয়ে দীনদয়াল এবং প্রথমেই জেনে নিতে হবে তার বাপ-মায়ের জন্ম-সার্টিফিকেট আছে কিনা, সে পুংলিঙ্গ নাকি স্ত্রীং। নামে কি আসে যায় বলেছিলেন শেক্ষপীয়র, পোষাক বিশেষজ্ঞ পোধানমন্ত্রীর নিজের ভাষণে কথিত আছে যে, পোষাক দেখেই লোক চিনে ফেলবার তার অসীম ক্ষমতা, বড় মানুষ যা পারে আমরা কৃমি কেঁচোর মতো মানুষ কি করে পারবো। সুতরাং পোষাক দেখে চিনে ফেলা সম্ভব নয় বলেই স্বদেশের ভান্ডারে ২৮ রকম গোয়েন্দা বাহিনী। প্রয়োজনে তারা জামাকাপড় খুলে বুঝে নিতে পারে কোন লিঙ্গের মানুষ, হ্যাঁ, এ বিষয়ে স্বদেশ তার যাবতীয় অনুমতি এই বাহিনীগুলোকে দিয়েই রেখেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী এক চোখের ঝারি এতকিছু ইতিহাস ভূগোল পজ্জালোচনায় আমাকে তটস্থ করে রেখেছে। দীনদয়াল আসলে কে? পুং নাকি স্ত্রীং, সে ধাধাঁয় লটকে গেছি আচুল পায়ের নখ। বরং হেঁয়ালী ছেড়ে চলুন দীনদয়ালকে আগে ফাঁক করে নিই।
দীনদয়াল রোহিঙ্গা নাকি গুজরাটী নাকি উত্তরপ্রদেশী সেটা আগে জেনে নিতে হবে। তো এব্যাপারে হাতে গরম দিশা দেখিয়েছেন এক গুপ্তজ্ঞানী নিব্বাচন কমিশন কাকা। নিয়ে আয় বাঞ্চোৎ বাপ-মায়ের জন্ম-সাট্টিফিকেট, নিয়ে আয়। গুপ্তজ্ঞানীর বাপের সেটা আছে ধরে নিতেই হবে, কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলে আলাদা খবর। যাইহোক দীনদয়াল, সে জানালো ওসবে আমি হেগে দিই, দেখলে না এসেই হাগুঘর খুঁজলাম। ঠিক কথা। ১০০ গোমাংস পর্যন্ত ঠিক, থুড়ি, ১০০ শতাংশ হবে। সুতরাং এটা আর জানা যাচ্ছে না মালটি উত্তরপ্রদেশী না গুজরাটী নাকি রোহিঙ্গা। তবে ঘুসপেটিয়া বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। এবার লিঙ্গ। কাপড়খোলা স্বচক্ষে দেখেছি কিন্তু লিঙ্গ খোলা তো দেখিনি। তবে? নামে দীনদয়াল পুং, কাপড়ে দিনদয়াল পুং কিন্তু লিঙ্গে দীনদয়াল নিদ্ধারণ করতে হ্যোলে বিমানবন্দর বাহিনীর কাছে যেতি হবে। যে কোন লিঙ্গে হাত চালিয়ে তারা দেখে নিতে পারে, অনুমতি আছে। কিন্তু ঝারি। ঝারি খেয়ে প্রায় গলে গিয়ে যে দিব্বদশশন হয়েছে, তারপর মালটাকে আর কারও হাতে গলিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। অতএব উবু। রোহিঙ্গা, গুজরাটী বা উত্তরপ্রদেশী যাই হোক বুঝে নেয়ার দায়িত্ব মোটা মন্ত্রীর, যার হাতে সীমান্ত বন্ধক দেয়া হয়েছে। সুতরাং চুপচাপ দই খাও কুঞ্জে বসিয়ে।
পোশ্ন আসবে পাঠকের কাছ থেকে, পোষাক দেখলেন, কথা শুনলেন তবু ভ্যানভ্যান করছেন কেন?-- তাই নাকি! এই চোটপাট নিয়ে দিল্লী পুলিশ, উড়িয়া পুলিশ, অহমিয়া পুলিশ, অন্য যে যে রাজ্যের পুলিশের কথা শুনছি, দেখছি কাগজে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলুন না গিয়ে, আবে, আমি বাঙালি বাংলায় কথা বলছি বেশ করেছি, আমাকে বাংলাদেশি বলছিস কোন সাহসে? ন্যাংটো তো আপনাকে করবেই বাপ-মায়ের জন্ম-সার্টিফিকেট দেখালেও কেড়ে নিয়ে গ্রেপ্তার কোরে পাছায় লাথি মেরে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে। যান না একবার সেখানে গিয়ে খেটেখাওয়া শ্রমিক আপনার চোটপাট দেখিয়ে আসুন। কত বুকের পাটা আছে দেখা যাবে। যাকগে, এসব কাদা ঘাঁটবো না এখন। কথা হচ্ছে ঝারি দেয়ার মালিক যে দীনদয়ালের কথা বলছি, ঝারি ও অর্ধন্যাংটো অবস্থা দেখে ধারণা করতে না পেরেই এই কলমবাজির পোয়াসে বোতি হইয়েছি। কী করিয়ে ঝারি মুক্তি ঘটিবে তাহাই পাছায় হাত দিয়া ভাবিতেছি ৭২ ঘন্টা ধরিয়া।
বিস্তর গবেষণান্তে জ্ঞানপ্রাপ্ত হইলাম যে, মানুষ হোমোসেক্সুয়াল হইলে, রূপান্তরকামী হইলে, ব্যাটাছেলের প্রতি ব্যাটাছেলের এমন খচাখচির বাসনা জাগ্রত হইতে পারে যাহার সংকেত থাকে চোখের ঝলকে, স্পর্শের মাদকতায়, এমনকি পোষাক সম্পর্কে খোলামেলা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষাতেও। যাহা পুরুষ ও নারীর আকর্ষণ তৈরির সংকেত বলিয়াও সমাজ দ্বারা সিদ্ধ। তাহা হইলে প্রশ্ন দাঁড়াইলো দীনদয়াল কোন প্রজাতির। সুতরাং লিঙ্গদর্শন ব্যতীত যাহা জানিবার কোনও উপায় নাই। বাধ্য হইয়া বাসনা ত্যাগপূর্বক চোখের ঝারি লকারে তালা দিয়া নিজের কর্মে ফিরিলাম। মনে পড়িল সদ্য গজানো বয়সে কলেজ ক্যান্টিন ফাটিয়ে সুনীল গঙ্গো আওড়ে যেতাম-- ভীড়ের মধ্যে নেমে গেলো সেই এলোকেশিনী / ঘাড় দেখেছি মুখ দেখেছি বুক দেখিনি...। আমার অবস্থায় পড়লে এবং বেঁচে থাকলে কবিবাবু নিচ্চয়ই লিখতেন 'কাপড় দেখেছি চোখ দেখেছি লিঙ্গ দেখিনি'। এই জন্যেই রামকৃষ্ণ ঠাকুর বিষয়বাসনাকে বিষ বলেছিলেন। কিছুতেই এই ঝারিবিষ এখন পান করিব না আমি। দাড়ি চুলকিয়ে পিতিজ্ঞে করলাম। আর পিতিজ্ঞে করতে যে মুহূর্তটুকু দরকার, সময়ের সেই ফাঁকটুকু গলে ব্যাস, মরার আগে পিতাশ্রীর শেষ লেখা চিঠি এসে মাথায় ঘুঘু হয়ে বসে কুরুর-কু, কুরুর-কু হেজিয়েই যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ঈশ্বরপ্রাপ্ত শ্রী বাপচন্দ্র বায়ুলোকে নির্গত হইবার পূর্বে এই অধম ক্যালসাকুমারের উদ্দেশ্যে কিছু অত্যন্ত কার্যকরী বাণী লিখিয়া ডাকবাক্সে ফেলিয়া গিয়াছিলেন। যাহা আমার হস্তধৃত হইতে তিনটি বছর লাগিয়া গিয়াছিলো অতিতৎপর পরিষেবাদক্ষ ভারতীয় ডাকবিভাগের কর্মকুশলতায়। মাত্র তিনটি বছর, ভাবা যায়! বায়ুলোকের যাত্রীর এমন মহার্ঘ্য লিপিসকল মাত্র তিন বছরেই ক্যাচ-কট। জনান্তিকে বলিয়া রাখি, শ্রী বাপচন্দ্র বিদ্যার্জনে নাঙ্গাপুরুষ, কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া জমিবেচার টাকায় লোকলস্কর মানে দালাল-টালাল লাগিয়ে, দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপছোপ্পর মারা একটি উচ্চশিক্ষিতের ছাট্টিফিকেট ক্রয় করিয়াছিলেন। তাহার পর হইতেই যখন তখন যাকে তাকে ধরে শাস্ত্র বলিয়াছে ঢপ ছাড়িয়া যা তা বাণী পোদান করিতেন। ভাবা যায়! এই দক্ষতা বাপ অজ্জন না করিলে বাপের গায়ে কখনও চন্দ্র লাগাইয়া চালানো সম্ভব, আপনারাই বলেন! যে জানিলোই না সংস্কিত বলিয়া ভাষাটি কেমন দেখিতে, তিনি উদ্গার করিতেছেন শাস্ত্রের নাম করিয়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কঠিন কঠিন সব বাণী। দৈবপুরুষ ইহাদেরই বলে। ইহারা কোন মানুষের পেটে জন্ম নেন না, হঠাৎ করিয়া যেখান সেখান হইতে পিছলাইয়া বাহির হইয়া আসেন। মানে দাঁড়াইলো ইহাদের মানবগর্ভে বায়োলজিকাল জন্ম বলিয়া কিছু নাই, মনুষ্যেতর ইতর জন্তুগর্ভ হইতেও পিছলাইয়া আসিতে পারেন, নিচ্চিত করিয়া কিছু বলা যাইবে না। যাহা হউক, সেই শ্রীযুক্ত বাপচন্দ্র বায়ুমার্গে ভাসান হইবার পূর্বে যে শাস্ত্রউদ্ধৃত বাণী তাহার অযোগ্য পুত্র ক্যালসাকুমারকে পত্রযোগে পাঠাইয়া গিয়াছিলেন, তাহাকে সম্যক অনুধাবন করিতে অধম পুত্রটির ১৫ বছর হাগুমুতুতে বিলাইয়াও, তাহা আজও অজানা ধাঁধার মত রহিয়া গিয়াছে। কি লিখিয়াছিলেন, চলুন একটি বাক্য অন্তত খোচাখুচির চেষ্টায় তালা খুলিয়া বসি--
বাণী ১। সব্বোদা মনে রাখিবা শাস্ত্র বলিয়াছে জীবের দুইটি কম্মঃ অ) অবশ্য কম্ম আ) পালনীয় কম্ম। যেমন, অনুসন্ধান করিয়া নমুনা তোমাকেই বুঝিয়া লইতে হইবেক।
পনেরো বছর ধরে নমুনা আমি জোগাড় করিতে পারি নাই এমনই রামপাঁঠা আমি। দীনদয়ালের লিঙ্গ নিদ্ধারণ করবো কিভাবে! কতজনকে ডেকে ডেকে বললাম একটু বুঝিয়ে দিন! সবাই কেমন অবজ্ঞা ভরে বলে, এটাও বোঝ না, তুমি একটা গাছপাঁঠা। মানে আমি নাকি একটা দলাপাকানো এঁচোড়! বুঝুন একবার জ্ঞানীর ঝাঁটা বাড়ুনের বারি! অবশেষে এক পাগল বললো, বুঝলি না পাগল, যা অবশ্য কম্ম তাই পালনীয় কম্ম। খাবি হাগবি খাবি। মানে খেয়ে হাগ বা হেগে খা ব্যাপারটা একই। যত্তসব পাগোল এটাও বোঝে না -- কথাটা বলেই চোখ গোলগোল করে কেমন গা জ্বালানী হাসতে হাসতে ছুটে চলে গেলো। আর সে আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো আরও এক ধাঁধা-- খেয়ে হাগ বা হেগে খা, ব্যাপারটা একই। হে দীনদয়াল, আর একবার আসেন! ঝারী খেয়ে ফেঁসে যাই চোখের চপারে!
তো এই হচ্ছে বাপচন্দ্রের দ্বিবিধ কম্ম বিষয়ক বাণী। এরও পর গোটা চিঠিজুড়ে আরও নানারকম 'মনের কথাবাত্তা' শাস্ত্রকথিত সম্ভাষণে লিখিত হইয়াছে যাহা সাহস করিয়া আর চক্ষুপাতে পতিত করি নাই। এক বাণী বোঝার জন্যই ঘষিতে ঘষিতে পেছনের চামড়া প্রায় ঝ্যালঝেলে হয়ে যাবার জোগাড়, আবার! এমত দিনে চরম খলবলে অবস্থা হইতে উদ্ধারের জন্যই যেন দীনদয়ালের হাগুঘর খুঁজিতে আবির্ভাব। কিন্তু মুক্তি হইলো কই, ঝারিচোখের প্যাঁচে প্রায় খাবি খাইতেছি, উদ্ধারের কেহ নাই। অতঃপর পাঠক / পাঠিকা এমতাবস্থায় আপনি কি করিতেন জানিবার বাসনা প্রকাশ করিয়া আপাতত ফুটিলাম।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন