কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৯ |
উজান
দুপুরবেলা হঠাতই আকাশটা ক্রমশ মেঘলা করে এলো। দূর থেকে মেঘেরা এমন করে ধেয়ে এসেছে যেন দরজা আগলে দাঁড়িয়েছে! মীরা নদীর দিকে বেরোচ্ছিল। রীতা ডেকে বলল,
-আরে, আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামছে…
এখন আবার কই যাও, শুনি?
মীরা ধীরে বলল,
-একটু নদী থেকে আসছি মা। বেশি সময়
লাগবে না।
-দিন নেই ক্ষণ নেই, অমন নদীর পাড়ে
যাবার দরকারটাই বা কী? বাড়িতে কলঘর নেই নাকি? রীতা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
রীতার ছেলে গোপীনাথ আজ তিনমাস হলো
রাজমিস্তিরির কাজে গুজরাত গেছে। মীরা তার বিয়ে করা বউ। বিয়ের দশ দিনের মাথায় বউকে মায়ের
জিম্মায় রেখে সে চলে গেছে টাকা উপায় করতে। মা যেন তার বউকে আগলে রাখার লোহার সিন্দুক!
গেছে তো গেছে, আর কোনো খবর নেই! এদিকে উচক্কা মেয়েটাকে ঘরে আগলে রাখতে যেন কালঘাম ছুটে
যাচ্ছে রীতার। কথায় বলে, রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ আর পুরুষের স্বাদ পাওয়া নারী! রাগ
হলেও পরক্ষণেই মেয়েটার জন্যে মনটায় মায়া হয় রীতার। তার সোয়ামিওতো ছেড়ে গেছে কতগুলো
বছর! পরে অবশ্য জানতে পেরেছে, সে আলাদা সংসার পেতেছে। ততদিনে গোপীর বয়স দশ পেরিয়েছে।
রীতার বুকের ভিতর কেমন জানি হাচরপাচর করে, 'ছেলেটা ফিরবে তো? বাপের মত সেও আবার নতুন
সংসার করতে লেগে যাবে না তো?'
মীরা পায়ে পায়ে নদীতীরে পৌঁছোয়। এই নদী তার বড় আপনার। কতদিন সাঁতরে চলে গেছে কতদূর! ফিরেছে আবার। নদীর জলে নামলে তার শরীর শীতল হয়। আজ মীরা শাশুড়ির নজর এড়িয়ে ব্লাউজের ভিতর গুঁজে এনেছে একটা ছোট্ট পুঁটলি। তার মধ্যে হাজার চারেক টাকা আর কয়েকটি হালকা পুলকা সোনার গয়না। দু’একটা শাড়ি সঙ্গে নেবার ইচ্ছেটাকে সে দমন করেছে কোনোমতে। আজ সে মন শক্ত করেই ঘর থেকে বের হয়েছে, খেপাটে মানুষটার সঙ্গে আজ সে ভেসে যাবে স্বপ্নের দিকে
পরনের লালরঙের সুতির ছাপা শাড়িখানা ঠিকঠাক করে নদীর দিকে মুখ করে কাঠের বেঞ্চটায় বসে মীরা। একমাত্র এই নদীই তার মনের সবটুকু জানে।
দূর থেকে একটা ডিঙিনৌকা ভেসে আসে।
রফিক মিঞা ছইয়ের বাইরে এলে মীরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার বাড়ানো হাত ধরে নৌকায় ওঠে।
রফিক তাকে নিয়ে যায় ছৈয়ের ভিতর। মীরাকে আদর করতে করতে বলে, 'তৈয়ার হয়ে এয়েচ তো আজ?
আমরা দুইজনা ভাইস্যা যামু বহুদূরে। নতুন কোনো গাঁয়ে গিয়া সংসার সাজাইমু!'
রফিক ক্রমশ দুর্বার হয়ে ওঠে মীরার
শরীরে। মীরার শরীর মন জুড়ে কিই-এক আনন্দ পারদের দানার মত ছুটে বেড়ায়। একসময় থিতু হয়
দুজনে। মীরা রফিকের গলা জড়িয়ে বলে, 'একটা কতা কইমু, রাগ করবা না? আজ বরং ফির্যা যাই
গো রফিক মিঞা। মানুষটা ছেলের জন্যি ভাবনায় মরতিসে... আবার আমিও যদি...'
রফিক মীরার চোখের দিকে চেয়ে থাকে
কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয় নদীর দিকে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন